মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

সাতচল্লিশ.
আমি বুঝতে পারছিলাম, কুইবেকের সার্বভৌমত্ববাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধানতম অস্ত্র হচ্ছে অখণ্ড কানাডার ইতিবাচক দিকগুলো তাদের সামনে তুলে ধরা। অন্য যে কোনো বিচ্ছিন্নবাদী শক্তির মত সার্বভৌমত্ববাদীদেরও মূল মনোভাব ছিল অখণ্ড কানাডার অনেক ভালো দিকগুলোর প্রতি কোনো রূপ দৃষ্টি না দিয়ে সামান্য যে কয়েকটি অসংগতি আছে সেগুলোর দিকেই আংগুল দিয়ে সবাইকে দেখানো। কিন্তু যদি তুমি ওদের অসংযত চিন্তা ভাবনা আর দাবীকে একটু চুলচেরা বিচার করে একটু গভীরে প্রবেশ করো, তখনই তুমি দেখতে পাবে, কুইবেক এর প্রায় সবার ধ্যান ধারণা আর মূল্যবোধ কানাডার অন্যান্য সবার মতই। আমি কয়েক বছর পর আমার নেতৃত্বের প্রচারণার জন্য যখন গোটা দেশ ঘুরছিলাম, তখন আমি সবার সামনে সেই মূল্যবোধ আর ধ্যান ধারণাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম, তবে এই কাজ করতে গিয়ে গভীরভাবে আমার মনে হয়েছিল, শুধু কুইবেকই নয়, বরং গোটা কানাডায় হচ্ছে সেই সত্যকে সামনে আনার জন্য আসল জায়গা।

আমার প্রতিপক্ষ স্টিফেন হারপারের কাজ ও পদক্ষেপের যে সব অসংযতা ছিল, সে সব বিষয় নিয়ে আমি পাপিনিউ’র বাসিন্দা, সার্বভৌমত্ববাদী বা অন্য যে কারো সাথে আলাপে বসলেই তাদের সাথে আমার একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠতো।

আমার রাজনৈতিক পথে এগুনোর কৌশল নির্ধারণে সোফির একটা মূখ্য ভূমিকা ছিল। কুইবেক নিয়ে তার চিন্তা ভাবনা খুবই কার্যকরী ও বাস্তবসম্মত ছিল। সেই সাথে আমার নির্বাচনী প্রচারণা ও গণমাধ্যামের সামনে আমার কিভাবে আসা উচিৎ, তার সবকিছুই সে গভীরভাবে লক্ষ্য করতো এবং যেটা করা উচিৎ ও প্রয়োজন, সেটা করার জন্য আমাকে পরামর্শ দিতো। যখনই তার মনে হতো, আমার কোনো কাজ ও পদক্ষেপ আমার ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব আনতে পারে, তখনই সে বিষয়টা আমার গোচরে নিয়ে আসতো, এবং সে বারে বারে আমাকে মনে করিয়ে দিতো, আমি যেন সব সময়ই লক্ষ্য রাখি যাতে কোনো অপ্রত্যাশিত ছোট খাটো বিষয় যেন কোনোভাবেই আমার ব্যক্তিত্বে কালিমা লেপন করতে না পারে। সে আমাকে প্রায়ই মনে করিয়ে দিতো, আমার রাজনীতিতে আসার প্রধানতম কারণ, একটা সুন্দর কানাডা গড়ে তোলা, আমার রাজনীতি কখনও কোনভাবেই শুধুমাত্র নেতা হওয়া বা জনপ্রিয়তার মধ্যে থাকা নয়। সোফি প্রায় আমাকে সতর্ক করে দিতো, ব্যক্তিগত লাভের ধান্দা বা চিন্তা যেন কখনোই আমার এই পরিশ্রমের মধ্যে না থাকে।

অনেক সময়ই দেখা যায়, রাজনীতি হয়ে পড়ে অনেক নেতার ব্যক্তিগত লাভ চরিতার্থ করার একটা চারণক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রে তারা প্রায়ই তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ বা আসল করণীয় কাজ ভুলে যায়। কিন্তু সোফি কখনোই সেই দিকে আমাকে সামান্যতম যাওয়ার সুযোগ দেয় নি।
এখনো আমার মনে হয়, ভিভিয়ান বারবোট সম্পর্কে আমার বলার অনেক কিছুই ছিল। আমার অবশ্যই সবাইকে বলা প্রয়োজন, ব্যক্তি বারবোটের যে সব গুণ রয়েছে তার জন্য তাঁকে প্রাণ থেকেই শ্রদ্ধা করা যায়, কিন্তু ব্লক কুইবেকোইস এর এমপি হিসেবে তিনি পার্টির যে কর্মসূচী ও দায়িত্ব পালন করতেন তার মূল লক্ষ্যই ছিল ঐ এলাকার মানুষের মধ্যে একটা বিভক্তি সৃষ্টি করা। কিন্তু আমি মনে করি, যে কোনো সংসদীয় এলাকা অথবা পৃথিবীর যে কোনো জায়গাতেই এমন সব রাজনীতিবিদদের প্রয়োজন যারা মানুষের মধ্যে যে বিভেদ কাজ করে তা দূর করে দিবে।

যখনই আমি যে কোনো স্থানীয় অনুষ্ঠানে কথা বলতাম, লিবারেল পার্টি সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে আমি সব সময়ই মাথায় রাখতাম আমি যেন দল সম্পর্কে সংক্ষেপে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ¡ ধারণা সবাইকে দিতে পারি। এটা এমন নয় যে, ভোটাররা দল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহ প্রকাশ করতো না, কিন্তু ভোটারদের সাথে আমার অধিকাংশ কথা বার্তাই হতো সংক্ষিপ্ত এবং আমি সব সময়ই চাইতাম, আমাদের দলের মূল লক্ষ্যটি সবাইকে জানিয়ে দিতে। আর আমার এই সব কাজের জন্য সোফির কোনো বিকল্প ছিল না। সে সব সময়ই আমাকে বলতো, যে বিষয় নিয়ে আমি ভোটারদের সাথে কথা বলবো, সেগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরার আগে যেনো তাকে একবার শুনিয়ে নি। আমি খুবই সহজ ভাষায় এবং কিছুটা বিশ্লেষণের ভংগিতে সবকিছু আগে সোফির সামনে উপস্থাপন করতাম, যদি কখনও কোনো কিছু শুনতে জটিল বা দূর্বোধ্য মনে হতো, তাহলে সে সেগুলো সহজ করে বলার জন্য আমাকে পরামর্শ দিতো। আমি সোফির কথা মত কাজে লেগে যেতাম এবং ধীরে ধীরে আমি যে কোনো কঠিন ও দূর্বোধ্য বিষয় খুব সহজে আর অল্প সময়ে সবার সামনে তুলে ধরার ব্যাপারে দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম। যেমন বলা যেতে পারে, স্টিফেন ডিওন এর সেই ভাগ্য বিড়ম্বিত ‘গ্রীণ শিফট’ মাত্র তিরিশ সেকেন্ড বা তারও কম সময়ে আমি সবার সামনে পরিস্কারভাবে তুলে ধরতে পারতাম।

রাজনীতির প্রথম জীবনে জাস্টিন ট্রুডো

আমি যখন পাপিনিউ’র বাসিন্দাদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতাম, তখন বেশীর ভাগ সময়ই সামাজিক বিষয়াদি নিয়ে কথা বলার একটা পরিস্থিতি তৈরী হতো, বিশেষ করে নতুন অভিবাসীদের সাথে, যারা সাধারণত নারী-নারী বা পুরুষ-পুরুষে বিবাহ, গর্ভপাত এবং মারিজুয়ানা খাওয়ার ওপর বিধি নিষেধ তুলে দেওয়ার মত বিষয় নিয়েই কথা বলতে চাইতো। আমি সব সময় তাদের অবস্থানের পক্ষে কথা বলতে পারতাম না বা তারা যা চায়, সে অন্যুায়ী আমি তাদেরকে খুশি করার মত কোনো উত্তরও দিতাম না, আমি যেটা বিশ্বাস করতাম বা আমি যেটাকে কানাডার সার্বিক সংস্কৃতি ও আগামী দিনের জন্য ভালো মনে করতাম, সেই বিষয়েই আমি আমার যুক্তি তুলে ধরতাম। আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিচল থেকে যখন আমি মসজিদ বা গীর্জায় প্রশ্ন-উত্তর এর মত কোনো জমায়েতে উপস্থিত থাকতাম, তখন প্রায়ই তাদের তোপের মুখে আমাকে পরতে হতো। এমন পরিস্থিতি যখন সৃষ্টি হতো, তখন আমি সাধারণত যেভাবে উত্তর দিতাম, তা হচ্ছে, ‘আমরা এই বিষয়টা সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করি, এটা সত্য। আর এটা ধারণ করার মূল কারণ হচ্ছে, আমরা নীতিগতভাবে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ আলাদা আদর্শের মানুষ। যেহেতু আমরা একই বিষয়ে দুই পক্ষ দুই মত পোষণ করছি, তাহলে এখানে একে অপরের এই পক্ষাবলম্বন করার কারণটা উপলব্ধি করে আমাদের উভয় পক্ষেরই কিছুটা ছাড় দেওয়া উচিৎ। আমি এটাও মনে করি, আরো যে সব বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে মতানৈক্য আছে, সেই সবেরও মিলের জন্য বা কাছাকাছি আসার জন্য কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আমরা মেনে নিতে পারি। শেষে, আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতাম, তারা যেন আমাকে ভোট দেবার বিষয়টা তাদের মাথায় রাখে।’ আমি যখন ওভাবে কথা বলতাম, সেটার যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হতো, তা সত্যিই আমাকে অভিভূত করতো। উপস্থিত সবাই শেষ পর্যন্ত আমার প্রশংসা করতো এই কারণে যে, আমি এমন সব জটিল সামাজিক বিষয়গুলো এড়িয়ে না গিয়ে এবং শুধুমাত্র তাদের খুশি না করে বরং আমি যে ভাবনাটা ধারণ করি, সেটাই বলেছি। সেই সাথে যে কোনো সামাজিক বিষয়ে উভয়পক্ষেরই যে কিছু বলার আছে বা যুক্তি আছে, সে ব্যাপারে আমি তাদের চিন্তার জগতটা উম্মোচিত করে দিয়েছি। আমার ভালো লাগতো, তারা আমার কাছে শোনার জন্য যা প্রত্যাশা করতো, সেই মতো আমি কিছু না বললেও, আমার যুক্তি ও বলার ধরণ তারা খুবই পছন্দ করতো।

রু-জ্য-তালুন এর একটি পাকিস্তানী কানাডিয়ান মসজিদের একটা ঘটনা এখন মনে পড়ে যাচ্ছে। ওখানে আমি যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম তা প্রায়ই আমাকে বিভিন্ন জায়গাই হতে হতো। আমি লক্ষ্য করতাম, যারা কানাডায় নতুন অভিবাসী হয়ে আসতো, তারা আমাকে সর্বতোভাবে সমর্থন করতো, কিন্তু সামাজিক কিছু বিষয় নিয়ে তাদের বিশ্বাস থেকে তারা এক চুলও নড়তো না। অ্যালেক্স আমাকে প্রায়ই বলতো, আমি যেন নারী-নারী বা পুরুষ-পুরুষে বিয়ের মত সামাজিক বিষয়টা নিয়ে কথা না বলি, কিন্তু আমি তা এড়িয়ে যাবার পক্ষে কখনোই ছিলাম না, বরং আমি আমার ভাবনা, তাদের ভাবনা এবং যারা এমন সিদ্ধান্ত নেয়, সেই তাদের অবস্থান থেকে বিষয়টা সবার সামনে ব্যাখ্যা করতাম।

আমি সেই মসজিদে উপস্থিত সবার সামনে বলেছিলাম, ‘আমি জানি এইখানে যারা উপস্থিত আছেন, তারা সবাই ‘চার্টার অব রাইটস’কে সমর্থন করেন। ওটা হচ্ছে আমাদের কাছে একটা ‘ডক্যুমেন্ট’ যেটাতে আমাদের সবার মূল অধিকারগুলোকে আমাদের মত করে উপভোগ করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে অবশ্যই সবার নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। কিন্তু আপনারা কি একবার ভেবেছেন? যে অধিকার আপনাদেরকে নিজ নিজ ধর্ম পালন বা অন্যান্য অধিকার উপভোগ করার ক্ষমতা দিয়েছে, সেই অধিকারের বলেই পুরুষ-পুরুষ বা নারী-নারীদের বিয়ের অধিকার দেয়া হয়েছে, এমনকি আপনাদের কন্যারা যদি অমুসলিম কাউকে বিয়ে করতে চাই, সেটাও তারা করতে পারে। ‘চার্টার অব রাইটস’ সবারই অধিকারকে রক্ষা করে। আপনারা কখনোই শুধু আপনাদের নিজেদের অধিকার রক্ষার কথা বলতে পারেন না, আর যাদের আপনারা পছন্দ করেন না, তাদের বিষয়টার কোনো মূল্য না দিয়ে তাদের বিপক্ষেও আপনারা দাঁড়াতে পারেন না।’ আমি এও বলেছিলাম, ‘আমাদের সবার উচিৎ আমাদের প্রতিপক্ষের স্থান থেকে এমন ধরনের সামাজিক বিষয়কে বিচার করা।’ ঐ মসজিদে যারা আমার কথা শুনছিল, তাদের দেখেই মনে হচ্ছিল, তারা নিজ বিশ্বাসে খুবই গোঁড়া প্রকৃতির। কিন্তু সেই সব দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ মানুষেরা আমার এমন সব কথা আর যুক্তি মন দিয়ে শুনে অনুধাবনের ভংগিতে কিছুটা মাথা নাড়িয়ে আমাকে সমর্থন করেছিল। আমার বিশ্বাস, তারা নিশ্চয় ভেবেছিল, নতুন প্রজন্ম আর দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য আমার কথার কোনো বিকল্প নেই। (চলবে)