সাজ্জাদ আলী : এক:
ডাইনিং টেবিলে থালা রাখারও জায়গা নাই। নানা রসনার তরকারি। ছোট, বড় সব সাইজের বাটিকুটি ভর্তি। তা অন্তত ১৫ পদের হবে। মাংসই তিন রকমের। মুরগি, খাসি ও কবুতর। কোনোটা ঝোল, কোনোটা বা কষানো। বড় মাছ, ছোট মাছ, ডাটা শাক, বেগুন চচ্চড়ি, কচুশাক ভর্তা, কলার মোচা ভাজি, কালোজিরা বাটা, আরো কত্ত সব আয়োজন। এক ফাঁকে আম্মা জানান দিয়ে গেলেন যে পায়েস, ক্ষীর, পিঠাআটা এগুলোও আছে। টেবিল খালি হলেই এনে দেবেন। পাঁচ বোন আর আমি খেতে বসেছি। আলভীকে ডাকাডাকি করেও টেবিলে আনা গেল না। ভাগ্নে ভাগ্নিরা সব থালায় খাবার নিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখছে। বারে বারেই আম্মাকে খেতে বসতে বলছি। কিন্তু নানা ছুতোয় তিনি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। আসলে ছেলেমেয়েরা সবাই তৃপ্তি করে খাচ্ছে কিনা, সেটা তাঁর আগে বোঝা চাই। তারপরে নিজের খাওয়া।

আহারে আমার আম্মা!
টরন্টো থেকে ঢাকা, ২৬ ঘন্টার লম্বা জার্নিতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর প্লেনে যা খেতে দেয়, তা আমার মুখে রোচে না। প্রায় দুইদিন পরে মন মতো খাবার পেয়ে কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছি। ট্যাংরা মাছের তরকারি মুখে দিয়েই বোনদের বললাম, এইটা তোদের কারো রান্না করা। ক্যাডা রানছিস ক’তো?

আমার কথা শুনে আম্মা ফিক করে হেসে দিলেন। বোনেরা এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। আমাদের কলির মুখে কপাট নাই। মনে যা আসে বলে ফেলে। সে বলে, দাদু সাত আট পদের তরকারি খাইলেন, কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করলেন না। এই ট্যাংরা মাছটা কে রানছে তা জানতি চাইলেন ক্যান?

এটা তো আম্মার হাতের রান্না না। তাই জানতে চাইলাম, বললাম আমি।
শেলী বলে, দাদু আপনি ২৫ বছর দ্যাশ ছাড়া, তবু আম্মার রান্না বুঝতে পারেন?
আম্মা বলে উঠলেন, কইছিলাম না, ও ট্যাংরা মাছের ঝোল মুখে দিলিই বুঝতি পারবি! তখন তো তুরা সে কথা নিয়া হাসাহাসি করলি!
আহারে আমার আম্মা!

দুই:
যে কটা দিন দেশে থাকি আম্মার চোখের সামনেই থাকি। কোনো আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে গেলেও তাঁকে সাথে নিয়েই বের হই। এই দিনগুলোতে তিনি তাঁর জমিয়ে রাখা কথাগুলো একে একে বলে যান। সংকটের কথা, সমাধানের কথা, সম্ভাবনার কথা। তবে তাঁর কথামালার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে আমার ভাইবোনেরা। মোটাদাগে দেখলে সে সব কথা অভিযোগের পর্যায়েই পড়ে। এই যেমন বুড়ি তার স্কুল নিয়ে মেতে থাকে। ছুটির পরেও খাটতে খাটতে শেষ। চম্পার পিঠে ব্যথা, কিন্তু শত ঠেলাঠেলিতেও সে ডাক্তারের কাছে যাবে না। কলি তার মেয়েদুটোকে লেখাপড়া নিয়ে সাংঘাতিক রকমের চাপে রাখে। শতবার বললেও শেলী সকালে হাঁটতে বের হয় না। তুলী আফিস শেষ করেই ঘোরন ফেরনে ব্যস্ত। ছেলে মেয়েদুটো কী খেল না খেল, তা পর্যন্ত খেয়াল করে না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তবে আম্মার কাঠগড়ায় সব থেকে বড় আসামী আলভী। সারাদিন সে ঘরের ছিটকিনি আটকিয়ে লেখাপড়া করে। এখন তো সে আর ছাত্র না, তাহলে এত পড়ার কী আছে? আর ছিটকিনি আটকায় ক্যান? বিড়ি সিগারেট খায় নাকি? জীবনে কোনোদিন তারে কাঁচাবাজারে পাঠানো গেল না। ময়লা কাপড়চোপড় একটার পর একটা গাদি হবে, তবুও লন্ড্রিতে পাঠাবার নাম নাই। খিচুড়ি, আলু ভর্তা, ডিম আর ডাল ছাড়া অন্য কিছু মুখে তুলবে না। আলভীর কীর্তিগুলো বলার সময় আম্মার কন্ঠে এক ধরণের জাগরণ তৈরি হয়। মনে হয় যেন ৭ই মার্চের ভাষণ শুনছি! আর আমার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের তালিকা অন্তত শত মাইল লম্বা। বিগত ৪৫ বছরের খুঁটিনাটি সব ঘটনা তিনি গড়গড় করে বলে যেতে পারেন। মনে হয় যেন বাঁধানো খাতায় সব লিখে রেখেছেন। নইলে এত কাহিনী মানুষ মনে রাখে কী করে? পাঠক বন্ধুদের না হয় আরেকদিন সে খাতা পড়ে শোনাব।

তো আমার ফিরতি ফ্লাইট যেদিন, সেদিন আমরা দুই ভাই নাস্তার টেবিলে একসাথে বসেছি। আম্মা খাচ্ছেন না, তবে বসেছেন আমাদের সাথে। পাতে খাবার তুলে দেওয়া তাঁর টাইপ না। এটা একটু খেয়ে দেখ বাবা, আরেকটা রুটি নে সোনা-এ ধরণের তুনুতুনু মার্কা আহ্লাদ দেওয়া মা না আমাদের। তিনি বরাবরই ‘আয়রন লেডি’। সারাটা জীবন তিনি মারধর আর ধমক-ধামকের ফাঁকে ফাঁকেই আমাদের জন্য স্নেহ বিলিয়েছেন। আমি খাচ্ছি আর আম্মার সাথে এ কথা সে কথা বলছি। আলভী চুপচাপ, ডিম আর সুজি দিয়ে পরোটা খাচ্ছে। হঠাৎ আমার মনে হল, আলভীকে একটু ধমকে দিয়ে যাই। আম্মা খুশি হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শুরু করলাম, অ্যাই তোর সমস্যা কী? রুমের ছিটকিনি আটকাইয়া সারাদিন কী করিস?

আভিয়া, তুমিও আম্মুর লাইনে কথা বলা শুরু কইরলা! (আলভী ছোট্টবেলা থেকেই আমাকে ‘আভিয়া’ ডাকে)

‘আম্মুর লাইন’ আবার কী? কথা তো সত্যি! এত্ত বড় এক ব্যাটা, আম্মার কাঁচাবাজারটা তো অন্তত কইরা দিতি পারিস? খাওয়া শ্যাষ কইরা আইজ বাজারে যা! ফাজিল কোথাকার!
মুহূর্তেই আম্মার মুখখানা থমথমে হয়ে গেল। সে মুখশ্রী আমার চিরচেনা। বুঝতে দেরি হলো না যে আলভীকে ধমকানোটা আম্মা পছন্দ করেননি। তাঁর ছেলেমেয়েদের তিনি ছাড়া আর কেউ ছুঁয়ে কথা বলুক, এটা তার পছন্দ না। তা সে যেই হোক। আমি তো চুপসে গেলাম। খানিক বাদে আম্মা শক্ত গলায় বললেন, বাড়ির বড় ছাওয়ালেরই বাজারে যাওয়ার কথা। তুই নাস্তা সাইরা বাজারে যা। আমি লিষ্ট লিখে দিচ্ছি।

আমি ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম, জ্বী আম্মা যাচ্ছি। হইছে কী, কয়দিন ধইরা আপনি আলভীর কথা কচ্ছিলেন তো, তাই ভাবলাম ওরে একটু বুঝাইয়া যাই। যেন সাংসারিক কাজকর্ম কিছু করে।

আরে না না, তোর কোনো অ্যাকশান নিতি হবে না। কথাগুলো আমি কইছি, তুই শুনিছিস। ওই পর্যন্তই শ্যাষ। বাদ বাকি আমি সামলাবো। এখন তুই উইঠা পড় টেবিল থেকে।
আহারে আমার আম্মা! আমাদের সামলাতেই সারাটা জীবন পার করে দিলেন!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)