মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

 

একত্রিশ.
বাবার জীবনের শেষ বছরে তিনি ধীরে ধীরে খুবই বিষাদগ্রস্থ ও নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। মানুষের মৃত্যু ও মানুষের আত্মার শেষ পরিণতির চিন্তা তাঁকে খুব বেশী ভাবিয়ে তুলেছিল। বিষয়গুলো সব সময় তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতো। মাঝে মাঝে তিনি ঈশ্বরের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন। তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন নি কেনো তাঁকে না নিয়ে ঈশ্বর তাঁর জীবন চাঞ্চল্যে ভরপুর সুন্দর ছেলেটাকে নিয়ে নিলো। তাঁর এই জিজ্ঞাসু মন ঈশ্বরের প্রতি তাঁর দীর্ঘদিনের বিশ্বাস’টাকে টলিয়ে দিয়েছিল। একদিন বাবা মা’কে নিরাশভাবে বলছিলেন, ‘যদি পরের জন্ম বলে কিছু নাই থাকে, তাহলে সারাজীবন ধরে আমি যে কাজ আর বিশ্বাস নিয়ে চললাম, সেগুলোর কোনো মানেই থাকলো না!’ আমার মনে হয়, বাবার মুখ থেকে আমি যত কথা শুনেছি, তার মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে বেশী বেদনাক্লিষ্ট আর নির্লিপ্ত কথা।

এই সময়েই আমি ঈশ্বরের সাথে আমার নিজের সম্পর্কের একটা বুঝাপড়া করে নিচ্ছিলাম। আমার বাবা তাঁর সারা জীবন ধরে একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক ছিলেন। যখন আমরা ছোট ছিলাম, তিনি যে রবিবারে সময় পেতেন, সেই রবিবারেই আমাদেরকে নিয়ে গীর্জায় যেতেন এবং সেই বয়সে আমাকে যেভাবে ধর্ম শিক্ষা দেয়া হয়েছিল, আমি সেইভাবেই ধর্ম কর্ম করতাম। তারপর ধীরে ধীরে বড় হতে হতে আমি বুঝতে পেরেছি, ধর্ম কর্মের বিষয়টা যতটা না ভেতরের তার চেয়ে লোক দেখানোই বেশী। আমার মাঝে মধ্যে আবার মনে হয়, আমি কি তখন সেটার সত্যিকারের মানে বুঝতে পারিনি? সম্ভবত আমি বুঝেছিলাম। যে সব ছেলেমেয়েরা তাদের সবচেয়ে সুন্দর পোষাক পরে গীর্জায় যায়, তারা আসলেই বাচ্চা ছেলেমেয়ে। যখন শাসা, মিশেল আর আমি বাবার সাথে গীর্জায় গিয়ে পাদ্রীর কথা শুনতাম, তখন আমাদের বিরক্তি চরম স্তরে পৌঁছে যেতো। সে অবস্থা থেকে নিজেদের মুক্তি দেবার জন্য আমরা চোখ আর মুখের ইশারায় হাসাহাসি করতাম।

আমার আঠার বছর বয়সে একদিন বাবার সাথে ধর্ম আর আমার ভাবনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আমি খোলাখুলিভাবেই বাবাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে আমার বিশ্বাসের কথা বলেছি, যে বিশ্বাসটা আমি এখনো করি। বাবার সাথে আমার আরো আলাপ হয়েছিল পৃথিবীর সব প্রধান প্রধান ধর্মের নীতি ও মূল্যবোধের সার্বজনীনতা নিয়ে। ধর্মের বিষয় নিয়ে বাবার সাথে আমার মতের মিলের চেয়ে অমিলই বেশী ছিল। ক্যাথলিকদের সেই গোঁড়া বিশ্বাস যাতে বলা হয়েছে, যারা মন প্রাণ আর নিষ্ঠার সাথে ক্যাথলিক নিয়মানুযায়ী ধর্ম কর্ম পালন করবে না, তারা কখনো স্বর্গের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। আমি বরাবরই এই বিশ্বাস থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে এক ধরনের লড়াই করেছি। এমন বিশ্বাস আমাকে খুবই অদ্ভুত মনে হয় আর আমি কখনও এমন বিশ্বাস মন থেকেই মানতে পারিনি যে বিশেষ কোনো ধর্মের রীতি নীতিতে না চললে, কেউ স্বর্গে যেতে পারবে না। আমার এমন সব প্রশ্ন শুনে বাবা শুধু বলেছিলেন, ‘অবশ্যই তুমি তোমার নিজের বিশ্বাস আর পছন্দ মত চলবে।’ তবে তাঁর এই কথা বলার মধ্যে একটা তৃপ্তির ভাব ছিল, যেহেতু আমি একজন খ্রীষ্টান হিসেবে বেড়ে উঠেছি, সে কারণে আমি যদি পরে কখনো সেই বিশ্বাস দ্বারা তাড়িত হয়, তাহলে আমি আবার সেই বিশ্বাসে ফিরে আসবো।

কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো

মিশেলের মৃত্যু বাবাকে তাঁর বিশ্বাসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল, কিন্তু আমার ওপর সেই মৃত্যুর একটা বিপরীতধর্মী প্রভাব পড়েছিল। আমি বর্ণনাতীত কষ্টের মধ্যে সময় পার করছিলাম এবং না বলা বিষাদমাখা মুহূর্তের মধ্যে আমার চেতনায় নতুন কিছুর একটা ছটা এসে লেগেছিল। আমার এই দুঃখের রাজ্যে কালাতিপাত করার সময় মনে হয়েছিল, এই মহাবিশ্বে ঐশ্বরিক শক্তি বলে কিছু একটা আছে যা সাধারণত আমাদের বোধগম্য হয় না। আমার মধ্যে এই ধারণা প্রকাশের ফলে আমার চেতনাগত মন বারবার আমাকে জানাতে লাগলো, অন্য সকলের মত আমার জীবনও সম্পূর্ণ ঐশ্বরের হাতে। আমার মধ্যে নতুনভাবে জন্ম নেয়া এই ধারণাটা কিন্তু আমাকে ভালো কিছু করার তাগিদ থেকে বা নিজেকে ভালো কিছু করার জন্য ভালোভাবে শাণিত করার বিষয়টা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় নি। এই ধারণা মৃত্যুর মত যে সব বিষয়ের ওপর আমাদের কোনো হাত নেই, সেগুলো নিয়ে আমাকে গভীরভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। এটা আমাকে আবার খ্রীস্টান ধর্মের যে মূল সুর সেটা বুঝতে সাহায্যে করেছে। আমি স্বীকার করছি, বর্তমানে আমি ধর্মকে যেভাবে দেখি বা যেভাবে চর্চা করি সেটা সেই সময়ই প্রথম আমার উপলব্ধিতে ধরা দিয়েছিল।

মিশেলের মৃত্যুর পর আমার জীবনে যে আত্মিক শূন্যতা চলচ্ছিল, সেই সময় আমার সাথে ম্যারিয়াম মাতোসেইন এর বন্ধুত্ব হয়। সে ছিল একজন আমেরিকান কানাডিয়ান। সেই সময়ে সে শিক্ষকতা করতো, তবে পরে সে একজন সফল লোকগীতি শিল্পী হয়েছিল। ম্যারিয়াম এবং আমার মধ্যে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট বন্ধুত্ব ছিল। আমরা নিয়মিত কথা বলতাম। আমাদের কথা বলার প্রধানতম বিষয় ছিল বিশ্বাস সম্পর্কিত। আমি ছিলাম একজন নামে মাত্র ক্যাথলিক আর সে ছিল এংলিক্যান খ্রীস্টান, তবে ঐশ্বর আর ধর্ম নিয়ে তাঁর মধ্যে অনেক দ্ব›দ্ব আর সন্দেহ ছিল। আমরা দু’জনেই তখন আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের দোলাচলের এক কঠিন সময় পার করছিলাম।

যখন ম্যারিয়াম আমাকে আলফা কোর্সে যোগ দেবার জন্য বললো, তখন সেই কোর্সে যোগ দিবো কি দিব না, এই নিয়ে এক দ্ব›েদ্ব ছিলাম। এই কোর্সটা ছিল মূলত খ্রীস্টিয় দৃষ্টিকোন থেকে জীবনের মানে খোঁজার একটা নির্দেশনা। প্রথমে সেখানে যোগ দেবার ব্যাপারে কিছুটা ইতস্তত করছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল ঐ ধরনের কোর্সের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, কাউকে সেই ধ্যান ধারণা বা বিশ্বাসের দিকে প্রভাবিত করা। কিন্তু আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম ওটা তেমন কিছু নয়। বরং ওটা ছিল এমন একটা কোর্স যার মূল লক্ষ্য ছিল নিজের আত্মিক শক্তিকে শণিত করা, আর নিজের মধ্যে যেসব ঘাত প্রতিঘাত বা ঝামেলা আছে সেগুলোকে জয় করে নিজের ভিতরের মানবিকতাবোধ সব সময় জাগিয়ে রাখা। আমাদের মানতেই হবে, মাঝে মধ্যে আমাদের ঈশ্বরের সাহায্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমি শুধু বুঝতে পারছিলাম, আমি এমন একটা কঠিন পরিস্থিতির দিয়ে মধ্যে যাচ্ছিলাম আর সেই কোর্সটা আমার ভিতর এমন এক চৈতন্য সৃষ্টি করেছিল যাতে আমার জীবনে ঐশ্বরের উপস্থিতির বিষয়টা আমাকে টের পেতে সাহায্য করেছিল।

রোমান ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ জন পল এর সাথে বাবা পিয়েরে ট্রুডো’র সাথে বালক জাস্টিন ট্রুডো।

২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে যখন টেলিভিশনে সিডনী অলিম্পিক গেমস দেখানো হচ্ছিল সেই দিন বাবা মারা গেলেন। সেই স্মৃতি’টা স্মরণ করতে গেলেই আমার চোখের সামনে ভেসে আসে অলিম্পিক এথলেটস ভিলেজে কানাডার পতাকা অর্ধনমিতভাবে উড়ছিল, সেই দৃশ্যটা আজো যখন চোখ বন্ধ করে দেখার চেষ্টা করি তখন চোখে আপনা আপনি জল চলে আসে। সেদিন বেতারে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক পাউন্ড শোকার্ত কন্ঠে বলেছিলেন, তাঁর বন্ধু পিয়েরে ট্রুডো ‘আর কখনও বার্ধক্যের দিকে এগুবে না’। তিনি এমন একটা বাক্য উচ্চারণ করে সবাই’কে বুঝাতে চেয়েছিলেন আমার বাবার জীবন পথের যাত্রা চিরদিনের জন্য থেমে গেছে। আমার বাবার যথেষ্ট বয়স হবার পরও তিনি খেলাধুলা করতেন এবং খেলাধুলার প্রতি তাঁর খুব বেশি আগ্রহ ছিল। তাঁর সামনে যে কোনো বাধাই আসুক না কেনো তিনি সেটা অতিক্রম করতেন। তাঁর সত্তর বছর বয়সে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে ছুটি কাটানোর সময় একটা খাদে তাঁর পা ঢুকে যাওয়ায় তাঁর পা’টা মচকে যায়। কয়েক বছরের চিকিৎসা আর অপারেশনের পর সেটা স্বাভাবিক হলে তিনি আবার হুইস্টলারের ডায়মন্ড ট্রেইল এ স্কি শুরু করেন। আমাদের পরিবারের সবাই বাবার একটা বিষয় নিয়ে খুবই হাসাহাসি করতাম। ব্যাপারটা ঘটতো বাবা যখন সিনেমা দেখতে যেতেন। তিনি সব সময় বয়স্কদের জন্য টিকিটের দাম ছাড় দেয়া আছে ওমন টিকিট কাটার জন্য সব সময় খেয়াল রাখতেন। আমরা যখন দেখতাম তাঁর আচরণ একেবারে গতানুগতিক বয়স্ক মানুষদের মত, তখন না হেসে আর পারতাম না। বাবার মধ্যে এমন পরিবর্তন খুব ভালোভাবে আমি লক্ষ্য করতাম। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর শারিরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সব দিক দিয়ে সবচেয়ে সবল আর কর্মঠ মানুষদের একজন। (চলবে)