ডঃ বাহারুল হক : আমেরিকার ডালাস শহরের বাসিন্দা আমার ভাই। আমি এবং আমার স্ত্রী ডালাসে আমার ভাইয়ের বাসায় ছিলাম কিছুদিন। ডালাস থেকে আমাদের টরন্টো ফিরা হবে শিকাগো হয়ে। শিকাগো শহরে একদিন থাকার ব্যবস্থা রেখেই আমরা আমেরিকান এয়ার লাইন্সে ডালাস থেকে টরন্টো ফিরার টিকেট নিয়েছি। শিকাগো আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম শহর। মিশিগান লেকের তীরে শিকাগো নদীর মোহনায় মাথা উঁচু করে এ শহর দাঁড়িয়ে আছে সেই ১৭৮০ সন থেকে। শিকাগোতে দিনের সবটুকু সময় যাতে অতিবাহিত করতে পারি সে উদ্দেশ্যেই আমরা ডালাস ছেড়েছি সুর্য্য উঠার আগে। ডালাস থেকে শিকাগো দুই ঘন্টার বিমান পথ। ভোর পাঁচটায় আমেরিকান এয়ার লাইন্সের একটি শার্কলেট বিমান তার যাত্রীদের নিয়ে ডালাসের ডালাস ফোর্ট ওয়ার্থ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ত্যাগ করলো। আমাদের বিমান দুই ঘন্টা পর পৌঁছলো শিকাগোর আকাশে তারপর ধীরে ধীরে নামলো শিকাগোর ও’হেয়ার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। বিশাল এক এয়ারপোর্ট। এত বড় এয়ারপোর্ট কমই দেখা যায়। এয়ারপোর্টে বসে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কোথায় যাবো, কীভাবে যাবো।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার আগে আমরা আমাদের ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। ভাইয়ের বৌ আমাদের দুই জনের জন্য যে পরিমান খাদ্যসামগ্রী দিয়েছে তা দিয়ে অনায়াসে পাঁচ জনের চলে। দুপুরের খাবারও সে দিয়ে দিয়েছে। সেটাও যে বিপুল পরিমান তা খাদ্যসামগ্রীর ওজন দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সব কাঁধে নিয়ে আমরা নেমে গেলাম এয়ারপোর্টের আন্ডারগ্রাউন্ড রেল স্টেশনে। স্টেশন এবং রেলগাড়ি দেখে বুঝলাম সবকিছু বহু পুরানো। রেলগাড়ি আমাদের সাবওয়ের রেলের মত, তবে অতটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন নয়। কোন বুথ নাই। কোন কর্মচারী- কর্মকর্তার দেখাও নিচে পেলাম না। টিকেট কেনা, টিকেট দেখা সব কর্ম-কান্ড উপরে। নিচে রেল স্টেশনে গিয়ে বুঝলাম এ জায়গাটা একেবারে বিচ্ছিন্ন; কিছু দেখার কেউ নাই। রেলের লোক বলতে শুধু রেলের অপারেটর। তারা রেল নিয়ে আসছে আবার রেল নিয়ে যাচ্ছে। চব্বিশ ঘন্টা রেল আসা যাওয়ার মধ্যেই আছে। সেখানে বাতির আলোও কম। কেমন যেন একটা পরিবেশ! রেলের জন্য প্লেটফরম-এ দাঁড়িয়ে আছি। কেমন যেন একটা গন্ধ! চারদিকে তাকালাম। কোন ওয়াশরুম চোখে পড়লো না। কোন সিকিউরিটি পার্সনও নাই। মনে মনে ভাবলাম- যাদের ইমার্জেন্সি তারা বোধ হয় কোথাও দাঁড়িয়ে কর্মটি সেরে ফেলে। সেই জন্য এরুপ গন্ধ।

যাইহোক, রেল আসলো। আমরা উঠলাম। যাত্রী বেশী নাই। আমাদের পাশে বসলো তিনটা ছেলে। কী নিয়ে যেন তারা খুব হাসাহাসি করছে। তাদের ভাষা বুঝি না। পরে কথা বলে জানলাম তারা ইটালিয়ান। ইটালি থেকে এসেছে বেড়াতে। হঠাৎ তাদের একজন আমার কাছে জানতে চাইলো আমরা কোথায় নামবো। আমি ওয়াশিংটন বলার সাথে সাথে তারা হেসে উঠলো। আমি প্রশ্নমাখা অভিব্যাক্তি মুখে নিয়ে তাদের দিকে চেয়ে থাকলাম। তারা বললো- “আমরা কোথায় যাচ্ছি তুমি কী জান”? আমি বললাম – “তা আমি কীভাবে জানবো”? তারা বললো- “আমরা যাচ্ছি ক্যালিফোর্নিয়া”। আমি বললাম- “ক্যালিফোর্নিয়া? তাহলে এই রেলে কেন? এখান থেকেতো ক্যালিফোর্নিয়া বিমানেই চার ঘন্টার পথ”। তারা বললো- “এ ক্যালিফোর্নিয়া সে ক্যালিফোর্নিয়া নয়। এটা শিকাগোর ক্যালিফোর্নিয়া। এই ক্যালিফোর্নিয়ার দেখা মিলবে শুধু শিকাগোর আন্ডারগ্রাউন্ড রেলে। এই যেমন ওয়াশিংটন। এটা এই রেলের একটা স্টেশন। এই ওয়াশিংটন সেই ওয়াশিংটন নয়। তুমি যাবে ওয়াশিংটন আমরা যাচ্ছি ক্যালিফোর্নিয়া”। বলেই সবাই আবার হাসলো। আমিও হাসলাম তাদের সাথে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আমাদের রেল এসে থামলো ওয়াশিংটন। ওদেরকে বিদায় দিয়ে আমরা নেমে গেলাম ওয়াশিংটন স্টেশনে। ওদের ক্যালিফোর্নিয়া বেশি দুরে নয়। আর দুই স্টেশন পর এই ক্যালিফোর্নিয়া। ওয়াশিংটন স্টেশনে আমরা দুইজন ছাড়া আর কেউ নাই। আর কেউ নামেনি। ওয়াশিংটন স্টেশন থেকে কেউ রেলে উঠেছে কিনা জানি না। স্টেশনে রেলেরও কেউ নাই। সে মুহুর্তে স্টেশন একেবারে জনমানবহীন। কোন ওয়াশরুম নাই, কোন বুথ নাই। উপরে-উঠা নামার জন্য কোন এলিভেটর-এস্কেলেটর নাই। চারদিকে তাকিয়ে আমাদের গা ছম ছম করে উঠলো। এ কেমন পরিবেশ? আমাদের টরন্টোর কথা মনে পড়লো। কী সুন্দর সাব- ওয়ে আমাদের! স্টেশনের অন্য প্রান্তের দিকে হাঁটতে থাকলাম। পেয়ে গেলাম উপরে উঠার দুইটা পথ। দুই দিকে দুইটা সিঁড়ি পথ। একটার প্রবেশ পথে লেখা মেডিসন স্কয়ার; অপর দিকের প্রবেশ পথের উপর লেখা মিশিগান স্ট্রিট। আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম; কোন দিকের সিঁড়ি ধরবো? স্ত্রীকে বললাম- “দাঁড়িয়ে থাকি, আর কেউ নামে কিনা দেখি”। পরের রেলথেকে তিনজন নামলেন। তাদের থেকে জেনে নিলাম কোন দিকের সিঁড়ি বেয়ে উঠলে মিলেনিয়াম পার্কে যাওয়ার পথ পাবো। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকলাম।সিঁড়ি নোংরা। রাস্তায় উঠলাম। উঠে আকাশ দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। পথ ঘাট ভেজা। বুঝলামএকটু আগেই বৃস্টি হয়েছে। আবারো হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। আমরা হাঁটতে থাকলাম। রাস্তাততটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন নয়। পথে পথে দেখা মিললো ভিক্ষাজীবির। টরন্টোর ভিক্ষাজীবিরাকাউকে বিরক্ত করে না, কিন্তু শিকাগোর ভিক্ষাজীবিরা অন্যরকম। তাদের ভিক্ষা চাওয়ার কায়দাততটা পরিমার্জিত নয়। এয়ারপোর্টে ব্রেকফাস্ট করার পর চা বা কফি খাওয়া হয়নি। তাই সেরকম দোকান খুঁজতেছিলাম। পেয়ে গেলাম স্টারবাক। নামযাদা কফি শপ। দুই জন সেখানে বসেকফি খেলাম। ইতিমধ্যে আকাশে মেঘের পরৎও কিছুটা পাতলা হলো। আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম।রাস্তার দুই পাশে উঁচু উঁচু ভবন। পুরানো ভবনগুলোর স্থাপত্যশৈলী এবং সেগুলোর উপর অলংকৃতট্যারাকোটা কাজ বেশ দৃস্টি নন্দন। সে সকল পুরানো ভবনের স্থপতিরা যে ইংরেজ ছিলেন তাভবন গুলো এক পলক দেখেই বলা যায়। প্রায় পনের মিনিট হাঁটার পর আমরা পৌঁছে গেলাম মিলেনিয়ামপার্কের সামনে। মিলেনিয়াম পার্ক দেখার জন্য আমরা শিকাগো এসেছি বললে খুব একটা ভুল বলাহবে না। এখন উইন্টার। পার্কের সব বৃক্ষই পত্রঝরা প্রকৃতির বলে উইন্টারে তারা পত্রহীনবিবর্ণ। ফলে পার্কটাও জৌলশহীন। এদিকে আবহাওয়াও ভালো নয়। প্রচন্ড ঠান্ডা মেঘলা।এরকম আবহাওয়া দর্শক আগমনে সবসময় একটা প্রতিবন্ধক। সামারে যেখানে দর্শকের ঢল নামেসেখানে এখন অন্য চিত্র। তারপরও দর্শক একেবারে কম নয়। এখানে বলে রাখি- এ পার্কেরঅন্যতম আকর্ষণ এখানকার ক্লাউড গেট । বিন আকৃতির এ গেটটির পরিচয় এখন শুধু বিন। সবারপ্রিয় বিন। এটি একটি পাবলিক ভাস্কর্য্য। এটির নির্মাতা ভারতীয় বংশোদ্ভত বৃটিশ শিল্পীঅনিশ কাপুর। স্টেইনলেস স্টীলের পাত দিয়ে একশত দশ টন ওজনের এই বিন তৈরী করতে শিল্পীসময় নেন দুই বছর। বিনটি পার্কে দৃশ্যমান হয় ২০০৬ সনে। তখন থেকেই বিনটি অগনিত দর্শকটানছে শুধু আমেরিকা নয় সারা বিশ্ব থেকে। বিনটির আশে পাশে যে সব ভবন আছে সেগুলোর স্বচ্ছপ্রতিবিম্ব পড়ে থাকে বিনের গায়ে। সে এক অপরুপ দৃশ্য। না দেখলে বুঝা যাবে না। বিনটিরসৌন্দর্য্য ভাষায় প্রকাশ করা সহজ নয়। প্রতি মাসে একবার এটি টাইড দিয়ে পরিস্কার করাহয় এবং তাতে টাইড লাগে চল্লিশ গ্যালন। বিনটি এখন শিকাগোর প্রতীক। বিনের চার পাশেহাঁটা যায়। সব দর্শক সেখানে গিয়েই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরাও হলাম। অনেকছবি তুললাম আমরা। ছবি তোলার সাধ আর মেটেনা। দুপুর হয়ে গেল। ঠান্ডার মধ্যে মিলেনিয়ামপার্ক দেখা হলো। ফলে আবারো চা / কফি খাওয়ার প্রবল ইচ্ছা জাগলো এবং আমরা কফি শপ খুঁজতেথাকলাম। ক্ষাণিক হাঁটার পর পেয়ে গেলাম একটা রেঁস্তোরা। তবে কফির দাম টরন্টোর টিম হরটন্সেরকফির দামের দ্বিগুণ। টোস্টেড গরম ব্যাগেল খাতে চাইলাম। পেলাম না। ব্যাগেল তারা বিক্রিকরে না। রেঁস্তোরা থেকে বের হয়ে আবার পথে নামলাম। এবার ধরেছি সে পথ যে পথ গেছে শিকাগোনদী তীরে ‘রিভারওয়াক’ প্রাঙ্গনে। নদী পার থেকে রাস্তা অনেক উপরে। ‘রিভার ওয়াক’ প্রাঙ্গনেযেতে হলে আমাদের অনেক সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে। তারপর আবার উঠা। কঠিন এক কাজ। আমরা আর‘রিভারওয়াক’ প্রাঙ্গনে গেলাম না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নিচে বহমান শিকাগো নদী দেখলাম।দেখে মনে হলো না আমরা তেমন সুন্দর কিছু দেখেছি। নদীর পানিই তো পছন্দ হয়নি। ময়লা পানি।বুড়িগঙ্গা বা তুরাগ নদীতে না হয় সারাক্ষণ নানা রকম তরল-কঠিন বর্জ্য পড়ছে। কেউ সচেতননা। কোন কিছু কারো নিয়ন্ত্রনে না বা ওসব দেখার কেউ নাই। কিন্তু এই শিকাগোতে নদীর পানিকেন ময়লা হবে? নদী দেখা আমার শখ। আমি বাংলাদেশের যে গ্রামে জন্ম গ্রহন করেছি, শৈশবঅতিবাহিত করেছি, সেখানে নদী কেন কোন রকম খাল বা ছরাও ছিলনা। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেদাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের গ্রাম। ফলে নদী দেখলে আমি ব্যকুল হয়ে যাই। যেখানেযাই আমি নদী খুঁজি। কানাডায় আমি বহু নদী দেখেছি। অন্টারিওর হাম্বার, ডন, অটোয়া, কারেন্ট;বৃটিশ কলাম্বিয়ার ভ্যানকুভার, ফ্রেজার, ইংলিশম্যান, স্যালমন, ইত্যাদি। এসব কোননদীর পানি শিকাগো নদীর পানির মত ময়লা নয়। শিকাগো নদীর এ হাল কেন? ভালো লাগলো দেখেযে এ নদী শিকাগোতে নৌ পথ হিসেবে ব্যবহ্রত হচ্ছে। যাত্রীবাহী ছোট বড় নানা সাইজের বোটজাহাজ দেখতে পেলাম নদীতে। আমরা আবার পথে নামলাম। পথে চলতে চলতে এবার দেখা মিললো ট্রাম্পটাওয়ারের। এটা ৫৮ তলা বিশিষ্ট এক বিশাল উঁচু ভবন। ভবনের গায়ে মাঝ বরাবর উঁচুতে ঞজ ট গ চ মস্ত বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে। এই টাওয়ারের মালিকআমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।এই টাওয়ারে আছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান‘ ট্রাম্প অর্গ্যানাইজেশন’-এর অফিস এবং ৩৩৯ কক্ষ বিশিষ্ট একটি ইন্টারন্যাশনাল হোটেল।এই টাওয়ার পার হয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে জন শেড একোয়ারিয়ামের। একোয়ারিয়ামদেখার ইচ্ছা বাদ দিলাম। কারণ এটা দেখতে কম পক্ষে দুই ঘন্টা সময় লাগবে। আমাদের হাতেআজ আর সময় নেই। আমরা ক্ষুধার্ত। আমাদের সাথে আছে বিরিয়ানি,কাবাব আর আমার ভাইয়ের বৌর নিজ হাতে তৈরী নানারকম খাবার। খালি পেটে এত সব খাবার কাঁধে বয়েনিয়ে পথে পথে হাঁটার কোন মানে হয়না। আগে কোথাও বসে খাবার খেয়ে ক্ষুধা নিবারন করতেহবে। তারপর অন্য কিছু ভাবা যাবে।