ফরিদ আহমেদ : ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানে এক ভয়াবহ সা¤প্রদায়িক আক্রমণ ঘটে। হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, হত্যা করা হয় তাদের, ট্রেন থেকে নামিয়ে আক্রমণ চালানো হয় তাদের উপর, ধর্ষণ করা হয় হিন্দু মেয়েদের। ভয়াবহ এই আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে না পেরে দলে দলে হিন্দু পালাতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে। পিছনে ফেলে রেখে যায় তাদের সহায় সম্পত্তি। জান নিয়ে পালানোটাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময়ে একমাত্র খুলনা জেলায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো। এক ধাক্কাতে সেটাতেও সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে পড়ে তারা। শুধু হিন্দু না, ভয়ের চোটে অন্য ধর্মের লোকেরাও পালিয়ে যায়। আসামে পঁয়ত্রিশ হাজার খ্রিষ্টান আশ্রয় নিয়েছিলো জান বাঁচানোর তাগিদে।

এরকম একটা ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হবার জন্য নিশ্চিতভাবেই অনেক বড় অপরাধ করা লাগে। বাংলাদেশের হিন্দুদের অপরাধ কি ছিলো জানেন? কোথাকার কোন কাশ্মিরে রাখা হজরতের চুল চুরি করা নিয়ে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হয়েছিলো ভারতে, ভারতের মুসলমানদের উপর। সেই দায় চুকিয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানরা।
এদের উপর জাতিগত আক্রমণে মূল ভূমিকা রেখেছিলো বিহারিরা। তবে, বাঙালি মুসলমানরাও যে জড়িত ছিলো না, তা কিন্তু নয়।

এই সময়কার একটা ঘটনা ‘Mujib – The Architect of Bangla Desh’ বইতে লেখা আছে। বইটা লিখেছেন যতীন্দ্র ভাটনগর। প্রকাশ হয়েছে ১৯৭১ সালে।
কাশ্মিরের হজরতবাল মসজিদে রাখা হজরত মুহাম্মদের চুল হারানোর জের ধরে ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছে।

ঢাকার জয়কালী মন্দির রোডের এক বাড়িতে একদল হিন্দু আটকা পড়ে গিয়েছিলো। প্রায় দেড়শোজন নারী-পুরুষ এবং শিশু ছিলো সেখানে। এদের ঘিরে ফেলেছিলো বিহারি এবং মুসলমান বাঙালিরা। সিরাজ নামের বিশ-একুশ বছর বয়সের এক দুঃসাহসী বাঙালি তরুণ একাই এই বিপুল সংখ্যক লোককে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলো। একটা মাত্র আগ্নেয়াস্ত্র সম্বল ছিলো তার। এই দিয়েই সারা দিন সে ঠেকিয়ে রেখেছিলো রক্ত-পিপাসু মুসলমান গুণ্ডাদের।
গুলি চালাতে চালাতে সন্ধ্যার দিকে গুলি শেষ হয়ে যায় সিরাজের। তারপরেও খালি পিস্তল দেখিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলো সে উন্মত্ত গোষ্ঠীকে।

তার এই নিরলস প্রচেষ্টায় উগ্র সা¤প্রদায়িক লোকগুলো পিছিয়ে যায় সাময়িকভাবে। কিন্তু, পরিকল্পনা করে রাতে ফিরে এসে হামলা চালানোর। রাতের অন্ধকারে সিরাজ দেখতে পাবে না তাদের ভালো করে, এটাই ভাবনা ছিলো তাদের।

তারা ফিরে আসার আগেই দীর্ঘদেহী এক নেতা এসে হাজির হন সিরাজের কাছে। পঞ্চাশ রাউন্ড গুলি নিয়ে এসেছেন তিনি সাথে করে। সিরাজের হাতে সেগুলো দিয়ে বজ্রকণ্ঠে তিনি বললেন, “নিজের জান দিয়ে হলেও আমার এই হিন্দু ভাই-বোনদের বাঁচাও তুমি বাবা। বাঙালির সম্মান আর মর্যাদা আজ হুমকির মুখে। যেভাবেই হোক সেটাকে রক্ষা করতে হবে তোমার।”

এই নেতা, যিনি যে কোনো মূল্যে হিন্দুদের বাঁচানোর জন্য গুলি নিয়ে সিরাজের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

এই অসা¤প্রদায়িক মানুষটার জন্ম শতবার্ষিকী এ বছর। সেখানে মূল বক্তা হিসাবে আনা হচ্ছে একজন অত্যন্ত জঘন্য ধরনের সা¤প্রদায়িক নেতাকে, যাঁর হাতে লেগে রয়েছে গুজরাটের মুসলমানদের রক্ত, যাঁকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিলো আমেরিকা এক সময় এই অপরাধে, যাঁর হাতে এই মুহুর্তেও মুসলমানদের রক্তের দাগ লাগছে।
কী অদ্ভুত এই পৃথিবী! একজন উদার মনের অসা¤প্রদায়িক মানুষকে সম্মাননা জানানোর জন্য প্রয়োজন পড়ে একজন রক্তলোলুপ সা¤প্রদায়িক মানুষের!