ফারহানা আজিম শিউলী: কানাডার টরন্টোয় শিল্প-সাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার ১৬তম আসর হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী লোকগায়ক পিট সিগারকে নিয়ে। গণমানুষের নায়ক ও বিপ্লবী চিন্তার দ্রষ্টা পিট সিগারের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এবারের আসরে আলোচনা হয় পিট সিগারের ওপর অ্যালান এম উইঙ্কলারের লেখা ‘টু এভরিথিং দেয়ার ইজ আ সিজন: পিট সিগার অ্যান্ড দ্য পাওয়ার অব সং’ বইটি নিয়ে।
গত ২১ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, এগলিন্টন স্কয়ারের টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে আয়োজিত এবারের আসরে আলোচনা করেন লেখক-অনুবাদক মুস্তাফা মাহমুদ ও সূত্রধরের দায়িত্ব পালন করেন ফারহানা আজিম শিউলী।
আসরে জানানো হয়, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামসহ বিশ শতকের ন্যায়সংগত প্রতিটি প্রতিবাদ-আন্দোলনের সাঙ্গীতিক ভাষ্যকার-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত গণ-প্রতিবাদী-লোকসঙ্গীতশিল্পী, সঙ্গীততবিশারদ, গানের সংগ্রাহক ও রচনাকারী, গণমানুষের নায়ক ও বিপ্লবী চিন্তার দ্রষ্টা ছিলেন পিট সিগার।
২০০৯ সালের ৩ মে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৫ হাজারের বেশি ভক্ত সমবেত হয়েছিলেন। সবাই এসেছিলেন খুব দীর্ঘদেহী, খুব হালকা-পাতলা, খুব সাধারণ পোশাক পরা একজন মিউজিশিয়ানকে শ্রদ্ধা জানাতে। সেদিন ছিল তাঁর ৯০তম জন্মদিন। কে ছিলেন এই শিল্পী? যদিও তাঁর লেখা ও গাওয়া গান আমেরিকা জুড়ে পরিচিত, কিন্তু আমাদের অনেকেই হয়তো তাঁর সম্পর্কে ততোটা জানেন না। অবশ্য এর একটা বড় কারণ, তিনি রেডিও-টিভিতে নিষিদ্ধ ছিলেন। সেই রাতে সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন তাঁর গানের জন্য এবং নিজস্ব বিশ্বাসে অটল থাকার জন্য। তাঁর বিশ্বাসটা কী ছিল? তাঁর বিশ্বাস ছিল — সব মানুষ সমান, গায়ের রং যা-ই হোক না কেন; পরিবেশ-প্রকৃতিকে বাঁচাতেই হবে এবং পৃথিবীতে শান্তি সম্ভব।

ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সে অনুষ্ঠানে সেই শিল্পীর সম্মানে গেয়েছিলেন সংগীত লিজেন্ডরা- ব্রæস স্প্রিংস্টিন, ডেইভ ম্যাথিউস, জোয়ান বায়েজ প্রমুখ। একদম শেষে সব লিজেন্ডসহ পুরো অডিয়েন্স একসঙ্গে গেয়েছিল ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি। গত শতকের ষাটের দশকে সমধিকারের জন্য যখন আফ্রিকান-আমেরিকানরা প্রাণপণ লড়াই করছিল, তখন সেই শিল্পী এই গানকে শ্লোগানে পরিণত করেছিলেন। আর তাঁর দীর্ঘ জীবনে একটাই গল্প, মুক্তির জন্য গান গাওয়া।
আলোচক মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, বিত্তবান ও হার্ভার্ড পড়ুয়া, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-পিয়ানিস্ট চার্লস সিগার ও নামকরা ভায়োলিনিস্ট কন্ট্যান্সের সন্তান পিট সিগার সেই শিল্পী। পিট নিজেও পড়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েক প্রজন্মের শিক্ষা-পারিবারিক আভিজাত্য পায়ে মাড়িয়ে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন পাঁচ তারের ব্যাঞ্জো আর কণ্ঠে গণমানুষের গান। শিশুদের জন্যও গেয়েছেন অসংখ্য গান। আর তাঁর ৯৫ বছরের দীর্ঘ অভিযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন লিড বেলি, পল রবসন, উডি গাথরি, বব ডিলানের মতো পৃথিবীখ্যাত আইকনিক শিল্পীরা, সঙ্গে জোয়ান বায়েজ-আর্লো গাথরি প্রজন্মও।

মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, অ্যালান এম উইঙ্কলার তাঁর ‘টু এভরিথিং দেয়ার ইজ আ সিজন: পিট সিগার অ্যান্ড দ্য পাওয়ার অব সং’ বইতে দেখিয়েছেন সারা পৃথিবীর সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে, সিভিল রাইটস মুভমেন্টে, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে, শান্তি রক্ষার আন্দোলনে, বর্ণবৈষম্যবিরোধী মুভমেন্টে কীভাবে পিট সিগার তাঁর সাংগীতিক প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন।
মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, এই বইয়ে পিটের দীর্ঘ জীবন এবং দারুণ সব গানের আলোচনার মধ্য দিয়ে ২০ শতকের বিভিন্ন প্রটেস্ট মুভমেন্টে লোকগানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। ত্রিশের দশকের ইউনিয়ন মুভমেন্টের অন্যতম সমর্থক পিট কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে শ্রমিকদের ঐক্য জাগাতে ব্যাঞ্জো ও গিটার হাতে গান করেন। পঞ্চাশের দশকে লালভীতির সময় তাঁর এই বিপ্লবী অতীতের জন্য তিনি তীব্র রোষের শিকার হন। ষাটের দশকের সিভিল রাইটস মুভমেন্টের তিনি হয়ে ওঠেন মুখপাত্র। শাসকের বর্ণবাদী বৈষম্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন এবং প্রতিবাদীদের সাহস জোগান গান গেয়ে। ২০ শতকের শেষভাগে এসে তাঁর গান সহায় হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী মুভমেন্টে। আবারও রোষানলের শিকার হন তিনি। আর সত্তরের দশকে হাডসন নদী সংস্কারের মধ্য দিয়ে পরিবেশবাদী অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে কণ্ঠে তুলে নেন গান।

পিটার সিগারের জন্ম নিউ ইয়র্ক সিটিতে, ১৯১৯ সালের মার্চের ৩ তারিখে। অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে। পিট নামে পরিচিত হন বেশ পরে। তাঁর বাবা চার্লস ও মা কন্সট্যান্স – দুজনই ছিলেন মিউজিশিয়ান। চার্লস ছিলেন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক কম্পোজার, পিয়ানিস্ট এবং বিশ্বখ্যাত বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনিই প্রথম বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মিউজিকোলজি’ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। আর কন্ট্যান্স ছিলেন একজন প্রতিভাবান বেহালা শিল্পী। পিটাররা ছিলেন ৩ ভাই। সবচেয়ে বড়ো ভাই চার্লস জুনিয়র, তারপরের ভাই জন, আর সবচেয়ে ছোটো পিটার।
পিটারের বয়স যখন ১৮ মাস, তখন চার্লস ও কন্সট্যান্স সপরিবারে এক অদ্ভুত ট্যুরে বের হন। চার্লস এক বছর ধরে একটা কাঠের ট্রেইলার বানান। সেই হোম-মেইড ট্রেইলারে পিয়ানো আর দরকারি জিনিসপত্র নেন। এটা দেখতে ছিল কভার্ড ওয়াগনের মতো। চার্লস তাঁর মডেল টি ফোর্ড গাড়ির পেছনে ট্রেইলারটা জুড়ে দিয়ে দক্ষিণে রওনা দেন। সিগারদের উদ্দেশ্য ছিল– গ্রামের লোকজনের কাছে বেটোফেন-বাখ-মোৎজার্টের ক্ল্যাসিকেল মিউজিক পৌঁছে দেওয়া। ট্রেইলার ভেতরেই একটা মঞ্চ বানানো ছিল, যেটাকে বাইরে টেনে তাঁরা পারফর্ম করতেন।

সেবারে তারা নিউ ইয়র্ক থেকে নর্থ ক্যারোলিনা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। লোকজন কৌতুহল নিয়ে তাঁদের ক্ল্যাসিকেল কন্সার্ট শোনে। কিন্তু গ্রামের লোকদের নিজস্ব এক ধরনের গান ছিল। ওরা নিজস্ব এক ধরনের বেহালা, ব্যাঞ্জো ও গিটার বাজিয়ে গাইতো। স্থানীয়রা বলে — “উডোন্ট ইউ লাইক টু হিয়ার আওয়ার মিউজিক?” চার্লস ওদের গান শুনে, নিজের গানের চেয়ে লোকসঙ্গীতের প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চার্লির ভাষ্যে — “ফর দ্য ফার্স্ট টাইম আই রিয়েলাইজড, পিওপল হ্যাড লট অব গুড মিউজিক দেমসেলভ্স। দে ডিডন্ট নিড মাই মিউজিক অ্যাজ মাচ অ্যাজ আই থট।” এই অভিজ্ঞতা গানের ব্যাপারে চার্লসের দৃষ্টিভঙ্গী আমূল পালটে দেয়।
এদিকে চার্লস র‌্যাডিকেল রাজনীতি বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং তাঁকে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিটা ছাড়তে হয়।
পিটারের বাবা-মা’র সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। পিটারের বাবা-মা আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং একসময় তাদের ডিভোর্স হয়। পিটারের বয়স তখন আট। ছেলেরা, বাবার সাথে নিউইয়র্কের প্যাটারসনে সামারের ছুটি কাটাতো, দাদার বাড়িতে। প্রতি রাতে, মূল ঘরের পাশে, গোলাঘরে পিটার ও তার ভাইরা বাবার সাথে ঘুমাতেন। গ্রীষ্মের লম্বা বিকালটায় পিটার আশপাশের বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর কাছে ওসব জায়গা স্বর্গের মনে মনে হতো।
খুব অল্প বয়সেই ইউকেলেলি যন্ত্র বাজিয়ে গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে পিটারের গানে হাতেখড়ি। আর ওদিকে মা’র কাছে গেলে পিটার দেখতেন, সারা বাড়ি জুড়ে মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ছড়ানো। সেখানেই তিনি অর্গান, অ্যাকর্ডিয়ান, মারিম্বা এবং আরো কয়েকটা ইন্সট্রুমেন্ট নিজে নিজেই শিখে নেন। তিনি নোটেশন দেখে শেখার চাইতে নিজ কানে শুনে শিখতে পছন্দ করতেন।

মিউজিকের পাশাপাশি পিটার বই পড়তে খুব ভালবাসতেন। আর্নেস্ট থম্পসন সেটনের লেখা বইগুলো ছিল তাঁর বেশি পছন্দের। বয় স্কাউটের প্রতিষ্ঠাতা সেটন আউটডোর এডভেঞ্চার নিয়ে লিখতেন। তাঁর গল্পের চরিত্রগুলো জানে — কিভাবে শিকার করতে হয়, বন্যপ্রাণী খুঁজতে হয় এবং বনে-জঙ্গলে বাঁচতে হয়। পিটার সেই চরিত্রগুলোর মতো হতে চাইতেন। দাদার বাড়িতে তিনি ন্যাটিভ আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের মতো পোশাক পরে সাজতেন। তিনি এমনকি ইন্ডিয়ানদের মতো নিজের জন্য ১৬ ফুট উঁচু একটা পোর্টেবল তাঁবু পর্যন্ত বানিয়েছিলেন।
১৯৩২ সালে ১৩ বছর বয়সে পিটার কানেকটিকার এভনে ছেলেদের বোর্ডিং স্কুলে পড়তে যান। স্কুলটা ছিল খুব নামী প্রাইভেট স্কুল। কিন্তু মেধাবি পিটার স্কলারশিপ নিয়ে সেখানে পড়তে যান। এভনে তাঁর প্রকৃতিপ্রেম আরো গভীর হয়। ওখানেই একজন গানের শিক্ষক পিটারকে চার-তারের ব্যাঞ্জো বাজাতে দেন। পিটার সাথে সাথেই এই ইন্সট্রুমেন্টের প্রেমে পড়ে যান। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পিটার তাঁর স্কুলের জ্যাজ ব্যান্ড দলে ব্যাঞ্জো বাজাতে শুরু করেন।
এদিকে পিটারের বাবা আবার বিয়ে করেন। চার্লস ও তাঁর নতুন স্ত্রী রুথ আমেরিকান লোকসঙ্গীতের বিরাট ভক্ত হয়ে ওঠেন। ১৯৩৬ সালে পিটারের হাই স্কুল গ্র্যাজুয়েশনের পর, বাবা তাঁকে দক্ষিণে আরেকটা মিউজিক্যাল রোড ট্রিপে নিয়ে যান। এই ট্রিপ পিটারের কান খুলে দেয় এবং তাঁর জীবনটাকে পুরোপুরি বদলে দেয়। নর্থ ক্যারোলাইনার এপালেশিয়ান পাহাড়ী এলাকায় পিটার শুনতে পান স্থানীয়দের পাঁচ-তারের ব্যাঞ্জো-বাদন। এটা ছিল ফুট-স্টম্পিং মিউজিক। তখন থেকেই পিটারের জন্য — লোকসঙ্গীত আর ব্যাঞ্জো — এই দুটোই হয়ে ওঠে ভবিতব্য।

মুস্তাফা বলেন, ঔপনিবেশিক আমলে ইউরোপের ক্ল্যাসিকেল মিউজিকই ছিল সবার পছন্দের। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে, নতুন ধরনের মিউজিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে – যা ছিল একদম আমেরিকার স্বতন্ত্র ধরনের। এর মধ্যে আছে — ফোক, জ্যাজ এবং ব্লুজ। এই আমেরিকান মিউজিক, আমেরিকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর থেকে উঠে আসা। লোকসঙ্গীত এসেছিল — দক্ষিণের পাহাড়ী প্রদেশ থেকে। আর আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা ব্লুজ এবং জ্যাজের জন্ম দেয় । প্রথমদিকের ব্লুজ মূলত আফ্রিকান-আমেরিকান দাসদের জীবনের কষ্ট-যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলত। এই সব গানগুলোই — সাধারণ মানুষের জীবনের ভালোবাসা, জীবনযাপন, ব্যথা, দারিদ্র্য এবং আনন্দের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নিয়েছিল।
মুস্তাফা বলেন, ১৯৩৬ সালে পিটার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। সেখানেও তিনি পার্শিয়াল স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। হার্ভার্ডেই পিটার পরিচিত হন পিট নামে। ক্লাসের বইয়ের বাইরেও তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। তিনি তখন ওখানকার ব্যাঞ্জো ক্লাবেও যোগ দেন।
পিট যখন হার্ভার্ডে ভর্তি হন, তখন চলছিল গ্রেট ডিপ্রেশন। হার্ভার্ডে পিট একটা স্টুডেন্টস গ্রæপে যোগ দেন। ওরা সাধারণ শ্রমজীবিদের জীবনের মান উন্নয়নের জন্য কাজ করতো। দলটার নাম ছিল — ইয়াং কম্যুনিস্টস। বছর দুয়েকের মাথায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আগে তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হন। তখন কম্যুনিস্টরা ফিফথ এভিনিউতে বিশাল মার্চ করে। পিট ব্যাঞ্জো হাতে তাতে যোগ দেন। নিজে গান গেয়ে, অন্য সবাইকে গাইয়ে উদ্দীপ্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার চেয়ে কোনো বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল পিটের কাছে। আর এসবে যুক্ত হয়ে পড়ার পর তাঁর গ্রেড আক্রান্ত হয়। স্কলারশিপ হারান তিনি। এবং ১৯ বছর বয়সে পিট হার্ভার্ড ছেড়ে দেন।

এই সময়টায় পিট বেশ আর্থিক টানাপোড়েনে ভুগলেও গানটা ছাড়েননি? এ সময় তিনি পরিচিত হন একজন মিউজিশিয়ানের সাথে। তাঁর নাম — হিউডি লেডবেটার। হিউডি ছিলেন লুইজিয়ানার, আফ্রিকান-আমেরিকান। তাঁকে ডাকা হতো লিড বেলি নামে। লিড বেলির গান গাওয়া ও ১২ তারের গিটার বাদন পিটকে মুগ্ধ করে।
অ্যালেন লোম্যাক্স নামে পিটের এক বন্ধু ছিল। অ্যালেন তখন লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের জন্য ফোক এবং ব্লুজ মিউজিক সংগ্রহ করছিলেন। অ্যালেন ও তাঁর বাবা জন দুজনই এই সংগ্রহের কাজে নিজেরা স্থানীয়দের কাছে গিয়ে, এমনকি জেলখানায় গিয়েও সাধারণ মানুষের গান শুনতেন। তাঁরা সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হন আফ্রিকান-আমেরিকানদের মিউজিকে। এই লোম্যাক্সদের ছাড়া আমেরিকানরা হয়তো কখনোই সেইসব গানের ব্যাপারে জানতো না, যেসব গান সেই দাস প্রথার আমল থেকেই সাধারণ মানুষজন গাইতো।
অ্যালেন পিটকে ওয়াশিংটনে একটা চাকরি দেন। কাজটা হচ্ছে — লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের জন্য গানের কথা ও নোটেশন লিপিবদ্ধ করা। এ কাজের জন্য পিট সাকুল্যে সপ্তাহে মাত্র ১৫ ডলার পেতেন। কিন্তু তিনি অনেক নতুন লোকসঙ্গীত সম্পর্কে জানতে পারেন এবং জানতে পারেন — দক্ষিণের আফ্রিকান-আমেরিকানদের সংগ্রামের ব্যাপারে।
আলোচক বলেন, ১৯৪০ সালে পিট একটা বড়ো ব্রেক পান। অ্যালেন তাঁকে নিউ ইয়র্ক সিটিতে একটা কনসার্টে গাইবার সুযোগ দেন। পশ্চিমের স্টেটগুলোর গরীব কৃষকের সাহায্যার্থে ছিল কনসার্টটা। বিরাট ব্রডওয়ে থিয়েটারে সেই কনসার্ট হয়। অনেক বিখ্যাত লোকগায়কদের সাথে গাওয়ার সুযোগ পান পিট। ঐ অনুষ্ঠানের ব্যাকস্টেজে পিটের পরিচয় হয় ওকলাহামার এক রোগা-পাতলা গায়কের সাথে। নাম তাঁর — উডি গাথরি — ক্ষণজন্মা, প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। উডি পিটের ব্যাঞ্জো বাদন পছন্দ করেন। এবং তারা দুইজন খুব ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে যান। এটা ছিল পিটের জন্য আরেকটা লাইফ-চেঞ্জিং মোমেন্ট। উডির সাথে পরিচয় তাঁর সঙ্গীত জীবনটাকেই অন্য পথে নিয়ে যায়।
উডির সবচেয়ে বিখ্যাত গান — “দিস ল্যান্ড ইজ ইয়োর ল্যান্ড।” এই গানে যুক্তরাষ্ট্রের সৌন্দর্যের বন্দনা আছে। কিন্তু গানটার শেষের অংশটুকু প্রায় সময়েই রেডিওতে বাজানো হতো না কিংবা স্কুলে পড়ানো হতো না। ওই অংশে আছে — আমেরিকার সৌন্দর্য উপভোগে ধনীদের মতো গরীবদেরও একইরকম অধিকার আছে।

উডি বা পিট কারোরই ধনী হওয়ার বা নাম করার ইচ্ছে ছিল না। তাঁরা দুজনই ভাবতেন — গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় আমেরিকানদের কষ্ট-যন্ত্রণার সত্যকথন গানের মধ্য দিয়ে তুলে ধরাটা বেশি দরকার।
উডি পিটকে অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন। মিউজিক্যাল ট্যালেন্টের পাশাপাশি তাঁর প্রচণ্ড রসবোধ ছিল এবং গান গাইতে গেলে শ্রোতাদের সাথে অনেক গল্প, কৌতুক বলতেন, যা শ্রোতাদের নজর কাড়ত। পিট পরে লিখেছেন — “আমি উডির কাছ থেকে এতো বিভিন্ন ধরনের জিনিস শিখেছি যে, সেসব বলে শেষ করা যাবে না।”
মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, নিউইয়র্ক সিটিতে ফিরে পিট, উডি গাথরি, লি হেইস এবং মিলার্ড লাম্পেল মিলে গড়ে তোলেন গানের দল — ‘অ্যালমানাক সিংগারস।’ এই দল গান গাইত মূলত আমেরিকান শ্রমিক এবং ইউনিয়নের জন্য। একবার ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ধর্মঘটী পরিবহন শ্রমিকদের জন্য একটা কনসার্টে গায় ‘অ্যালমানাক সিংগারস।’ ২০০০০ দর্শক উপস্থিত ছিলেন সেদিন।

আলোচক বলেন, পিট যে শুধু গান আর রাজনীতি নিয়ে থাকতেন, তা না। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটিতে স্কয়ার ড্যান্সে যেতেন এবং ১৯৩৯ সালে তাঁর সাথে এক মেয়ের পরিচয় হয়, প্রেম হয়। মেয়েটির নাম — তোশি ওহতা। তিনি জাপানিজ-আমেরিকান। তোশিও পিটের মতো একই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তোশি ছিলেন আমৃত্যু পিটের প্রেরণার উৎস। কিন্তু তাঁদেরকে বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। হাওয়াইয়ের পার্ল হারবারে জাপানিরা বোমা মারলে, ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। পিটকে পরের বছর আর্মিতে যোগ দিতে হয়। পিটের সব সঙ্গীদের তখন পাঠানো হয়েছিল হয় ইউরোপে, না হয় প্যাসিফিক আইল্যান্ডে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না, শুধু তাঁকে কেন পাঠানো হয়নি। অনেক বছর পরে তিনি কারণটা জানতে পারেন। আর্মিরা তাঁর চিঠি খুলতো। তোশিও চিঠি পাঠাতো তখন। কাজেই ওরা এমন সৈনিককে বিশ্বাস করতে পারেনি, যার প্রেমিকার বাবা জাপানি বংশোদ্ভূত।
ছয় মাস মিসিসিপিতে থাকার পর পিট তোশিকে বিয়ের জন্য একটা ছোট্ট বিরতি চান। ১৯৪৩ সালের ২০শে জুলাই নিউ ইয়র্কের এক ছোটো চার্চে তাঁদের বিয়ে হয়। তোশিকে বিয়ের আংটি দেওয়ার মতো টাকাও পিটের ছিল না।
এবারে মিসিসিপি থেকে পিট ম্যারিল্যান্ডে স্থানান্তরিত হন। এখান থেকে মাঝে মাঝেই তোশির সাথে দেখা করতে পারতেন। ১৯৪৪ সালে অবশেষে পিটকে প্যাসিফিকে পাঠানো হয়। তিনি গানের ওয়ার্কশপ, কনসার্ট ইত্যাদি করতেন সেখানে।
১৯৪৪ সালের গ্রীষ্মে পিট তোশির কাছ থেকে চিঠিতে দারুণ এক সংবাদ পান। তোশি মা হয়েছে। ছেলে হয়েছে। নাম রেখেছেন – পিটার। কিন্তু পিট-তোশির এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কয়েক মাস পর, পিট আরেকটা চিঠিতে জানতে পারেন, জন্মগত এক রোগে ছোট্ট পিটার মারা গেছে। পিট আর তোশি তখন একে অন্যের কাছ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। তারা একে অন্যকে সান্তনা পর্যন্ত দিতে পারেননি। এবং ব্যাপারটা কতটা দুঃখের যে, পিট সিগার তাঁর প্রথম সন্তানকে একটাবারের জন্যও দেখতেও পারেননি।
১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর জাপানিরা সারেন্ডার করলে অবশেষে ২য় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। পিটকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরেই থাকতে হয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলেও পৃথিবীতে মোটেও শান্তি এলো না। বরং নতুন আরেক যুদ্ধ – “কোল্ড ওয়ার” শুরু হয়ে গেলো। ঐ অর্থে তখন মাঠে ময়দানে যুদ্ধ চলছিল না। কিন্তু সময়টা খুবই ভয়ঙ্কর ছিল।

১৯৪৬ সালের লেবার ডে তে জন্ম নেয় তাঁদের পুত্র সন্তান — ড্যানিয়েল। আরো আনন্দ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ১৯৪৮ সালে জন্মায় কন্যাসন্তান — মাইকা। এই মাইকা ও ছেলেদের সাথে নিয়ে নিয়ে তোশি পিটের কন্সার্টের সময় সব জায়গায় সাথে যেতেন।
ঐ সময় পিট গানের দল ‘হুটেনানিস’ এর সাথে যুক্ত হন। হুটেনানিসদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের জন্য গান গাওয়া। সামাজিকভাবে সচেতন মিউজিশিয়ানদের নিয়ে পিটরা তাঁদের ইউনিয়নকে গানের ইউনিয়নে রূপ দিয়েছিলেন।
পিট এবং তার বন্ধুদের রাজনীতি, যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আতঙ্কিত করে তোলে। এফবিআই, ‘হুটেনানিস’ দলের লোকশিল্পীদের পেছনে গোয়েন্দাগিরি শুরু করে। বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিল পাশ হয়। সব উল্লেখযোগ্য ইউনিয়ন নেতাদের ফায়ার করা হয় এবং একপর্যায়ে গোটা ইউনিয়ন মুভমেন্টই মুখ থুবড়ে পড়ে।
আলোচক বলেন, ১৯৪৮ সালে পিট প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী একজনকে নির্বাচনে সহযোগিতা করেন। তাঁর নাম ছিল — হেনরি ওয়ালেস। পিট ওয়ালেসের জন্য কন্সার্ট করতেন। হ্যারি ট্রুম্যান সেবারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ওয়ালেস না জিতলেও, এই প্রচারণায়, পিট এবং তাঁর লোকসঙ্গীত কিন্তু জাতীয় দৃশ্যপটে চলে আসে?
এদিকে ১৯৪৯ সালে পিট, পল রবসনের সাথে কন্সার্টে গাইবার সিদ্ধান্ত নেন। পিকস্কিল সিভিল রাইটস কংগ্রেসে, সিভিল রাইটস গ্রæপের জন্য টাকা তোলার উদ্দেশ্যে ছিল সেই কন্সার্ট। নিউইয়র্ক সিটির উত্তরে এক ঘণ্টা ড্রাইভের দূরত্বে পিকস্কিলের কাছে আউটডোরে হয় কন্সার্টটা। ঐ পিকস্কিল এলাকায় ছিল ক্লু ক্লাক্স ক্লানদের ঘাঁটি। কন্সার্ট শুরু হলে, ক্লু ক্লাক্স ক্লানদের সহায়তায় লোকজন লাঠিসোটা, পাথর দিয়ে তাঁদের আক্রমণ করে। কন্সার্ট বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এসবের পরও পল রবসন, পিট সিগার ও অন্যান্যরা নতি স্বীকার করেননি। তাঁরা পরের সপ্তাহে আবারো কন্সার্টের সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় ২০০০০ এর মতো মানুষ পল রবসন ও পিট সিগারের গান শুনতে আসে। তোশি, তোশির বাবা, ছোট্ট ড্যানি আর মাইকাও তাদের সাথে যোগ দেয়। খুবই হিংগ্র একদল দাঙ্গাবাজ কন্সার্ট শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। শেষ করে পিটরা গাড়িতে উঠতে না উঠতেই এরা এলোপাতাড়ি গাড়িতে পাথর ছুড়তে থাকে? ১৪০ জনেরও বেশি লোকজন দাঙ্গাবাজদের হাতে হতাহত হয়। পল রবসন ও পিট সিগার ভাগ্যক্রমে সেদিন জীবন্ত ফেরেন। কন্সার্টে অনেক পুলিশ ছিল। কিন্তু তাদের প্রশ্রয়েই বরং ঘটনাটা ঘটে।

আলোচক মুস্তাফা বলেন, পিট এবং পিটের পরিবারের জন্য সময়টা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু তারপরেও ১৯৪৯ সালে দারুণ একটা ব্যাপার ঘটে। পিট আর তোশি নিউইয়র্ক সিটি ছেড়ে ড্যানি আর মাইকাকে গ্রামে বড়ো করতে চাইছিলেন। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের থেকে টাকা ধার নিয়ে ওঁরা নিউইয়র্কের বীকন এলাকায় পাহাড়ের ধারে জঙ্গলে সাড়ে ১৭ একর জমি কেনেন। তাঁদের জমিটা ছিল হাডসন নদীর সামনে। পিট নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে “লগ কেবিন” নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করেন এবং ঠিক করেন, নিজেই এমন একটা বানাবেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, গ্রীষ্মের মধ্যেই কেবিনের ফাউন্ডেশন দাঁড়িয়ে যায়। ওদিকে পিট, তোশি আর বাচ্চারা আকাশের তারার নিচে তাঁবুতে থাকে তখন। ঠাণ্ডা পড়ে গেলে, তোশি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে যেতেন। আর পিট ও তার বন্ধুরা কেবিনের কাজ চালিয়ে যেতেন।
এর মধ্যে পিট কাজের খোঁজে প্রায়ই নিউইয়র্ক সিটিতে আসতেন। ১৯৪৮ সালে রনি গিলবার্ট, লি গেইস ও ফ্রেড হেলারম্যানকে নিয়ে একটা নতুন গানের দল তৈরি করেন। গ্রæপের নাম দেওয়া হয় — “উইভারস।”
“উইভার”রা পুরোনো লোকগানগুলোকে একটু নতুন আঙ্গিকে দর্শকদের সামনে হাজির করতো। ১৯৫০ সালে উইভাররা তাদের প্রথম রেকর্ড বের করে। রেকর্ডের একদিকে ছিল — “গুডনাইট আইরিন” আর অন্যদিকে ছিল, ইজরায়েলের একটা দারুণ টিউনের গান “স্যানা স্যানা স্যানা।” উইভারদের এই রেকর্ডটি এক মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল! টপ চার্টে ছিল বহুদিন। উইভার তখন সাফল্যের শীর্ষে।
মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, এই সময়কালে এফিবিআই হারভে মাতুসো নামের একজন প্রাক্তন কম্যুনিস্টকে পেইড এজেন্ট হিসেবে পিট এবং পিটের মতো আরো লোকশিল্পীদের পেছনে গোয়েন্দাগিরিতে নিয়োগ দেয়। রেডিও-টিভির স্পন্সর বড়ো বড়ো কোম্পানীগুলোতে এফবিআই নামের লিস্ট পাঠায়। এই তালিকাভুক্ত সবার শোগুলোতে ডাকা বন্ধ করে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। যাকে আমরা বলি “ব্ল্যাকলিস্টিং।” ১৯৫২ সালের মধ্যে এই কালো তালিকার বদৌলতেই উইভারদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়।

আলোচক বলেন, ১৯৫৫ সালে পিটকে এইচিউএসি নামে একটি সরকারি কমিটির মুখোমুখি হতে হয়। এইচিউএসি হচ্ছে — হাউজ আন-আমেরিকান এক্টিভিটিজ কমিটি। ওদের প্রধান টার্গেট ছিল — বিনোদন শিল্পী, লেখক, গায়ক এবং আর্টিস্টরা। এইচিউএসি চাইছিল — আমেরিকানরা যে সব চলচ্চিত্র দেখে, যে সব বইপত্র পড়ে কিংবা যে সমস্ত গান শোনে, সেসবের কোথাও যেন কম্যুনিস্ট ভাবধারার কিছু না পায়।
কেও কেও এইচইউএসির সাথে চুক্তিতে রাজি হয়। কম্যুনিস্ট সন্দেহভাজন তাদের বন্ধুদের কিংবা অন্য কারো ব্যাপারে তারা তথ্য সরবরাহ করে। এটাকে বলা হতো “নেইমিং নেইমস্।” এইভাবে কংগ্রেসকে কনটেম্পট করবার দায়ে জেল খাটা থেকে রেহাই মিলতো।
পিটের কেইস লড়ার জন্য তোশি একজন আইনজীবী যোগাড় করেন। আইনজীবী বুঝে গিয়েছিলেন যে, পিট “নেইমিং নেইমস” এ রাজি হবেন না। তাই তিনি বরং পিটকে উপদেশ দেন, হিয়ারিং এর সময় অভিযুক্ত হয়ে পড়তে পারে, এমন কোনো প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ার। এটা আইনগতভাবে করা যায়। একে বলা হয় “প্লিডিং দ্য ফিফিথ অ্যামেন্ডমেন্ট।” জেলে যাওয়া এড়াতে এটাই পিটের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ পথ ছিল। কিন্তু পিট আইনজীবীর উপদেশ মেনে নিতে চাইলেন না। আর পিট তো আসলেই কোনো কিছুর জন্য দোষী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বিশ্বস্ত আমেরিকান যিনি ২য় বিশ্বযুদ্ধে দেশের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। এইচইউএসির হিয়ারিং হয় নিউইয়র্ক সিটিতে। কম্যুনিস্ট পার্টিকে সমর্থন করে এমন ইভেন্টে তিনি গান গেয়েছেন কি না জিজ্ঞেস করা হয়। পিট ততোদিনে কম্যুনিস্ট পার্টি ইউএসএ ছেড়ে দিলেও তাঁর মনে হয়, এইচইউএসির তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে নাক গলানোর কোনো অধিকার নেই। তিনি এইচইউএসিকে বলেন — সংবিধানে প্রতিটি আমেরিকান নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো বাক স্বাধীনতা ও মতামতের স্বাধীনতারও অধিকার আছে। পিট বলেন, হিয়ারিংটা ঠিক হচ্ছে না এবং তিনি কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেবেন না। এইচইউএসির হিয়ারিং এ সহযোগিতা না করায় পিটকে অভিযুক্ত করা হয়। তিনি তাঁর নিজস্ব বিশ্বাসে ও চিন্তায় অটল থাকবার বিনিময়ে জেলে যেতেও রাজি ছিলেন। এই ট্রায়াল বেশ কয়েক বছর (৭ বছর) পিছিয়ে যায়। পিট পুরো সময়টা জুড়ে কালোতালিকাভুক্ত থাকেন আগের মতোই।
মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, ৫০ এর দশক জুড়ে পিট ব্যাঞ্জো বাজানো শেখান। তিনি ব্যাঞ্জোর ম্যানুয়াল তৈরি করেন। সারা আমেরিকা যেন ব্যাঞ্জো জ্বরে আক্রান্ত হয় তখন। ঐ সময়টায় পিট সামার ক্যাম্প এবং স্কুল এসেম্বলিতে বাচ্চাদের জন্য গাইতে শুরু করেন। তিনি কলেজ কনসার্টেও গাইতেন সেই সময়। কনসার্ট ভণ্ডুলের চেষ্টা চলে সবরকম। কিন্তু যত পিকেটিং হতো ততো বেশি কনসার্টের টিকিট বিক্রি হতো। তিনি একনাগাড়ে তখন গান গেয়ে যান এবং কাজটা তিনি খুব ভালোবেসেই করেন (১৯৫৩-৬০)। আর এই পারফরম্যান্সগুলোতে পিটের গান শুনে বাচ্চারা তাঁর সারাজীবনের ভক্ত হয়ে যায়। শাসকরা ভেবেছিল পিট নিরাপদ বাচ্চাদের কাছে। কিন্তু তাদের হিসাবে ভুল ছিল। পিট এই সুযোগে সাবভার্সিভ মুভমেন্ট ঘটান। পুরো আরেক প্রজন্মের হাত ধরে লোকসঙ্গীতের পুনরুত্থান ঘটে যায় এর মধ্য দিয়ে। তোশি তখন পিটের ম্যানেজার। তোশি যে কাজই খুঁজে আনতেন, পিট সেটাই করতেন। ঐ সময়েই, ১৯৫৬ সালে, তাঁদের সংসারে আসে আরেক কন্যা সন্তান তিনিয়া। একটা পুরো বছর পিট আমেরিকার প্রায় প্রতিটি রাজ্যে এবং কানাডায়ও পারফর্ম করেন।

আলোচক বলেন, অবশেষে, ১৯৬১ সালে পিটের ট্রায়াল শুরু হয়। তাঁর বিরুদ্ধে চার্জ ছিল — “কনটেম্পট অব কংগ্রেস।” এর মানে, তিনি এইচইউএসিকে সহযোগিতা করতে সম্মত হননি। পিটের ১ বছর ১ দিনের জেল হয়। কোর্টরুমের বাইরে বিশাল গণজমায়েত হয় । তারা কোর্টের এই রায়ের প্রতিবাদ করে। আইনজীবী পিটকে ছাড়িয়ে আনার আগে কয়েক ঘন্টা পিট জেলে কাটান। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পিটকে আরেকবার সুযোগ দিতে, দ্বিতীয় ট্রায়াল ধার্য করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে, ১৯৬১ সালের দিকে অনেক আমেরিকান বুঝতে পারে যে, এই কালোতালিকা আর এই এইচইউএসি আসলে ঠিক না। দ্বিতীয় ট্রায়ালে পিটকে অনেক টাকা ঢালতে হলেও তা সফল হয়। ১৯৬২ সালে পিট সিগারের বিরুদ্ধে কোর্ট কেইস সরকার তুলে নেয়।
মুস্তাফা বলেন, পরে উইভার আবার একত্রিত হয়। নতুন ম্যানেজার লাভেনথল কার্নেগি হল ভাড়া নেন, যেটা অনেকটা জুয়া খেলার মতো ছিল। কিন্তু হল কানায় কানায় ভরে যায়? তবে এর মধ্যে উইভাররা সিগারেট কোম্পানির জন্য বিজ্ঞাপন করলে পিট দ্বিমত করে দল ছাড়েন।
রেডিও টিভিতে পিট ১৭ বছর নিষিদ্ধ ছিলেন। তখন টিভির শিক্ষামূলক চ্যানেলে পিট কিছু নিজস্ব শো করেন। কিন্তু টাকা ফুরালে পিট-তোশি ক্ষান্ত দেন।

এই পর্যায়ে আলোচক ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটির প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। ১৯৫৭ সালে আমেরিকার টেনেসির হাইল্যান্ডার স্কুলে (ইন্টাররেসিয়াল স্কুল) মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের উপস্থিতিতে বেশ প্রাচীন একটি গসপেল গানের কথায় কিছু পরিবর্তন এনে নতুন এক স্তবক জুড়ে ‘উইল’–এর জায়গায় ‘শ্যাল’ করে প্রথমবারের মতো ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি পরিবেশন করেন পিট সিগার। সেই গান পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে সিভিল রাইটস মুভমেন্টের অনানুষ্ঠানিক অ্যান্থেম হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন ভাষায় গানটি প্রটেস্ট মুভমেন্টের অপরিহার্য সঙ্গীত হয়ে ওঠে।
আলোচক বলেন, গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যুদ্ধবিরোধী গান গেয়ে আলোড়ন তোলেন প্রটেস্ট মুভমেন্টের সাঙ্গীতিক ভাষ্যকার, আমেরিকার লোকগায়ক পিট সিগার। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধবিরোধী ভূমিকাকে তুলে ধরতে পিট সিগার রচনা ও সুরারোপ করেন ‘হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস্ গন’ গানটি। সেই গান এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরোধী গানের আইকন হয়ে আছে। দেশ-কাল নির্বিশেষে অসংখ্য ভাষায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত পিট সিগারের অবিস্মরণীয় সেই গান।

মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, এ দুটি গান ছাড়াও পিট সিগারের গাওয়া ‘ইফ আই হ্যাড অ্য হ্যামার’, ‘টার্ন টার্ন টার্ন’—এসব গানও সারা পৃথিবীর মানুষের মুখে মুখে। নামী লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অ্যালান এম উইঙ্কলার তাঁর ‘টু এভরিথিং দেয়ার ইজ আ সিজন: পিট সিগার অ্যান্ড দ্য পাওয়ার অব সং’ বইয়ের শিরোনাম নিয়েছেন পিট সিগারের অত্যন্ত বিখ্যাত ২০ শতকের সিভিল রাইটস মুভমেন্টের অনানুষ্ঠানিক জাতীয় সঙ্গীত ‘টার্ন টার্ন টার্ন’ গানটি থেকে।
আলোচক বলেন, পৃথিবীর নানা অঞ্চলের নানান ভাষার অনেক লোকগান প্রথম পিট সিগারের কণ্ঠে প্রথম শোনে সারা পৃথিবীর মানুষ। এ পর্যায়ে আলোচক মুস্তাফা মাহমুদ গেয়ে শোনান পিট সিগারের কণ্ঠে পরিচিতি পাওয়া বিশ্বময় অসম্ভব জনপ্রিয় স্প্যানিশ ভাষায় কিউবার লোকসঙ্গীত ‘গুয়ান্তানামেরা।’
বইয়ের আলোচনার সঙ্গে সম্পূরক তথ্য হিসেবে আলোচক মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, ‘আমরা করব জয়,’ “নাম তার ছিল জন হেনরি,’ ‘ফুলগুলি কোথায় গেল’ গানগুলো আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবাদের হাতিয়ার, শান্তি-স¤প্রীতির বাহক। এ গানগুলো আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। এ গান শোনেননি, উদ্দীপ্ত হননি, এমন বাঙালি বিরল। আর এসব গানের প্রতিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পিট সিগার। পিট সিগারের “উই শ্যাল ওভারকাম”, “জন হেনরি”, “জন ব্রাউন,” “হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস্ গন” গানগুলোর সুর ও কথা বাংলায় প্রাণ পেয়েছে ২০ শতকের বাংলার প্রতিবাদ আন্দোলনের শিল্পী-সংগঠক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের হাতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী পিট সিগারের লেখা ও সুর করা “হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস্ গন” গানটির ছায়ায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনা করেন “ফুলগুলি কোথায় গেল।”

উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালে পিট সিগার কলকাতায় এলে সরাসরি তাঁর কাছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস এই গান শেখেন এবং গানটিতে মুগ্ধ হেমাঙ্গ ‘ফুলগুলি কোথায় গেল’ রচনা করেন। পিট সিগারের ‘জন হেনরি’র আদলে হেমাঙ্গ বিশ্বাস সৃষ্টি করেন ‘নাম তার ছিল জন হেনরি,’ ‘জন ব্রাউন’-এর ছায়ায় করেন ‘জন ব্রাউনের দেহ শুয়ে সমাধিতলে’। আর পিট সিগারের গাওয়া বিশ্বজুড়ে সামাজিক প্রতিবাদ আন্দোলনের অ্যান্থেম, আইকনিক গান ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনা করেন ‘আমরা করব জয়।’ হেমাঙ্গ বিশ্বাস পিট সিগারের আরও কয়েকটি গান থেকে বাংলার প্রতিবাদ-সঙ্গীত তৈরি করেন। পিট সিগারের গান থেকে বাংলা গান বেঁধেছেন কবীর সুমন, গান বেঁধেছে ক্যালকাটা ইয়ুথ ক্যয়ার। তাঁর গান থেকে সৃষ্টি হয়েছে বাংলা কবিতাও। আলোচক বলেন, ১৯৬২-৬৫ এই ৪ বছর দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে ফ্রিডম মার্চে ডঃ কিং এর সাথে যোগ দিয়েছেন পিট সিগার। পিটের দায়িত্ব ছিল গান দিয়ে জমায়েতকে উদ্দীপ্ত রাখা।
১৯৬৩ সালের ২৮শে আগস্ট, ওয়াশিংটনে লক্ষ মানুষ — সাদা কালো — এক পদযাত্রায় অংশ নেয়। ওদের দাবি ছিল — আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্য উন্নত কাজের সুযোগ এবং সম অধিকার। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র পুরো জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর সেই বিখ্যাত “আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম” ভাষণটি দেন। সেটা টিভিতে প্রচারিত হলে দেখে লক্ষ লক্ষ মানুষ। ওয়াশিংটনের ঐ সমাবেশ এক বিরাট নাড়া দেয়। পরের দুই বছরে, প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন কংগ্রেসে গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ করান — ১) সিভিল রাইটস অ্যাক্ট, ১৯৬৪ এবং ২) ভোটিং রাইটস অ্যাক্ট, ১৯৬৫।

এ পর্যায়ে মুস্তাফা বলেন, অনেক দিন থেকেই পিট আর তোশি বাচ্চাদেরকে পৃথিবীর অন্য দিকটা দেখাতে চাইছিলেন। আমেরিকানরা যেসব দেশ সম্পর্কে খুব কম জানে, সেসব দেশের মানুষদের জীবনযাত্রা বাচ্চাদেরকে তাঁরা দেখাতে চাইছিলেন। কাজেই তাঁরা ১৯৬৩ সালের আগস্টে যান অস্ট্রেলিয়ায়। ১০ মাস জুড়ে তাঁরা ৪ মহাদেশের ১৪ টা দেশে ভ্রমণ করেন। সবগুলো দেশের গান আর নাচ তোশি ফিল্ম করেন। তোশির সেই সব মুভি লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ফিল্ম কালেকশনে আছে। পিট অনেকগুলো কনসার্ট করেন বেড়ানোর খরচ মেটানোর জন্য। এদিকে পিট ৬৩-৬৯ এই সময়কালে ‘নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভ্যাল’ চালু করেন। এটি খুব সফল একটি উৎসব হিসেবে আজও চলছে। বলা হয়ে থাকে — লোকসঙ্গীত, কাউন্টার কালচার থেকে মূল সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে এই উৎসবের মাধ্যমে।
আলোচক বলেন, ১৯৬০ সালে ভিয়েতনামে আমেরিকান সৈন্যদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে অন্য অনেক আমেরিকানদের মত পিটও খুব বিক্ষুব্ধ ছিলেন। অনেকের মতো পিটও তখন মনে করেন, পৃথিবীর আরেক প্রান্তের এক দেশের নিজস্ব বিষয়াদিতে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর এবং সিদ্ধান্ত দেওয়ার কোনো অধিকার নেই। পিট একটা নতুন গান লিখেন — ওয়েইস্ট ডিপ ইন দ্য বিগ মাডি। এই গানের গল্প — এক আমেরিকান অফিসার তার সৈন্যদের বোকার মতো অর্ডার দিচ্ছেন। গানে ভিয়েতনাম উল্লেখ না থাকলেও এতে এক যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যে যুদ্ধের কোনো মানে হয় না। এতে আবারো পিট রোষানলে পড়েন। দ্য স্মোদারস ব্রাদার্স কমেডি আওয়ার ছিল সিবিএস এর তখনকার খুব জনপ্রিয় টিভি শো। ১৯৬৭ সালে পিট ঐ গানটি ঐ শোতে গাওয়ার আমন্ত্রণ পান। এটা তাঁর জন্য বিশাল একটা ব্যাপার ছিল। কালোতালিকা ভুক্তির কারণে তিনি তখন বছরের পর বছর টিভিতে নিষিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু টিভি শো টা ছিল প্রি-রেকর্ডেড। এবং সিবিএস পিটের প্রটেস্ট সংটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে অবশ্য পিট পুরোটা গানই করেন টিভিতে এবং মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ তা শোনে।

৬০ এর দশকের শেষের দিকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রটেস্ট মুভমেন্ট আরো জোরালো হয়ে ওঠে। পিট একইভাবে এর সমর্থনে গান গেয়ে চলেন। ১৯৬৯ সালে ওয়াশিংটনে যুদ্ধের বিরুদ্ধে এক প্রটেস্টে আধা মিলিয়ন লোকের সামনে পিট জন লেননের — গিভ পিস এ চান্স — গানটা গান। ১৯৭৩ সালে অবশেষে আমেরিকান ট্রুপ ভিয়েতনাম ছাড়ে। ৫৮০০০রও বেশি আমেরিকান সৈন্য প্রাণ হারায় ভিয়েতনাম যুদ্ধে। জানা যায়, কয়েক মিলিয়ন ভিয়েতনামি প্রাণ হারায়, যাদের অর্ধেকেরও বেশি ছিল সাধারণ মানুষ। ১৯৭২ এ ভিয়েতনাম সরকারের আমন্ত্রণে ভিয়েতনাম ভ্রমণ করেন পিট সিগার।
এ পর্যায়ে আলোচক মুস্তাফা মাহমুদ পিট সিগারের ‘ক্লিয়ারওয়াটার মুভমেন্টে’র বিষয়ে বলেন। তখন ৬০ এর দশকের শেষ দিক। পিটরা ততোদিনে বীকনে ২০ বছর ধরে বসবাস করছেন। আর ঐ ২০ বছরে পিট আর তোশির চোখের সামনে অনেককিছুই বদলে গেছে। পিট তাঁর ছোট্ট পাল তোলা নৌকায় করে পরিবার ও বন্ধুদের হাডসন নদীতে ঘুরে বেড়াতেন। পানি তখন নোংরা। নদীতে ফেলা কারখানার রাসায়নিক বর্জ্যে পানি দূষিত।
পিটের এক বন্ধু তাঁকে একটা বই দেখান, ‘স্লুপস অফ দ্য হাডসন’ নামে। ছবি দেখে পিট কল্পনায় বিভোর হন। তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। হাডসন নদীতে এই ধরনের বোটে চড়ে লোকজন যদি নদীর গুরুত্ব বুঝতে পারে, তাহলে কেমন হয়? নদীটাকে জানলে, একে বাঁচাতেও আরো অনেক বেশি মানুষ কি যুক্ত হবে না?
আগে যেমন ভেবেছিলেন লগ কেবিনে বসবাস করবেন, এবার ভাবলেন একটা স্লুপ বানানো দরকার। এতো বিশাল কাজ তাঁর একার পক্ষে অসম্ভব। তাই তিনি ভাবলেন, তিনি অর্থ জোগাড় করবেন এটার জন্য। এটা বানাতে অনেক মানুষের সাহায্য দরকার হবে। তাই পিট আর তোশি মিলে গড়ে তুললেন ‘ক্লিয়ারওয়াটার অর্গানাইজেশন।’
অনেকে তখনও ভেবেছেন, এটা পিটের গ্রেফ পাগলামি। কিন্তু তোশি কয়েকটা কনসার্টের আয়োজন করেন। পিট এবং অন্যান্যরা সেগুলোতে পারফর্ম করেন। টাকা তোলার জন্য তাঁরা দিনে ৩/৪ টা কনসার্টও করেছেন। পিট নিজে প্রচণ্ড শারিরীক পরিশ্রম করতে পারতেন। তিনি তা করতে ভালোওবাসতেন। প্রাচীনকালে নাবিকদের গাওয়া লোকসঙ্গীত তিনি শেখেন এই সময়।

প্রায় ৯ মাসের মাথায়, ১৯৬৯ এর ২৭শে জুন, “ক্লিয়ারওয়াটার” এর যাত্রা শুরু হয়। প্রথম যাত্রায় হাডসন নদী সংস্কারের জন্য ২৭,০০০ ডলার ওঠে।
ক্লিয়ারওয়াটারের কারণে অনেক মানুষ হাডসনে আসা শুরু করে। সেখানে পিটের কন্সার্টগুলোতে কোম্পানি ও ব্যক্তি যাতে আর হাডসনে বর্জ্য ডাম্প করতে না পারে, সে ব্যাপারে আইন তৈরির জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। এই ক্লিয়ারওয়াটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিউইয়র্কবাসী জানতে পারে রাসায়নিক বর্জ্য ও পেস্টিসাইডের ব্যাপারে, যা মাছের মৃত্যু ঘটায় ও জল দূষণ করে। ১৯৭২ সালে ‘ক্লিন ওয়াটার অ্যাক্ট’ নামে একটা ফেডারেল আইন পাশ হয়। নিউইয়র্ক জল দূষণের জন্য দায়ি কোম্পানিকে ফাইন করার অধিকার পায়।
মধ্য ৮০র দশক থেকে লোকজন দেখে, জল অনেক পরিষ্কার। ১৯৬৯ সাল থেকে আধা মিলিয়নেরও বেশি লোক ক্লিয়ারওয়াটার বোটে ভ্রমণ করে। এদের অধিকাংশই ছিল শিশু। তাদেরকে শেখানো হতো, ভবিষ্যতে কিভাবে হাডসনকে দূষণ মুক্ত রাখা যায়? প্রতি বছর অর্গানাইজেশনটা ‘ক্লিয়ারওয়াটার ফেস্টিভ্যাল’ নামে দুই দিন ব্যাপী আয়োজন করতো। হাজার হাজার মানুষ আসতো সেখানে? বিভিন্ন ব্যান্ড ও পারফর্মাররা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ধরিত্রীকে বাঁচানোর ভিশন নিয়ে একাত্ম ছিল। আর এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছিল — পিট সিগারের জন্য।

আলোচক বলেন, ১৯৭৯ সালে পিট ৬০ বছরে পড়েন। কালো তালিকার দুঃসময় তখন অতিক্রান্ত। ৮০র দশকে পিট, আর্লো গাথরি ও তাঁর ব্যান্ডের সাথে অসংখ্য সোল্ড-আউট পারফর্ম্যান্সে যোগ দেন। এর মধ্যে আছে নিউইয়র্কের কার্নেগি হলের মতো নামী ভেন্যুও। পারফর্ম্যান্সের পাশাপাশি পিট লেখালেখি চালিয়ে যান। তাঁর লেখার বিষয় মূলত ছিল লোকসঙ্গীত। তিনি ৩০ টিরও বেশি বই লিখেন। বলাই বাহুল্য, পিটের যাবতীয় সবকিছুকে সম্ভব করে তুলেছিলেন — তোশি। এক সাক্ষাৎকারে পিট তোশিকে বলেন ‘দ্য রিয়েল হিরো।’
মজার ব্যাপার হলো, যেই মানুষটি “আন-আমেরিকান” হওয়ার দায়ে প্রায় জেল খাটতে বসেছিলেন, তিনিই তখন “জাতীয় বীর।” ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন, ৭৫ বছর বয়সী পিট সিগারের গান এবং কাজ দুটোর জন্যই “ন্যাশনাল মেডেল অব আর্টস” সম্মাননা প্রদান করেন। এর কয়েক সপ্তাহ পর পিটকে ‘কেনেডি সেন্টার অনার’ দেওয়া হয়। এটিও প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনই প্রদান করেন। ক্লিন্টন পিটের জীবন নিয়ে বলেন — “সাম আর্টিস্টস মেইক মিউজিক্যাল হিস্ট্রি। পিট সিগার মেইড হিস্ট্রি উইথ হিজ মিউজিক।”

৮০তে পা দেওয়ার পর পিটের কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন শ্রোতারা যোগ দিতো তাঁর সঙ্গে গানে। সারাজীবন তিনি সেটা ভালোওবেসেছেন। তিনি বলতেন, সবার সঙ্গে একসাথে গাইতে পারাটা একটা বড়ো ব্যাপার, বিশেষ কিরে সেই গানগুলো যেগুলো ন্যায়ের কথা, ইনসাফের কথা বলে। পিট বিশ্বাস করতেন, গান আসলেই মানুষদের বদলাতে পারে এবং পৃথিবীটাকে ভালোভাবে বসবাসযোগ্য করে তুলতে পারে।
‘ওল্ড পিট’ (এভাবেই তিনি তখন নিজেকে পরিচয় দিতেন) বেস্ট ট্র্যাডিশনাল ফোক এলবামের জন্য গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জেতেন ৮৯ বছর বয়সে। ব্রæস স্প্রিংসটিন, আরো ১২ জন মিউজিশিয়ানকে নিয়ে ‘উই শ্যাল ওভারকাম: দ্য সিগার সেশনস্’ নামে রেকর্ড বের করেন। এটা পিটের মিউজিকের প্রতি ট্রিবিউট ছিল। এই অ্যালবামের গান নিয়ে ব্রæস স্প্রিংস্টিনের ওয়ার্ল্ড ট্যুরে স্টেডিয়ামগুলোতে উপচে পড়া ভিড় হতো।
আলোচক বলেন, পিট বিনয়ের সাথে এইসব প্রাপ্তি গ্রহণ করেছেন। ফেইম এবং অ্যাটেনশন — এই দুই জিনিস কখনোই পিটের লক্ষ্য ছিল না। পিট চাননি তাকে হিরো বা সুপারস্টার বানিয়ে লোকজন পূজা করুক। তিনি চেয়েছিলেন — আমেরিকানরা যেন বুঝতে পারে, যে মহৎ কিছু অর্জনের সক্ষমতা তাদের আছে এবং গানের মতো একটা সাধারণ জিনিস দিয়েও তা অর্জন করা যায়।

২০০৮ সালে বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ওয়াশিংটন ডিসির লিঙ্কন মেমোরিয়ালে, ব্রæস স্প্রিস্টিনের সাথে পিটকে গাইবার অনুরোধ জানান ওবামা। সেটা ছিল ওবামার অফিস গ্রহণের দুই দিন আগে। পিটের নাতি টাও-রড্রিগেজ-সিগারও এতে যোগ দেয়। তারা সবাই মিলে গায় উডি গাথরির সেই গান — দিস ল্যান্ড ইজ ইয়োর ল্যান্ড। মিলিয়ন মিলিয়ন আমেরিকান টেলিভিশনে উপভোগ করেন “ওল্ড পিটে”র গান।
পিটের শেষ কনসার্ট করার কথা ছিল কার্নেগি হলে আর্লো গাথরির সাথে। তখন তিনি বাসাতেই সময় কাটাতেন তাঁর সন্তান, নাতি নাতনিদের সাথে। ২০১৩ র ডিসেম্বরে বীকনে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সেলেব্রেশনে একটা স্পেশাল মার্চের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পিট। এটা জানুয়ারির ২০ তারিখ, ২০১৪ তে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেদিন সেটি হয়, সেদিন আর পিট সেখানে থাকতে পারেননি। শত শত মানুষ এসেছিল মার্চে। তাঁর শরীর খুব খারাপ ছিল। প্যারেডের পরদিন পিট নিউইয়র্ক সিটির হাসপাতালে ভর্ত্তি হন। পিট শান্তিপূর্ণ মৃত্যুবরণ করেন ২০১৪ সালের ২৭শে জানুয়ারি।
মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, পিটের সামগ্রিক জার্নিকে একটা শব্দে ব্যাখা করা যায়: পার্টিসিপেইট। আর পিটার, পল ও মেরির গাওয়া, নোয়েল পল স্টুকির লেখা একটা গানে এর সারবস্তু পাওয়া যায় —
“দেয়ার অলওয়েজ ওয়াজ দিস মোমেন্ট
কাইন্ডা হার্ড টু আন্ডারস্ট্যান্ড
হোয়েন দ্য মিউজিক বিকেইম বিগার দ্যান দ্য ম্যান।’
আলোচক বলেন, লেখক উইঙ্কলার যে মানুষটির গল্প বলেছেন, সেটি আর একক ব্যক্তির গল্প থাকেনি। হয়ে উঠেছে একটি জাতির-একটি পৃথিবীর গল্প, যে গল্পের অন্যতম নায়ক ব্যাঞ্জো হাতে এক লোকগায়ক।
মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, আসরে আলোচিত বইয়ে উত্তর খোঁজা হয়েছে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের। ১। পিট সিগারের আকর্ষণ-ক্ষমতার উৎস কী? ২। তিনি কেমন করে সারা পৃথিবীর মানুষের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছেন এবং ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন? এবং ৩। গান কেন এতটা শক্তিশালী মাধ্যম?
আলোচকের প্রাণবন্ত আলোচনায় উপস্থিত শ্রোতারাও এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে ফিরেছেন এবং পেয়েছেন। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে পিট সিগারের ওপর ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। বিশ শতকের এই মহান শিল্পীর জন্মশতবর্ষে পাঠশালার পক্ষ থেকে সবাই মিলে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি গেয়ে অভিবাদন জানিয়ে আসরের সমাপ্তি টানা হয়।