মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

একচল্লিশ.
দ্বিতীয় দফার ভোটাভোটিতে জেরাডের ভরাডুবি হলো। নতুন ত্রিশটি ভোট বেশি পেলেও তিনি সেই চতুর্থ স্থানেই পড়ে রইলেন। মি. ড্রাইডেন পঞ্চম স্থানে থাকার ফলে তাঁকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল এবং সেই মুহূর্তে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে বব রে’ কে সমর্থন করবেন, তবে তিনি তাঁর সদস্যের জানিয়েছিলেন, তারা তাদের ইচ্ছেমত যে কাউকে ভোট দিতে পারবে। জেরাড নিজে নিজেই নেতৃত্বের এই দৌড় থেকে সরে দাঁড়িয়ে স্টিফেন ডিওন এর প্রতি সমর্থন জানানোর ঘোষণা দিলেন। আমি ইতোমধ্যে ঠিক করে ফেলেছিলাম, জেরাড যদি এই নেতৃত্বের দৌড়ে না থাকেন তাহলে মি. ডিওন’কে জয়ী করানোর জন্য আমি কাজ করবো। ফলে এমন সময়ে আমি তাঁর সাথে দেখা করলাম। মি. ডিওন ছিলেন কুইবেকবাসী এবং অখণ্ড কানাডার পক্ষে তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী কন্ঠস্বর। এ ছাড়াও তিনি সুন্দর পরিবেশ নীতি তৈরীর জন্য রাস্তায় নেমে মানুষকে সচেতন করার কাজ করতেন। আমি যখন তাঁর এই সব কাজ কর্ম সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম, তখন থেকেই তাঁর প্রতি আমার এক ধরনের মুগ্ধতা ছিল। সরাসরি বলতে গেলে বলতে হয়, তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন সুন্দর ও দায়িত্ববান মানুষ। তিনি যে কোন বিষয়ই খুব গুরুত্বের সাথে অনেক ভেবে চিন্তে গ্রহণ করতেন আর যে কোনো জটিল বিষয়কে খুব সহজভাবে সবার কাছে তুলে ধরে তার সমাধানের চেষ্টা করতেন। আমি এখনো স্টিফেন ডিওন এর সেই সুন্দর আর আবেশিত করা ক্ষমতার স্পর্শ পাই।

তৃতীয় ভোটাভোটিতে মি. ডিওন মি. রে আর মি. ইগনাতিয়েফ’কে অনেক পেছনে ফেলে প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়ে এগিয়ে ছিলেন। যখন মি. রে এই নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে যেতে বাধ্য হলেন, তখন তিনি তাঁর প্রতিনিধিদের বলেই ফেললেন তারা তাদের ইচ্ছেমত যে কাউকে ভোট দিতে পারবে। তাঁর এই ঘোষণা এক নাটকীয় দিকে মোড় ঘুরেছিল। মি. রে ও মি. ইগনাতিয়েফ’এর সমর্থকদের একে অপরের প্রতি সমর্থনের ব্যাপারে এত বেশি অনীহা ছিলো যে, রে’র অধিকাংশ প্রতিনিধিই মি. ডিওন এর দিকে ঝুঁকে গেলেন, আর এর ফলাফলস্বরূপ পরের দিনে ভোটে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন মি. ডিওন।

কনভেনশন সমাপ্তির পর দিন আমি স্টেফিন ডিওন’কে ফোন করে তাঁর বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। আমি তাঁকে বলেছিলাম, দলকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য এই দিনগুলোতে প্রায় রাতদিন কাজ করে আমার এখন অনেক বেশি ভালো লাগছে। সেই সাথে আমি আরো বলেছিলাম, আপনার নেতৃত্বে দল নিশ্চয় এবার এক সুন্দর জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে। তাঁর সাথে কথা শেষ করার আগে আমি জানিয়েছিলাম, ‘এখন আমার ফেরার সময় হলো, আমি আবার আমার নিজের জীবনে ফিরে যাচ্ছি।’ আমার এই কথা শুনে টেলিফোনের ওপার থেকে স্টিফেন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিলেন, ‘খুব দূরে কোথাও যেও না যাতে আমি তোমাকে খুঁজে না পাই, হারপার সরকারকে সরানোর জন্য তোমাকে আমার খুব বেশি প্রয়োজন।’

তাঁর কাছে এই উক্তিটি হয়তো নিছক ভদ্রতা ছিল, কিন্তু ফোন রাখার পর আমি কিছুক্ষণ সোফির দিকে তাকিয়ে তারপর ডিওন এর শেষ কথাটা তাঁকে জানালাম। আমরা দুজনেই তখন বুঝে গেলাম, অনেক বড় এক সিদ্ধান্তের দিকে আমরা পা বাড়াতে যাচ্ছি।

কনভেনশনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বেশ কিছু জিনিস শিখেছিলাম। আমার কাছে এই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আমার নামের শেষ অংশের জন্য রাজনৈতিকভাবে আমি সব জায়গায় একটা বিশেষ সুবিধা পাই। আমি অস্বীকার করবো না, এই নামের জন্য আমি অন্যদের চেয়ে এক সুবিধাজনক পর্যায়ে থাকি, কিন্তু আমার নিজের কাছে বারবার মনে হয়েছিল, এই বিশেষ সুবিধাতো আমাকে সত্যিকারভাবে সামনে এগুতে দিবে না আর আমার একেবারে নিজস্বতা না থাকলে সেখানে আমার কৃতিত্বেরও কিছু নেই।

পরের কয়েক সপ্তাহ আমি সোফির সাথে রাজনৈতিক জীবনের ঝুঁকি, ত্যাগ আর সুবিধা অর্থাৎ ভালোমন্দ নিয়ে গভীর আলোচনা চালিয়ে গেলাম। আমি আমার বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও পরামর্শ নিলাম, এবং আমি নিজে নিজেই অনেক ভাবলাম, রাজনীতি আমার ও আমার প্রিয়জনদের জীবনে কি ধরনের প্রভাব ফেলবে। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল, আমার সামনে যে সময়টা এসে দাঁড়িয়েছে এই সময়টাকে এখন সত্যিকারভাবে কাজে লাগিয়েই আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

এনভায়রনমেন্টাল জিওগ্রাফী’তে মাস্টার্স এর পড়াশুনার প্রায় সব কিছুই তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল, শুধু থিসিস লেখাটা বাকী ছিল। আমার মাথায় রাজনীতির এই বাতাসটা এমন হঠাৎ করে না আসলে আমি যেভাবে আমার জীবনটা এগুনোর চিন্তা করেছিলাম, ঠিক সেই পথেই হয়তো সামনে এগুতাম।

পল মার্টিনের সাবেক কুইবেক লেফট্যানেন্ট ও আউটারমন্টের এর পার্লামেন্ট সদস্য জ্য লাপিয়ের কনভেনশনের পর পরই ঘোষণা দিলেন তিনি আর নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। পাহাড়ের উত্তর পূর্বদিকে অবস্থিত এই স্থানটিকে মন্ট্রিয়লের কেন্দ্রবিন্দু বলা যেতে পারে, আর এখানেই রয়েছে ট্রুডো পরিবারের শেকড়। এছাড়া ব্রেবফ এ আমার যে সাত বছর কেটেছে, সেটা এখানেই। সোফি আর আমি দু’জন মিলে যে কন্ডো কিনে তখন বসবাস করতাম সেটাও ছিলো সেই আউটারমন্টেই। আমার অবচেতন মনে আমি কখনও কখনও ভেবেছি, আমি যদি কখনও নির্বাচন করি তবে সেই আসনটিই হবে আমার জন্য সবচেয়ে যথোপযুক্ত।

সেই সাথে আমি এটাও জানতাম, নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য জায়গাটা খুব সহজ নয়, কারণ সব সময় এখানে সব বাঘা বাঘা বাজনীতিবিদরা লড়াই করে। অতএব, আমি ধরেই নিয়েছিলাম, সেখান থেকে নির্বাচন করতে গেলে আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আমার মনে হচ্ছিল, সেখান থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার পর অর্থাৎ নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য কেন্দ্র থেকে সম্মতি পাবার সব ব্যবস্থা করার পর লিবারেল পার্টির কিছু নেতা কর্মী বলে উঠবে, আমিতো পার্টিতে আমার সদস্য ফি’ই ঠিকমত দিই নি, অতএব, কেনো আমাকে এই আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অনুমতি দেয়া হলো। অতএব, এমন সব কিছু মাথায় রেখেই আমি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, সেই সাথে আমি নিজে নিজেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম, যেভাবেই হোক সবাইকে বোঝাতে হবে আমি শুধু আমার নামের শেষ অংশটুকুর জোরে নির্বাচনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা করে নিই নি, বরং নির্বাচনে দাঁড়ানোর মত সব যোগ্যতা আর ক্ষমতা আমার একান্ত নিজেরই আছে।

সেই বড়দিনের কয়েক দিন আগে আমি স্টিফেন ডিওন’কে ফোন করে জানালাম, আমি আউটারমন্ট থেকে নির্বাচনে দাঁড়াতে চাচ্ছি এবং আমি এটাও তাঁকে জানালাম, আউটারমন্ট থেকে নির্বাচনে লড়াই করা আমার পক্ষে বেশ সুবিধাজনক। তিনি আমার এই সিদ্ধান্তে আমাকে সাধুবাদ জানালেন এবং এটাও জানালেন, তিনি আমার সঙ্গে আছেন।

২০০৬ সালের ‘লিডারশীপ কনভেনশন’ এ জাস্টিন ট্রুডো

প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে নতুন বছরের একেবারে শুরুতে জ্য লাপিয়ের ঘোষণা দিলেন তিনি খুব দ্রæতই তাঁর রাজনীতি জীবন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন, ফলে আউটারমন্ট এ উপ নির্বাচন হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়ে গেলো। আমার মনে তখন নির্বাচন করার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আর আমি শুধু ভাবছিলাম, এই নির্বাচনে জিততে হলে আমাকে অনেক বিষয় মাথায় নিয়ে সামনে এগুতে হবে, আর সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দিতে হবে কালের পরিবর্তনে নতুন প্রজন্মের মধ্যে যে পরিবর্তন আসছে সেটাকে ভালোভাবে বুঝে নিয়ে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
আউটারমন্ট থেকে কে নির্বাচন করবে এই বিষয় নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই লিবারেল পার্টির অন্তর্গত দলাদলির বিষয়টি প্রকট হয়ে দাঁড়ালো। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ভালো লাগলো না এবং আমি এটাও বুঝতে পারলাম, আউটারমন্ট আসনের প্রার্থীর মনোনয়নের ব্যাপারে যে কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা সেই আসন থেকে আমার নির্বাচনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে, সেই সাথে কেন্দ্রের নেতার কাছ থেকেও আমি তেমন কোনো ইতিবাচক সাড়া পেলাম না। ফলে আমি আবার সিদ্ধান্ত নিলাম, এই আসন থেকে আমার নির্বাচন করার উচিৎ হবে না।

আমার যতটুকু নিজের ক্ষমতা আছে সেটুকুর প্রতি যথার্থ বিচার করা হয় নি। সত্যি বলতে কি, তারপর আমার ভাইয়ের উপদেশ মত আমি মন্ট্রিয়লের অন্য কোনো জায়গা থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানো যায় কিনা সেটা খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে যে দু’টি আসন থেকে নির্বাচন করা যায় বলে সিদ্ধান্ত নিলাম তার একটা হচ্ছে, আরেকটু উত্তর পূর্বের পাপিনিউ আর দক্ষিণ ডাউনটাউনের জেন-লা বার। দু’টোতেই বহু সংস্কৃতির মানুষের বসবাস আর দু’টোর মানুষেরই অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এছাড়া ঐ দু’টো আসনেই আগের বার বøক কুইবেকোইস জিতেছে। ফলে আমার তখন মনে হয়েছিল, ঐ আসনগুলোই জেতা মানে শুধু সেই সব জায়গাকে লিবারেলদের দখলে আনা নয়, বরং কুইবেক স্বাধীনতাপন্থীদের শক্তিকে খর্ব করে দেয়া। আমার তখন এটাও মনে হয়েছিল, দলে আমার যোগ্যতা ও ক্ষমতা দেখানোর জন্য সেই মূহূর্তে এর চেয়ে ভালো কোনো চ্যালেঞ্জ আর থাকতে পারে না। (চলবে)