হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব

জোৎস্নালোকিত রাতে, প্রিয়তমর চেয়ে প্রিয় কিংবা আরোধ্য কোন সখার জন্য আপ্লুত ভালোবাসা আর যাতনাভরা অপেক্ষার পঙক্তি মালা সাজিয়ে ছিলেন রবিঠাকুর। “আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে”।
চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের কবি সান্নিধ্যের বর্ণনা পড়েছি এভাবে। “কোন এক উৎসব উপলক্ষ্যে বহু লোক গিয়েছিলেন বোলপুরে। বসন্তকাল, জ্যোৎস্না রাত্রি। যত স্ত্রীলোক ও পুরুষ সঙ্গী ছিলেন তাঁদের সকলেই প্রায়, পারুলডাঙ্গা নামক এক বনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কেবল যাননি চারুচন্দ্র রাত জাগবার ভয়ে। গভীর রাত্রি, হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল, মনে হল যেন ‘শান্তিনিকেতনের’ নীচের তলার সামনের মাঠ থেকে কার মৃদু মধুর গানের স্বর ভেসে আসছে। তিনি উঠে ছাদে আলসের ধারে গিয়ে দেখলেন, কবিগুরু জ্যোৎস্নাপ্লাবিত খোলা জায়গায় পায়চারি করছেন আর গুন্গুন্ করে গান গাইছেন। চারুচন্দ্র খালি পায়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেলেন, কিন্তু কবিগুরু তাকে লক্ষ করলেন না। আপন মনে যেমন গান গেয়ে গেয়ে পায়চারি করছিলেন তেমনি পায়চারি করতে করতে গান গাইতে লাগলেন। মৃদুস্বরে গাইছিলেন ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে”। যদিও ধারণা করা হয়, পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর কোন এক জোৎস্না রাতে তাকে মনে করেই কবিগুরুর এই রচনা। রবীন্দ্র গবেষকদের কাছে এর উত্তর পাওয়া যাবে। তা যে প্রেক্ষাপটেই হউক, ভালোবাসার এই বেদনাবিধুর প্রকাশে আমাদের মন বাষ্পে ভাসে জোৎস্নালোকিত আকাশে।

হাওর পাড়ের মানুষ আমি বরাবরই জোৎস্না বিলাসী। জোৎস্নার উৎসব হয় আমাদের বাড়ির পাসে টাঙ্গুয়ার হাওরে। দল বেঁধে মানুষ পূর্ণিমা রাতে জোৎস্না উপভোগ করে যার-যার জীবনের জায়গা থেকে; কেউ দেখে রুপোর থালায় চাঁদ, কারো ক্ষুধার কাছে, ‘চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ কেউ খুঁজে ফেরে গৃহত্যাগী বৌদ্ধকে স্বচ্ছ পূর্ণিমার মাঝে। কেউবা প্রকৃতির কোলে অপার সৌন্দর্যের মাঝে ঠাঁই করে নেয় নিজেকে।

কিন্তু চোখের আলোয় এই প্রথম জোৎস্না রাতে জোনাকি দেখার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতেই এই লেখা; মসীর এতটা পথচলা। ফিলিপাইনের কোরন আইল্যান্ডে আমাদের শেষ সব্ধ্যা কাটাতে গিয়েছিলাম ঋরৎবভষু দেখতে। অনুমান ছিলো কৃত্রিম কিছু হবে। ভূল ভাঙলো, কংক্রিট পাড় হয়ে জিপ গাড়িতে লাল মাটির পাহাড়ি পথের ধূলা উড়ায়ে যখন গন্তব্যে পৌঁছালাম। সুনিল আকাশ তখন কমলা বর্ণ গড়িয়ে ধরেছে রক্তিম আভা। নোনা জলের বিশাল জলরাশির উপর আমাদের হাওরের হিজল বাগানের মতই তবে আরও বেশি ঘন, ম্যান গ্রোভ গার্ডেন। “Rain forest of the see” সাধারণত ট্রপিক্যাল দেশ গুলিতেই এর দেখা মেলে। সমুদ্রতীরবর্তী এই ফরেস্টগুলি পানির তলদেশে উদ্ভিদের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীতে ৭০টি ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের ৪৬টি ফিলিপাইনে। আমরা এসেছি কোরনে। একই জায়গায় সকাল এবং সন্ধ্যায় দুই রকম চিত্র। ভোরে পর্যটকদের ভিড়ে ফিনিক্স পাখির আনাগোনা আর রাতের ধবল দুধের মত জোৎস্নাধারায়, লাখো-লাখো জোনাকিরা আঁকে আলোর আল্পনা ম্যানগ্রোভের ঝোপে। ডাঙা থেকে কায়াকে (লম্বাকৃতির ডিঙি নাও তিন জনের বেশি উঠা মানা) দশ মিনিট অন্ধকার ভেদ করে আলোর পানে যাত্রা। তারপর পনেরো থেকে বিশ মিনিট পিনপতন নীরবতায় জোনাকির আলোয় তৃপ্ত অবগাহন। চোখের উঠানে সবুজের উপর জোৎস্না আর জোনাকির আলোর মিতালি, নিচে নোনাজলের গন্ধ যেন প্রিয়ার শরীরের উষ্ণতার ঘ্রাণ। ম্যানগ্রোভের ডালে ফিনিক্স পাখিদের আশ্রয় আর পাতায় রাতের সমস্থ রুপ পেয়েছে বাসা, জলের উপর কায়াকে ভাসার শান্তি অনাবিল; পুলকিত হৃদয় জোনাকির আলোয় ঝিলমিল। সময়ের দামে কেনা জীবন এই অভিজ্ঞতা স্মৃতির ব্যাকপ্যাকে নিয়ে অতঃপর “ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে” হলুদ পাতা মাড়িয়ে টরন্টোতে ফেরা।