সাজ্জাদ আলী : “মুক্তি” শব্দটি ৭১’এ আমাদের গাঁয়ের লোকদের কাছে ছিলো আবেগে ভেজা আর আশায় রঞ্জিত। “মুক্তি” বলতে তাঁরা মুক্তিবাহিনী’র গেরিলাদেরই বুঝতো। শব্দটি মনে এলেই তাঁদের চোখে ভাসতো সেই তেজস্বী যুবকের ছবি, যে দেশের জন্য তাঁর জীবনকে খরচের খাতায় লিখে ফেলেছে। মুক্তিরা শৃঙ্খলিত বাঙালির শিকল কাটবে। বেয়নেটের মাথায় ওরা স্বাধীন বাংলার বিজয় পতাকা উড়াবে। সাড়ে সাতকোটি পরাধীন মানুষকে এই মুক্তিরাই অনধীন করবে। তো সেই যুদ্ধের বছরে প্রথম যখন আমাদের গাঁয়ে মুক্তিরা এলো, বিজয়ের মাসে সে সব কথাই স্মরণে আনবো। পাঠক বন্ধুদের সাথে থাকার বিনীত অনুরোধ রাখছি।

এক:
শিহাব ভাইরা আমাদের পুরোনো কুটুম্বু। গাঁয়ের ছেলে হলেও আখন, শিহাব, ওরা সব ক’ভাই শহুরে শিক্ষায় শিক্ষিত। ইস্ত্রি না করে কখনও জামা-প্যান্ট গায়ে তোলে না, খালি পায়ে হাঁটে না, ওদের গ্রামের বাড়িতেও ওরা ডাইনিং টেবিলে ভাত খায়। ছাত্র জীবনে শিহাব ভাই ছিলেন তুখোড় মেধাবী। বৃটিশ ধাঁচে অনর্গল ইংরেজি বলতে পারেন। শুধু কি ইংরেজি? বাংলা বলার সময়েও সম্পূর্ণ সাধু ভাষায় কথা তাঁর, একটি চলতি শব্দের মিশ্রণও নেই। আর কি তাঁর আভিজাত্যপূর্ণ চলন! পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে বড়সড় চাকুরে তিনি, করাচীতে পোষ্টিং। শুনেছি ফাইটার জেট বিমান নিয়ে তাঁর কাজকারবার। সদাচারণের জন্য সবার প্রিয়, আমাদের কাছে তো বটেই। ছুটিছাটায় বাড়িতে এলে দাদীর সাথে দেখা করতে আসবেনই। করাচী থেকে আমাদের জন্য চকলেট আনতে ভোলেন না কখনও, আর দাদীর জন্য বার্মীজ চুরুট। শিহাব ভাই’র কথায় ফিরছি খানিক বাদেই, তবে তার আগে আপনাদের সেই সময়ের পটভূমিকাটা সংক্ষেপে একটু বলেনি।

দুই:
৭১’এর ২৬ মার্চ পাকিস্তানী হানাদারেরা “নিধন করে” বাঙালি দমাতে চাইলো। আরে পাকি শয়তানরা, বাঘা বাঙালি কি বন্দুকে ডরায় রে? ক্ষোভে ফুঁসে উঠলো সারা বাংলা। সে ফোসফুসানি কি শুধু শহরে? মোটেই না, প্রত্যন্ত গাঁয়ের কোনাকাঞ্চিতেও আবাল বৃদ্ধ বণিতা সেদিন গর্জে উঠেছিলো। গাঁয়ের লোকেরা আধাপেট খেয়ে নৌকা মার্কাকে ভোটে জেতালো। এখন শেখের ব্যাটা গদিতে বসে তাদের ভরাপেট খাওয়াবে, এতো সোজাসাপ্টা কথা! কিন্তু কথাটি আর সোজা থাকলো কই? চারিদিকে শুধুই গোলাগুলির খবর! ঢাকা, চাটগাঁ, খুলনা, রাজশাহী, ইত্যাদি বড়বড় সব শহরে পাঞ্জাবীরা নাকি পাখির মতো বাঙালিদের মারছে! কি হচ্ছে ঢাকায়? গাঁয়ের মানুষদের এখন কর্তব্য কি? কেউই কোন নির্দেশনা দিতে পারছে না।
আমাদের পুরো এলাকাটি তখন একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ। বাইরের জগতের কোন খবরই আমরা পাই না। আজকে লোকমুখে যে উড়ো খবর শুনি, কাল শুনি ঠিক তার উল্টোটা! বহু বছর থেকেই ডাকযোগে “দৈনিক ইত্তেফাক” আমাদের বাড়িতে আসতো। যদিও ঢাকা থেকে কাগজটি এসে পৌঁছুতে ৪/৫ দিন পার হয়ে যেত, তবুও সব খবরাদি পাওয়া যেত। যুদ্ধের কারণে এখন তা আর আসে না। গাঁয়ের আকাশে বাতাশে গুজব ছাড়া খবর পাওয়া দায়। বাড়ির ৫ ব্যান্ডের রেডিওতে ক’দিন আগে নব ঘুরাতে ঘুরাতে শেখ সাহেবের ৭ই মার্চের ভাষণের খানিকটা শোনা গিয়েছিলো। সেই থেকে অনবরত চেষ্টা চলছে আরো কিছু শোনা যায় কিনা? জোড়ায় জোড়ায় ব্যাটারী পুড়ছে, কিন্তু রেডিওতে ওই স্টেশনটি আর ধরছে না।
ভোর থেকে গভীর রাত অব্দি কাচারী ঘরে, আর বাইরবাড়ির উঠোনে লোক গিজগিজ করে। “কিছু একটা করতে” সবাই প্রস্তুত, কিন্তু কেউই কর্তব্য জানে না। এমনই উৎকন্ঠা আর সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে কেটে গেল ৭১’এর এপ্রিল মাসটিও। আমাদের ইদ্রিস কাকা ২৬ মার্চ রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ব্যারাকে ছিলেন। হানাদারদের অতর্কিত আক্রমণ থেকে কোনমতে বেঁচে জীবন নিয়ে তিনি বাড়ি পৌঁছুতে পেরেছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে বাড়ির সামনের মাঠে প্রতিদিন আশপাশের গাঁয়ের যুবকদের যুদ্ধের ট্রেনিং চলে। অস্ত্রপাতি বলতে বাঁশের লাঠি, ঢাল, শড়কি, রামদা আর আমাদের দোনলা বন্দুকটি। গুড়ের চা, বিস্কুট, খিচুড়ি, পুকুরের মাছ, পালানের সব্জি, আর আমন ধানের চালের ভাত; বড় বড় পিতলের ড্যাগে দিনভর রান্না চলছে। কলার পাতার থালায় যার যখন খুশি, নিজের হাতে বেড়েকুড়ে খাচ্ছে। দেশমুক্তির এই কাজে আমার দাদীর গোলা সদাই খোলা।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের এমএলএ সাহেব কলকাতা থেকে লোক মারফত আব্বাকে কিছু নির্দেশনা পাঠালেন। ২৬ মার্চের পরে এই প্রথম ভারত প্রবাসী নেতৃত্বের সাথে আমাদের অজ পাড়াগাঁয়ের যোগাযোগ হলো। নেতা লিখেছেন, অবিলম্বে যেন এলাকার বাছাই করা পরীক্ষিত দলীয় কর্মীদের মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিতে ভারতে পাঠানো হয়। আদাজল খেয়ে আব্বা কাজে লেগে পড়লেন। জিকাবাড়ির বিশিশ্বর বাবু ও সজনী ডাক্তার, মামুদপুরের কুলেস্বর বাবু, ডোমরাকান্দির লালমিয়া ও সামাদ মোল্যা, ওড়াকান্দির মিহির ঠাকুর, আড়কান্দির সালাম সরদার, পারুলিয়ার সাবান মিয়া, প্রমুখ সমাজপতিদের নিয়ে জয়বাংলা স্টিয়ারিং কমিটির সভা বসলো আমাদের কাচারীতে। সে সভায় যাচাই বাছাই করে “দেশের জন্য প্রাণ কাঁদে” এমন যুবকদের বিশাল এক তালিকা প্রণীত হলো।

একেক রাতে ১০/১৫ জনের একেকটি দলকে বেনাপোল বর্ডার অভিমুখে পাঠানো হয়। ট্রেনিং ক্যাম্পের ঠিকানা লিখিত চিরকুট আর সামান্য কিছু পাথেয় যুবকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো। দলগুলো রওনা হবার পূর্বে শেখ সাহেবের নামে বিশেষভাবে রচিত শপথবাক্য পাঠ করায়ে আব্বা ওদের মনোবল চাঙ্গা করতেন। এই যে দলে দলে যুবকেরা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে যাচ্ছে; ওখানটায় গিয়ে ওরা কি করছে, কোথায় ট্রেনিং নিচ্ছে, কবে ফিরবে, -এর কোন কিছু সম্পর্কে গাঁয়ের কারোরই কোন ধারণা নেই। শুধু একবুক আশা, ওরা একদিন অস্ত্র হাতে দ্যাশে ফিরা পাকিস্তানীগো লাশ ফালাইবো, আর দ্যাশটা স্বাধীন হইয়া যাইবো!

গাঁয়ের প্রত্যেক বাড়ি থেকেই ২/৪ জন বর্ডার পার হয়ে মুক্তি’তে নাম লিখিয়েছে। ওরা যাঁরা যুদ্ধে গেছে, আমাদের কাছে তাঁদের সম্মান সহ¯্রগুণ বেড়েছে। এমনকি আমরা তাঁদের নামটিও সম্ভ্রমের সাথে উচ্চারণ করি। এই যেমন, মুক্তি মোস্তফা, মুক্তি শাহীদ, মুক্তি আকু, ইত্যাদি। সে সময়ে এই “মুক্তি” নামটির মধ্যে আমরা দ্রোহ, ত্যাগ, নৈতিকতা আর বীরত্বের সুগন্ধ পেতাম। সেই জুন মাসের শুরু থেকে এলাকার এই মুক্তিদের আমরা শুধু ভারতে যেতেই দেখছি। ওদের কেউই তখন পর্যন্ত যুদ্ধ শিখে গাঁয়ে ফিরে আসনি। আমাদের কল্পনার জগৎ নানা কথা ভাবে? কখনও বা মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। অস্ত্র হাতে নিয়ে ওই দামালেরা ফিরতে পারবে তো? ওরা দেশটা স্বাধীন করবে তো? উৎকন্ঠার সেই দিনগুলোতে অনাগত ওই মুক্তিদের নিয়ে আমাদের বুড়াগুড়াদের সে কি অসামান্য কৌতুহল ছিলো?

তিনঃ
২৬ মার্চের পর থেকে আমাদের শিহাব ভাইয়ের আর কোন খবর পাওয়া যায় নাই। তিনি করাচীতে আটকা পড়েছেন। উড়ো উড়ো শোনা গেছে যে, করাচী ক্যান্টনমেন্টে সব বাঙ্গালী অফিসারদের লাইন দিয়ে দাঁড় করায়ে ব্রাশ ফায়ারে মেরেছে। তাঁদের সবার লাশ নাকি গর্ত খুড়ে জানাজাবিহীন পুঁতেছে। বাড়ির রেডিওতে এখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান পরিস্কার শুনতে পাই। প্রতি সন্ধ্যায় এম. আর. আকতার মুকুল রচিত “চরমপত্র”, দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় পঠিত “সংবাদ পর্যালোচনা”, আর জাগরণের গানগুলো শোনার জন্য কাচারী ঘরে শত লোক উপস্থিত হয়। রেডিও নিত্য খবর দিচ্ছে যে, ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিরা পাঞ্জাবীদের কোনঠাসা করে ফেলেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাঙ্গালী সৈনিকরা পালিয়ে ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার খবরও প্রায়ই রেডিওতে শুনতে পাচ্ছি।

বিলাঞ্চলে বাড়ি আমাদের। ভাদ্রমাসে অথৈই জলে গাঁয়ের সব বাড়িঘর ডুবুডুবু। প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি দ্বীপ-বাড়ি। এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌকা বা কলাগাছের ভেলা। সন্ধ্যা নামলেই ২ জন পাহারাদার ৫ ব্যাটারী টর্চ লাইট আর বন্দুক হাতে নিয়ে আমাদের বাড়িটি পাহারা দেয়। প্রায়ই উড়ো খবর আসে যে, অমুক দিন বা তমুক রাতে মিলিটারিরা আব্বাকে ধরতে আসবে। সন্ধ্যা নামতেই পাহারাদারেরা হাঁক ছেড়ে আগত যে কোন নৌযানের পরিচয় জিজ্ঞাসা করে। জবাবে সন্তুষ্ট না হলে বা সন্দেহজনক গতিবিধিতে নৌকা তাক করে বুলেট ছোড়ার অনুমতি আছে ওদের।

আমাদের বাড়ি আর মাছকান্দি গাঁয়ের মাঝে মাইল খানিক বিস্তৃত ধানি জমি। সেদিন বেলা ডুবুডুবু তবে তখনও আঁধার ততটা ঘনায়নি, দুরেও আবছা দেখা যায়। সেই ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ৩ খানা ছই দেওয়া নৌকা আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। বিপদ সীমানার মধ্যে পৌঁছুতেই পাহারাদারেরা হাঁক ছাড়লো। নায়ে কারা? কুথার থেইকা আসতাছো? যাবা কুথায়? কোন জবাব নাই, নৌকা ৩ খানা বাড়ির দিকে নির্বিকার এগুচ্ছে! মারাত্মক সন্দেহজনক পরিস্থিতি! এবারে পাহারাদারেরা হুঙ্কার ছাড়লো! নাও থামাও, এক কদম আগাইছো তো গুলি মারবো! তথাপিও নৌকাগুল আগাচ্ছে?

কাচারী ঘরে তখন প্রায় শতজন স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান হা করে গিলছে। কেউ একজন ছুটে এসে আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বললো, বড় ভাইজান বাড়িত মেলেটারি আইত্যাছে, শিগগির পানিত ঝাপ দেন। মুহুর্তে কাচারী ঘর ফাঁকা, আব্বা ব্যপারটা বুঝতে দ্রæত বাড়ির দক্ষিণ ঘাটে গেলেন। পাহারাদারেরা দুনলা বন্দুকে দুটো বুলেট পুরে গুলি করতে প্রস্তুত। নৌকা তিনখানা ততক্ষণে আধা কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়েছে। হাত উঁচিয়ে ওদের গুলি ছুড়তে বারণ করলেন আব্বা। নিজেই ডাক ছাড়লেন; ওই কারা তোমরা, আর আগাইয়ো না কইত্যাছি? আবছা অন্ধকারে দেখা গেল প্রথম নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে কেউ একজন বেরিয়ে এসে উচ্চস্বরে বললো, মামা আমি নিজড়ার শিহাব। শিহাব ভাই’র গলা শুনে আনন্দে আত্মহারা আব্বাও চেঁচিয়ে বললেন, তুই কোহানতে আইলি বাজান? আয় আয় শিগগির আয়।

আমাদের দক্ষিণমুড়ার ঘাটে শতবর্ষি রেন্ট্রি গাছের তলায় যখন নৌকা ৩ খানা এসে ভিড়লো তখন ঘোর অন্ধকার। তবে নোয়াকাকা হ্যাচাক লাইটটা ঘাটে আনতেই সব দিনের আলোর মতো ফকফকা। নৌকাগুলা থেকে একে একে লোকেরা নামছে। কারো গায়ে গেঞ্জি, কারো শার্ট, পরণে লুঙ্গি, কেউবা লুঙ্গিতে কাছা দেওয়া। সবার হাতেই একেকটা অস্ত্র। কিন্তু রাইফেলগুলা ছাড়া আর কোন অস্ত্রই আমরা চিনি না। বাড়ির ঘাটে দাঁড়ানো শতজনের সবাই কিংকর্তব্যবিমুড়। এতসব মারণাস্ত্র জীবনে দেখেনি ওরা। কারা এরা, কোথা থেকে এলো? এতসব অস্ত্রপাতিই বা ওরা পেল কোথায়?

একটা পিস্তল হাতে নৌকা থেকে হাসতে হাসতে নেমে শিহাব ভাই বললেন, মামা করাচী থেকে পালিয়ে ভারত হয়ে দলবল নিয়ে সোজা আপনার কাছে চলে এলাম। আব্বা তাঁকে বুকে জড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, দ্যাশে “মুক্তি” আইসা পড়ছে রে আর ভয় নাই! সাথে সাথেই উপস্থিত শতকন্ঠে ধ্বনিত হলো, জয় মুক্তি, জয় শ্যাখের ব্যাটা, জয় বাংলা! সেই রাতে গাঁয়ের আকাশ বাতাশ শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত ছিলো!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)