ফরিদ আহমদ

“বাঙালির মেয়ে হয়ে হোটেলে নাচবে?” পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করেন তাকে।
“ক্যান, আপনে আমারে খাওয়াইবেন? রাখবেন আপনার বাড়িতে? ঝি হইয়া কিন্তু থাকুম না, মেয়ের মতো রাখতে হইব। তাইলে আমি হোটেলে নাচুম না।”
নাচতে নিষেধ করার কারণে উপরের যে তেজি উত্তর দিয়েছিলো, সেটা এক বারো বছর বয়সী কিশোরীর উত্তর। দেশ বিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কোলকাতায় গিয়েছিলো তার পরিবার। জীবিকার তাগিদে এই মেয়েটা ওইটুকু বয়সে নাম লিখিয়েছিলো বিলাসবহুল হোটেলের ক্যাবারেতে। সেখানে নেচেই কষ্টকর জীবনকে সুখকর করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা নিয়েছিলো সে।

১৯৪৭ সালে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ভারত। তৈরি হয় এক কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের। দেশ ভাগের সাথে সাথে ভারতের দুটো প্রদেশও ভাগ হয়ে যায় তখন। এর একটা হচ্ছে পাঞ্জাব। আর আরেকটা হচ্ছে বাংলা। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা বঙ্গে বসবাস করা, একই ভাষায় কথা বলা, একই নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তার লোক, হঠাৎ করেই জানতে পারে দুটো আলাদা জাতে পরিণত হয়েছে তারা। শুধু তাই নয়, মাঝখানেও তৈরি হয়ে গিয়েছে এক দুর্লঙ্ঘনীয় সীমান্ত। শুরু হয় সীমান্ত পার হবার দুর্বার প্রয়াস। পশ্চিম প্রান্ত থেকে মুসলমানরা আসে পূর্বপ্রান্তে। আর পূর্ব প্রান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক হিন্দু চলে যেতে থাকে পশ্চিম প্রান্তে।

এই চলে যাওয়া হয় চিরতরে, ভিটেমাটি সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে। একদিন যারা জলভেজা সবুজ বনানীতে ঘেরা বাস্তুতে বসবাস করতো সুখে শান্তিতে, তারাই পাড়ি জমায় ধূসর এক অচেনা অঞ্চলের দিকে। রাতারাতি পরিণত হয় উদ্বাস্তুতে। কঠিন এক জীবন শুরু হয় তাদের। একদিন যার গোলাভর্তি ছিলো ধান, পুকুর ভর্তি মাছ, সেই লোক নিঃস্ব হয়ে কঠিন এক সংগ্রামে নামে ভিনদেশে। সেই অচিন ভূমিই নাকি তার নতুন দেশ, আর নিজের নাড়িপোতা ভিটে হচ্ছে পরদেশ।
পূর্ববঙ্গ থেকে কোলকাতায় যাওয়া উদ্বাস্তুদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে বাংলা সাহিত্যে খুব ভালো কিছু কাজ হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকো’, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, এইসব বই পড়লে পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বঙ্গে যাওয়া হিন্দুদের করুণ পরিস্থিতি বেশ খানিকটা অনুমান করা যায়। ঋত্বিক ঘটকও এই সময়টাকে তুলে ধরেছেন তাঁর অসাধারণ ফিল্ম ‘মেঘে ঢাকা তারা’-তে। পঞ্চাশের দশকের এক সীমান্ত অতিক্রমকারী বাঙালি পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এর কাহিনি। ছবির মূল চরিত্র নীতা নামের একটি মেয়ে। সে পরিবারের বড় মেয়ে। নতুন দেশে টিকে থাকার জন্য পড়ালেখা শেষ করার আগেই পরিবারের হাল ধরতে হয় তাকে। সংসার চালাতে চালাতে নিজের জন্য কিছুই করা হয় না তার। শেষমেশ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় সে। তাও সংসারের হাল ছাড়ার উপায় থাকে না তার। নীতার নামের এই মেয়েটিই শুধু, এরকম অসংখ্য ছেলেমেয়েকেই তখন জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে সংসারের বাকিদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।
উপরে যে কিশোরীর কথা বললাম, সেও মেঘে ঢাকা তারার নীতার মতোই। পার্থক্য একটাই। নীতা কাল্পনিক চরিত্র, সেলুলয়েডে আঁকা। আর এই মেয়েটি কঠিন বাস্তব।

বাস্তব এই মেয়েটির নাম আরতি দাস। জন্ম হয়েছিলো পূর্ব বঙ্গের নারায়ণগঞ্জে। পূর্ব বঙ্গ থেকে তার বাবা-মা এবং ঠাকুমা যখন কোলকাতায় যায়, তখন আরতির বয়স এক বছরেরও কম। এই পরিবারটা ধনী পরিবার ছিলো না, আবার অভাবও সেভাবে ছিলো না। কিন্তু, নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে কোলকাতায় আসার পরে অভাব কী সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলো তারা। একে ওকে ধরে আহিরীটোলায় মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হলো। সামান্য যে সঞ্চয় ছিলো তা ফুরিয়ে গেলো দ্রুত। আরতির মা-কে চাকরানির কাজ নিতে হলো মানুষের বাড়িতে। তার বাবা ফলের দোকানের হিসাব রাখার কাজ পেলো। কিন্তু, এই সামান্য আয়ে সংসার চালানো মুস্কিল। আধপেটা খেয়ে দিন চলতো তাদের। পাঠশালার বেশি পড়াশোনা হয়নি আরতির। এরকম আধপেটা খেয়ে দিন চালানোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে আরতি এক সময়। কাজের সন্ধানে নেমে পড়ে সে। এক এ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের কাজের লোক হিসাবে কাজ জুটিয়ে নেয় সে। বয়স তার মাত্র তখন এগারো।

রাতে আরো অনেক কাজের লোকের সাথে এক রুমে গাদাগাদি করে ঘুমতে হতো তাকে। সেই ঘুমনোটাও শান্তির ঘুম ছিলো না। গভীর রাতে লোলুপ এক হাত ঘুরে বেড়াতো তার সারা শরীর জুড়ে। শরীরের কাপড় খুলে নিতে চাইতো। কিশোরীকে লড়তে হতো সারারাত এই অদৃশ্য আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে।
এই এ্যাংলো পরিবার প্রচুর পার্টি দিতো। সেই পার্টিতে মদের পাশাপাশি নাচগানেরও ব্যবস্থা ছিলো। রেকর্ড প্লেয়ারে একের পর গান বাজতো, আর তার সাথে নর-নারীরা নেচে চলতো। পাশের ঘরে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আরতি তাদের দেখতো, নাচকে নকল করতো হাত-পা ছুড়ে।

এ’রকম লুকিয়ে লুকিয়ে নাচ দেখা এবং সেটা দেখে নাচার সময়ে সে ভিভিয়ান নামের এক লোকের কাছে ধরা পড়ে যায়। এই ভিভিয়ানই তাকে ক্যাবারে ড্যান্সার হবার বুদ্ধি দেয়। নিঃস্ব একটা মেয়ের কাছে এই প্রস্তাব বেশ লোভনীয় মনে হয়। একদিন ভিভিয়ানের হাত ধরে হোটেলের ক্যাবারে নাচার কাজ জোগাড় করার জন্য এই বাড়ি ছেড়ে পথে নামে সে। বয়স তার তখন মাত্র বারো।
ক্যাবারে ড্যান্সার হিসাবে প্রথম দিনই তাকে হায়ার করে নেয় ফিরপোজ হোটেল। বয়স মাত্র বারো হলেও বাড়ন্ত শরীর ছিলো তার। সেই সাথে ভিভিয়ান বুদ্ধি করে তাকে শাড়ি পরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো যাতে করে বয়সের তুলনায় বড় দেখায় তাকে। আরতি নামের আটপৌরে নাম ক্যাবারে ড্যান্সারের সাথে যায় না বলে তার নাম রাখা হয় শেফালি, মিস শেফালি। মিস শেফালি নামের জৌলুসময় ক্যাবারে ড্যান্সারের আড়ালে হারিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জে জন্ম নেওয়া আরতি নামের সাদামাটা মেয়েটা।
ফিরপোজ হোটেলের পর থেকে আর কখনোই পিছু ফিরতে হয়নি শেফালিকে। একের পর বড় বড় হোটেলে ক্যাবারে ড্যান্সার হিসাবে যোগ দিয়েছেন শেফালি। প্রতি রাতে নেচেছেন সেখানে। আনন্দ যুগিয়েছেন পুরুষের পিয়াসু দৃষ্টিকে।

শরীর নিয়ে সংকোচ তাঁর কেটে গিয়েছিলো নাচ শুরু করার পর থেকেই। তারপরেও সহজে কারো হাতে ধরা দেননি শেফালি। ক্যাবারের ড্যান্সাররা সহজলভ্য, এ’রকম একটা ধারণা তখন চারিদিকে প্রচলিত ছিলো। তাঁর দিকে হাত বাড়ানোর লোকেরও অভাব ছিলো না। কিন্তু, শেফালি সেই সব আহবানকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন নিজের স্বার্থেই। তাঁর ভাষাতেই বলি, “বুঝেছিলাম শরীরটাই আমার একটা অ্যাসেট, যেটাকে সাবধানে, যতœ করে রাখতে হবে। আরও একটা ব্যাপার ছিল আমার। আমি হোটেলে ক্যাবারে করতাম ঠিকই, কিন্তু আমি না চাইলে কেউ আমার গায়ে হাত ছোঁয়াতেও পারত না। সাফ কথা ছিল আমার যে, দেখছ দেখো। প্রাণ ভরে দেখো। আমার খোলা বুক, আমার খোলা পা, আমার কোমর, আমার নাভি, যতক্ষণ আমি ফ্লোরে আছি, দেখে যাও। কিন্তু ছুঁয়ে দেখার সাহস করো না। হাত বাড়িও না আমার দিকে। আমি ডান্সার, প্রস্টিটিউট নই।”
শেফালি শুধু ক্যাবারে ড্যান্সই করেননি। পরে যোগ দিয়েছিলেন থিয়েটারে এবং চলচ্চিত্রেও। সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্ব›দ্বী’ এবং ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতেও শেফালি অভিনয় করেছেন। এর বাইরেও পরে আরো অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। যাত্রাতেও তাঁকে দেখা গেছে ক্যারিয়ারের শেষের দিকে।

আত্মজীবনীতে সাধারণত লোকজনকে সত্য গোপন করতে দেখা যায়। উত্তমকুমার তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার আমি’-তে লিখেছিলেন সব সত্য কথা বলা সম্ভব নয়। ধীরাজ ভট্টাচার্যও তাঁর ‘যখন নায়ক ছিলাম’ বইতে একই কথা বলেছেন। কিন্তু, শেফালি তাঁর আত্মজীবনীতে কোনো কিছু গোপন করতে চাননি। তিনি লিখেছেন, “আমার জীবনের এই ভিলেনদের কথা যেমন আছে, তেমন হিরোদের কথাও আছে এই বইতে। মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন, অথবা বাঙালি মহানায়ক উত্তমকুমার, এঁদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অনেক রটনা আছে, কিন্তু ঘটনাগুলো আমি এই প্রথম বললাম। জীবনীতো, সত্য গোপন করা মিথ্যারই সামিল। তাই অকপটেই বলেছি আমার জীবনের পুরুষদের কথা। তাঁরা কেউ নামজাদা শিল্পপতি, কেউ সফল পেশাদার। তাঁরা সবাই মিস শেফালিকে চেয়েছিলেন। আর আমি কী চেয়েছিলাম, সে কথাও বলেছি।”

তিনি আসলেই অকপটে তাঁর জীবন উন্মোচন করেছেন। উত্তম কুমারের একা একা তাঁর নাচ দেখতে চাওয়া, মাতাল অবস্থায় তাঁকে একা পেয়ে ভিন্ন চোখের চাহনিতে জড়িয়ে ধরার চেষ্টার কথাও বলে গেছেন তিনি। উত্তম কুমারের যে গুডি গুডি প্রেমিক ইমেজ বাঙালিদের কাছে, সেই ইমেজ ভাঙার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টাটা অন্তত করেছেন মিস শেফালি।
শুধু লাম্পট্য না, তিনি ক্যাবারে ড্যান্সার বলে, অনেক শিল্পীই যে তাঁকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো, উপেক্ষা করতো, সেটাও তিনি বলে গেছেন নিঃসংকোচে। তিনি লিখেছেন, “আমার খারাপ লাগতো অন্য কারণে। আমি ক্যাবারে নাচি, ঠিক। তার মানেই আমার চরিত্র খারাপ? হোটেলের নাইট ক্লাবে নাচি বলেই আমি খারাপ মেয়ে হয়ে গেলাম? ওপার বাংলা থেকে এক কাপড়ে পালিয়ে আসা একটা রিফিউজি পরিবারের দু’বেলা ঠিকমতো খেতে না পাওয়া একটা মেয়ে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়, কী কষ্ট করে, কী পরিশ্রম করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা তাঁরা কেউ দেখতে পেলেন না? একলা মেয়েটার লড়াইটা ওঁদের চোখ এড়িয়ে গেল? অথচ কী অদ্ভুত, যাঁদের নাম করলাম, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার বা উৎপল দত্ত, এঁরা সবাই বামপন্থী বলে পরিচিত। খেটে খাওয়া মানুষের কথা ভাবতেন, বলতেন। তাঁরা কেউ কিন্তু আমার পরিশ্রমটা, আমার লড়াইটা দেখতে পেলেন না।”

শেফালির এই একক লড়াইটা এরা কেউ না দেখলেও, একজন ঠিকই দেখেছে। কোলকাতার এই রঙ্গমঞ্চে মিস শেফালির পাশে সবসময় দাঁড়িয়ে থেকেছে নারায়ণগঞ্জের আরতি দাস। কঠিন চলার পথে শেফালি ধরে থেকেছে আরতির হাত। মিস শেফালি হয়তো জীবনযুদ্ধে কখনো কখনো হেরে গিয়েছে, কিন্তু আরতি দাস কখনো হার মানেনি। নিজে হারেনি, শেফালিকেও হারতে দেয়নি, দেয়নি হারিয়ে যেতেও। ভিড়ের মধ্যে ধরে রেখেছে শেফালির হাত। শেফালির কষ্ট হলে, শেফালি কাঁদলে, পরম যত্নে তাঁর চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছে আরতি। শেফালির প্রতি আরতির ভালবাসাটা অকৃত্রিম। কারণ, শেফালি যে তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তীব্র ক্ষুধায় পেটে ভাত দিয়েছে, মাথার উপরে ছাদ দিয়েছে, ইজ্জত-সম্মান দিয়েছে। শেফালি না থাকলে এই বিশাল নগরে আরতি হারিয়ে যেতো সেই কবেই। যাত্রার শেষ সময় পর্যন্ত শেফালি আর আরতি তাই পরস্পরের হাত ধরেই থাকবে। এ বন্ধন অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধন।