ফরিদ আহমেদ : বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৬৭ সালে। এটা একটা নাতিদীর্ঘ উপন্যাস। এই নাতিদীর্ঘ উপন্যাসকে কেন্দ্র করেই দীর্ঘ এক বিতর্ক তৈরি হয়েছিলো। যেতে হয়েছিলো আদালত প্রাঙ্গণে।

প্রকাশের পরেই ব্যাপক আলোড়ন তোলে উপন্যাসটা। সেই আলোড়ন যে শুধু ইতিবাচক ছিলো তা নয়। বইটার বিরুদ্ধে অনেকেই অশ্লীলতার অভিযোগ এনেছিলেন। নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে শুদ্ধচারী এবং শুদ্ধবাদী বাঙালিদের কাছ এই বইয়ের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আসাটা অপ্রত্যাশিত কিছু ছিলো না। উপন্যাসের শুরু হয়েছিলো এ’ভাবে:
“হ’য়ে গেছে – ওটা হ’য়ে গেছে – এখন আর কিছু বলার নেই। আমি, মালতী মুখোপাধ্যায়, একজনের স্ত্রী আর একজনের মা, আমি ওটা করেছি। করেছি জয়ন্তর সঙ্গে, জয়ন্ত আমাকে চেয়েছে, আমিও তাকে। নয়নাংশু হয়ত ভাবছে আগেই করেছিলুম, কিন্তু না – আজই প্রথম। আজ রাত্রে – চার ঘণ্টা আগে। যেখানে মালতী এখন শুয়ে আছে।”

ষাটের দশকে যৌনতা নিয়ে বাঙালির যে সামাজিক সংস্কার এবং নীতিবোধের সীমারেখা ছিলো, সেই সীমারেখার জন্য এই চরণগুলোকে হজম করা কঠিন ছিলো কারো কারো জন্যে। এদেরই প্রতিভ‚ হয়ে এসেছিলেন নীলাদ্রি গুহ নামের একজন ল কলেজের ছাত্র। তিনি আদালতে বইটার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ এনে মামলা ঠুকে দেন।

এটা একটা দীর্ঘ মামলা ছিলো। শুরু হয়েছিলো ১৯৬৯ সালে, শেষ হয়েছিলো ১৯৭৩ সালে। বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা ছিলো এই উপন্যাসটি আর কখনোই আলোর মুখ দেখবে না। ১৯৭৩ সালে অবশ্য আদালত বুদ্ধদেব বসুর পক্ষেই রায় দেয়। অশ্লীলতার অভিযোগ খারিজ হয়ে যায় ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ উপন্যাসের বিরুদ্ধে।

বুদ্ধদেব বসুর লেখার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ এটাই অবশ্য প্রথম নয়। নানা সময়ে এই অভিযোগের তীর তাঁর দিকে ছুটে এসেছে। অভিযোগ এলেও আদালতে তাঁকে যেতে হয়নি কখনো এই উপন্যাসের আগে। তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনাতেই সেগুলো শেষ হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার প্রথম অভিযোগ এসেছিলো একেবারে সেই প্রথম তারুণ্যেই।

বুদ্ধদেব বসুর বয়স তখন মাত্র আঠারো বছর। তাঁর লেখা প্রথম গল্প প্রকাশিত হলো ‘কল্লোল’ পত্রিকায়। গল্পটার নাম “রজনী হলো উতলা”। কোথায় উতলা হয়ে সবাই তাঁকে বাহবা দেবে, তা না, তার বদলে অদ্ভুত সব অভিযোগ আসতে থাকলো তাঁর বিরুদ্ধে। প্রথম অভিযোগ এলো অশ্লীলতার অভিযোগ। এই অভিযোগ অবশ্য পরবর্তী জীবনেও তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে।

এই গল্পের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার প্রথম অভিযোগ করলেন বীণাপাণি দেবী নামের এক ভদ্রমহিলা। আত্মশক্তি পত্রিকায় তিনি কঠোর ভাষায় লিখলেন, “এমন লেখককে আঁতুড়েই নুন খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিল।” ভাগ্যিস তাঁর কথা কেউ শোনেনি বুদ্ধদেবের জন্মের সময়। নইলে বাংলা ভাষার দ্বিতীয় সেরা সাহিত্যিককে আঁতুড়েই মারা যেতে হতো। তাঁর সৃষ্ট বিপুল এক সৃষ্টিভাণ্ডার দেখার সুযোগ আর আমাদের হতো না।

আরেক ভদ্রমহিলাও রেগেমেগে লিখলেন, “লেখক যদি বিয়ে না করে থাকে তবে যেন অবিলম্বে বিয়ে করে, আর বউ যদি স¤প্রতি বাপের বাড়িতে থাকে তবে যেন আনিয়ে নেয় চটপট।” ভদ্রমহিলার ইঙ্গিত পরিষ্কার। হরমোনজাত আবেগ নির্গমনে ব্যর্থ হয়েই যে বুদ্ধদেব বসু এইসব অশ্লীল লেখা লিখছেন, সেটা জানিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কসুর করেননি তিনি।

অশ্লীলতার মানদণ্ড ব্যক্তিভেদে আলাদা হয়, সমাজভেদে আলাদা হয়, কালভেদেও আলাদা হয়। কাজেই এ নিয়ে আসলে বলার বিশেষ কিছু নেই। তবে, তাঁর এই লেখার বিরুদ্ধে অদ্ভুত এবং মারাত্মক এক অভিযোগ নিয়ে এলেন নির্মলকান্তি ধর নামের একজন ব্যক্তি। তিনি ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় চিঠি লিখে অভিযোগ করলেন যে, বুদ্ধদেব বসুর এই গল্পটি চৌর্যবৃত্তির ফসল। স্টেফান জোয়াইগ এর Erstes Erlebnis নামের গল্পগন্থের প্রথম গল্পের সাথে বুদ্ধদেব বসুর রজনী হলো উতলা গল্পটার হুবহু মিল রয়েছে বলে তিনি জানালেন।

বুদ্ধদেব বসু অশ্লীলতার অভিযোগ আনা দুই ভদ্রমহিলার বিরুদ্ধে কিছু না বললেও, নির্মলকান্তি ধরের অভিযোগের উত্তর দিলেন। নবশক্তি পত্রিকায় তিনি চিঠি লিখে জানালেন, তাঁর গল্প জোয়াইগের কোনো গল্পের নকল নয়। এর কারণ হিসাবে তিনি বললেন, রজনী হলো উতলার প্রকাশকাল হচ্ছে ১৯২৬ আর জোয়াইগের বইটা প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩১ সালে। পাঁচ বছর পরে প্রকাশ হওয়া কোনো বইয়ের গল্পের নকল করা যে সম্ভব না কারো পক্ষে, সেটা সকলেরই বোঝা উচিত।

‘রজনী হলো উতলা’ গল্পটা কল্লোলে প্রকাশিত হবার পরপরই সরাসরি এবং সবচেয়ে স্থূল ভাষায় একে আক্রমণ করলেন সজনীকান্ত দাস। তিনি তাঁর পত্রিকা “শনিবারের চিঠি”-তে অতি-আধুনিক সাহিত্যকে ব্যঙ্গ করে একটা নাটিকা লিখলেন। নাটিকাটার নাম ‘Orion বা কালপুরুষ’। নিজের নামে অবশ্য তিনি এটা লিখলেন না, লিখলেন কেবলরাম গাজনদার ছদ্মনামে। শুধু এ করেই ক্ষান্ত হলেন না তিনি। রবীন্দ্রনাথকে দীর্ঘ এক পত্র লিখে এই সব ছাইপাঁশ অশ্লীল অতি-আধুনিক লেখার বিরুদ্ধে প্রতিকার করার জন্য আহবান জানালেন। সজনীকান্তের সেই আহবানে কিছুটা সাড়াও দিয়ে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ। অনেকটা একমত হয়েই চিঠির উত্তর দিলেন তিনি। সজনীকান্তের পত্রের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছিলেন, তা হচ্ছে এরকম:
“আধুনিক সাহিত্য আমার চোখে পড়ে না। দৈবাৎ কখনো যেটুকু দেখি, দেখতে পাই, হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুচে গেছে। আমি সেটাকে সুশ্রী বলি এমন ভুল কোরো না। কেন করিনে তার সাহিত্যিক কারণ আছে, নৈতিক কারণে এস্থলে গ্রাহ্য না-ও হতে পারে। আলোচনা করতে হলে সাহিত্য ও আর্টের মূলতত্ত¡ নিয়ে পড়তে হবে। এখন মনটা ক্লান্ত, উদভ্রান্ত, পাপগ্রহের বক্রদৃষ্টির প্রভাব – তাই এখন বাধ্যতার ধুলো দিগদিগন্তে ছড়াবার সখ একটুও নেই। সুসময় যদি আসে তখন আমার যা বলার বলব।”

নোবেল পুরস্কার পাওয়া পঞ্চান্ন বছর বয়েসী সাহিত্যিক, যিনি তখন বাঙালিদের কাছে প্রায় দেবতার আসনে বসে গেছেন, তাঁকে তাঁর এই বক্তব্যের জন্য রেহাই দিলেন না আঠারো বছরের সদ্য তরুণটি। অত্যন্ত শালীন কিন্তু কঠিন ভাষায় রবীন্দ্রনাথকে প্রতি আক্রমণ করলেন তিনি। প্রগতি পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখলেন,
“যদিও ‘আধুনিক সাহিত্য’ তাঁর ‘চোখে পড়ে না’, তবুও তাতে ‘হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুচে গেছে’ বলে মত দিয়েছেন। আব্রæ ঘুচে যাওয়ার বিরুদ্ধে কী সাহিত্যিক কারণ আছে তা রবীন্দ্রনাথ জানালেও পারতেন। সে কি এই যে, ভদ্র শ্রেণী-উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা হওয়া এতকাল যাঁদের একচেটে সৌভাগ্য ছিলো – ও নিম্নস্তরের লোকের মধ্যে সাহিত্যের দিক দিয়ে যে-ব্যবধান এতকাল ছিলো, তা হঠাৎ খসে গেছে, না এই যে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র যেসব জিনিশ ইঙ্গিতমাত্র করেছেন, আধুনিকেরা সেইটেই একটু স্পষ্ট করে বলেছেন? গোগলের আমলে রুশীয় নাটক-নভেলে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ভিন্ন কোনো লোক স্থান পেতো না; সেই ব্যবধান লঙ্ঘন ক’রে চেখব গর্কী নিশ্চয়ই মহাপাতক করেছেন? যুবনাশ্বের গল্প যে ভালো নয়, তার একমাত্র কারণ কি এই যে, তাঁর চরিত্রগুলি পুরানো আমলের জমিদার বা বালীগঞ্জ নিবাসী ব্যারিস্টার নয়?”