Home সাহিত্য অমানুষ

অমানুষ

আতোয়ার রহমান : বৈশাখের শেষ দুপুর। বাইরে প্রচন্ড রোদের ঝালর। সজল আর অমল তাদের কাজে বেরিয়েছে। সজলের হাতে কাঁচি আর অমলের হাতে পোস্টকার্ড এবং সিগারেটের প্যাকেটের অংশ। অল্প কয়েক মাস হল সজল এসব কাজে লেগেছে। তার আগে মাদারটেকে তিন মাসের ট্রেনিং সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। কলকাতার হাওড়া ব্রিজ এলাকা থেকে দুই সপ্তাহের উচ্চতর ডিগ্রীও সম্পন্ন করেছে। এ লাইনে এত ভাল প্রোফাইল সত্ত্বেও এর মধ্যে একবার ধরা পড়ে তিন মাস জেলও খেটেছে। তবে অমলের রেকর্ড তেমন ভাল নয়, গত দশ বছরে কয়েকবার ধরা পড়েছে।

অমল বলল, “অই হালা সজইল্ল্যা, কথা হুন, পকেটমাইরের কাজ সহজ মনে করছোছ? পয়লা পয়লা অনেক বার ধরা খাইছি, পাবলিকের গণপিটানিও খাইছি হালায়, আবার হালায় পুলিছেও ধরছে কয়েকবার। কিন্তু হালায় লাইন ছাড়িনাইক্যা, লাইগ্যা রইছি চুম্বকের লাহান, লাথ্যি গুতা খাইতে খাইতে আর লউরানি খাইতে খাইতে আছেপাছের অল্লিগল্লি আর অল্লিগল্লির মাস্তান আর পুলিছ, ব্যাক্তের লগে পাক্কা কানেকছন হয়া গ্যাছে গা। অহন হালায় ধরা খাইলেও পানির লাহান বাইরায় যাই।”

এই অমলদা, আবার হালায় ওস্তাদে কইল এ লাইনে নাকি আগের লাহান ইনকাম নাইক্যা, এইট্যা আবার কেল্লাইগ্যা, দুঃশিন্তার একরাশ কালোছায়া মুখে মেখে সজল বলল।
গলা চিকন করে অমল কয় ইনকাম কমে নাইক্যা। ঘটনা হালায় উল্টা। অহন হালায় পাবলিকে আগের মত পাঞ্জাবি পায়জামা পরে না। আবার হালায় পাবলিক ক্যাশ ট্যাগা না রাইখা ব্যাক ট্যাগাপয়ছা প্লাস্টিক কার্ডের ভিত্তে ঢুকাইয়া রাখে। মনে হয় আমাগো পুরান ধান্দা বন্দ করতে অইব। পেশার অনিশ্চিত নিয়তি অথবা বিলুপ্তির চিন্তায় এক চরম বিষাদগ্রস্ততা গ্রাস করে ফেলে ওদের।

তয় হালায় চিন্তা করিছ না। ব্যাবাক মাইনছের হাতে অহন মোবাইল ফোন থাকে। যত দাম তত লাভ। তয় হালায় অহন বেছি ছাবধান অইতে হয়। যেমন পাবলিক ঘরের ভিত্তে বইয়া বইয়া হালায় ছি ছি টিভি, ক্যামেরা দ্যাহে রাস্তাঘাটে কি অয় না অয়। আবার হালায় মানুছ আগের মত নাইক্যা, মন পাছান হয়া গ্যাছে গা। ধরা খাইলে পাবলিকের গণপিটানিতে দয়ামায়া নাইক্যা।

তয় হালায় যেইটাই কছ বই মেলাতে পকেট মাইরের মত মজা আর কোন জায়গায় নাইক্যা।
ক্যামতে?

কারণটা ওইতাছে বই পাগল হালারা পকেটে ক্যাছ ট্যাগা রাখে। কার্ডে বই কেনার সিস্টেম অহনও চালু হয় নাইক্যা। এল্লাইগ্যা হালাগো পকেটে ক্যাছ ট্যাগা থাকে ছব ছময়। আবার হালায় হাতে বইয়ের প্যাকেট থাকনে পাবলিকে পকেট ছামলাইতে পারে না। আবার হালায় বই কিনে যারা ওই হালারা কবি টাইপের মানুছ। হালারা ছব ছময় উদাছ হয়ে থাকে।
আব্বে হালায় কথা হুন, ওস্তাদে কাচি দিয়ে পকেট মারতে মারতে এমুনভাবে হাতছাপা করে, ফাকা রাস্তার ভিত্তেও পাকেট মাইরা পানির লাহান বাইরায়া যায় গা। কেমুন হালায় প্রাকটিছ করছে ওস্তাদে? আমাগো ওস্তাদ হালায় এই লাইনের ম্যারাদোনা।

আচ্ছা মেলাটা আর কতদূর?

এই তো আইছ্যা পড়ছি। ছামনে গিয়া ডাইন দিকে খামার বাড়ি, বাম দিকে ফার্মগেট, ছামনে ছংছদ ভবন।

তারা মানিক মিয়া অ্যাভেনিউ-র চওড়া ফুটপাথের বড় পাম গাছটার নীচে এসে দাঁড়াতেই মেঘ গজরাতে লাগল। বৃষ্টি আসার আলামত। গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে অমলের চোখ তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। যেমন মোটা হয়েছে, লম্বাও হয়েছে বেশ।

অমল বলল, “কিরে হালার পো, কইছিলাম না বৃছটি অইবো।”
সজল খেঁকিয়ে উঠল, “তুই থাম, হালার পো হালা, বৃছটি অইলে ত মেলাই জমবোনা।
তইলে কি বাইত্তে যাবি? অই সজইল্ল্যা, চল যাইগ্যা।”

অহন এহেনে সারাদিন থাইক্যা লাভ নাই।
অই হুন ওস্তাদে আইজক্যা চেইত্তা যাইবোগা। গতকাইল্ক্যার পুরা মিছন ফেইল, আবার আইজক্যারটাও।

চলতো যায়া দেহি, বড়ো রাস্তার অই পারে স্কুলের ভিত্তে এতো লোকজন ক্যা? ভরপুর লোকজন থাকনে ঠেলাঠেলি কইরা কে কার আগে যাইব, তার চেষ্টা করছে ছবাই।
অই হালা এগিনি তো ছব হালায় ফকিন্নি ফকিন্নি, মনে হয় হালায় রিলিপ দিতাছে। চাইল ডাইল এইছব। আবার তো হালায় অনেকের হাতে চটের ব্যাগ ও দ্যাখতাছি।

চল দেহি ওহনে, খালি হাতে বাইত্তে না যায়া কিছু একটা লয়া যাই। এই হালাগো লগে ট্যাগাপয়ছা কিছু না থাকুক, মোবাইল ফোন ঠিকে থাকে। অন্তত নেছার পয়ছাটা তো অয়া যাইবো গা। কয়েক দিন ধইরা নেছা না করনে ছইলটা হালায় ঝিম ঝিম করতাছে।

আস্তে করে তারা লাইনে দাঁড়ায়। হুড়োহুড়ি, ব্যস্ততা। মানুষজন একটি-দুটি করে চটের ব্যাগ পেল। পাঁচ কিলো চাল। ব্যাগে আরও আছে তেল-লবণ-মরিচ-পেঁয়াজ, মসুর ইত্যাদি। দূরে থেকে ওনেকেই ওয়ার্ড কমিশনারকে গালি দিচ্ছে। যতটুকু পাওয়ার কথা তার থেকে নাকি ওজনে অনেক কম দিচ্ছে, নিম্নমানের চাল দিচ্ছে। আবার কার্ড নেই বলে কয়েকজনকে লাইন থেকে বের করে দিয়েছে। অনেকে বিমর্ষ মুখে জটলা পাকাচ্ছে। কিন্তু কমিশনারের লোকজন কুত্তা খেদানোর মত তাদের গেটের বাইরে বের করে দিচ্ছে। স্কুলের বারান্দায়, চালের বস্তাগুলোর পাশে একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে কমিশনার। দামি সিগারেটে টান দিচ্ছে, আর ভলান্টিয়ারদের নানা রকম নির্দেশনা দিচ্ছে। পাশে দুই জন ক্যাডার দুইটা লাল রঙের মটোর সাইকেলে বসে আছে। এখানেই জটলাটা বেশি।

সজল ও অমল দুজনই জটলার কাছা কাছি। ইতিমধ্যে ওরা আজকের সম্ভাব্য শিকার শনাক্ত করেছে। যেকোন মুহূর্তে কাঁচির আঁচড়ে কেটে যাবে পকেট। পকেটমার সন্দেহে সাবধানী চোখে কেউ কেঁউ আবার ওদের দিকেও তাকায়। ওরাও বেশ সাবধানি হয়।

হঠাৎ সজল ও অমলের সামনে আগুনে লাল চোখে এসে দাঁড়াল ওদের ওস্তাদ।
হ্যারে সজইল্লা, কিরে হালা অমল, কি কছ? এহেনে মেলা জমছে নাকিরে। তগো লজ্জা করলো না তগো, লজ্জ্বা করলো না, তোরা হালা গরিব মাইনছের পকেট মারতে গ্যাছোছ, তোদের লজ্জ্বা করলো না। তোদের জন্য লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায় মোর।

ওদেরকে শাসনের ছলে ওয়ার্ড কমিশনারকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাগুলো বলল।

তোরা হালায় মানুছ? না অইন্য কিছু, মানুছ না কি অন্য কিছু, অ্যা, তোরা মানুছ না অইন্য কিছু। উঁ। ছিঃ। ছিঃ। ছিঃ।

Exit mobile version