আকতার হোসেন : রোমান সভ্যতার আদলে গড়া পুরাতন একটি ভবনের দিকে ছুটে আসছেন আব্দুল মোমেন। বাইরে থেকে দেখলে ভবনটিকে গির্জার মত মনে হয়। বাইরে ভেতরে রঙিন কাঁচের জানালা। গম্বুজগুলোতে পাথরকুচির কারুকার্য। বিশ্বের নাম করা এক মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়য়ের এক্সটেনশন বিল্ডিং এর নিচ তলার হল রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আব্দুল মোমেন। আজ এখানে জড়ো হয়েছে নানান দেশের সাংবাদিক। একটু বিলম্বে পৌঁছানোর জন্য তাকে শেষ সারীতে এসে বসতে হলো। চেয়ারে বসেই আব্দুল মোমেন ঘড়ির কাটা দেখলেন। তারপর বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওভারকোট খুলতে লাগলেন।
নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগে এক তরুণ এসে পোডিয়ামে দাঁড়ালো। তার পেছনে এলো আরও কিছু লোক। ওরা দাঁড়িয়ে থাকলো দেয়াল ঘেঁষে। ভীষণ এক নীরবতার মধ্যে লাউড স্পিকারে শব্দ ভেসে এলো।

একটা সুখবর জানাতে আপনাদের ডাকা হয়েছে। বিশ্বের সর্বত্র ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে আমরা ধর্ষণ প্রতিকার সংক্রান্ত কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিন বছর আগে কাজ শুরু করেছিলাম। তারই ফলাফল আজ আপনাদের জানাবো।

আমাদের গবেষণার পদ্ধতি ব্যবহার করলে, এখন থেকে নারী পুরুষের দেহ মিলনের আগে পরপর তিনটি কোড ব্যবহার করতে হবে। ধরুন প্রতিটি কোডের জন্য আলাদা আলাদা নাম আছে। সর্বপ্রথম কোডের নাম সম্মতি কোড। এটা নারীর ব্রেন সেলের মধ্যে তৈরি হবে। এই কোড নারীর নিজস্ব ইচ্ছে শক্তি কিংবা পুরুষের কাম বাসনা বুঝতে পারার পর তৈরি হবে। এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সম্মতি কোড শুধুমাত্র নারীদের ব্রেন সেল তৈরি করতে পারবে। নয় ডিজিটের এই কোড পুরুষ পার্টনারের কাছে পৌঁছে যাবে চোখের রেটিনা, মুখের লালা মিশ্রণে অথবা ত্বক স্পর্শের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ায় পুরুষ ব্রেন সেল থেকেও একটি কোড তৈরি হয়ে সেটা পৌঁছে যাবে পার্টনারের ব্রেন কোষে। পুরুষ কোডটিও হবে নয় ডিজিটের। এই কোডের নাম রেসপন্স কোড।

হলে উপস্থিত সাংবাদিকরা নোট নিতে ব্যস্ত। কেউ কেউ সেলফোনে কথাগুলো রেকর্ড করে নিচ্ছে। আব্দুল মোমেন এখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত হয়েছেন। চশমার ফাঁক দিয়ে গোল গোল চোখে তিনি সব কিছু হজম করছেন এমনকি হলের নীরবতাও। যেন নিশ্বাস নেবার সময় নেই তার। কোন সন্দেহ নেই আব্দুল মোমেন গবেষকের সব কথাই পরিষ্কার বুঝতে পারছেন।

এরপর নারীর সম্মতি কোড এবং পুরুষের রেসপন্স কোড একত্রে মিলিত হয়ে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুই সংখ্যা বিশিষ্ট ম্যাচিং কোড নামের একটি কোড তৈরি হবে উভয়ের ব্রেন সেলে। ম্যাচিং কোডটি হবে একটি অভিন্ন সংখ্যা। ধরুন নারীর ব্রেন কোষে জন্ম নেওয়া নম্বরটি হলো ১১ সেক্ষেত্রে পুরুষ ম্যাচিং কোডটিও ১১ হতে হবে। এছাড়া কারোর পক্ষে যৌন মিলন সম্ভব নয় অর্থাৎ তাদের উভয়ের দেহ মিলনের জন্য অক্ষম অচেতন অবস্থায় থাকবে।

ম্যাচিং কোর্ডের নম্বর শোনার পর আব্দুল মোমেন দুইহাতের আঙুলে এগারো চেপে বসে আছেন। বকের মত উঁচু তাঁর গলা। ভাগ্যিস পেছনে কেউ নেই তাই কারোর কোন অসুবিধা হচ্ছে না।

লক্ষণীয় বিষয় হোল, কোড তৈরির ব্যাপারে নারীরা প্রাধান্য পাচ্ছেন। প্রথম কোড অর্থাৎ সম্মতি কোড শুধু মাত্র নারীদের ব্রেন সেলে তৈরি হবে। পুরুষের কাজ হলো রেসপন্স কোড তৈরি করা। এবং পুরুষ যদি রেসপন্স কোড তৈরি না করে সেক্ষেত্রে কোন কিছুই অগ্রসর হবে না। পুরুষের রেসপন্স কোড ছাড়া কোন নারীর পক্ষে একক ভাবে ম্যাচিং কোড তৈরি করা সম্ভব হবে না।

উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবনটি হলো, নারীর নেগেটিভ রেসপন্স কোড অর্থাৎ আপত্তি সংক্রান্ত কোড যেকোনো পুরুষের কামভাবকে ডিফিউস করে দিতে সক্ষম। সেটা বর্তমান অবস্থায়ও অর্থাৎ আজকের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় কার্যকর করা যাবে। শুধু প্রয়োজন মানব দেহে একটি করে চিপস সংযোজন।

কোডগুলো তৈরি করতে ছোট্ট চিপস নাভির নিচে নাম মাত্র অপারেশন করে বসিয়ে দেওয়া হবে। ইচ্ছে করলে শিশু জন্ম নেবার সাথে সাথেই আপেলের বিচির মত ছোট্ট এই চিপস বসিয়ে দেওয়া সম্ভব।

গবেষক বলেছেন এপেল কিন্তু আব্দুল মোমেন শুনেছেন আপেল। এবার তার হাতদুটো আপেল বা কমলা লেবুর মত গোল হয়ে গেল। আব্দুল মোমেনের হাত পা চোখ অনবরত পরিবর্তন হতে থাকলেও একটি কথাও মাটিতে পড়তে দিচ্ছেন না। দেখে মনে হবে সবার থেকে তারই আগ্রহ বেশি।

এই চিপস সত্তর বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। কেবল মাত্র ভয় ভীতি দুশ্চিন্তা জাতীয় মানসিক অবস্থায় চিপসটি একটিভ হবে না। নারী পুরুষ উভয়ের মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া কারোর কাছেই কোন পজিটিভ সিগনাল পাঠাবে না। দেহ মিলনের প্রাথমিক আমন্ত্রণ যদি পুরুষ সেলে তৈরি হয় ফিমেল চিপস সেটাও বুঝতে সক্ষম হবে। তবে প্রাথমিক সম্মতি কোড তৈরি হবে কি হবে না সেটা নারীর ব্রেন সিগনালের উপর নির্ভর করবে। একবার একটিভ হয়ে গেলে পরপর তিনিটি কোড তৈরি হতে সময় লাগবে ৬০ সেকেন্ডের কম।
প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ করে এবং ইঁদুর ও বানরের কাছ থেকে সন্তোষজনক ফলাফল পাবার পর এখন সেক্স চিপস বাজারজাত করনের কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও নামের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাতে পারিনি তবে কিছু প্রস্তাব নিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে। নাম নির্ধারণের শীর্ষে রয়েছে ‘আপেল চিপস’। আমরা আশা করছি ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক আপত্তি না থাকলে প্রতিটি মানব শিশুর জন্য এটা যেন সম্ভাব্য অথবা বাধ্যতামূলক করা হয়। আমাদের দ্বিতীয় সংস্কারের জন্য আমরা ইতিমধ্যে মেমোরি কোড সহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছি। সমান্তরাল কোড নিয়েও কাজ করা হচ্ছে।
এই কাজে অংশ নেওয়া সকল বৈজ্ঞানিকদের পক্ষ থেকে আমি স্পোক পারশন হিসাবে বলছি, নারীদের গুরুত্বপূর্ণ প্রটেকশন নিয়ে যার ভাববার কথা ছিল তিনি গোড়া থেকেই এমন কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিলে পৃথিবীতে নারীরা ধর্ষণ মুক্ত থাকত।

আমাদের আনন্দ লাগছে এই ভেবে যে মানব সমাজের অতি পুরাতন একটি অসম ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় আমরা বের করেতে পেরেছি। বিশেষ করে সময়টা যখন এমন যে, একসাথে চার পাঁচজন ধর্ষণ করে অসুস্থ উন্মাদনা প্রকাশ করতে লজ্জিত হচ্ছে না। আমরা জানি যে একক ভাবে ধর্ষণ করা হলো ব্যক্তির নিজস্ব বদ আচরণ। দলবদ্ধভাবে সেই কাজ করা মানে গোষ্ঠীবদ্ধ কাজ। অতীত বলে, বহুদিন ধরে একটি গোষ্ঠীবদ্ধ কাজ চলতে থাকলে সেটা সামাজিক সংস্কারে রূপ নিয়ে ফেলে। কোন এক সময় সেটা হয়ে ওঠে সামাজিক রীতিনীতি। সমাজ যখন ধর্ষণকে গরিমা হিসেবে মেনে নেবে তখন নর ও নারীর বৈষম্য কোন পর্যায় চলে যাবে ভাবতেও ভয় লাগছে। আমরা তাই সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে পড়লাম। আমাদের কেউ কেউ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, কেউ মনোবিজ্ঞানী, কেউ আবার নিউরো সার্জেন। টিমের বাকী সদস্যরা সংশ্লিষ্ট ফিল্ড থেকে সাধ্যমত সাহায্য করেছে। বিস্তারিত কিছুদিনের মধ্যে জার্নালে প্রকাশ করা হবে।

আপনারা বিভিন্ন সংবাদ মিডিয়া থেকে নিউজ কাভার করতে এসেছেন। আপনারা জেনে খুশি হবেন যে ধর্ষণ বন্ধের জন্য এযাবৎ যত যন্ত্র-মন্ত্রের কথা শোনা যায় সেগুলোকে পিছনে ফেলে আমাদের আবিষ্কার অধিকতর সফলতা দিতে সক্ষম।
প্রেস কনফারেন্সে বসে থাকা শত শত সাংবাদিক করতালি দিয়ে যখন এক ঝাঁক তরুণ বৈজ্ঞানিকদের অভিনন্দন জানাচ্ছিল তখন আব্দুল মোমেনও দাঁড়িয়ে করতালিতে সামিল হলেন। এদিকে তার গিন্নি চেঁচিয়ে বলল, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাত তালি দিচ্ছ কেন? চোখ খুলে তিনি দেখলেন যুগলবন্দী হাত শূন্যে উঠে আছে।

কিছুদিন আগে ভারতের কোন এক গ্রামের রাস্তা থেকে জোর করে তুলে আনা এক বিধবা নারীকে সবার আগে কে ধর্ষণ করবে তা নিয়ে মারামারি লেগে যায় পাঁচ অপহরণকারীর মধ্যে। ওদের মধ্যে থেকে প্রথমে ধর্ষণ করতে চাওয়া অপহরণকারীকে বাকী চারজন পিটিয়ে মেরে ফেলে। এরপর ৩২ বছরের সেই বিধবা নারীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে বাকীরা। অনলাইনে এই খবর পড়ার পর থেকে আব্দুল মোমেনের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। যুদ্ধ না, অধিকার আদায় না, বেঁচে থাকার লড়াই না শুধু কে আগে ধর্ষণ করবে তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি ও হত্যা কাণ্ড!

সেই থেকে তিনি ভাবছেন কেউ কি নেই যে এগিয়ে এসে কোন সুখবর দিবে। তারওপর গতরাতে আবারও এক তরুণী ধর্ষিত হয়েছে। মেয়েটির বাবা হাসপাতালে ওর পাশে বসে আছেন। আব্দুল মোমেন ভাবছিলেন সেও বাবা, তারও একটি মেয়ে আছে। তার মেয়েটিও ঘরের বাইরে যায়। তবে কি তাকেও মেয়ের পাশে হাসপাতালের বেডে বসে থাকতে হবে? সাদা চাদরে লেগে থাকা ছপছপ রক্তের দাগ দেখে তাকেও কি সনাক্ত করতে হবে নাম পরিচয় হীন কোন যুবকের ঠিকানা!

তিনি আর ভাবতে পারছেন না। তার গলার নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে তার ছোট্ট সোনামণি মেয়েটা ঘাড়ে ভর দিয়ে বলছে, বাবা অনেক কষ্ট হচ্ছে। গতরাতের খবরটা পড়ার পর থেকে অনেকক্ষণ ছটফট করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা আর বলতে পারবে না আব্দুল মোমেন। স্বপ্নে নিজেকে একজন সাংবাদিকের ভূমিকায় দেখতে পেলেও বাস্তবে তিনি একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক।
একজন বাবার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু এখনো তিনি শুনতে পাচ্ছেন প্রেস কনফারেন্সের কথাগুলো। বিশেষ করে সবশেষে কথাটি – যার কাছে মানব সমাজ সত্যিকার প্রতিকার আশা করেছিল তিনি নিষেধ করা ছাড়া কার্যকরী কিছু করেননি। আমরা এক ঝাঁক তরুণ মিলে সেই কাজ সফল ভাবে করতে পেরে আনন্দিত। এরপর মুহুর্মুহু করতালি।