অনলাইন ডেস্ক : পেশায় আবদুল মালেক ওরফে বাদল গাড়িচালক। চাকরি করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢাকায় তাঁর দুটি সাততলা ভবন, নির্মাণাধীন একটি দশ তলা ভবন, জমি, গরুর খামার খুঁজে পেয়েছে। তারা বলছে, এখনো এই খোঁজ শেষ হয়নি।

র‍্যাব-১ রোববার বেলা সোয়া ৩ টার দিকে আবদুল মালেককে তুরাগের বামনারটেক এলাকার একটি সাততলা ভবন থেকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় তাঁর কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ জাল বাংলাদেশি টাকা, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইল উদ্ধার হয় বলে দাবি তাদের।

তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের একজন গাড়িচালক ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। অষ্টম শ্রেণি পাস আবদুল মালেক ১৯৮২ সালে প্রথম সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পের গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। বছর চারেক পর অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে যোগ দেন। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত তিনি প্রেষণে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের গাড়িচালক ছিলেন। ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তিনি বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।

আবদুল মালেক ওরফে বাদল কত সম্পদের মালিক জানতে চাইলে র‍্যাব সূত্রগুলো বলছে, তাঁর (আবদুল মালেক) স্ত্রী দুজন। প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগ এলাকার দক্ষিণ বামারপাড়া রমজান মার্কেটের উত্তরপাশে ছয় কাঠা জায়গার ওপর সাত তলার দুটো আবাসিক ভবন আছে। নাম হাজী কমপ্লেক্স। এতে ফ্ল্যাট সংখ্যা ২৪টি। ওই ভবনের সামনে আছে ১০-১২ কাঠার আরেকটি প্লট। ভবনের তৃতীয় তলায় তিনি সপরিবারে থাকেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া আছে। বড় মেয়ে ‘বেবি’র নামে দক্ষিণ কামারপাড়ার ৭০ রাজাবাড়ি হোল্ডিং এ ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ইমন ডেইরি ফার্ম নামে একটি গরুর ফার্ম আছে। এতে ৫০টি বাছুরসহ গাভি আছে। এর বাইরে ২৩, ফ্রি স্কুল রোড, হাতিরপুলে পৈতৃক সাড়ে চার কাঠা জায়গার ওপর দশতলা নির্মাণাধীন ভবন আছে। ভাই আবদুল খালেকের সঙ্গে বিরোধের কারণে ভবনটির নির্মাণকাজ আদালতের নির্দেশে বন্ধ আছে।

অধিদপ্তরের এই গাড়িচালক কাগজে-কলমে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়ি চালক। যদিও মহাপরিচালক নিজে অন্য একটি গাড়িতে চড়েন এবং এর চালকও আলাদা। আবদুল মালেক মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দ হওয়া একটি পাজেরো জিপসহ তিনটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। অধিদপ্তরের একটি পিকআপ তাঁর খামারের দুধ বিক্রি এবং মেয়ে জামাইয়ের ক্যানটিনে মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার হয়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ব্যবহারের জন্য ব্যবহার করেন একটি মাইক্রোবাস।

এত সম্পদের মালিক কি করে হলেন গাড়িচালক? জানতে চাইলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, তিনি বরাবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ চিকিৎসক নেতাদের আনুকূল্য পেয়েছেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রাবেয়া খাতুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইব্রেরিতে কাজ করেন। আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ড্রাইভারস অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করে নিজেই সংগঠনের সভাপতি পদে বসেছেন। গাড়িচালকদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে। চিকিৎসকদের বদলি ও পদোন্নতি এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগে তাঁর হাত আছে বলে অভিযোগ আছে। এক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেই তিনি তাঁর পরিবারের সাতজনকে চাকরি দিয়েছেন।

অধিদপ্তরে এখন অফিস সহকারী পদে কাজ করেন আবদুল মালেকের মেয়ে নৌরিন সুলতানা বেলি। এর বাইরে ভাই আবদুল খালেক অফিস সহকারী পদে, বড় মেয়ে বেবির স্বামী রতন অধিদপ্তরের ক্যানটিন ম্যানেজার, ভাগনে সোগেল শিকারী গাড়িচালক, ভায়রা মাহবুব গাড়ি চালক এবং নিকটাত্মীয় কামাল পাসা অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি করছেন।

তদন্তে কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও চিকিৎসক নেতাদের আনুকূল্যে এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন আবদুল মালেক। তাঁরা ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনে কর্মরত একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ছিল তাঁর। টাকার বিনিময়ে কয়েকজন সাংবাদিককেও হাত করেছিলেন আবদুল মালেক। ২০০৯-১০ সালে স্বাস্থ্য সহকারী পদে শতাধিক লোককে নিয়োগ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে হাত আছে মালেকের বলে জেনেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

আবদুল মালেক সম্পর্কে জানতে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এনায়েত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁর গাড়িচালকের এসব কীর্তির খবর তিনি জানতেন না।

আবদুল মালেকের মেয়ে নাজনীন সুলতানা বলেন, র‍্যাব-পুলিশ মিথ্যা কথা বলছে। তাঁদের ভবন দুটি নয়, একটি। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদোন্নতির পর নতুন একটি গাড়ি ব্যবহার করায়, পুরোনোটি তাঁর বাবা মাঝে মাঝে বাসায় নিয়ে আসতেন। নিয়মিত ব্যবহার করতেন না। সবাই মিথ্যা কথা বলছে। তাঁদের সম্পদ বিবরণী দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা আছে।