ডঃ বাহারুল হক : ফেসবুক। ভারি মজার এক বুক। দুনিয়াতে প্রথম ফেসবুক চালু হয় ২০০৪ সনে। এটা একটা সাইট এবং এ সাইটের প্রকৃত টাইপ বললে বলতে হয় এটা একটা সোসাল নেট ওয়ার্কিং সার্ভিস পাবলিশার। এর প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ যার নাম এখন দুনিয়ার সবার মুখে মুখে। প্রতিষ্ঠার পরই ফেসবুক বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্তমানে ফেসবুকের সাথে সংযুক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ২.৫ বিলিয়ন। এখন আমি ট্রেনে। দেখছি সবার হাতে হাতে এখন ফেসবুক। দৃষ্টি সবার ফেসবুকের উপর নিবদ্ব। শুধু আমি একজনা ফেসবুক ছাড়া। আমার হাত খালি। কিন্তু চোখ কর্মব্যস্ত। দেখে যাচ্ছি সবাইকে। দেখছি কেউ হাসছে। কেউ কীবোর্ডে বাটন টিপে যাচ্ছে। কেউ বিড় বিড় করে কিছু বলছে। কেউ কেউ তার নিজের ফেসবুকটা পাশে বসা বন্ধুর মুখের উপর মেলে ধরছে। তারপর দুজনে মিলে সে কী হাসি! কোন কোন সময় দেখি এক ফেসবুকওয়ালা হাসতে হাসতে নেতিয়ে পড়ে তার পাশে বসা বন্ধুর গায়ে। এটা হাসতে হাসতে নেতিয়ে পড়া নাকি নেতিয়ে পড়ার জন্য হাসা তা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়। ভাবি, থাক, যে কারণে পড়বে পড়ুক আমার কী! মাঝে মাঝে আমার খুব ইচ্ছা হয় গলাটা বাড়িয়ে দেখতে, কী দেখে তাদের এমন হাসি। কিন্তু সঙ্গত কারণেই তা হয়ে উঠে না। আমি সোজা হয়ে আমার সিটে বসে থাকি সামনের দিকে মুখ করে। তারপরও কোন কোন সময় ফেসবুকে চোখ পড়ে যায় যদি ফেসবুকওয়ালা হয় একেবারে আমার গা ঘেসে বসা কোন প্যাসেঞ্জার। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় না। ফেসবুক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হই। কারণ ফেসবুকের ভাষা আমার অজানা। স্ক্রিপ্ট দেখে বুঝি চীনা, আরবী, তামিল, এরকম সব ভাষা যেসব ভাষা আমার কাছে বরাবরই গ্রীক – ল্যাটিন। ফেসবুক ওয়ালাদের হাসাহাসি, চোখমুখ, মাথা, কাঁধ, হাতের নড়াচড়া দেখলে আমার মনে হয় কম্পার্টমেন্টের অন্দরমহলটা আচমকা চনমনে হয়ে উঠেছে। তবে ফেসবুক পড়ে আজ পর্যন্ত কাউকে কাঁদতে দেখিনি। তবে দু’একবার দেখেছি ফেসবুক পড়ে দু’একজনকে বড় কঠিন মূর্তি ধারন করতে। এরকম কঠিন মূর্তি দেখলে আমিও ভয় পেয়ে যাই। আমার ভিতরটা নিড় পিড় করে উঠে। ভাবতে থাকি, আহা, কী হয়ে গেল! কেমন করে হয়ে গেল। একবার বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম। আমি আগেই বলেছি আমার হাতে কিছুই নাই; আইফোন, সেলফোন, গ্যালাক্সি, পিক্সেল কোন কিছুই না। তাই বাসে ট্রেনে আমাকে দেখা যাবে ব্যাস্ত চোখ আর খালি হাতে একজন মানুষ হিসেবে। সুন্দর স্বাস্থবান সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ এক ছেলে আমার পাশে বসা। আইফোনটা হাতে ধরে নিবিষ্ট মনে গান শুনে যাচ্ছে সে। আমি শুনতে পাচ্ছি না । কারণ সে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতেছিল। কিন্তু আইফোনে দেখতে পাচ্ছিলাম গায়ককে। গায়ক জেসন ডিরুলু। আমেরিকান সঙ্গীত জগতের এক উজ্জল তারকা। জেসন ডিরুলু আমারও প্রিয় শিল্পী। ওর আইফোনের পর্দায় আমার দৃষ্টি বাধা পড়ে আছে দেখে সে আমাকে বললো- “তুমি কী ওর গান পছন্দ কর”? ছেলেটার মুখ দেখেই বুঝলাম ছেলেটা ভারি মিশুক এবং উচ্ছল। বেশ সপ্রভিত হয়ে বললাম- “জেসন ডিরুলু আমার খুব প্রিয় একজন গায়ক। তাকে আমার খুব ভালো লাগে”। ছেলেটা বললো- “তুমি শুনতে চাও”? আমি বললাম- “হাঁ, শুনতে পারলে খুশি হতাম”। ঝটপট ব্যবস্থা করে ফেললো ছেলেটি। আমি যেটা ভাবিনি সে তাই করলো। আমি ভেবেছিলাম সে গ্যালাক্সি থেকে ইয়ারফোন সরাবে। সে তা না করে তার কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নিল এবং ১টা উইং লম্বা করে আমার কানে পরিয়ে দিল। এদেশে এমন আপ্যায়ন আমি আর কোনদিন পাইনি। তারপর দুজনে শুনলাম একের পর এক তিনটি গান; প্রথমে ‘ব্রিদীং’ ( আই অনলি মিস ইউ ইন ব্রিদীং), তারপর ‘ইন মাই হেড’ (ইন মাই হেড, আই সি ইউ অল ওভার মি), এবং সব শেষে ‘গুডবাই’ ( ইটস টাইম টু সে গুডবাই)।

জেসন ডিরুলুর ‘গুড বাই’ শেষ হলো সেই সাথে শেষ হলো ছেলেটার ট্রেন জার্নি। ফর্সা রঙের ছেলেটার মাথায় কোঁকড়া লম্বা চুলের পাহাড়। দেখলেই চুলগুলো ছুঁতে ইচ্ছা করে। ছেলেটা কোন দেশের কে জানে! তবে কথা বলে বুঝলাম ইংলিশ তার ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজ। ছেলেটাকে দেখে আমার আরও ধারনা হলো ছেলেটার শরীরে মিশে আছে রক্তের দু’ধারা- একটা কালো আরেকটা সাদা। গায়ের রঙ, গাল, থুতনি, চোখের ভুরু আর নাকের জ্যামিতি বলে দিচ্ছে সেসব সাদার ফসল অপরদিকে মাথার কালো ফাঁপা কোঁকড়া চুল, ঠোঁটের গড়ন, আই ল্যাশ, দু’চোখের আইরিশের কালো রঙ বলে দেয় এসব এসেছে কালো থেকে। কালো ধলো মিলে এক সুদর্শন ছেলে সে। শুনেছি এ ধরনের বাচ্চারা নাকি মিশুক, উদার, সাহসী আর আমুদে প্রকৃতির হয়।

জেসন ডিরুলুর গায়কি ঢং ভারি আকর্ষণীয়। তার ‘ব্রিদীং’ (আই অনলি মিস ইউ ইন ব্রিদীং) আমি বিরামহীনভাবে পরপর দশবারও শুনেছি তবু আমার মন ভরেনি। এখনও সুযোগ পেলেই আমি জেসন ডিরুলুর ‘ব্রিদীং’-এ কান ছেড়ে দেই। কী প্রচন্ড রকম মন জুড়ানো এক গান! সবার হাতে সেল ফোন। ফলে সবাই ডুবে থাকে ফেসবুকে। আমিও ফেসবুকে ঢুকি। তবে আমার জায়গা হলো বাসায় থাকা আমার ল্যাপটপ। ল্যাপটপ আমি বহন করি না । ফলে বাহিরে আমি ফেসবুক জগতহারা। আমি খুব সাধারন একজন ফেসবুক ওয়ালা। ফেসবুকের অনেক কিছু আমি জানি না, বুঝি না। ফলে আমার একাউন্টটা বলতে গেলে খোলা। খোলা মানে অরক্ষিত। আমি নিরিহ একজন মানুষ। সকলের সাধুতায় আমার অগাধ বিশ্বাস। লগ আউট করি না। পাস ওয়ার্ড ভুলে গেছি। মানুষের কাছে শুনি প্রযুক্তি বিজ্ঞানে অসম্ভব পোক্ত কেউ কেউ নাকি কায়দা করে অন্যের ফেসবুক একাউন্টে ঢুকে পড়ে। এদেরকে হ্যাকার বলে। এসব হ্যাকার ঢুকে কী করে? এরা নাকি একাউন্টের ভুগোল ইতিহাস বদলে দিয়ে এক মহা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার সৃষ্টি করে। হ্যাকার-টেকার নিয়ে আমি কোনদিন ভাবিনি। আমি নিরিহ একজন মানুষ। নিজে দু’চার লাইন লিখি, অন্যের লেখা পড়ে কমেন্ট পাস করি। এসব নিয়েই আমার ফেসবুক। যতটা লিখি তারচেয়ে অনেক বেশি পড়ি। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডের সংখ্যাও কম নয়। তাদের পোস্ট দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। দেখি আর ভাবি । দেখলাম মানুষের একটা কমন প্রবৃত্তি হলো নিজের সৌন্দর্য্যকে মেলে ধরা। পায়ে পায়ে লয়ে লয়ে থরে থরে নিজেকে তুলে ধরা। আচ্ছা, মানুষের কী হ্রদয় জগতের অসমান বা অসুন্দর কোন চিত্র নাই? আছে। না থেকে পারে না। কিন্তু কেউ সেটা প্রকাশ করে না। তবে পর্যবেক্ষণের প্রগাঢ় ক্ষমতা থাকলে কোন কোন সময় কারো কারো মনের অন্ধকার রুপটি ধরা যায়। আচ্ছা থাক সেটা। আমরা হাসি, আনন্দ, উচ্ছাস, আবেগ, স্পন্দন নিয়াই থাকি। সুন্দরকে, সৌন্দর্য্যকে প্রশ্রয় দেই। এতে মানুষের সুন্দর থাকার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে; মানুষ সুন্দর থেকে সুন্দরতর এবং তা পেরিয়ে মানুষ সুন্দরতম অবস্থানে পৌঁছে যাবে। আলো ঝল মল এই পৃথিবীতে হরর-টেরর সৃষ্টি করে লাভ কী? সবাই সুন্দর থাকুক, খুশিতে থাকুক। যাক বলছিলাম কথা হ্যাকার নিয়ে। আমি একজন নিরিহ মানুষ। হ্যাকার আমার মত একজন মানুষের একাউন্টে ছোবল মারবে তা আমি কোনদিন ভাবিনি। কিন্ত সে রকম এক অপ্রত্যাশিত ঘটনাই ঘটে গেল গত এপ্রিল মাসে। সকাল বেলা আমার ফেসবুক ওপেন করলাম। ওপেন করেই আমি ফিট; আমি আর নাই। আমার প্রোফাইল পিকচারের জায়গায় আমার ছবি নাই। সেখানে অন্য এক ছবি, যে ছবির দিকে তাকাতেই পারছি না। কী জঘন্য এক ছবি! আমি যে হ্যাকারের হাতে ধরা খেয়েছি তা আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডরা বুঝে ফেলেছে এবং তা তারা আমাকে জানাচ্ছে। কী করি ভাবছি। আমার একাউন্টতো এখন আর আমার হাতে নাই, সম্পুর্ণভাবে হ্যাকার-এর নিয়ন্ত্রনে। হঠাৎ মনে হলো হ্যাকারতো উল্টা পাল্টা কিছু লিখে পোষ্ট করে দিতে পারে এবং তাতে আমাকে অনাকাঙ্খিত কোন কঠিন ঝামেলায়ও প্ড়তে হতে পারে। চট করে সিদ্ধান্ত নিলাম নিকটস্থ কোন পুলিশ স্টেশনে যাই এবং একটা জেনারেল ডায়েরি (জিডি) করি। গেলাম ক্র্যানফিল্ড রোডে অবস্থিত ৫৪ ডিভিশনের একটা স্টেশনে। জিডি করলাম। সেখানকার কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার সমস্যার সমাধান পাওয়ার লক্ষে ডাউনটাউনে অবস্থিত ফেসবুক অফিসে সরাসরি যাওয়ার জন্য আমাকে উপদেশ দিলেন।

ডাউনটাউনে গিয়ে ফেসবুক অফিস খুঁজে বের করলাম। ফেসবুক অফিসের রিসেপশনে গিয়ে আমার আগমনের কারণ বললাম। রিসেপশন থেকে মেসেজ পাওয়ার পর একটা ছেলে আসলো। সে আমাকে নিয়ে বসলো একটা কক্ষে। তাকে আমি আবার সব বললাম। মনে হলো সে ডাক্তার আমি রোগী। সে তার ল্যাপটপ খুললো। কীবোর্ডে আঙুল চালিয়ে কিছুক্ষণ খট খট করলো। তারপর আমার দিকে মুখ তুলে প্রশ্ন করা শুরু করলো। আমার উত্তর শুনে সে হতাশ। আমি কিছুই তাকে বলতে পারছি না। ফেসবুক খোলার সময় দেয়া ইমেইলের পাস ওয়ার্ড জানি না; টেলিফোন নাম্বার জানি না। ফেসবুক খোলার সময় যে কজন বিশেষ ফ্রেন্ডের নাম দিয়েছি সে তাদের নাম চায়। আমি বললাম- আমি কারো নাম দেই নি। ডাক্তার কী করবে? ডায়াগনোসিস সঠিক ভাবে হচ্ছে না। তারপরও সে আমাকে আশা দিল। হতাশ না হয়ে সে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে বললো। কোন অগ্রগতি হলে সে আমাকে ইমেইলে জানাবে বলে আমাকে বিদায় দিল।

দিনের পর দিন যাচ্ছে কোন খবর নাই। টেনশনে আমার ঘুম নাই। হ্যাকার কিছু লেখে না , তবে যে প্রোফাইল পিকচার দিয়ে রেখেছে সেটি সরায় না। আমি সব ফেসবুক ফ্রেন্ডদের বললাম ফেসবুককে লিখতে আমার হয়ে। সাত দিন পর আবার গেলাম ফেসবুক অফিসে। ছেলেটার সাথে কথা হলো। সে তার ল্যাপটপে টিপাটিপি করে কী কী যেন দেখলো। তারপর আমাকে বললো- তুমি ওয়েট কর তোমাকে জানাবো মেইলে। মেইলে এইটা সেটা জিজ্ঞাসা করে। উত্তর দেই। কিন্তু কোন ফল পাচ্ছি না। এবার আমি একটা নতুন একাউন্ট খুললাম। পরদিন দেখি আমার নতুন একাউন্টটা নাই। আবার গেলাম ফেসবুক অফিসে। জানতে চাইলাম আমার নতুন একাউন্ট ফেসবুক এক্সেপ্ট করছে না কেন? সে বললো- আগেরটার বিহিত না হওয়া পর্যন্ত নতুন একাউন্ট পাবে না। কী আর করা অপেক্ষা করছি। ইতোমধ্যে চব্বিশ দিন গত হয়েছে। শেষের দিকে আমার দুজন ছোটভাই এবং এক বন্ধু (তারা সবাই আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড) আমার একাউন্ট হ্যাক হওয়া বিষয়ে বড় বড় চিঠি ছাড়লো ফেসবুকের উদ্দেশ্যে। ওসব চিঠি ছাড়ার দুইদিন পর দেখি আমার হ্যাক হওয়া ফেসবুক একাউন্টটি আর নাই। নাই দেখে আমার মনে হলো অজানা অচেনা কক্ষপথে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুর্ণায়মান এই আমি চাঁদে অবতরন করলাম। অবতরন করেই খুলে ফেললাম নতুন এক ফেসবুক একাউন্ট। এ একাউন্ট সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত। এর পাস ওয়ার্ড খুবই স্ট্রং এবং আমি নিয়মিত পাস ওয়ার্ড চেঞ্জ করি। তারপর ও হ্যাকার সাহেবরা দুর্বল এরকম ভাবার কোন কারণ নাই।