মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

সাইত্রিশ.
আমার বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সবাই সোফি’কে খুব ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিল, আর আমি সোফি’র সাথে সাথে তার বাবা-মা’রও প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তার পরের বছরই সোফি আর আমি দু’জন মিলে এভিনিউ ভ্যান হোর্ণ এর কাছে একটা এপার্টমেন্ট কিনে আমি জীবনে প্রথম বারের মত কোনো গার্লফ্রেন্ড এর সাথে একত্রে থাকা শুরু করেছিলাম। আমরা একসাথে কোথাও হঠাৎ করেই ভ্রমণে বের হয়ে যেতাম, এমনকি শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে একে অপরের সাথে পাল্লাপাল্লি করতাম এবং এর ফলে একে অপরের প্রতি গভীর প্রেম অনুধাবনে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা দু’জনে শুধুই দু’জনার।

আমার দেখা মতে সোফিকেই মনে হয়েছে সবচেয়ে বর্ণিল, স্পষ্টভাষী, আবেগী আর চমৎকার হৃদয়ের একজন। তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে অনেক বিপরীতধর্মী গুণের সমাহার আমি লক্ষ্য করেছি। আকাশচুম্বী চিন্তার সাথে সাথে সে জানতো কিভাবে একেবারে মাটির ছোট ছোট সু² বিষয় নিয়ে সফলভাবে কাজ করতে হয়। তার চরিত্রে কঠিন দৃঢ়তার সাথে লক্ষ্য করেছি সে কত বেশী কোমল, পরোপকারী মায়ের মত। তার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, শৃংখলাবোধ আর চারিত্রিক দৃঢ়তার সাথে সাথে দেখেছি এক শৈল্পিক আর অনাবিল রসবোধের এক মিশ্রণ। সে ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, কিন্তু সবসময়ই অন্যের ভালোমন্দ বিষয়ে যথেষ্ঠ যতœবান আর তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সে সব সময়ই অন্যের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তার সাবলীলতা, বুদ্ধিমত্তা আর সহজজ্ঞান সব সময়ই আমাকে মুগ্ধ করে আর আমি দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলতে পারি, এক একটি দিন অতিবাহিত হয় আর তার প্রতি আমার ভালোবাসা গভীর থেকে আরো গভীরের দিকে বয়ে চলেছে।

২০০৪ এর ১৮ই অক্টোবর আমি সেন্ট রেমী’র কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে আমি তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাবার সেই পচাশিতম জন্মদিনে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে খুবই শান্তভাবে বাবার কাছে আমাদের দু’জনের জন্য আশীর্বাদ চেয়েছিলাম। তার কয়েক ঘন্টা পরে পুরাতন মন্ট্রিয়লের মোমবাতির আলো আর গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো এক হোটেল কক্ষে তার হাতটা আমার হাতে রেখে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করতে যাতে আমরা দু’জন মিলে একসাথে আমাদের দু’জনের জীবন গড়তে পারি।

সেই সপ্তাহের শেষ দিনের আগেই আমি সোফির বাবা-মা’র শহরের উত্তর লরেনশিয়ানের সেন্ট-এডেলে’র বাসায় গিয়েছিলাম। তার বাবার সাথে বাড়ীর পাশের গাছ গাছালির মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে কথা বলতে বলতে এক সময় সেই পুরাতন কায়দায় শরতের পাতা ছড়ানো পথে তার বাবার পায়ের কাছে হাঁটু গেঢ়ে বসে আমি তার মেয়েকে বিয়ে করার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলাম। আমার এই কাণ্ড দেখে সোফির বাবা জীন তার সেই চমৎকার ভুবনজয়ী রসবোধ আর হাসি নিয়ে আমাকে বলে উঠেছিলেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার তুমি উঠো! তোমার প্যান্ট কিন্তু ভিজে যাচ্ছে।’

ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে আমি সোফি’কে আংটি পরিয়েছিলাম, আংটি’টা রাখার জন্য শাসা আমাকে প্রাচীন রাশিয়ায় তৈরী একটা ছোট্ট চমৎকার কাঠের বাক্স এনে দিয়েছিল। সেখান থেকে সেই আংটি’টা বের করে আমি ওটাকে সোফির সুন্দর আংগুলে পরিয়ে আমার চিরকালের ভালোবাসার বন্ধন এঁকে দিয়েছিলাম। সবকিছুই ছিল চমৎকার, বিশেষ করে আমার ভালোবাসার মানুষকে আমার ভাই যে সুন্দর ও উৎফুল্লতার সাথে গ্রহণ করেছিল তা আমাকে খুবই সুখী করেছিল। আমি কখনও ঐ মুহূর্তটা ভুলবো না যখন আমি সোফি’র চুড়ান্ত উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার বারবার মনে হচ্ছিল, আমি তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছি আর আমার চারিদিকে সবকিছু কিছু মুহূর্তের জন্য চুপ করে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমি অপেক্ষা করেই ছিলাম। তারপর তার লাস্যময়ী মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল, যার মানে কিছুক্ষণের মধ্যে সেও আমাকে বুঝিয়ে দিলো, আমার মত সেও আমাকে চাই, ঐ মুহূর্তে তার চোখ দিয়ে যে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল, সেটার সাথে ভালোবাসা প্রকাশে আমার সাথে তার এক অদ্ভুত মিল ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি তাকে তাগাদা দিতে লাগলাম, কত তাড়াতাড়ি আমাদের মত করে সংসার শুরু করা যায়। সেই দিন থেকে এক বছরেরও কম সময়ে ২০০৫ এর ২৮শে মে আমরা এগলিস সেন্ট-ম্যাডেলিন ডি’আউটারমন্ট এ বিয়ে করেছিলাম। সেদিন আমরা একে ওপরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সারাজীবন সুখে দুঃখে, ভালো সময়ে আর খারাপ মুহূর্তে এক সাথে থাকবো।

নব বিবাহিত দম্পতি জাস্টিন ট্রুডো-সোফি গ্রেগরী। পাশে জাস্টিন ট্রুডোর মা মার্গারেট ট্রুডো এবং ভাই আলেকজান্দর ট্রুডো

আমাদের বৈবাহিক জীবনটা একেবারে যথার্থ হয় নি, বিভিন্ন সময়ে আমাদের মন খারাপ করা ঘটনা ঘটেছে, তারপরও সোফিই আমার জীবনে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আমার সুন্দর সংগী আর হৃদয়ের ভালোবাসা হয়ে আমার সাথে রয়েছে। সে আমার সব কাজে আমার সাথে থাকে, সে আমাকে সব কাজে উৎসাহ দেয়, আমার কঠিন সময়ে আমার পাশে থেকে আমাকে সাহস যোগায়। কোনো কোনো দিন কোনো প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি সে আমাকে যুগিয়েছে আর অন্য দিনে আমার পাশে সে ভালোবাসা আর মমতা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এই জীবন ভ্রমণে আমরা সারাজীবন দু’জনে একই পথের যাত্রী। সময় ও ভাগ্যের পরিবর্তনে আমাদের একে অপরের প্রতি এই অপার ভালোবাসা আমাদের সব সময় স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা কিভাবে সামনে এগুবো।

পলিটেকনিক এ দু’বছর পড়ার পর আমি আমার পড়ার ধারাটা একটু পরিবর্তন করেছিলাম, আমি মূলত তাদের পড়ানোর বুদ্ধিবৃত্তিক ধারাটায় জ্ঞান নিতে চেয়েছিলাম। পেশাগতভাবে একজন প্রকৌশলী হবার আমার কোনো ইচ্ছেই ছিল না, এবং আমি সেই সময় এটাও উপলব্ধি করেছিলাম, আমি অন্য যে সব বিষয়ে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম, সেগুলো শুধুমাত্র যুক্ত থাকার জন্যই নয়, বরং সেগুলোর সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা বা জ্ঞানলাভের জন্য নিবিষ্ঠভাবে লেগে থাকার প্রয়োজনে।

ইতিমধ্যে আমি ‘কাতিমাভিক’ বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলাম, আর সেই সময় সেই দায়িত্ব পালন করতে করতে জ্য ক্রেতিয়ন এর লিবারেল সরকারকে ‘কাতিমাভিক’ সংগঠনের জন্য বছরে ২০ মিলিয়ন ডলারের ব্যবস্থা করতে রাজী করিয়েছিলাম। সেই সময় সারা দেশের অসংখ্য হাই স্কুলে গিয়ে সামাজিক কাজ আর স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করার গুরুত্ব নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতাম।

২০০৫ সালের ২৮শে মে বিয়ের পর মন্ট্রিয়লের সেন্ট ম্যাডেলিন ডি’আউটারমন্ট গীর্জা ছেড়ে যাচ্ছে উৎফুল্ল জাস্টিন ট্রুডো আর সোফি গ্রেগরী।

সেই সময় আমি কানাডিয়ান আভাল্যাঞ্চে ফাউন্ডেশনের বোর্ড এ ছিলাম। তুষার ধসের দূর্ঘটনা যেন আর না ঘটে সে জন্য পশ্চিমের বিভিন্ন স্কি’র জায়গাগুলোতে সচেতনা বাড়ানোর কাজ করেছি, সেই সময় ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও আলবার্টার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে কানাডিয়ান আভাল্যাঞ্চে কেন্দ্রগুলোর জন্য অর্থ সংগ্রহে নেমেছিলাম। সত্যি বলতে কি, সেই সময় আমি সত্যিকারভাবে বুঝতে পেরেছিলাম, পশ্চিমের মানুষেরা এ ধরনের সুন্দর কাজের জন্য কত বেশী নিবেদিত প্রাণ। আমার এখন বিশেষভাবে মনে পড়ে, ক্যালগরী চিড়িয়াখানায় যে বার্ষিক অর্থ সংগ্রহের জমায়েত ঘটেছিল তাতে আলবার্টার তৈল খনির খুব শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এসেছিলেন এবং এমন ভালো কাজের জন্য তাঁরা যথেষ্ঠ পরিমাণে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

এক বছর আমি মন্ট্রিয়লের ফরাসী ভাষার রেডিও স্টেশন সিকেএসি’তে কাজ করেছি। সে সময় প্রতি সপ্তাহে ২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিকের চলমান বিষয় নিয়ে সেই রেডিও স্টেশনের একজন কর্মী হয়ে আমি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতাম। এই কাজটা আমাকে কুইবেকের মিডিয়া ও সংস্কৃতির পরিবেশটা একেবারে ভিতর থেকে জানতে সাহায্য করেছিল। ঐ কাজটা করার ফলে আমি সত্যি সত্যিই জনগণের সাথে কোনো বিষয়ে যোগাযোগ রাখতে রেডিও যে কি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে সেটা অনুধাবন করেছিলাম। মানুষজন রেডিও’তে কথা শুনে আর তাদের মন মত অনুষ্ঠান শুনতে পেলে কান খাঁড়া করে থাকে, আর একটা অনুষ্ঠান শুরু হবার দশ সেকেন্ড পর অনুষ্ঠানটা কে করছে সে বিষয়ে তাদের কোনো ভাবনা থাকে না। তারা যে বিষয়টা খেয়াল করে তা হচ্ছে, তুমি কী বলছো, কেমনভাবে বলছো আর জনগণের কাছে কি বিষয় তুলে ধরছো, শুধু বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর কাছে নয়, বরং সমস্ত মানুষের কাছে তোমার কথাগুলো কেমন আবেদন রাখছে। আর এই বিষয়গুলো সে সময় ভালোভাবে লক্ষ্য করে সতর্কতার সাথে কাজ করার ফলে এখন যখন আমি রেডিও স্টেশনের স্টুডিও’তে কোনো সাক্ষাৎকার দিই, তখন যে আমার সাক্ষাৎকার নেয় তার সাথে আমি একেবারে এক হয়ে যায়। বিষয়টা এমন এক পর্যায়ে দাঁড়ায় যে, দুই পক্ষই প্রচুর আনন্দ ও সন্তুষ্টির মধ্যে দিয়ে এক উপভোগ্য সময় পার করি। (চলবে)