সাজ্জাদ আলী
দাদীবাড়ির উঠোনে খোশগল্পের এই আসরটি নিয়মিতই বসে। কাউকেই ডাকতে হয় না, সন্ধ্যাবেলা নিজ গরজেই সবাই চলে আসে। যুদ্ধের বাজারে গাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষদের কাজকর্মের তেমন সুযোগ নেই। তারপরও ছুটো কাজ হিসেবে কেউ কিষান বেঁচে, কেউ গরুর কাঁধে জোয়াল ঝুলিয়ে নিজের দু’কাঠা জমি চাষ করে রাখে। আবার কেউ ঘরামি ডেকে চালের ছন খানিকটা পুরু করে, কেউ গোবরের ঘসি মুঠোদলা করে রোদে শুকাতে দেয়, কেউবা পুস্কুর্নিতে পলো চাবায়ে আধা খালই টেংরা-পুটি-টাকি মাছ ধরে; আর গাঁয়ের অকম্মা-ভাদাইম্যাগুলা বুলবুলিকে এক ঝলক দেখার জন্য মীরবাড়ির সামনের রাস্তা দিয়া দিনে দশবার টহল দেয়।

তবে দিনভর যে যাই করুক না কেন সন্ধ্যায় সবাই ঈমান দাদার তামুক টানার আসরে জড়ো হবেই। এই যেমন কাজী বাড়ির আকু, আকমাল ঘরামি, তালবাড়ির সিরাজ, লুচ্চা কাঞ্চন, শংকর মিস্ত্রি, টাউট মোস্তফা, ইদ্রীচ বয়াতী, ছেকন সরদার, রইস্যা গাছি, এমন আরো অনেকেই সে বৈঠকের নিয়মিত সভ্য। তামাক টানতে টানতে সান্ধ্যকালীন এই গপসপই গেঁয়ো জীবনের একমাত্র বিনোদন। কত রকমের কথা যে সেখানে উঠে তার কি আর সাকিন আছে! কার ছাওয়াল ভারতে গ্যাছে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতি, রাক্ষুসে বোয়াল মাছে কার পুকুরের অন্য সব ছোট মাছগুলান খাইয়া শেষ করলো, কার পালানের মাচার কদু আড়াই হাত লম্বা হইছে, ইত্যাদি সব বকর বকর। আর সঞ্চালক বলেন, বা বক্তা বলেন; রাশভারি ঈমান দাদাই আসরের মধ্যমনি। তাঁর পছন্দের বাইরে কেউ টু-শব্দটি করলে ঠাটা পড়ার শব্দসম ধমক জুটবে তাঁর কপালে।

ওদিকে ছেকন সরদারকে ঈমান দাদা চিটাগুড় আর মিশ্রী কিনতে রামদিয়ার হাটে পাঠাইছে। সন্ধ্যা হয়ে এলো তবু তার ফেরার নামটি নাই! মুলিবাঁশের চাটাই বিছাইয়া ঈমান দাদা মতিহারি তামাকের ডাটা ও পাতা ধরালো ছ্যান দিয়া কুঁচি কুঁচি করে কাটছেন। হাট থেকে চিটাগুড় এলেই তামাকের কুঁচি সেই গুড়ের সাথে চটকায়ে চটকায়ে মাখাবেন তিনি। তাঁর মাখানো তামাকের স্বাদের সুখ্যাতি দশ গাঁয়ের লোকে জানে। কল্কিতে সেই তামাক ভরে একবার যে সুখ টান দিছে, তার আবারো এই আসরে ফিরে আসতে হবে শুধু তামাক টানার লোভেই।

বাড়ির দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথের শতবর্ষী রেন্ট্রি গাছের তলায় পৌঁছেই ছেকন সরদার গলা ছেড়ে ডাক পাড়লো, ও দুদু আইসা পড়ছি। অবদমিত তামাকের নেশায় ততক্ষণে ঈমান দাদার মাথা গরম! চিৎকার পেড়ে বললেন,
-আরে হারামখোর, চিটাগুড় কিনতি তুই কি দর্শনা’র কারখানায় গিছিলি? রামদিয়া যাইতে আসতে এত সময় লাগে রে?
-আর কইয়ো না দুদু! আইজ তো হাটই মেলে নাই!
-ক্যা, কি ওইছে?
-ভাইট্যাপাড়া নাকি মেলেটারী আইছে। ওয়ারলেস ইস্টিশনে ঘাটি গাড়ছে। যারে সামনে পাইত্যাছে তারেই গুলি। ফাকির মতন মানুষ মাইরা ফালাইত্যাছে! দুএক দিনের মইধ্যে নাকি পাঞ্জাবীরা গাঁয়ে গাঁয়ে ঢুকবো, বাড়িঘর জ্বালাইয়া দিবো। হাটুইরাগো চোখেমুখে ডর! মোড়ে মোড়ে জটলা, কি করন যাই তাই কইত্যাসে সবাই।

-তুই চুবো! আধা বলদা কোহানকার। খালি গুজব ছড়াস! সেদিন তুই খোঁজ আনলি সোনাডাঙ্গা খালে নাকি এক সাথে দড়ি দিয়া বান্দা ১১ডা গুলি খাওয়া লাশ ভাইসা যাইতাছে। ওমা, যাইয়া দেহি লাশ মোটে তিনডা।

খেঁজুরের পাতায় বোনা বিশাল দুটো পাটিতে বসে তামাক টানার অপেক্ষায় সবাই। ধমক খেয়ে চুপসে যাওয়া ছেনকও পাটির এক কোনে জায়গা পেয়েছে। কুচি তামাকের স্তুপের উপরে হাড়ি কাঁত করে ঈমান দাদা চিটাগুড় ঢালছেন। এমন সময় ভেতর বাড়ি থেকে দাদীর গুরুগম্ভীর উচ্চকন্ঠ ভেসে এলো। ওই ঈমান হাটের থেইকা আমার মিশ্রী আনছে? দাদীর হাকে সচকিত ঈমান দাদা দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য! হাত থেকে গুড়ের হাঁড়ি তামাক কুচির উপর পড়ে গেল! বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, হাঁ দাদীআম্মা আনছে তো। লুঙ্গির কোছায় হাত মুছে মিশ্রীর ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে বেকি ব্যাড়া পেরিয়ে তিনি ভেতর বাড়ি দৌঁড়ালেন। প্রতিদিন গোলাপজল মিশানো এক গ্লাশ মিশ্রীর শরবত পান করা দাদীর ৫৫ বছরের অভ্যাস।

ঈমান মোল্যা জোতদার দাদীর খাস লোক। আধুনিক ভাষায় বলা যায় তাঁর স্টেট ম্যানেজার। অক্ষরজ্ঞানহীন এই মানুষটির মধ্যে গ্রামীণ বিষয়গুলো দ্রুত বুঝে উঠার সহজাত সক্ষমতা রয়েছে। রাতে কতটুকু বৃষ্টি হলে সকালে জমিতে লাঙ্গল চলবে, সে জ্ঞান তাঁর প্রখর। কোন জমিতে আউস আর কোন জমিতে আমন ধান ভাল ফলবে, সে তাঁর জানা। কঁচুরীপানা সরিয়ে পুকুরের পানিতে দুতিনটা ডুব দিয়ে কাঁদা হাতড়েই বলে দেবে সেই পুকুরে ওই বছরে কি পরিমান মাছ পড়েছে। তাঁর লাঠির সামনে দাঁড়ায়, এমন সাধ্য এ তল্যাটে কার আছে? মস্ত পালোয়ান তিনি! বন-বাদাড় থেকে বেত কেটে এনে ধারালো ছুরিতে ফালি ফালি করে ফেড়ে নিজের হাতে ঢাল বুনবে। ঝাড়ের পাকা বাঁশটি কেটে এক বেলার মধ্যেই চেছে ছুলে লোহার ফলা আগায় গেঁথে দশটি শড়কী বানিয়ে আটি বেঁধে রাখবে। গ্রাম্য কাইজ্জায় তাঁর সম লাঠিয়াল-বীর দশ গাঁয়ে নাই। এহেন ঈমান মোল্যার আনুগত্য ও কর্মদক্ষতা ছাড়া দাদীর জোতদারী অচল হয়ে পড়তো।

দুহাতের কব্জি দিয়ে ডলে ডলে চিটাগুড় আর তামাক মিশাচ্ছেন ঈমান দাদা। যত মিশবে, তামাক-ধুয়া ততই কড়া হবে। মোস্তফাকে পুকুর ঘাটে পাঠাইছেন কল্কিটা ভাল করে ধুয়ে আনতে। অপেক্ষমাণ তামাকসেবীরা নানা কথায় সময় পার করছে। মোক্তার ফকির বলে উঠলো, আড়কান্দির সালাম সর্দারের ধানিজমি দাদীআম্মার থেকে কিছু বেশিই হবে, কি কও তোমরা? কিন্তু উপস্থিত কেউই তার এ কথায় সায় দিলো না।
মোক্তারঃ আইচ্যা আমার কথা সত্যি না মিথ্যা তা তোমরা প্রেমাণ কইরা দেহো। সামনের হাটবারে হাটে যাবার সময় সালাম সর্দারের খেড়ের পালার সাইজটা ভাল কইরা পরখ কইরবা। আমার তো মনে হইচে দাদীআম্মার খেড়ের পালার থ্যাইক্যা সর্দার সাবের পালাটা খানিক বড়ই হইবো।

আকু কাজীঃ খেড়ের পালা বড় হইলেই জমি বেশি হয় না, বুইচ্ছ। দাদীআম্মার পাঁচজোড়া হালের বলদ, সর্দার সাবের কিন্তুক ৪ জোড়া।
আকমল ঘরামিঃ কাজীর বেটা ঠিকই কইছে। ৫ জোড়া হালের গরু দিয়া জমিন চাষের পরেও দাদীআম্মার প্রেত্যেক জষ্টিমাসে চাষের মরশুমে হাজার টাকার হাল-গরু ভাড়ায় কেনোন লাগে। তাইলে এবার বোঝ, কার জমি-জিরাত বেশি?
ইদ্রীচ বয়াতিঃ আসল কথাডা বাদ দিয়া তুমরা এত কথা কইতাছো ক্যা কও দেহি? দাদীআম্মা যে বরগাইতগো খ্যাড় বাড়ি উঠায় না, সেইডা তুমরা জানো না? যদি উঠাইতেন তয় খেড়ের পালাডা কত্ত বড় হইতো একবার ভাবোতো মিয়ারা!

ওই তোরা থামবি ? ধমতে উঠলেন ঈমান দাদা। জানোস না সর্দার সাবেরা দাদীআম্মাগো আপনার লোক, আত্মীয়। হ্যাগো মইধ্যে তুলুনা কইরতোছোস ক্যা? বাজান কাঞ্চন, ওই বেড়ায় দ্যাখ হুক্কাগুলান ঝুলানো আছে। ওহান তে নতুন হুক্কাডা নিয়া আয় তো বাপ। ঝোলানো ৩টা হুক্কার মধ্যে কাঞ্চন ”নতুন“ কোনটা তা বুঝে উঠছে না। গলা চড়িয়ে বললো, ছোট দুদু কোনডা নতুন? সগগোলডাই তো পুরান মনে হইত্যাছে। নতুন হুক্কা কবে কিনলা? আরে হারামজাদা, গত হপ্তায় ওড়াকান্দির বারুনির থন কিনছি। বলতে বলতে বিরক্ত ঈমান দাদা নিজেই উঠে গিয়ে তাঁর “নতুন হুক্কাটা” বেড়া থেকে খুলে আনলেন।

মাটির মালসার মধ্যে গোবরের জ্বলন্ত ঘসি রক্ত বর্ণ ধারণ করে আছে। ঠিক যেন কয়লার আগুন। ঢাউস সাইজের কল্কিটায় মাখানো তামাক ভরে দুদলা আগুনে ঘসি সযতনে কল্কির উপরে রাখলেন। অতপর ঈমান দাদা গাল ফুলিয়ে ফু দিয়ে দিয়ে তামাককে তপ্ত করার চেষ্টা করছেন। উপস্থিত সভাসদরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাই করছে। তারা বুঝতে চেষ্টা করছে যে, এই পুরোনো হুক্কাটাকে ঈমান মোল্যা “নতুন হুক্কা” বলছেন কেন?

এ প্রসঙ্গে ফিরছি আবার। তার আগে শহরে বড় হওয়া আমার পাঠক বন্ধুদের জন্য গ্রাম্য হুক্কার নির্মাণ কাঠামোটা একটু বলেনি। আমার মতো গাঁয়ে বেড়ে উঠা বন্ধুরা যে হুক্কা চেনেন, সে আমি জানি। দেখুন দেশী হুক্কার মাত্র দুটোই অঙ্গ। ঝানু নারকেলের একটি খোল, আর কাঠের এক দেড় ফুট লম্বা একটি নল। গাঁয়ের লোকেরা নলটিকে “নলচে” বলে। তো এই খোল আর নলচে নিয়েই হুক্কা। দোকান থেকে হুক্কা কিনলে আপনি যুক্ত অবস্থায় এই খোল আর নলচেই পাবেন। তবে চাইলে শুধু খোল অথবা নলচেও পৃথকভাবে কিনতে পারেন।
কল্কিকে হুক্কার অংশ হিসেবে গন্য করা হয় না। কারণ খোল-নলচে ছাড়াও তীব্র নেশাখোর এবং গাঁজাখোরেরা শুধু কল্কি থেকেই সরাসরি কড়া ধৃ¤্র-নেশা সেবন করে থাকেন।
যাই হোক, পুরোনো একটি হুক্কাকে কোন বিবেচনায় “নতুন” বলা হচ্ছে তা নিয়ে উপস্থিতদের মধ্যে ঘুজুরঘুজুর ফুসুরফুসুর চলছে। কিন্তু কেউই প্রকাশ্যে তা ঈমান দাদাকে জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ব্যঞ্জন প্রস্তুত, সেবন শুরু হয়েছে। ঈমান দাদার হুক্কা টানার নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। নারকেলের খোলে মুখ লাগিয়ে ছোট ছোট করে ৫/৭টা টান দেবেন, তারপরেই ৫০/৬০ সেকেন্ড ব্যাপী দীর্ঘ সুখ টান। ধীরে ধীরে এই সুখ টানের ধোঁয়া ছাড়বেন এবং কাশতে থাকবেন। কাশি থামতেই আবার ছোট টানগুলো শুরু। আমাদের আকু কাজী বরাবরই ফাজিল এবং ঠোটকাটা। খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে সে জিজ্ঞাসা করে বসলো, আইচ্যা ছোট নানা এই হুক্কাডা আপনারে অন্তত দশ বছর ধইরা টানতে দ্যাখতাছি। এইডারে আপনে নতুন কন কোন আক্কেলে?

ঝাকড়া চুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে নিজের চুল যেন নিজেই ছিড়বেন! রক্ত উঠা চোখে আকুর দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকালেন ঈমান দাদা! আজ যেন আর রক্ষা নেই। এই বুঝি বিস্ফোরণ ঘটে! কিন্তু না নিজেকে শান্ত রেখে হুক্কাটি ইদ্রীচ বয়াতীর হাতে দিতে দিতে শান্ত গলায় বললেন, তোর মাথামুটা বুদ্দিতে হুক্কার বয়স তো ১০ বছর বোঝনেরই কথা। ওরে গাধা, ২ বছর আগে মেলা থেইক্যা “নতুন খোল” কিনা পুরানো খোলডা ফালাইয়া দিছি। আর গেল হপ্তার বারুনীর মেলা থেইক্যা “নতুন নইলচ্যা” কিনা লাগাইছি! এই যে হুক্কার খোল আর নইচ্যা দুইডাই বদলাইলাম, তবুও হুক্কাডারে তোর নতুন মনে হয় না? কি আর কমু তোরে!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)