মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

চৌত্রিশ.
বাবার মৃত্যুর পর আমার মস্তিষ্কে যে বিষয়টা সব শেষে আসে তা হচ্ছে, নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করবো কি করবো না। আমি ভ্যাংকুভারে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম, আমি চেয়েছিলাম আমার সেই শিক্ষকতা পেশা’তেই থাকতে। সেই সময় আমি প্রবলভাবে উপলব্ধি করছিলাম, আমার সারা জীবন জুড়ে যে মানুষটা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিলেন, সেই প্রিয় মানুষটা আর আমার চারপাশে নেই।

বাবার অন্তোষ্টিক্রিয়ার কয়েক দিন পর আমি কেনো যেনো ভেবে বসলাম বাবার লিবারেল পার্টির হয়ে আমিও কাজ করি, কিন্তু আমি নিজের সাথে নিজেই বুঝাপড়া করে বুঝতে পেরেছিলাম, ঐ রাজনীতির প্রতি আমার কোনো আকর্ষণই নেই। আমি শিক্ষক হিসেবে ভালোই করছিলাম আর নিজেকে এই পেশার সাথে যুক্ত করতে পেরে আমার ভালোই লাগছিল। কিন্তু সেই সময় আমার এটাও মনে হচ্ছিল, হয়তো কোনো একদিন আমাকে রাজনীতির সাথে নিজেকে যুক্ত করার প্রয়োজন হতে পারে, তবে সেটা হতে পারে যদি আমার জন্য রাজনীতি করা খুব বেশি দরকার হয়ে পড়ে। আমি সব সময়ই গতানুগতিক রাজনীতির জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতাম, আর আমি সব সময়ই জানতাম, আমার কথা বা কাজ যাই থাকুক না কেনো আমার নামটার অনেক বেশি ওজন আছে। আমি কখনো লিবারেল পার্টির যুব সংগঠনে ছিলাম না, এবং আমি কখনোই লিবারেল পার্টির কোনো কনভেনশন বা সে ধরনের কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিইনি। আসলে ঐ জগতটা আমাকে কখনোই টানেনি।

আমি আমার শিক্ষকতা পেশায় ফিরে গিয়েছিলাম। এই সময় একটা ভালো কাজে আমার নামটা জনগণের সামনে চলে এসেছিল। আমি মন প্রাণ থেকেই ওই কাজটা করতে শুরু করি। কাজটা ছিল তুষার ঝড় থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরুত্বে সরিয়ে রাখা। তুষার ঝড়ে মিশেলের মৃত্যুর পর যে শুন্যতা কাজ করছিল, তাতে মনে হয়েছিল আর কারো মধ্যে আমার মত যেন শুন্যতার সৃষ্টি না হয়, সেই সাথে আর কেউ যেন আর মিশেলের মত প্রাণ না হারায়, সে জন্যই এমন প্রচারণা আর সচেতনার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলাম, তবে অবশ্যই নিজের নাম জাহির করার জন্য এমন কাজ করিনি।

আমার বাবার পুরনো বন্ধু জ্যাক হেবার্ট যিনি সত্তরের দশকে কানাডার জাতীয় যুব সংগঠন ‘কাতিমাভিক’ এর কাজ শুরু করেন, তিনি হঠাৎ করেই সেই সংগঠনটির বোর্ড অব ডিরেক্টরস এর একজন সদস্য হবার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানান। সত্যি বলছি, তাঁর এত বড় এক প্রস্তাবে আমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। সেই সময় সেই সংগঠনের কার্যক্রম ভালোই চলছিল। আমার মনে পড়ে গেলো, জ্যাক সিনেটর থাকা অবস্থায় যখন মুলরোনী সরকার এই কর্মসূচীর কাজকর্মের প্রতি সরকারী অনুদান বন্ধ করে দিচ্ছিল, তখন জ্যাক অনশন ধর্মঘটের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু আমি সব সময় দেখেছি এবং বরাবরই মনে করেছি, যুব স¤প্রদায়কে বিভিন্ন কর্মসূচীতে যুক্ত করলে সেটা খুবই ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। আমি তখন থেকেই মনে করতাম, যুব স¤প্রদায়কে যদি ভালোভাবে প্রয়োজনীয় সব কাজের মধ্যে আনা যায় যেগুলোতে তারা আনন্দ পায়, তাহলে সেটা তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে খুবই ভালো প্রভাব ফেলে এবং তাদের মধ্যে একটা সুন্দর জীবনবোধ তৈরী করে যা তাদেরকে তাদের আশেপাশের জগতটাকে আরো সুন্দর করার প্রেরণা দেয়।
‘কাতিমাভিক’ এ যুব স্বেচ্ছাসেবীরা অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এবং সব সময় তাদের স্কুলের পাঠ্যসুচীকে অনুসরণ করে তারা তাদের এই স্বেচ্ছাসেবীমূলক কাজে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখে। তাদের এই কাজগুলোতে মূলত দ্বিতীয় ভাষা জানা আর কানাডিয়ান সংস্কৃতি এবং নেতৃত্বের জন্য নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে জোর দেয়া হয়। প্রতি বছর হাজারেরও বেশী নতুন প্রজন্মের কানাডিয়ান সারা কানাডার বিভিন্ন জায়গার ‘কাতিমাভিক’ এর পক্ষ থেকে দেশের পাঁচশ’র বেশী সঙ্গী সংগঠনের সাথে কাজ করে সমাজে অবদান রাখার সাথে সাথে নিজেদেরকে সেই সব কাজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করে। ইতিমধ্যে, পয়ত্রিশ হাজারেরও বেশী নতুন প্রজন্মের কানাডিয়ান দুই হাজারেরও বেশী স¤প্রদায়ে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছে। এই দেশে ওই কর্মসূচীর একটা ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল এবং আমি মনে করি কোনোভাবেই সেটাকে খাটো করে দেখা উচিৎ নয়।

শেষ বয়সে পিয়েরে ট্রুডো

স্বেচ্ছাশ্রমের যে অপার মূল্য এবং যে কোনো জায়গায় মনে প্রাণে কাজ করার জন্য নিজেকে নিযুক্ত করার যে শিক্ষা তারা পেয়ে থাকে তাতে তারা কানাডাকে নতুনভাবে আবিস্কার করতে পারে। তারা বছরের একটা সময়ে কানাডার তিনটি অংশে দেশের অন্যান্য অংশের যুবক যুবতীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার ফলে যে উৎসাহ, জ্ঞান ও আনন্দ পায়, তা তাদেরকে আরো সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। মূলত, ‘কাতিমাভিক’ কানাডার নতুন প্রজন্মকে বহুজাতির কানাডার সব স¤প্রদায়ের মানুষের সাথে মিলে এক হয়ে এক সুন্দর দেশ গড়ার জন্য তৈরী করছিল।

আমার খুব খারাপ লাগে প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানে আমরা যত জন যুবক যুবতীকে অন্তর্ভূক্ত করতাম তার চেয়ে দশ গুণ বেশী এই কর্মসূচীতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য আমাদের আবেদন জানাতো। যেহেতু এখানে আমরা আর্থিক সহায়তা দিতাম, সেজন্য এর এই সংখ্যাটা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পারতাম। হাই স্কুল শেষ করার পর প্রায় দশ হাজার যুবক যুবতী তাদের সব শক্তি আর উদ্দীপনা দিয়ে দেশের কাজে লাগতে চায়, কিন্তু তারা একেবারে নিশ্চিত হতে পারতো না তারা এই সু্যােগ পাবে কি না। কারণ দশ জনের মধ্যে নয় জনকেই আমরা নিতে পারতাম না। ‘কাতিমাভিক’ এ কাজ করেছে এমন কারো কাছে জানতে চাইলেই সে বলবে, তার সেই অভিজ্ঞতা কিভাবে তার জীবনকে ইতিবাচক দিকে চালিত করেছে। আমার মনে হয়, কানাডার মত সফল হওয়া অন্য কোনো দেশ তার নতুন প্রজন্মকে স্থানীয় সংগঠনের সাথে যুক্ত করে নিজেদের এমন উদ্যেগী আর গণবান্ধব নাগরিক হতে এত ব্যাপক ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। আমরা সত্যিই চাইতাম, কানাডার বেড়ে উঠা প্রজন্ম তাদের বেড়ে উঠার সাথে সাথে নিজেদের সমাজ, দেশ ও মানুষকে ভালোভাবে জানুক আর তাদের সর্বোচ্চ সেবা দেবার জন্য ছোট থেকেই নিজেদের প্রস্তত করুক, আমরা এমনটিই চাইতাম এবং এখনও তেমনটাই চাই।

সেই পশ্চিম উপক‚লে আর এক বছর থাকার পর আমি আবার আমার বাড়ী কুইবেক এ ফিরে আসার জন্য তৈরী হই। আমি ভ্যংকুভারের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, সেখানে আমার এক চমৎকার সুন্দর বন্ধুমহল গড়ে উঠেছিল, সেই সাথে সেখানকার পাহাড়, সমুদ্র আর জীবনযাত্রা সবকিছুই আমার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু ত্রিশে এসে আমার মনে হতে শুরু করলো, এবার আমাকে স্থির হতে হবে আর সম্ভব হলে ঘর সংসার পাত’তে হবে। আমি কখনোই ভাবতে পারতাম না যে আমার এই ভাবনাগুলো বাস্তবায়িত করার জন্য মন্ট্রিয়ল ছাড়া আর অন্য কোনো জায়গা আছে।

আমি সব সময় ফরাসী ভাষা ভাষীর মধ্যে থাকাটাতে আনন্দ পাই। আমি ওখানে ফরাসী ভাষা পড়াচ্ছিলাম সত্য, কিন্তু নিজের ভাষার মানুষের সাথে বাস করার সেই আনন্দ তা আমি পেতাম না এবং আমি কখনোই কল্পনা করতে পারতাম না যে আমার বাকী জীবনটায় আমি এমন সংগীর সাথে থাকছি যার সাথে আমি আমার ভাষা আর সংস্কৃতির সৌন্দর্য্য ভাগাভাগি করে নিতে পারছি না। আমি আমার মায়ের অভাব খুব বোধ করতাম এবং আমি প্রায়ই ভাবতাম তাঁকে আমার সহযোগিতা করা প্রয়োজন, কারণ সেই সময় পরিবারে দুই দুটো মৃত্যুর ঘটনার পর মানসিকভাবে নিজেকে সুস্থির রাখা তাঁর জন্য খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাজার হাজার মাইল দূরে ভ্যাংকুভারে বাস করার ফলে, দিন দিন আমি হতাশ হয়ে পড়ছিলাম যে আমার যে মা বেঁচে আছেন তাঁর কোনো প্রয়োজনে আমি তাঁর উপকারে আসতে পারছি না।

কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো’র কফিন বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মেজো ছেলে আলেকজান্ডার ট্রুডো ও বড় ছেলে কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো (সর্ব ডানে)।

আমি যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে মন্ট্রিয়লে শিক্ষকতার চাকুরী পাওয়াটা ছিল আরো বেশী কঠিন। ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় আমার যে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা তা কুইবেকে যাচাই বাছাই করতে একটা প্রক্রিয়া লাগে আর এতে বেশ কিছু সময় লেগে যায়। এই সময় লেগে যাওয়ার ব্যাপার থেকেই সেই সময়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, নতুন এক দিকে আমি আমার শিক্ষা জীবনের মোড় ঘুরাবো। ফলে, ২০০২ এর শরতে বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান নেয়ার জন্য আমি মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোল পলিটেকনিক এ ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশুনা শুরু করলাম। সব সময়ই আমার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টা ভালো লাগতো, বিশেষ করে এখানে অংক ও বিজ্ঞানের যে ব্যবহার আছে তা আমাদের ব্যবহারিক জীবনে খুব কাজে লাগে। খুব ছোট বেলা থেকে যুক্তির ধাঁধাঁ আর অংকের সমস্যার সমাধান করা ছিল আমার অবসর কাটানোর জন্য খুব প্রিয় খেলা। অতএব আমি জ্ঞান জগতের এক নতুন ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়োজিত করার যে সুযোগ পেলাম, তাতে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেললাম। (চলবে)