মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

বত্রিশ.
আমি পঁচিশ বছরে পা দেবার কয়েক বছর আগে আমার খুব প্রিয় এক বন্ধুর অনুরোধে বাবার সাথে একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম। শারীরিকভাবে বাবা তখনো খুব ভালো অবস্থায় ছিলেন, কিন্তু বড় ছেলে হিসেবে আমার কেনো যেনো বারবার মনে হয়েছিল, শেষ জীবনের কিছু বিষয় নিয়ে বাবার সাথে আমার কথা বলা দরকার। আমার এটাও মনে হয়েছিল, ওমন কোনো পরিস্থিতি আসার আগেই বিষয়টা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁর জীবন প্রদীপ যখন নিভে যাবে তখন তাঁর প্রতি কি ধরনের দায়িত্ব পালন করা উচিৎ। তিনি সরাসরি আমাকে জানিয়েছিলেন, তাঁর একান্ত প্রত্যাশা, মৃত্যুর পর তিনি সেই ছোট্ট শহর সেইন্ট রেমি’র পারিবারিক গোরস্থানে বাবা-মা আর দাদা-দাদির সাথে মিলে যেতে চান এবং তিনি সত্যি সত্যিই চাইতেন যে তাঁর কবরটা যেনো তাঁর দাদা-দাদি আর বাবা-মা’র কবরের পাশে হয়। তিনি এটাও বলেছিলেন, তাঁর অন্তোষ্টিক্রিয়ায় প্রচুর মানুষ উপস্থিত থাকুক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে সেটা বিশেষ মর্যাদা বা গাম্ভীর্যের সাথে হোক, এ সব ব্যাপারে তাঁর কিছুই যায় আসে না, তবে মন্ট্রিয়লেই তাঁর যেন শেষ দিনগুলো কাটে।
বাবার সাথে এমন সব কথা চালিয়ে যাওয়া আমার জন্য খুবই বেশী কঠিন ও কষ্টের ছিল, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, আমার এমন আলোচনা তিনি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। আমি সত্যিই মনে করি, কারো বৃদ্ধ বাবা-মা’র সাথে এমন সব কথাবার্তা তোলা বা চালিয়ে যাওয়া আসলেই কঠিন, কিন্তু সব দিক বিবেচনা করলে বলতে হয়, আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ যে সব বয়স্ক ছেলেমেয়েদেরকে তাদের পিতা-মাতার মৃত্যু বিষয় এবং সে সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ কর্ম বা রীতি নীতি নিয়ে যে ধরনের মল্লযুদ্ধ করতে হয়, আমার তেমন কিছুই করতে হয় নি, এমন কি এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা কোনো আবেগঘন পরিবেশও তৈরী করিনি। দু’জনের ঐ কথাগুলো খুব বাস্তবসম্মত ও পরিস্থিতি নির্ভর ছিল এবং দু’জনের ঐ কথাগুলো বড় বেশি প্রয়োজনও ছিল। বাবা অসুস্থ্য হবার পূর্বেই তাঁর সাথে আমার ঐ আলাপ হয়েছিল।

বাবাকে নিয়ে আমার যত স্মৃতি আছে বা তাঁর সাথে আমার যে সম্পর্কের উষ্ণতা ছিল সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতর বা অভূতপূর্ব মুহূর্ত যদি উল্লেখ করি, তাহলে সবার আগে উল্লেখ করতে হয় বাবার মৃত্যুর এক বছর পূর্বে ভ্যাংকুভারের ওয়েস্ট পয়েন্ট গ্রে একাডেমীতে আমার পড়ানো অবস্থায় যখন তিনি সেখানে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি এসেছিলেন এক শান্ত শুক্রবারের দুপুর বেলায়। আমার সহকর্মীদের সাথে কথা বলে ও আমার সাথে সারা একাডেমীটা ঘুরে তিনি খুব মজা পাচ্ছিলেন। তাঁকে আমার বসার জায়গা, ক্লাস নেয়ার জায়গা দেখাতে দেখাতে যখন আমি আমার পেশাগত দিকগুলো তাঁর সামনে তুলে ধরছিলাম, তখন আমার খুব মজা লাগছিল।

আমরা যখন একাডেমীর ভবন থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ পেছন থেকে থপ থপ আওয়াজ তুলে আমাদের দিকে ছুটে আসা পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আমরা দুজনেই পেছন ফিরতেই দেখতে পেলাম আমার এক ছাত্রী ছুটতে ছুটতে একেবারে আমাদের নিঃশ্বাস নেয়া দূরত্বে চলে এসেছে। আমাদের ওভাবে পেছন ঘুরায় এবং সে আমাদের একেবারে নাকের কাছে চলে আসায় সে একেবারে ভড়কে গিয়েছিল। ঐ অবস্থায় তারপর কিছুটা হাফাতে হাফাতে সে শুধু মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেছিলো, ‘মি. ট্রুডো…’

আমার জীবনে হাজার হাজার বার আমি এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছি। আমি যখনই বাবার সাথে কোথায় গেছি, সেখানেই আমি দেখেছি সেই পিচ্চি ছেলেপুলের দল থেকে বুড়োর দল সবাই বাবার দিকে ওমনভাবে এগিয়ে এসে তাঁর অটোগ্রাফ চেয়েছে, বা তাঁর সাথে একটু হাত মেলানোর জন্য তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে অথবা বাবার সাথে একটি ছবি তোলার জন্য তাঁকে জেঁকে ধরেছে। ওমন সব সময়গুলোতে আমি বরাবরই একটু পেছনে সরে গিয়ে সবার কাণ্ড কারখানা দেখতাম আর নীরবে হাসতাম। বাবা কিন্তু সেই সময়গুলোতে সব সময়ই খুবই বিনয়ের সাথে সবার সাথে ব্যবহার করে সবার আবদার মেটাতেন, ঠিক তেমনি পূর্বের সেই দৃশ্যগুলো স্মরণ করে এবারও আমি সেই সময়গুলোর মতই একটু পেছনে সরে দাঁড়ালাম।
যে ছাত্রীটা ওভাবে ছুটে এসেছিল, সে সম্ভবত বাবা যে বছর তাঁর সেই স্মরণীয় বরফের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটেছিলেন সেই বছরই জন্মেছিল, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সে কিন্তু বাবার দিকে একটুও তাকালোই না। বরং আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘মি. ট্রুডো, আমি আপনাকে শুধু জানাতে এসেছি যে আজকের বিকেলে ফরাসী ভাষার ক্লাসে আমি একটূ দেরীতে আসবো, কারণ জিমনেসিয়ামের কাজে আমাকে সহযোগিতা করতে হবে।’ আমি মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে ধন্যবাদ দিলে সে আর কোনো কথা না বলে লাফাতে লাফাতে চলে গেলো।

এমন অবস্থার মুখোমুখি হয়ে আমি কিছুটা বিব্রত হচ্ছিলাম। ছাত্রীটি এক অভিবাসীর মেয়ে। সে ছিল সা¤প্রতিক সময়ে সফল হওয়া সেই সব অভিবাসী পরিবারের একজন, যারা বাবার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় অভিবাসীদের পক্ষে নেয়া সব নীতিতে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হয়েছে। বাবার বহু সংস্কৃতি ও বহুজাতিক নীতির ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অভিবাসীরা এ দেশকে নিজেদের দেশ মনে করতে পেরেছে এবং তাদের স্বপ্নের পথে সফল হতে পেরেছে। নতুন প্রজন্মের অভিবাসীরা বেশীর ভাগই বাবার সেই পদক্ষেপের কথা জানে না, এমনকি তাদের অনেকেই বাবাকে চিনেও না। সেই কারণে এখন বাবা অনেকের কাছে এক অপরিচিত মানুষ আর তাঁর সাথে অনেকেই সেই অপরিচিতের মতই ব্যবহার করে। বাবার দিকে মুখ ঘুরানোর আগে আমি খুব ইতস্ততবোধ করছিলাম, আমি বুঝতে পারছিলাম না বাবাকে আমি কী বলবো।

কানাডার দুই প্রধানমন্ত্রী। বাবা কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো, আর বাবার কোলে শিশু অবস্থায় কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো

আমার খুব ভালো লেগেছিল যখন তাঁর দিকে ঘুরেই দেখেছিলাম তিনি আমার দিকে তাকিয়ে এক মহা তৃপ্তির হাসি হাসলেন। বাবার কাজ ও কৃতিত্বের জন্য তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের যে ভালোবাসা আর উষ্ণতা পেয়ে এসেছেন তাতে একজন নতুন প্রজন্মের কানাডিয়ানের কাছ থেকে সেই ধরনের ব্যবহার না পেলেও তাঁর এমন কিছু যায় আসে না। সত্যিই তিনি সেই সময় পিতা হিসেবে খুবই গর্ববোধ করছিলেন যে তাঁর সন্তান তাঁর পারিবারিক পরিচয় নিয়ে কানাডার কর্মস্থলে কাজ করে চলেছে, আর কাজটা হচ্ছে, একদল যুবক যুবতীর প্রিয় শিক্ষক হয়ে তাদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করা। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ের কাছে এখন আমিই ‘মি. ট্রুডো’। ‘ট্রুডো’ বলতে এখন আর শুধু পিয়েরে এলিয়ট ট্রæডো বুঝায় না। বাবা কিন্তু আমার এই পরিচয়ের জন্য খুবই গর্ববোধ করতেন। ঐ মুহূর্তটা কিন্তু আমাদের দু’জনের জন্যই ছিল খুব অসাধারণ এক সময় যা আমাদের দুজনেরই ভালো লেগেছিল।

এবং ওটাই ছিল বাবার সাথে আমার শেষ সময়গুলোর একটি। ২০০০ সালের বসন্তে ওয়েস্ট পয়েন্ট গ্রে একাডেমীর ক্লাস যখন শেষের দিকে তখনই আমি শাসা’র কাছ থেকে টেলিফোন পেয়েছিলাম। সে ফোনে শুধু জানিয়েছিল, বাবা বোধ হয় আর বাঁচবেন না। তাঁর পারকিনসন’স রোগ ধরা পড়েছে এবং কঠিন নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে কোনো রকমে তিনি বেঁচে আছেন। খবরটা শুনে আমি নিজে নিজেকেই বুঝাতে লাগলাম, এই সব রোগ থেকে তিনি অবশ্যই সেরে উঠবেন। আবার আমার মাথায় এই চিন্তাটাও এসেছিল, তিনি যতই শক্ত মনের মানুষ হোন না কেনো, তিনিতো আর সব কিছুতেই অজেয় নন। শাসা আমাকে আরো জানিয়েছিল, বাবার বেশ কিছুদিন আগে প্রোস্টেট ক্যানসার ধরা পড়েছে, কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এটার তিনি চিকিৎসা করাবেন না। অসুখটা তখন মনে হয় একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছিল।

‘কি বাজে বকছো?’ টেলিফোনের এ পার থেকে আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম। তারপর ধমকের স্বরে তাকে বলেছিলাম, ‘আমাকে এ সব কথা এত দিন জানাও নি কেনো?’
শাসা আমার এমন উত্তেজিত কথা শুনে শুধু জানিয়েছিল, তার করার কিছুই ছিল না, কারণ তার প্রতি বাবার কঠোর নির্দেশ ছিল, এ সব কিছুই যেন আমাকে জানতে দেওয়া না হয়। বাবা ভালোভাবেই জানতেন, আমি যদি ঘুণাক্ষরেও বাবার এমন অবস্থার কথা জানতে পারতাম, তাহলে আমি ভ্যাংকুভারের সব কিছু ফেলে সেই মুহূর্তেই মন্ট্রিয়লের দিকে রওনা হয়ে যেতাম। তিনি কোনোভাবেই চান নি যে একাডেমীর ছেলেমেয়েদের কোর্স শেষ না করে আমি মন্ট্রিয়লের পথে পা বাড়ায় আর ছাত্রছাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্থ হোক। আমি জানি বাবা সব সময় বৃহত্তর মঙ্গলের কথা ভাবতেন, কিন্তু সে সময় আমি আমার মাথা আর ঠাণ্ডা রাখতে পারছিলাম না, আমি খুব বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। আমার মধ্যে একটা চিন্তা তখন ভীড় করছিল এবং আমার বারবার মনে হচ্ছিল, বাবার এই অবস্থা সম্পর্কে যদি আমি আগে জানতাম তাহলে এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে পারতাম যাতে বাবার শারীরিক অবস্থা এত খারাপের দিকে যেতো না। যখন আমার মাথা ঠাণ্ডা হলো আর যখন আমি মানসিকভাবে স্থির হলাম, তখনই আমি আমার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার মন্ট্রিয়লের দিকে সেই দীর্ঘ বিষাদময় যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমি তখনই ঠিক করে ফেলেছিলাম, গোটা গ্রীষ্মের ছুটিটা আমি বাবার সাথে কাটাবো, আর বাবার প্রিয় সেক্সপীয়ার, রাচিন এবং কোর্নেইলী’র নাটকগুলো তাঁকে পড়ে পড়ে শুনাবো এবং তাঁর পাশে শুধু শান্ত হয়ে চুপচাপ বসে সময় কাটাবো। (চলবে)
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা