ডঃ বাহারুল হক : আমেরিকায় বাংলাদেশীরা বহু ক্ষেত্রেই মেধা ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছে। তবে আমেরিকার অধিবাসী বাংলাদেশী আমেরিকান প্রকৌশলী ডঃ শহীদুল হকের পুত্র সায়েম হক তার মেধা ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখার জন্য যে ক্ষেত্র বেছে নিয়েছে আমার মনে হয় সেটি একেবারেই নতুন একটা ক্ষেত্র। সায়েমের ক্ষেত্র হলো সাহিত্য ও চলচ্চিত্র। সায়েমের শিশুকাল কেটেছে কানাডার রাজধানী শহর অটোয়ায়। তারপর তার মা-বাবা আমেরিকার ডালাস নগরীতে থিতু হলে সেখানেই বড় হয় সায়েম। সায়েম ইরেজি সাহিত্য ও ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ ব্যাচেলর করেছে আরলিংটনের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে। আর মাষ্টার্স করেছে ডালাসের এসএমইউর কক্স বিসনেস ম্যানেজমেন্ট স্কুল থেকে। ২০১৫ সনে হার্ভার্ড ক্যানেডি স্কুল থেকে এক্সিকিউটিভ এডুকেশনের উপর নেওয়া সার্টিফিকেট সায়েমের শিক্ষা বৃত্তিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।সাতাশ বছর বয়সী সায়েম বর্তমানে আমেরিকার ন্যাশনাল প্রতিষ্ঠান প্রজেক্ট ডাউন্টাউন-এ কো-ডাইরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছে এবং কর্মসূত্রে এখন বসবাস করছে লস এঞ্জেলেস নগরীতে যেখানে বিরাজ করছে চলচ্চিত্রের স্বপ্নপুরী হলিউড। ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ দক্ষ সায়েমের চাকুরির বাহিরে সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা শুধু লেখা-লেখি নিয়ে। গল্প লেখক হিসেবে আমেরিকান গল্পকারদের ভুবনে তার প্রথম আত্মপ্রকাশ ২০০৯ সনে। সে বছর তার লেখা গল্প- ‘ব্লাডিন: এজ অব ব্লেড’ দুই শত আঠার পৃষ্ঠার এক বই প্রকাশিত হয়। সায়েম তখন সতের বছরের এক যুবক। পুরস্কার এবং প্রচুর প্রশংসা পাওয়া তার গল্পের বই- ‘ব্লাডিন: এজ অব ব্লেড’-এর প্রকাশনা তাকে লেখক হিসেবে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে; লেখার প্রতি তার অনুরাগ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘ড্রোন্স এমাঙ্গ আস: দা মোরালিটি অব মার্সিনারিস’ নামক তার আরেকটি বইও তাকে খ্যাতি এনে দিয়েছে। ‘দা ট্রায়াল অব ইবনে বতুতা’ নামে তার আরেকটি বই প্রকাশের পথে। গল্প, কবিতার পাশাপাশি ‘হরাইজন’, ‘সিনার্জি’র মত আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনে সায়েম নিয়মিত কলাম লিখে। বিপুল কর্মানুরাগী সায়েম স্কুল জীবন থেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত যার বেশির ভাগই দাতব্য প্রকৃতির। বর্তমানে সে সম্পৃক্ত আছে মিশন আরলিংটন, ডালাস লাইফ হোমলেস শেল্টার, সেভ দার্ফুর-এর মত জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সাথে। সে জন্য তার লেখার উপজীব্য অনেক বিষয় সে সকল প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত।
লিখতে লিখতে সায়েম এক সময় তাগিদ অনুভব করলো কিছু গড়ার। কী গড়বে? গড়বে চলচ্চিত্র। মনে হয় লস এঞ্জেলেস থাকে বলে সায়েম ধীরে ধীরে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে হলিউডের প্রতি। তাছাড়া ২০১৮ সনে ইউসিএলএর বিখ্যাত থিয়েটার ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন প্রোগ্রাম থেকে সার্টিফিকেট নেয়ার পর সে মোহ বাড়িয়ে দিয়েছে চলচ্চিত্রের পথে তার হাঁটার গতি এবং দৃঢ়তা । এ বছর প্রথম তার হাতে নির্মিত হয়েছে শর্ট ফিল্ম ‘থিঙ্গস থ্যাট ফল’ এবং তার আত্ম প্রকাশ ঘটেছে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রের স্বপ্নপুরী হলিউডে। ‘থিঙ্গস থ্যাট ফল’-এর স্ক্রিনপ্লে রাইটারও সায়েম নিজে। ‘থিঙ্গস থ্যাট ফল’, একটা ব্যতিক্রমধর্মী চলচ্চিত্র। সিজোফ্রেনীয়্যা সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে তীব্র শ্রুতি বিভ্রান্তিতে ডুবে থাকা এক ছেলের (আলেক্স) সাথে বধির এক মেয়ের (কার্লি) ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে সায়েমের নিজের লেখা গল্পের অনবদ্য এক চিত্ররুপ ‘থিঙ্গস দ্যাট ফল’। গল্প নিজের লেখা এবং ছবির স্ক্রিনপ্লে রাইটারও সে নিজে বলে ছবিটি বহুমাত্রায় সমৃদ্ধ হয়েছে। ছবিতে আলেক্স আর কার্লির চরিত্রে অভিনয় করেছে যথাক্রমে স্টারলিং বোমন এবং স্টেফ্যানী নগরেস। দুজনই হলিউডের উঠন্ত যোগ্য বা গুণী অভিনেতা অভিনেত্রী। ‘থিঙ্গস দ্যাট ফল’ ছবিতে ফুটে উঠেছে লেখা এবং পরিচালনায় সায়েমের মুন্সীয়ানার পরিপুর্ণ ছাপ। স্বল্প দৈর্ঘের ফিল্মটি হয়েছে দর্শদের অতি দীর্ঘ ভাবনার এক নান্দনিক আধার। সায়েমের স্বভাব হলো যে কোন বিষয়ের গভীরে গিয়ে নিখুঁতভাবে বিষয়টকে আত্মস্থ করে। বিষয়কে সম্পুর্নভাবে আত্মস্থ না করে সায়েম বিষয়টির লিপিরুপ বা চিত্ররুপ দিতে যায় না। এতে তার সময় এবং পরিশ্রম যতই হোক সে পিছ পা হয় না। ‘থিঙ্গস দ্যাট ফল’ নির্মানের আগে সায়েম সিজোফ্র্যানীয়ার উপর লেখা- পড়া করেছে। জেনেছে সিজোফ্র্যানীয়া নানা প্রকারের হয়। যেমন, প্যারানয়েড, ক্যাটাটনিক, আনডিফারেনসিয়েটেড, ইত্যাদি। কোন ধরনের সিজোফ্র্যানীক পার্সনকে তার চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করলে ছবি দর্শক নন্দিত হবে সেটা সে ছবি নির্মানের আগেই ঠিক করেছে এবং সে ভাবেই অভিনেতা অভিনেত্রী নির্বাচন করেছে। ছবি নির্মানের আগে সিজোফ্র্যানীক এবং বধির পার্সনদের ভালোভাবে জানার-বোঝার জন্য সায়েম ন্যাশনাল কোয়ালিশন ফর মেন্টাল হেলথ রিকভারি, জে ই ডি ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল এম্পাওয়ার্মেন্ট সেন্টার, মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট কমিউনিটি, ডিফ কাউন্সেলিং সেন্টার, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছে।
সার্বিক বিচারে এটা স্পস্ট যে সায়েম আটঘাট বেঁধেই ছবি নির্মানে নেমেছে এবং তার মেধা, সাহস, একাগ্রতা, বিচক্ষণতা, নিষ্ঠা, পরম ধৈর্য্যশীলতার স্বাক্ষর সে রেখেছে। সায়েমের লেখা এবং পরিচালনায় নির্মিত ছবি ‘থিঙ্গস দ্যাট ফল’ একটি অসাধারন ছবি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সায়েমের ভাষ্য মতে অন্যের সাথে সফলভাবে কমিউনিকেট করার জন্য দুনিয়ার প্রত্যেকটা মানুষ (হোকনা সে সিজোফ্রেনীক বা বধির) জন্ম নেয় একটা হিডেন বা সুপ্ত শক্তি নিয়ে। পরিবেশ অনুকুল হলে মানুষের সে সুপ্ত শক্তি উন্মোচিত হয়, মানুষ সে শক্তি প্রয়োগ করে এবং সফলকাম হয়। সায়েম তার ছবিতে সে সুপ্ত শক্তি কী এবং তার প্রয়োগ কিভাবে সম্ভব তা বোঝাতে চেস্টা করেছে।
পৃথিবীর নানা দেশের প্রখ্যাত নানা রকম ফিল্ম ফ্যাস্টিবল যেমন, বার্সেলোনা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম, হলিশর্ট ফিল্ম ফ্যাস্টিবল, লস এন্জেলেস ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফ্যাস্টিবল, লিফ্ট-অফ ফিল্ম ফ্যাস্টিবল(জাপান), রেইনড্যান্স ফিল্ম ফ্যাস্টিবল-এর মত ফ্যাস্টিবলে ‘থিঙ্গস দ্যাট ফল’ প্রদর্শিত হয়েছে এবং প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছে। শুধু প্রশংসা নয় ‘থিঙ্গস দ্যাট ফল’ ছবির জন্য সায়েম ডাইরেক্টর এবং স্ক্রীনপ্লে রাইটার হিসেবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন রকম এওয়ার্ড যেমন, এটি এন্ড টি ফিল্ম এওয়ার্ড (২০১৯), লস এঞ্জেলেস ফিল্ম (২০১৯) এওয়ার্ড-এর মত প্রেস্টিজিয়াস এওয়ার্ড পেয়েছে এবং আরো কিছু এওয়ার্ডের জন্য মনোনিত হয়েছে। ।
সব শেষে সব চেয়ে বেশি খুশির খবরটি দিয়ে ‘থিঙ্গস দ্যাট ফল’ এর উপর আজকের প্রতিবেদন শেষ করবো। সিনেম্যাটিক কৃতিত্বের জন্য দুনিয়ার সর্বোচ্চ সন্মান অস্কারের (২০২০ সনের) লক্ষ্যে সায়েমের ‘থিঙ্গস দ্যাট ফল’ফিল্মটি জীবনধর্মী সেরা শর্ট ফিল্ম হিসেবে প্রতিদ্ব›িদ্বতাকারীদের তালিকায় অফিসিয়্যালি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
লেখক-
ডঃ বাহারুল হক : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও কলাম লেখক।