মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

বায়ান্ন.
আমার নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় আমি সব সময়ই চাইতাম, অনেক বেশি দল বা সংগঠনের সদস্যদের সাথে কথা বলতে। এখানে আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই কুইবেকের ট্যাক্সি চালক সমিতির কথা। সত্যি বলতে কি, রাজনীতি বা যে কোনো বিষয়ে এই ট্যাক্সি চালকরা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তোমরা নিজেরাই একটু চিন্তা করে দেখো, ট্যাক্সিতে চড়ার পর অনেক সময় তুমি তাদের সাথে কি নিয়ে কথা বলো। সেই দিনগুলোতে সাধারণত প্রচারণা অফিসে বসেই আমি ভলিন্টিয়ারস’দের সাথে ভাগাভাগি করে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতাম। এতে তারা বিশেষভাবে আপ্লæত হয়ে উঠতো আর প্রতিনিয়ত নব উদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তো। বিকেলে কোন এক মেট্রো স্টেশনে ঢোকার আগে আমি কোন এক বৃদ্ধনিবাস বা বয়স্করা যে সব জায়গায় থাকেন, সেই সব জায়গায় ঢুঁ মারতাম। বয়স্ক মানুষদের সাথে সুন্দর সময় কাটিয়ে আমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে কাজ থেকে ফেরা যাত্রীদের দিকে হাত বাড়িয়ে তাদের সাদর সম্ভাষণ জানাতাম। তারপর সন্ধ্যায় শুরু হতো কমিউনিটি’র নেতাদের বা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোন করে আমার পরবর্তী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ করা। মাত্র কয়েক ঘন্টা ঘুমানোর পর, ঘুম থেকে উঠে আবার সারাদিন ধরে একই কাজ করে চলতাম।

কাজগুলো করতে অনেক পরিশ্রম করতে হতো, কিন্তু এই সব কাজের প্রতিটি মুহূর্ত আমি উপভোগ করতাম। আমি আরো উপভোগ করতাম সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই সব কাজ করতে গিয়ে নিয়ম আর ছন্দের মধ্যে দিয়ে প্রতিনিয়ত যে শিক্ষাটা আমি অর্জন করতাম সেই প্রক্রিয়াটাকে। কিন্তু সত্যি বলছি, এগুলোর থেকেও আমি সবচেয়ে বেশী আনন্দ পেতাম পাপিনিউ’র মানুষের সাথে কথা বলে আর তাদের কথা শুনে। এখানে কথার মধ্যে রাজনীতি খুব একটা থাকতো না, থাকতো অন্য সব আলাপ। বলা যেতে পারে, এক ধরনের প্রাণের আলাপ। তবে আমি তাদের সাথে কথা বলে তাদের কাছ থেকে যে বিশ্বাস আর আস্থা অর্জন করেছিলাম সেটা কিন্তু আমার কাছে অনেক বড় এক নিয়ামত ছিল। আমার সামনে এগুনোর পথে বারবার মনে পড়ে আমার প্রতি তাদের সেই আস্থার কথা, আর যে জন্য আমি সব সময় প্রাণপণে চেষ্টা করি আমি এমন কিছু কাজ করতে যাতে তাদের সেই বিশ্বাসের মর্যাদা আমি আজীবন সম্মানের সাথে রাখতে পারি।

যে রাতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছিল, সেই রাতে এক প্রবল আবেগায়িত আবেগে আমি উৎফুল্ল হয়ে পড়েছিলাম। তার আঠারো মাস আগে আমি যখন লিবারেল পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলাম, তখনও এক চরম বিজয়ের আনন্দে আমার মন প্রাণ নেচে উঠেছিল। তারপর সেই নির্বাচনে বিজয়ের আনন্দ। আমি একেবারে কানের গোড়া দিয়ে পাপিনিউ থেকে পাশ করেছিলাম। আমি পেয়েছিলাম ১৭,৭২৪ ভোট, আর ভিভিয়ান বারবোট পেয়েছিল ১৬,৫৩৫ ভোট। কিন্তু এই আনন্দ আর বিজয়ের পরও আমি অন্যান্য লিবারেলদের মতো বিজয়ের উৎসব করার অবস্থায় ছিলাম না। সারাদেশে লিবারেল দলের একটা ভরাডুবি হয়েছিল। সারাদেশে মাত্র শতকরা ২৬ ভাগ ভোট লিবারেল পার্টি পেয়েছিল। অন্যদিকে কনজারভেটিভরা তাদের আগের ১২৭টি আসনকে বাড়িয়ে ১৪৩টি আসনে জয়ী হয়েছিল। যে সব ভলান্টিয়াররা আমার এই নির্বাচনে আমাকে সহযোগিতা করেছিল তাদের সবার প্রতি ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উচ্ছ¡সিত একটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম, কিন্তু লিবারেল পার্টির সার্বিক ফলাফল আমাদের সবাইকে খুবই ব্যথিত করেছিল।

আমি আমার এলাকায় নির্বাচনী কাজ নিয়ে এত বেশী ব্যস্ত ছিলাম এবং আমি এর ফলে যে ফলটা পেয়েছিলাম তা আমার কাজ করার উদ্দীপনাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছিল। কিন্তু অন্যদিকে যখন দেখলাম, জাতীয় রাজনীতিতে আমার দলের এমন ভরাডুবি, তখন আমি খুবই কষ্ট পাচ্ছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম, অন্যান্য জায়গায় লিবারেল এর প্রার্থীরা মানুষের সাথে তেমনভাবে মিশেনি বা কাজ করেনি। সারা কানাডায় লিবারেল পার্টিতে আমরা কেবল কয়েকজন নতুন প্রার্থী ছিলাম যারা লিবারেল পার্টির এমপি হয়ে অটোয়ার পথে পা বাড়িয়েছিলাম। এই নির্বাচনী ফলাফল আমার মধ্যে এক গভীর বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয় যে, সমাজের মানুষের সাথে সত্যিকারভাবে না কাজ করলে রাজনীতিতে সামনে চলার পথ উম্মোচিত হবে না।

সেই রাতে কুইবেকের প্রখ্যাত সংবাদ উপস্থাপক বার্ণার্ড ডেরোমী রেডিও কানাডা’র নির্বাচনী-রাত তুলে ধরতে গিয়ে আমার সাক্ষাৎকার নেয়। পেছনে উচ্ছ¡সিত সব ভলান্টিয়ার ভরা এক ঘরে আমি বসলাম। আমার কানে ছিল অডিও হেডসেট, আর আমার নির্বাচনী প্রচারণার কিছু ভিডিও দেখিয়ে শুরু হয়েছিল সেই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান। আমাকে স্বাগত জানিয়ে ডেরোমী প্রথমেই এক পিছলা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিল, যে প্রশ্ন আমি আরো অন্যদের কাছ থেকে শুনে আসছিলাম। ডেরোমী প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, মি. ডিওনের দলের নেতার আসনে আর থাকা উচিৎ কি না?

নির্বাচনের ফলাফলের অংকটা সত্যিই তাঁর জন্য বড় বেশি বিব্রতকর ছিল, তাঁর নেতৃত্বে দলের ভোট ৯৫ থেকে ৭৭ এ নেমে এসেছিল যা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু এর জন্য তাঁর ভাগ্যে এমন নিষ্ঠুর পরিণতি ঘটবে সেটা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছিল না। আমার মতো অনেক লিবারেল’রাই তখন মনে করেছিল, তাঁকে ভালোভাবে কাজ করতে দেয়া হয় নি। তিনি যে বেষ্টনী দ্বারা আবৃত হয়েছিলেন, সেটা যে কোনো নেতার পক্ষেই এত অল্প সময়ে ভেঙ্গে সামনে এগুনো খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। দলের মধ্যে কাঠামোগত যে সমস্যার ডালপালা গজিয়ে উঠেছিল, সেগুলোর শেকড় এমনভাবে গভীরে গ্রোথিত হয়ে পড়েছিল যে একজন ভালো নেতার পক্ষে দলের জন্য সফলতা আনতে অনেক বেশী বুদ্ধি আর ঘাম ঝরানোর প্রয়োজন ছিল।

ডেরোমীর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘মি. ডিওন একজন যথেষ্ট বুদ্ধিমান আর যোগ্য নেতা। দেশের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ঠ গ্রহণযোগ্য ও প্রয়োজনীয়, আর তাঁর কাছ থেকে আমার অনেক কিছুই শেখার আছে।’

ডেরোমী আমার এমন উত্তর পেয়ে বলে উঠেছিল, ‘তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো, তাঁর নেতৃত্বের কোনো দূর্বলতা নেই আর তুমি তাঁকে দ্বিতীয় বারের মতো আবার লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে দেখতে চাও।’

এবার আমি বলেছিলাম, ‘আমরা কিন্তু এখানে নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলছিনা। আর আমি তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই লিবারেল পার্টির একজন নেতা আছেন এবং আমি তাঁর নেতৃত্বে কাজ করতে আনন্দই পায়।’

ডেরোমী এবার তাঁর গলার স্বরটা একটু নামিয়ে বললো, ‘ওহ, তাহলে দেখছি, তুমি ইতিমধ্যে তোমার কাজ ভালোই বুঝে গেছো। রাজনীতির মারপ্যাচের মতই তুমি সরাসরি কোনো উত্তর দিচ্ছো না।’

আমি তার এমন কথা শুনে বলে উঠেছিলাম, ‘তাহলে তুমি আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করো?’
আমার বলার এমন ভঙ্গি দেখে এবার ডেরোমী জোরে হেসে উঠে বললো, ‘তোমার বলার ভঙ্গি দেখে তোমার বাবার কথা মনে পড়ে গেলো।’ এবার একটু থেমে সে বললো, ‘মি. ডিওন’এর কি এখন দলের নেতৃত্বে থাকা উচিৎ?’

মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত জাস্টিন ট্রুডো

আমি প্রত্যয়ের সাথে তাকে বলেছিলাম, ‘মি. ডিওন’এর অবশ্যই দলের নেতৃত্বে থাকা উচিৎ।’

আমাদের কথা শেষ হবার আগে এবার ডেরোমী উচ্ছ¡াসের সাথে বলেছিলো, ‘এই বেশ বলেছো, একেবারে সরাসরি। আর আমি তোমার এই সাহসী বলা’টাকে সাধুবাদ জানাই।’
সেই সময়টা খুবই জটিল এক সময় চলছিল। সাংবাদিকরা তক্কে তক্কে ছিল কিভাবে দলের মধ্যে আরো কোন্দল সৃষ্টি হয় এমন সব গল্প খুঁজতে। সেই সাথে দলের অনেক সদস্যই ছিল যারা চাচ্ছিল আমার কাছ থেকে ওমন কিছু কথা বের হয়ে আসুক। তারা খুবই অপেক্ষার সাথে চেয়ে ছিল ‘ইয়াং ট্রæডো’র মুখ দিয়ে এমন কিছু কথা বের হয়ে আসুক যা এই হেরে যাওয়া লিবারেল নেতাদের প্রতি প্রচণ্ড চপোটাঘাত হয়ে আসে। কিন্তু আমি তেমন কিছু করিনি বা করতে রাজিও হয়নি। মি. ডিওন এমন একজন সুন্দর মানুষ যিনি এক দশকেরও বেশী সময়ে দলের খারাপ সময়ে দল ও দেশের জন্য কাজ করে এসেছেন। আমার বারবার মনে হয়েছিল, সেই নির্বাচনের রাতে যে সব সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়া সব কথা হচ্ছিল, সেটা তাঁর প্রাপ্য ছিল না।

এছাড়া, তখন আমার অন্যকিছু নিয়ে ভাবার বিষয় ছিল। আমি প্রায় দুই বছর পাপিনিউ’এর রাস্তায় থেকে মানুষকে বুঝিয়েছি কেনো আমাকে আর লিবারেল পার্টিকে সমর্থন করা প্রয়োজন। তারা আমার কথা শুনেছিল আর আমাকে বিশ্বাস করেছিল। আর তারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল বলেই আজ আমি এখানে। আমাকে এখন অটোয়ায় যেতে হবে, আর যারা আমাকে বিশ্বাস করে তাদের কথা বলার জন্য সেখানে পাঠিয়েছে, তাদের কথা বলতে হবে এবং তাদের জন্য কাজ করতে হবে। আমি আশা করেছিলাম, আমি যেভাবে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে সেই মানুষদের সমর্থন ও আস্থা নিয়ে দলের একটি আসনে জিতেছি, সেখান থেকে এবার সত্যি সত্যিই দল কিছু শিক্ষা গ্রহণ করবে।

২০০৮ সালের সেই নির্বাচনী-রাত থেকে আমার মনে হয়েছিল, লিবারেল পার্টি এই পরাজয় থেকে ভালো একটা শিক্ষা লাভ করবে। কানাডার মানুষের সাথে আমাদের যোগাযোগ আর সম্পর্ক খুবই দূর্বল। এখন প্রয়োজন পড়েছে যে কোনো মূল্যে আর কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আপামর জনগণের সাথে দলের একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা। (চলবে)