মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

পঞ্চান্ন.
পাপিনিউ’র মানুষের কাছ থেকে যে বিষয়ে আমি সব চাইতে বেশী আবেদন পেতাম, সেটা হচ্ছে নাগরিকত্ব আর অভিবাসন বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের খোঁজ খবর। যারা নিজেরা এই সব বিষয় নিয়ে ভালোভাবে জানতে চাইতো, তারাই সময় সুযোগ করে নিজেদের এলাকার এমপি’র অফিসে এসে এই সব বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নেবার জন্য ঢুঁ মারতো। ওদের অনেকেই ভিজিটর ভিসার ব্যাপারটা জানতে চাইতো এবং চেষ্টা করতো যেভাবেই হোক তাদের পরিবারের প্রিয়জনদের তাদের কাছে নিয়ে আসতে যাতে তাদের পারিবারিক যোগাযোগের মেলবন্ধনটা অটুট থাকে। যে বিষয়টা সব চেয়ে বেশি হতো, তা হচ্ছে, কারো হয়তো নতুন সন্তান হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সে আবেদন জানাতো সেই নতুন ভুমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের দাদা-দাদি বা নানা-নানি’কে কয়েক মাসের জন্য নিয়ে আসতে যাতে তাদের জন্ম নেওয়া সন্তানেরা একটু ভালোভাবে দাদা-দাদি বা নানা-নানির আদর বা যতœ নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। এই অছিলায় তারা নিজেরাও চাইতো এই বিদেশ বিভূয়ে নিজ নিজ বাবা-মায়ের সাথে কিছুদিন কাটাতে এবং তারা যে দেশে বসবাস করে সেই দেশটি তাদের বাবা-মা’রা ঘুরে দেখে যাক। আমরা অভিবাসন কর্মকর্তার কাছে তাদের এই সব অনুরোধের প্রেক্ষিতে সুপারিশ করার পূর্বে সব সময় সেই সব অনুরোধগুলো ভালোভাবে যাচাই বাচাই করতাম যাতে আমরা সত্যিকারের আবেদনকারীর জন্য কাজ করতে পারি।

স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার জন্য দরখাস্ত কেউ করে ফেললে এমপি অফিসের আর তেমন কিছুই আর করার থাকে না। আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এটা একটা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে। আমরা শুধু অভিবাসন কর্মকর্তাদের কাছে শুধু খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করে দেখতাম যে দরখাস্তটা কোন পর্যায়ে আছে। দেখা যেতো সঠিকভাবে দরখাস্ত না করা বা প্রয়োজনীয় তথ্য না দেবার ফলে অনেককেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো।

আমার এলাকার অনেকেই অভিবাসন সংক্রান্ত কথা বলতে এসে হতাশার সুরে বলতো, অটোয়াতে বসে কনজারভেটিভরা যেভাবে অভিবাসীদের সুযোগ সুবিধা বা অভিবাসন প্রক্রিয়াকে সহজ করার কথা বলে হম্ভি তম্ভি করে কিন্তু বাস্তবে তারা কিছুই করে না। আমি মনে করি, মি হার্পার এর পদক্ষেপ দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। সেই ১৮৯০ সাল থেকে উইলফ্রেড লোরিয়ের গোটা দেশে ব্যাপক অভিবাসনের পক্ষে যে কাজ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা নিঃসন্দেহে কানাডার জন্য মঙ্গল বয়ে আনে। এটাতো সত্য, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভিবাসীদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। যদি যুক্তি দিয়ে বলতে হয়, তবে আমি সব সময়ই বলি, কনজারভেটিভরা যা করে বা যে সব পদক্ষেপ নেয়, তার অধিকাংশই তারা ঐতিহাসিক ভিত্তিতে করে না, সহজ কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, তারা ইতিহাস থেকে খুবই কম শিক্ষা গ্রহণ করে। দেশের অর্থনীতিতে অভিবাসীদের অবদান এখন সবাই ভালোভাবে স্বীকার করে। অভিবাসীদের এই অবদান ছাড়া আমরা খুব বেশি এগুতে পারতাম না। আমি বিশ্বাস করি, কোন রাজনৈতিক দল জনগণকে শুধু তাদের টিকে থাকার ক্রীড়ানক হিসেবে ব্যবহার করলে ভুল করবে, বিশেষ করে নতুন যে সব অভিবাসীরা এ দেশে আসছে তাদেরকে সম্মান না দিলে এবং তাদের সত্যিকারভাবে এদেশে আত্মীকরণ না করলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে কানাডার অভিবাসনের মূল নীতি তৈরী করা হয়েছিলো সেটা ব্যর্থ হবে। অভিবাসীদেরকে এমন সুযোগ দিতে হবে বা এমন এক জায়গায় বসাতে হবে যাতে তারা সত্যিকারভাবেই দেশ গড়ার কারিগর হতে পারে। কনজারভেটিভদের অদূরদর্শী অভিবাসন নীতির ফলে আমরা কানাডার অভিবাসনের মূল সুর থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, অভিবাসীরা যেনো শুধু ভালো চাকরীর জন্য যেন এখানে না আসে, বরং তারা যেনো এখানে আসে নতুন জীবনের জন্য। আমরা অবশ্যই চাই, এ দেশে যারা নতুন আসছে, তারা যেনো এ দেশের সুন্দর প্রত্যাশিত নাগরিক হিসেবে নিজেদের তৈরি করে, কখনও যেনো নিজেদের নিছক চাকুরীজীবী হিসেবে না ভাবে।

পাপিনিউ’র মত একটি শহুরে বহুজাতিক এলাকা থেকে সংসদ সদস্য হওয়ায় আমার সামনে অনেক কঠিন করণীয় কাজ এসে আপনা আপনিই হাজির হয়ে যেতো। সেই সাথে অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন বাস্তবতার মুখাপেক্ষী হতে হতো। বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী হয়ে আসা মানুষেরা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসতো যেগুলো সবগুলো সমাধান করা আমার পক্ষে কখনও সম্ভব হতো না। হয়তো তারা তখন ভাবতো তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করা বা তাদের জন্য লড়াই করার মত ক্ষমতা কানাডার একজন সংসদ সদস্যের নেই। অনেক উন্নয়নশীল দেশেই দেখা যায়, রাজনীতিবিদরা দেশের প্রচলিত নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিজেদের খুশী মত যা ইচ্ছে তাই করেন। তারা হয়তো নিজের ক্ষমতাবলে কারো ট্যাক্স মওকুফ করে দিতে পারেন বা কাউকে জেল থেকে নিমিষেই ছাড়িয়ে নিতে পারেন অথবা একটা ফোন করেই অভিবাসন সংক্রান্ত কোন কাজ নিজের ইচ্ছেমত করে ফেলতে পারেন। এই সব দেশগুলোর প্রধান সমস্যা হচ্ছে, এই সব রাজনীতিবিদদের কাছাকাছি যাওয়া খুব সহজ একটা ব্যাপার নয়। কিন্তু তাদের কাছাকাছি যেতে পারলে বা তাদেরকে কোন সমস্যার কথা বলতে পারলে কারো সমস্যার সমাধান রাতারাতিই হয়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে অনেকাংশেই নির্ভর করে একজনের অর্থ আর প্রতিপত্তি কেমন রয়েছে।

উপস্থিত দর্শকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো

এই সব কথাগুলো কিন্তু আমি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের মুখেই শুনেছি। আমি দেখেছি, তারা কোন রকম বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতা ছাড়ায় যখন কোনো শুক্রবারে আমার অফিসে এসে সরাসরি আমার সাথে কথা বলতে পারতো, তখন তারা প্রায়ই বিস্মিত হয়ে পড়তো। তারা আমাকে বলেছে, তাদের দেশে রাজনীতিবিদরা সব সময়ই তাদের দেহরক্ষী দ্বারা বেষ্টিত থাকেন। আমি লক্ষ্য করেছি, নতুন অভিবাসী হয়ে আসা কেউ আমার অফিসে কোন কাজের জন্য যখন আসে, তখন প্রায়ই কমিউনিটির হোমরা চোমরা কাউকে নিয়ে আসে তাদের হয়ে তদবির করার জন্য। কিন্তু সত্যি বলতে কি, কানাডায় কোনো কাজ করার জন্য এমন কিছু করার কোনো দরকার পড়ে না।

আমার সংসদীয় এলাকার মানুষদের সাথে এই কয়েক বছরে কথা বলে সাধারণ জনগণের সাথে সরকারের সম্পর্কের একটা চিত্র আমি পেয়ে গেছি। সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বড় যে অভিযোগ তা হচ্ছে, সরকার জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে না বা সরকারের এই যোগাযোগ প্রক্রিয়াটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমলাতান্ত্রিক। আমি মানছি, কিছু ক্ষেত্রে এটার খুবই প্রয়োজন রয়েছে। ফেডারেল সরকার যখন পয়ত্রিশ মিলিয়ন জনগণের জন্য কাজ করে তখন অবশ্যই সেটাকে কম্পিউটারাইজড বা টাচ টোন ফোনের মাধ্যমেই হওয়া উচিৎ। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা আর নাগরিকদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কারণ যখন কোন কারণে আমরা সংসদ সদস্যরা কোনো নাগরিকের কোনো সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হই, তখন যেনো তারা সামনা সামনি সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে তাদের সমস্যার সমাধানের উপায় বের করতে পারে। আমার বারবারই মনে হয়েছে, দেশের মানুষের সাথে যোগাযোগটা আরো ভালো বা ফলপ্রসূ করতে অটোয়া আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারে। সত্যি বলতে কি, আরো সুন্দর ও জনবান্ধব কানাডা গড়তে অটোয়াকে এটা করতেই হবে। (চলবে)