খুরশীদ শাম্মী

ভারতের ‘নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন ২০১৯’ মূলত বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতে আগত বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়ার জন্যই এই আইন। এর মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধিত হলো। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইনে সা¤প্রদায়িকতা খুবই স্পষ্ট।

এ নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই ১৯৪৭ এর দেশভাগের ইতিহাস সামনে এসে দাঁড়ায়। শোষক বৃটিশদের রাজত্ব থেকে মুক্ত হলেও ধর্মের কারণেই একত্রিত থাকতে ব্যর্থ হয়ে তখন দু’টো দেশের জন্ম নিয়েছিল এবং ধর্মের চাদর প্যাঁচিয়ে তাদের নাম হয়েছিল হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান। সেই থেকে আজ অবধি দেশ দু’টোতে যত রাজনৈতিক মুভমেন্ট হয়েছে প্রায় সবকিছুতেই দেশ দু’টোর নামকরণের সার্থকতা প্রমাণিত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতেও এমন সা¤প্রদায়িক নাম দু’টো এখনও যেখানে টিকে আছে, সেখানে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন পাশ করা কি অলিখিত কিন্তু প্রচলিত আইনকে লিখিত ও দলিলবদ্ধ করা ছাড়া অন্য কিছু? এর মধ্যে কি নতুনত্ব আছে কিছু?
ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো দেশের নামই আসুক না কেন, আছে বিভাজন। আছে সা¤প্রদায়িকতা। আছে কোলাহল। আর আমরা সবাই এর জন্য দায়ী।

উদাহরণ স্বরূপ, বাংলাদেশের সাংবিধানিক রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতির একটি কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে সরকারের সবকিছু শুরু হয় “বিসমিল্লাহির রহমানের রহিম” দিয়ে এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম।
হ্যাঁ, বুঝলাম, বাংলাদেশ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ। কিন্তু দেশে অন্যান্য ধর্মের নাগরিকও তো আছে। তবুও বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, শপিংমলসহ পাবলিক প্লেসগুলোতে মুসলমানদের অগ্রাধিকার। প্রায় সবগুলো স্থানে আছে ওজুর ব্যবস্থা ও নামাজঘর, অর্থাৎ মুসলমান নাগরিকদের জন্য দৈনিক ইবাদত করার সুযোগ সম্পূর্ণভাবে খোলা। আর সেই সুযোগে সরকারী অফিস, হাসপাতাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকান, রেস্তোরাঁগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ কখনো নোটিস লিখে আবার আবার কখনো নোটিস ছাড়াই নামাজের জন্য বিরতি নিয়ে থাকে। নামাজ আদায় কালে তারা সকল ধর্মের ক্রেতাদের ক্রেতাসেবা থেকে বঞ্চিত করে।

প্রচলিত ভাঙা ভাঙা এগুলোর কিন্তু কোনো লিখিত নিয়ম কিংবা আইন নেই। যদ্যপি এগুলো সা¤প্রদায়িকতা ছাড়া ভিন্ন কিছুও নয়। তথাপি সাধারণ মানুষ চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ কেবলমাত্র তখনই এগুলোকে সা¤প্রদায়িকতা ভেবে আন্দোলন করবে যখন এগুলোকে লিখিত আইনে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। অথচ সচেতন মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগুলোকে সূচনা লগ্নেই উপড়ে ফেলতে পারে।
আমরা (যারা উত্তর আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা উন্মুক্ত সংস্কৃতির দেশে বসবাস করছি) উন্নত বিশ্বের এমন এক কিনারে এসে বসবাস করছি, যেখানে হিপোক্রেসির অন্তরালে মানুষ হিসেবে নিজের সত্তা নিয়ে চলতে পারা যায়। তবে ইচ্ছে করলে সা¤প্রদায়িকতার সমুদ্রের ঢেউ উপলব্ধি করা যায়, আবার ইচ্ছে করলে শুধু শান্তি দেখা যায়। দেখার জন্য চোখ দরকার, আর উপলব্ধির জন্য দরকার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভব শক্তি। হ্যাঁ, যা বলতে চাচ্ছিলাম, এখানেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসীদের আশ্রয়ের আবেদন নাকচ হয়ে যায় এবং তাদের জোর করে বহিষ্কার করা হয়। আবার অ্যামনেস্টি অর্থাৎ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে বিভিন্ন শর্তে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ইমিগ্রেশনের সুযোগ দেয়া হলেও সেখানেও বাদ পড়ে যায় অনেকে। এই উন্নত দেশগুলোতে যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন পালন করা হয় মহা ধুমধাম করে। ঐদিন সরকারী ছুটি থাকে। সবকিছু বন্ধ থাকে। উৎসবের জোয়ার বয়ে যায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। এছাড়াও ইষ্টার মানডে, গুড ফ্রাই ডে, ইত্যাদি। খ্রিস্টান ধর্মের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম পালনে এইসব দেশে কোনো প্রকার নিষেধ নেই। গীর্জার মতো মসজিদ, মন্দিরও রাস্তার মোড়ে মোড়ে। তবে অন্য কোনো ধর্মের বিশেষ দিনে সরকারী ছুটি থাকে না। অথচ ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশে বড়দিন পালন করার জন্য সরকারী ছুটি থাকে।

ফিরে আসি আবার মূল আলোচনায়, ভারত হিন্দু অধ্যুষিত দেশ। আর বিজেপি ওই দেশের একটি হিন্দুত্ববাদি দল এবং সেই দলের প্রধান নরেন্দ্র মোদী ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাত্রা শুরুতেই এই নরেন্দ্র মোদী গোমাংস নিষেধ করেছিল ভারতে। সুতরাং নরেন্দ্র মোদীর মতো সা¤প্রদায়িক মানুষের থেকে অসা¤প্রদায়িক কিছু আশা করা বোকামি। হিন্দুস্তান যদি মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো থেকে আগত ও আশ্রিত শুধুমাত্র অমুসলিম নাগরিকদের নিজ দেশে নাগরিকত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তবে ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য নাগরিক অধিকার আমার কিংবা আমার মতো ভারতের নাগরিক নয় এমন মানুষদের নেই। কেননা সিদ্ধান্তটি ওই দেশের একান্ত নিজস্ব। তবে, হ্যাঁ, এমন সা¤প্রদায়িক সিদ্ধান্তকে নিন্দা জানাতে পারি। সে অধিকার আমাদের সবার আছে। যতই দেশ ভাগ হোক না কেন, পৃথিবী কিন্তু একটাই। যতই ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কেন্দ্র করে মানুষকে বিভাজিত করা হোক না কেন, মানুষ সব একই। সুতরাং ভারতের সা¤প্রদায়িক নাগরিকত্ব আইন অবশ্যই নিন্দনীয়।

ধর্ম যেহেতু রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই না, আর সাধারণ মানুষ ধর্মের ক্ষেত্রে অন্ধ। সেক্ষেত্রে চতুর রাজনৈতিক নেতাগণ এর ফায়দা লুটে নেয়। বিশ্ব পরিবর্তনের পরতে পরতে তা প্রমাণিত হয়েছে। আর এর থেকে মুক্তির উপায় আমাদের অর্থাৎ মানুষে মানুষে ঐক্য। যেদিন বিশ্বের সকল মানুষ মনে প্রাণে বিশ্বাস করবে, ধর্মের আগে মানুষ। ধর্মের আগে জীবনের নিরাপত্তা। ধর্মের আগে মানবতা, সেদিন আপনাআপনি বিশ্বের সা¤প্রদায়িকতা দূর হবে।
ভারতের তরুণ ও যুব সমাজসহ সকল গোত্র, ভাষা ও ধর্মের জনগণ আইনটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তারা ফুঁসে উঠেছে একপ্রকার। জয় হোক অসা¤প্রদায়িক চেতনার। এই চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বের সকল দেশের, সকল ভাষার, সকল বর্ণের মানুষের মাঝে। আমরা প্রত্যেকে নিজে সচেতন হই এবং অন্যকে সচেতন হতে সহযোগিতা করি যেন সা¤প্রদায়িকতা বিশ্বের কোথাও আর বিস্তারিত হতে না পারে। সকল প্রকার সা¤প্রদায়িকতা যেন বিনষ্ট হয় সূচনা লগ্নেই।
খুরশীদ শাম্মী: টরন্টো, অন্টারিও