ফরিদ আহমদ

“ক্লিওপেট্রার মতো টিকালো নাক তার। চোখ হচ্ছে পলিন বোনাপার্টের। দেবী ভেনাসের স্তনসদৃশ স্তন তার। হাত এবং পা অত্যন্ত রোমশ। নিয়মিত তা কামাতে হয়। শারীরিক এবং মানসিক দুইভাবেই সে হচ্ছে নারীর চেয়েও বেশি পুরুষ। আমি তাকে বলবো পুরুষালী নারী।”
এই পুরুষালী নারী যাঁকে বলা হচ্ছে, যাঁর রূপের গুণকীর্তন করা হচ্ছে, তিনি আমাদের অত্যন্ত পরিচিত একজন। তাঁর নাম ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে লৌহ-কঠিন প্রধানমন্ত্রী তিনি। শুধু লৌহ-কঠিনই নন, একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসাবে, একজন প্রাজ্ঞ স্টেটপারসন হিসাবেও তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছেন ভারতের অনেক ঝানু ঝানু ব্যক্তিকে।
তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সুগম করে তুলেছিলো। স্বীকৃতিবিহীন একটা দেশের জন্য সবচেয়ে কঠিন যে কাজটা, দেশে দেশে ঘুরে নানা দেশের সাহায্য এবং সহযোগিতা আদায় করা, যুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা, সেই কাজটা তিনি একক হাতে সামাল দিয়েছেন আমাদের জন্য।

ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে উপরের ওই কথাগুলো যিনি লিখেছেন বলে ধারণা করা হয়, তিনি হচ্ছেন এম, ও, মাথাই। ধারণা করা হয়, এই কথাটা বলা হচ্ছে এ কারণে যে, এই বক্তব্য যে প্রবন্ধে লেখা রয়েছে, সেটা কোথাও প্রকাশিত হয়নি। হাতে হাতে ঘুরেছে এটা। এখন অনলাইনেও আছে। কিন্তু, কেউ সলিড প্রমাণ নিয়ে আসতে পারেননি এটা মাথাইয়ের লেখা বলে। তবে, লেখার ভাষা, ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ এবং এই প্রবন্ধে লিখিত নানা প্রসঙ্গ থেকে মোটামুটি সবাই নিশ্চিত যে, এটা মাথাইয়েরই লেখা।

এম, ও, মাথাই ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত প্রায় এক যুগ ধরে জহরলাল নেহরুর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি এই সময়ের স্মৃতির উপর ভিত্তি করে একটা বই লেখেন। বইটার নাম হচ্ছে “রেমিনিসেন্সেস অব দ্য নেহরু এজ”। এই বইটা একটা ব্যতিক্রমধর্মী বই। সাধারণত দেখা যায় ঐতিহাসিক স্মৃতিকথায় মানুষজন কিছুটা আনুষ্ঠানিক ঢঙে তথ্য প্রকাশ করে। এর সাথে জড়িতদের মান-সম্মান রক্ষা করার একটা দায় লেখকের কাঁধে অনেক সময় বর্তে যায় বলে অনেক ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ থেকেই লেখক সাধারণত বিরত থাকেন। মাথাই সেই কাজটা করেননি। তিনি যা দেখেছেন, যা ভেবেছেন, সেটাকেই সরাসরি বলে দিয়েছেন বইতে। কোনো ধরনের রাখঢাক বা ভদ্রতার আড়ালে তিনি যাননি। তাঁর বইয়ের ভূমিকাতেও তাঁর এই মনোভাবের পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন,
When a number of friends urged me to write my reminiscenses, I said ‘Either I shall write without inhibition or not at all.”
কোনো কিছু লুকোছাপা করে যে তিনি তাঁর বইটা লেখেননি, সেটা যাঁরা বইটা পড়েছেন, তাঁরাই জানেন। এই বই প্রকাশ হবার পরে প্রচণ্ড রকমের আলোড়ন তুলেছিলো, সেটা বলাই বাহুল্য। ১৯৭৮ সালেই এর ছয়টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে যায়। এই বইয়ে প্রকাশিত লেখা যেমন আলোড়ন তুলেছে তুমুল, ঠিক একইভাবে এই বইতে না থাকা লেখাও ঝড় তুলেছে ব্যাপক। সেটাই বরং ঘটেছে বেশি।

বইটা যখন প্রকাশিত হয়, তখন এতে উনপঞ্চাশটা অধ্যায় ছিলো। তবে বিস্ময়কর হচ্ছে, বইতে উনত্রিশ নাম্বার অধ্যায়ের শুধুমাত্র শিরোনাম ছাড়া অন্য কিছু ছিলো না। ছিলো না বললে ভুল হবে। প্রকাশকের দেওয়া ছোট্ট একটা নোট ছিলো সেখানে। তাতে বলা হয়েছিলো এই অধ্যায়টা শেষ মুহূর্তে লেখক প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। প্রকাশক যা লিখেছিলেন, সেটা হুবহু এরকম।
This chapter on an intensely personal experince of the author’s, written without inhibition in the D.H. Lawrence style, has been withdrawn by the author at the last moment.
এই অধ্যায়টা বিচ্ছিন্ন একটা অধ্যায়, লেখক প্রত্যাহার করে নিলেও মূল বইয়ের কোনো ক্ষতিসাধন হবার কথা ছিলো না। এটাকে ছাড়াই বইটা প্রকাশিত হতে পারতো। পাঠকের জানার কথা ছিলো না যে এরকম একটা অধ্যায় লেখক লিখেছেন এবং শেষ মুহূর্তে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। প্রকাশক কেন একটা নোট দিয়ে এই অধ্যায়কে বায়বীয়ভাবে বইতে স্থান দিলেন, সেটা কিছুটা বিস্ময়করই বটে। পাঠকের কৌতূহল বাড়ানো, নিজেদের সততা প্রকাশ করা, নাকি ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে ছিলো, সেটা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে লেখক প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, ফলে কম্পোজে অধ্যায়ের শুরু রয়ে গেছে, এরকম টেকনিক্যাল বিষয়কেও বাদ রাখা যায় হিসাব থেকে। সেরকম কিছু হলে পরের সংস্করণগুলোতে এটাকে শুধরানো হতো। সেটা করা হয়নি। অধ্যায়টার শিরোনাম এবং প্রকাশকের নোট রয়ে গেছে বইটাতে।

যে অধ্যায়টা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই অধ্যায়টার নাম “শি” বা “সে”। মাথাইয়ের বইয়ের এই ‘সে’ হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধী। বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জননী তরুণী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে গোপন প্রেম ছিলো মাথাইয়ের। সেই গোপন প্রেমের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের রগরগে বিবরণ এখানে ছিলো, এটাই হচ্ছে সর্বজনস্বীকৃত ধারণা। ইন্দিরা গান্ধির সাথে মাথাইয়ের দেহজ প্রেমের সম্পর্ক টিকে ছিলো বারো বছর। এর ফলশ্রুতিতে ইন্দিরা গান্ধী একবার গর্ভবতীও হয়ে পড়েন। গোপনে গর্ভপাত করা লাগে সম্পর্কটাকে গোপন রাখার স্বার্থে। বারো বছর পরে মাথাইয়ের সাথে ইন্দিরার কামজ সম্পর্কের অবসান ঘটে ইন্দিরার শোবার ঘরে তাঁর ইয়োগা প্রশিক্ষক ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীকে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে।

এই ‘শি’ অধ্যায়টা এখন পুরোটাই পাওয়া যায়, অফলাইন এবং অনলাইন দুটো জায়গাতেই। সেই অধ্যায় পড়লে আসলেই দেখা যায় মাথাই তাঁর সাথে ইন্দিরা গান্ধীর প্রেমের, দৈহিক সম্পর্কের রগরগে বর্ণনা দিয়েছেন সবিস্তারে। যদিও কেউ-ই শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি এটা মাথাইয়ের লেখা সেই অধ্যায়ই। শতভাগ নিশ্চিত না হলেও, এটাকে মাথাইয়ের লেখা অধ্যায় বলে স্বীকার করে নিতে খুব অল্প মানুষেরই দ্বিধা রয়েছে। বইটার প্রকাশক নরেন্দ্র কুমারকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো এর সত্যতা সম্পর্কে। প্রকাশক এই বলে এড়িয়ে গেছেন যে, মাথাই এর ‘শি’ চ্যাপ্টারটা তিনি কখনোই হাতে পাননি। কাজেই তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে এটাই মাথাইয়ের লেখা কিনা। প্রকাশকের এই উত্তর যে কূটনৈতিক উত্তর সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না বইতে তাঁর নোট পড়লে। এই চ্যাপ্টার যে মাথাই ডি, এইচ, লরেন্সের স্টাইলে লিখেছেন, সেটা অধ্যায়টা না পড়া থাকলে প্রকাশকের জানার কথা নয় সুস্পষ্টভাবে। যদিও এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে পাঠক আকর্ষণের জন্য টিজার হিসাবে এটাকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন। এই অধ্যায়ের আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই।

প্রকাশক অস্বীকার করলেও, মাথাইয়ের অধ্যায়টা আসলেই আছে, এই বিষয়ে কানাঘুষা চলছিলো বহুদিন ধরেই। ইন্দিরা গান্ধীর জীবনীকার ক্যাথেরিন ফ্রাঙ্কও মাথাইয়ের বইয়ে একটা অধ্যায় অনুপস্থিত রয়েছে যেখানে মাথাইয়ের সাথে ইন্দিরার সম্পর্কের বিষয়টা বর্ণনা করা আছে বলে উল্লেখ করেছেন। এখন অবশ্য আর কানাঘুষা নেই। এই অধ্যায়টা এখন সহজলভ্য, যদিও শতভাগ প্রমাণিত নয় যে এটা মাথাইয়ের লেখা। যাঁরা এটা প্রমাণ করতে পারতেন, তাঁরা সবাই এড়িয়ে গেছেন কূটনৈতিক বাক্যজালের বিন্যাস ঘটিয়ে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বইতে না থাকার পরেও ‘শি’ কীভাবে ফাঁস হলো? মাথাই নিজে করেননি, এটা নিশ্চিত। তিনি তাঁর বইটা প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত অজনপ্রিয়ভাবে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় থাকলে এই বই প্রকাশ করার ব্যাপারে তাঁর সাহস হতো কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বছর দুয়েক আগে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রাক্তন ডিরেক্টর টি, ভি, রাজেশ্বর স্বীকার করেন যে ১৯৮১ সালে তিনি মাথাইয়ের বইয়ের একটা অধ্যায় ইন্দিরা গান্ধীকে হস্তান্তর করেছিলেন। তিনি এটা তামিল নাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম, জি রামাচন্দ্রন এর কাছ থেকে পেয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন। যদিও এটাই সেই প্রকাশিত ‘শি’ অধ্যায় কিনা, সেটা নিশ্চিত করতে অস্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন যে, আমি অধ্যায়টা পড়ে দেখিনি। মুখ্যমন্ত্রী আমাকে দেবার পরে আমি কোনো মন্তব্য ছাড়াই গ্রহণ করি এবং সেটা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে হস্তান্তর করি। ইন্দিরা গান্ধীও কোনো মন্তব্য না করে নীরবে তা গ্রহণ করেন।

ক্যাথেরিন ফ্রাঙ্কের ধারণা হচ্ছে, ‘শি’-কে জনসম্মুখে নিয়ে আসার পিছনের প্রধান ব্যক্তি হচ্ছেন ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ মানেকা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে মানেকা গান্ধীর সম্পর্ক খারাপ হবার পরে, তাঁকে বিব্রত করতে মানেকা নানা জায়গায় ছড়িয়ে দেন মাথাইয়ের লেখা সেই অপ্রকাশিত অধ্যায়কে।