ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টোভিত্তিক সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৩০তম ও ৪র্থ বর্ষপূর্তির ভার্চুয়াল আসরটি সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে নিবেদিত এই আসরে আলোচিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক এ জি স্টক এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্মৃতিকথন “মেমোয়ারস অফ ঢাকা ইউনিভার্সিটি”। বইটি নিয়ে আলোচনা করেন ১৯৭২-৭৩ সময়কালে এ জি স্টক এর এমএ ক্লাসের ছাত্র, বাংলা একাডেমি পুরষ্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলনে একাত্ম, ভারত উপমহাদেশের প্রতি আগ্রহী, এমি জেরাল্ডিন স্টক নামে বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি অনার্সের এক ছাত্রী, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উপনিবেশ বিরোধী ছাত্র ফোরামে’র প্রতি রোববারের সান্ধ্য বিতর্ক-সভায় নিয়মিত হাজিরা দিতেন। স্টক তাঁর বন্ধুদের বলেছিলেন, তিনি ভারতে শিক্ষকতায় আগ্রহী। তবে পরাধীন ভারতে না, বৃটিশ শাসন-মুক্ত স্বাধীন ভারতে। ১৯৪৭ সালে সেই সুযোগ এসে যায়। মিস স্টক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৪৭-৫১ এই চার বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। তাঁর ওপর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নজরদারি শুরু হলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন। আবার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ১৯৭২-১৯৭৩ সময়কালে।

২০ বছর উত্তর-উপনিবেশবাদী অধ্যাপক হিসেবে আরো কয়েকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে শিক্ষকতার পর এ জি স্টক অবসর নেন। ইংল্যান্ডের এক নির্জন গ্রামে ১৯৭০ সালে রচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক বই – ‘Memoirs of Dacca University – 1947-51.’ বইটি প্রথমে ১৯৭৩ সালে ঢাকার গ্রিন বুক হাউস থেকে প্রকাশিত হয়। পরে ২০১৭ সালে এটি বেঙ্গল লাইটস বুকস থেকে খাদেমুল ইসলামের সম্পাদনা ও কায়সার হকের ভূমিকা সহ পুনঃপ্রকাশিত হয়। খাদেমুল ইসলাম সম্পাদকীয়তে বইটি পাঠের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন।

বইয়ের ভূমিকায় প্রফেসর স্টক পাঠকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, এটি স্মৃতিকথন, ইতিহাস না, গবেষণা না। কিন্তু তাঁর স্মৃতিকথন শেষমেষ ১৯৪০ এর দশকের শেষ ও ১৯৫০ এর দশকের শুরুর সময়কালে বৃটিশ শাসন থেকে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া এক দেশের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চালচিত্রের এক মূল্যবান সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

আমরা জানি, দেশভাগের পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া ধর্মীয় আইডেন্টিটি এবং বাঙালিদের সংস্কৃতি ও ভাষার ওপর আঘাতের বিরুদ্ধে শুরু হয় তীব্র প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম দূর্গ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই আন্দোলনে র?্যাডিকেল রাজনৈতিক ভাবধারার মিস স্টকের আত্মিক যোগাযোগের কারণে, বিষয়টি বারে বারে নানাভাবে উঠে এসেছে বইয়ের লেখায়।

 


‘মেমোয়ারস অফ ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ: দেশভাগ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল সময় এবং যে বিষয়গুলো বাঙালির প্রতিবাদ-আন্দোলনকে ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করেছিল, সেসবের বয়ান এতে আছে; বইটির অনন্য এথনোগ্রাফিক চরিত্র। প্রফেসর স্টকের সাহচর্যে আসা প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি জায়গার অনুপুঙখ বিবরণ আছে এতে; এটি নির্মোহ-বহিরাগতের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা আমাদের উপমহাদেশের ইতিহাস পাঠ; এটি সব বয়সী নারীদের জন্য অনুপ্রেরণারও, যারা অপ্রথাসিদ্ধ ও মুক্ত জীবনযাপন করতে চায়; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাপিয়েও বইটির ক্যানভাস অনেক ব্যাপ্ত; এবং সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় ব্যাপার – শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপারে লেখকের ইতিবাচক ও নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ এখনো দুই বাংলাতেই যে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা দেখে চমকে যেতে হয়।

একাডেমিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিদ্রোহ-প্রতিবাদ-বিপ্লবের অনন্য প্ল্যাটফর্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষের মাইলফলক পার হলো। এখনই যথার্থ সময় সেসব লেখার দিকে ফিরে তাকানো যেখানে উঠে এসেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবিস্তার বৃত্তান্ত। যে সময়টায় সর্বঅর্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর সগৌরব অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল, সে সময়ের ইতিবৃত্ত সবচেয়ে সার্থকভাবে ধরা আছে যে গুটিকয় দু-এক বইয়ে, এ জি স্টকের ‘মেমোয়ারস অফ ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ বইটি তার অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে, এ জি স্টকের ‘মেমোয়ারস অফ ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ বইটি ঘিরেই হয়েছে পাঠশালার ৪র্থ বর্ষপূর্তি আসর।
আলোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এ জি স্টকের ‘মেমোয়ারস অফ ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ একটি অসাধারণ বই। এটি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষেই পাঠ্য না, বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতেও এই বইটি একটি উল্লেখযোগ্য আঁকর গ্রন্থ বলা যায়। কারণ মনে রাখতে হবে, তিনি বাইরে থেকে এসেছিলেন। বাইরে থেকে এসে সাড়ে তিন বছরের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। সেই সময় তিনি চেষ্টা করেছেন নির্মোহ দৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাঠ করতে। কিন্তু যে সমস্ত মন্তব্য তিনি করেছেন, তাতে খুব যুক্তিবাদী মনের একজন মানুষের যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে যেন তাঁর কিছু আবেগেরও প্রকাশ ঘটেছে। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। এক জায়গায় এমনও বলেছেন, উর্দু থেকে বাংলা অনেক ভালো একটি ভাষা। তিনি নিজেই বলছেন, তিনি দুটো ভাষার একটা ভাষাও জানেন না। তারপরেও যে মন্তব্যটি করলেন, তার কারণটা হচ্ছে, তিনি জানতেন এই ভাষাটি জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। উর্দু ভাষা নিয়ে তাঁর কথা আছে, মন্তব্য আছে, কিন্তু বাংলা নিয়ে তাঁর যে ভালোবাসা সেটি অবিশ্বাস্য।

আলোচক বলেন, মনে রাখতে হবে, এ জি স্টক কোনো মেমসাহেব হিসেবে এই উপমহাদেশে আসেননি। মেমসাহেব বলে তখন একটা গোষ্ঠী ছিল। তারা ছিলেন খুব বড়ো বড়ো বৃটিশ সরকারি কর্মকর্তাদের স্ত্রী। অভাব বলে কিছুই তাদের জীবনে ছিল না, কিন্তু করারও কিছু ছিল না। বিকেলে বাগানে চায়ের পার্টি করেই তাদের সময় কাটত। এবং তাদের আচার-আচরণে যে ঔদ্ধত্য থাকতো, মানুষের থেকে বিশাল দূরত্ব থাকতো, তার কিছুই এ জি স্টকের জীবনে ছিল না।

এ পর্যায়ে ডঃ মনজুরুল ইসলাম বলেন, তাঁর সুযোগ হয়েছে এ জি স্টকের ক্লাসে পড়ার, তাঁর সঙ্গে কথা বলার। এ জি স্টক ইয়েটস এর ওপর W B Yeats: His Poetry and Thought শিরোনামে একটা বই লিখেছেন। বইটি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৯৯ সালে রিপ্রিন্ট হয়। খুবই মূল্যবান বই সেটি। বইটা প্রফেসর স্টক তাঁকে পড়তে দিয়েছিলেন। তিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে শেক্সপিয়ার নিয়ে পড়াশোনা করতে চাইলেও পরে সুপারভাইজারের কারণে তাঁকে মত পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু এ জি স্টকের উৎসাহেই তিনি ইয়েটসকে বেছে নেন। ফলে তাঁর জীবনে এ জি স্টকের একটা বড়ো প্রভাব ছিল বলা যায়।

আলোচক বলেন, এ জি স্টক পরে আবার ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি এসে ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এক বছরের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে চলে যান। সেই সময়টা খুব কঠিন একটা সময় ছিল। সেই সময়েও ছাত্র আন্দোলন হচ্ছিল। তিনি তখনও বলেছেন যে, আমরা আসলে বিশ্ববিদ্যালয়কে একদম ভিন্ন চোখে দেখি। পশ্চিমে এই অবস্থানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেতে পারেনি। তিনি ভেবেছিলেন, একটা দেশ স্বাধীনতা পাবার পর বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব চরিত্রে ফিরে যাবে, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের যা কাজ – জ্ঞান উৎপাদন করা, একটা নির্মোহ অবস্থানে থাকা। ‘টাউন এন্ড গাউন’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে ইংল্যান্ডে। টাউন-গাউন সম্পর্ক হবে পারষ্পরিক শ্রদ্ধার। কিন্তু গাউন মানে বিশ্ববিদ্যালয়, টাউনের কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না এবং টাউনও গাউনের কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। অর্থাৎ দুই গোলার্ধে দুটো সত্তা। তিনি দেখলেন যে, আমাদের এখানে সমস্ত বাংলাদেশ এসে মিশেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছড়িয়ে গেছে সমস্ত বাংলাদেশে। এই বিশাল ফেনোমেনন কথাটা তিনি বলেছিলেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এ জি স্টক ক্লাস নিতেন ইয়েটস এর ওপর। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি খুব মন দিয়ে শুনতেন। এমনকি সবচেয়ে দুর্বল প্রশ্নটাও তিনি কখনো নাকচ করে দিতেন না। তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, অগ্রসরবাদী চিন্তা ছিল। তিনি ছিলেন স্বঘোষিত এন্টি-ইম্পেরিয়ালিস্ট অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী একজন মানুষ। তিনি জীবনে কখনো প্রতিষ্ঠা চাননি। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি যখন পাশ করে বের হলেন, তখন চেষ্টা করলে তিনি অনেক ভালো চাকরি পেতে পারতেন, ইংল্যান্ডে সুন্দর একটা জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি যে জীবন বেছে নিলেন সেখানে ওপরের দিকে ওঠার কোনো উপায় ছিল না। তিনি ঢাকায় কয়েকবছর অধ্যাপনা করলেন, তারপর পাঞ্জাব চলে গেলেন পড়াতে। তারপর আরো কয়েকটি জায়গায় শিক্ষকতা শেষে বাড়িতে যখন ফিরলেন, তিনি তো সেই অবস্থানে আর যেতে পারেননি যেখানে একজন অধ্যাপনার চূড়ান্ত পর্যায়ে, অনেক বই প্রকাশ করে, একটা তৃপ্তি নিয়ে অবসরে যায়। কিন্তু তাঁর তৃপ্তিটা ছিল এই জায়গায় – তিনি অনেক মানুষকে স্পর্শ করতে পেরেছেন। এই স্পর্শ করাটাই ছিল তাঁর একটা বড়ো পাওয়া। সেই সময় এই ধরনের শিক্ষকের কোনো কমতি ছিল না। তাঁরা প্রত্যেকের জীবন স্পর্শ করে গেছেন। যেমন এই বইতে যাঁদের কথা বলা আছে – খান সারোয়ার মুর্শিদ, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা। আলোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষক খান সারোয়ার মুর্শিদ ইয়েটসের ওপর পিএইচডি করেছিলেন। সেই সময় অর্থাৎ দেশভাগের পরপর খান সারোয়ার মুর্শিদ ‘নিউ ভ্যালুজ’ প্রকাশ করতে শুরু করলেন। এ জি স্টক বলেছেন, জার্নালটা অসাধারণ ইংরেজিতে প্রকাশিত হচ্ছে, একটা নতুন ধারার সূচনা করেছে। সেই সাহিত্যের জার্নালে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা হতো এবং তার ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে ধরে রাখাটা ছিল কঠিন একটা কাজ। সেই কাজটা সারোয়ার মুর্শিদ সফলভাবে করেছেন। তখন ছিলেন জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, যাঁকে একাত্তর সালে পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর মতো জ্যোতির্ময় মানুষ খুব কম দেখা যায় – এতো গুণী, এতো বিনয়ী, এতো চমৎকার একজন আলো ছড়ানো মানুষ। সেই মানুষটাকে পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে হত্যা করে। সে মানুষটা শুধু বাংলাদেশের নয়, সমস্ত পৃথিবীর একটা সম্পদ ছিলেন। যে সমস্ত মানুষকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে তাঁদের মধ্যে মুনীর চৌধুরীও ছিলেন। মুনীর চৌধুরীর নাম স্টকের বইতে ক্রমাগত এসেছে। মুনীর চৌধুরী ছিলেন নাটক পাগল মানুষ। নাটক লিখতেন তিনি। তাঁর চরিত্র স্টক চিত্রায়িত করেছেন ঘূর্ণিঝড়ের মতো। ঝড়ের মতোই তিনি আসেন আর যান। মুনীর চৌধুরী পরে শিক্ষক হন। তাঁর হাতটা প্রসারিত ছিল প্রত্যেকের প্রতি – তাঁর ছাত্রছাত্রীর প্রতি, তাঁর সহকর্মীদের প্রতি। বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর প্রাণবন্ত সম্পর্ক ছিল।
অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, এ জি স্টক সম্পর্কে অনেকের ধারণা, অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা করা একজন বৃটিশ অধ্যাপককে নিয়ে এতো হৈচৈ করার কিছু নেই। কিন্তু ব্যাপারটা তা মোটেও না। তিনি অক্সফোর্ড থেকে এসেছেন বললেই বলাটা সম্পূর্ণ হবে না? তিনি অক্সফোর্ড থেকে এসেছেন একজন ভিন্ন মাপের ইংরেজ হিসেবে যিনি ছিলেন উপনিবেশ-বিরোধী। স্টক যখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন, তখন ‘অক্সফোর্ড মজলিস’ নামে ভারতীয়দের একটা সংগঠন ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর সদস্যরা নিয়মিত আলোচনা সভার আয়োজন করতেন। সে আলোচনা সভাগুলো ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। ইংল্যান্ডে তখন গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে, আবার ভারতে এসে বৃটিশরাই গণতন্ত্রকে প্রায় হত্যা করার মতো অবস্থায় চলে গেছে। উপনিবেশবাদের এই দ্বিমুখী চরিত্র এ জি স্টক খুব ভালোভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর বইতে।

আলোচক বলেন, এ জি স্টক ছিলেন সেই মুক্ত চিন্তার, অগ্রসরবাদী চিন্তার, মানবিক মননশীলতার একজন মানুষ, যিনি প্রত্যেককে সেই মানুষটির মাপে বিচার করতেন। তিনি অন্যের মাপে কাউকে বিচার করতেন না। আগে চাপরাশি বলে একটা পদ ছিল, যেটি বর্তমানে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আমরা যে খুব একটা সম্মান দেখাই তা কিন্তু না। তিনি তাঁর বিভাগের চাপরাশি কালীপদের এমন বর্ণনা করেছেন যেন সে তাঁর একেবারে অন্তরঙ্গ একজন সহকর্মী। এই সম্মানটুকু তিনি কালীপদকে দিয়েছেন। একজন চাপরাশি ও একজন অধ্যাপকের মধ্যে তিনি কোনো পার্থক্য করেননি। এই উদার মানবিকতা ১৯৭২ সালে এসেও তাঁর মধ্যে একদম অটুট ছিল। সেই সময় তাঁর মতো আরো শিক্ষক ছিলেন যাঁরা ছাত্রদের মনের জানালা খুলে দিয়েছিলেন, আমাদের মানস গঠন করে দিয়েছিলেন। সে কাজটি এখন কাউকে করতে খুব একটা দেখা যায় না। ফলে তখনকার ভিন্ন একটা অবস্থানে থেকে দেশের জন্য ভাবার সুযোগ ছিল, কিছু করারও সুযোগ ছিল। শুধু নিজের কাজে ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যস্ত থাকতো না। তারা প্রত্যেকেই রাজনীতি সচেতন ছিল। ঘুর্ণিঝড়ে সবাই এগিয়ে যেতো, মঙ্গার সময় উত্তরবঙ্গে গিয়ে কাজ করতো। এই যে জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া, এই বিষয়টি ১৯৪৭ সালেরও আগে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসছে। এ জি স্টক তা দেখেছেন ১৯৪৭ সালে।

ডঃ মনজুরুল ইসলাম বলেন, বাঙালির প্রতি এ জি স্টকের উদার ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গী ও সহমর্মিতা, বইয়ের প্রত্যেকটি পাতায় প্রকাশ পেয়েছে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ সেই সক্ষমতা দেখিয়েছে। তারা দরিদ্র ছিল কিন্তু চিন্তায় দরিদ্র ছিল না। আর বাঙালির সংস্কৃতি ভীষণ সমৃদ্ধ। এবং তিনি আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি, কথ্যসাহিত্যকে অনেক উঁচুতে স্থান দিয়েছেন। আমরা পরে দেখতে পেয়েছি, আমাদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছে আমাদের লোকসংস্কৃতি এবং আমাদের গ্রাম-মনষ্কতা। এই বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি এটি খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। যারা পাকিস্তানের নিপীড়ণের শিকার হয়েছেন, সেইসব নিপীড়িতের সঙ্গে তিনি একাত্মতা প্রকাশ করতেন। পাকিস্তানের এই নিপীড়ণ আমরাও সবাই প্রত্যক্ষ করেছি।

আলোচক বলেন, এ জি স্টক ভিন্ন দেশ থেকে আসা খুব বস্তুনিষ্ঠ, যুক্তিবাদী একজন মানুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন ক্ল্যাসিসিস্ট। তিনি আধুনিকতার বাইরের চমকটাতে একেবারেই বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি। তিনি আধুনিকতার মূলে চলে যেতেন, যেটা রেনেসাঁসের আধুনিকতা। মানুষ-কেন্দ্রিকতা, মানবিকতা এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অসম্ভব দৃঢ় অবস্থান – এই বিষয়গুলি তাঁর ভেতরে ছিল। আর ছিল বলেই তাঁকে সনাতনী বলা হচ্ছে। এটা তাঁকে নাকচ করা না। এটি বরং একটা যুগের নিরিখে তাঁকে প্রশংসা করাও বটে।

এ জি স্টক শিক্ষাঙ্গনের সহকর্মীদের সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি ছিলেন আগাগোড়া একজন শিক্ষা-সমর্পিত মানুষ। শিক্ষা এবং সংস্কৃতিতে এরকম নিবেদিতপ্রাণ মানুষ খুব কমই দেখা যায়। তাঁর শিক্ষা নিয়ে উৎসাহ ছিল, ভাষা নিয়ে উৎসাহ ছিল, সংস্কৃতি নিয়ে উৎসাহ ছিল। জসীমউদ্দীন, যাকে আমরা পল্লীকবি বলি, তাঁকে তিনি পেয়েছিলেন একজন বন্ধু হিসেবে। এবং জসীমউদ্দীন তাঁকে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের একেবারে ভেতরে শারীরিকভাবে না নিয়ে, তাঁকে মানসিকভাবে সেখানে একটা জায়গা দিতে পেরেছিলেন। ফলে তিনি জসীমউদ্দীনের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখেছেন। আমাদের অনেকের সেই সুযোগ কোনোদিন হয়নি, হবেও না। জসীমউদ্দীনের সময় অনেকেই সেই সুযোগটা নিতেও চাননি। জসীমউদ্দীনের চোখ দিয়ে কেউ যদি বাংলাদেশকে দেখেন তবে তিনি কোন বাংলাদেশ দেখবেন? স্টক সেই বাংলাদেশকে দেখতে পেয়েছেন, তার জীবনটাকে দেখেছেন। সেইজন্য দেশটির প্রবাহের সঙ্গে, সেটির প্রাণস্পন্দনের সঙ্গে নিজেকে এতটা একাত্ম করতে পেরেছেন তিনি।

আলোচক বলেন, এ জি স্টক রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেন। কারণ তিনি বলতেন, ‘এই দেশের রাজনীতি তো আমার না।’ কিন্তু বইয়ের পাতায় পাতায় সাক্ষ্য পাওয়া যায় যে, তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একেবারেই নিবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন, একেবারে অঙ্গাঙ্গীভাবে এই দেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মন্তব্যগুলি তীর্যক। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তীর্যক মন্তব্য তিনি করেছেন, তীর্যক মন্তব্য করেছেন তাদের জাতিসত্তা নিয়েও। তিনি বলেছেন তাদের কৌলীন্য একদম মেকি। কোনো জাতি অহঙ্কার দিয়ে কুলীন হতে পারে না। কুলীন হতে হয় সাংস্কৃতিক চর্চা দিয়ে। তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি অনেক বেশি উন্নত।
এ জি স্টক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় এসেছিলেন, ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের ১০-১২ দিন আগে। তিনি একেবারে শুরু থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্মপন্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং বাঙালি যে একেবারে গোড়া থেকে জাতীয়তাবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমেছে সেটির একজন সাক্ষী তিনি। ফলে এই বইটা সাক্ষ্য দেয় বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষের, সাক্ষ্য দেয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের। ভাষা আন্দোলন একেবারেই শুরু থেকে তিনি দেখেছেন। অনেকের ধারণা আমাদের ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে হয়েছে। অনেক স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা সেটি জানে। কিন্তু এ জি স্টকের বই পড়লে বোঝা যায়, ১৯৪৮ সালের ফেব্রæয়ারি মাস থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত, জিন্নাহ যখন ঢাকা আসেন তখন থেকেই। তাঁর লেখায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বর্ণিত হয়েছেন ক্ষমতালোভী, ক্ষমতায় অন্ধ এক শাসক হিসেবে, যার সংস্কৃতি নিয়ে সূক্ষ্ণ কোনো বিচারবোধ নেই, একটা জাতিসত্তার ভেতরের কোন বিষয়টি স্পন্দন সৃষ্টি করে সে ব্যাপারে যিনি একেবারেই অজ্ঞ। জিন্নাহ মোটা দাগে একটা আদেশ দিয়ে দিলেন যে, বাংলা না, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এটি যে কতো অন্ধতার বহিঃপ্রকাশ এ জি স্টক সেটি তাঁর বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর মতো একজন বুদ্ধিমান আইনজীবি সামান্য সত্য-মিথ্যার প্রভেদটুকু ধরতে পারেননি। ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষার প্রশ্নে বাঙালিদের যে অবস্থান তৈরি হলো স্টক এই বিষয়টাকে খুব গুরুত্বের সাথে বইয়ে তুলে ধরেছেন।
ডঃ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ধর্মকে বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বহু আগে থেকেই এবং এটি কিন্তু থেমে থাকেনি। ধর্ম হচ্ছে মানুষের মঙ্গলের জন্য, কোনো সন্দেহ নেই। প্রত্যেকটা ধর্মের উদ্দেশ্য মানুষের মঙ্গল সাধন, আরো বৃহত্তর অর্থে বললে – মানবের মঙ্গল সাধন। কিন্তু ধর্মতন্ত্র ধর্মের নামে মানুষকে শোষণ করে। এটি রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন। ইউরোপের ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা একই জিনিস দেখতে পাই। ইউরোপ হচ্ছে এনলাইটেনমেন্টের, যুক্তি, তর্ক ইত্যাদির একেবারে পিঠস্থান। সেখানেও চার্চ কিভাবে মানুষের অধিকার হরণ করেছে যুগের পর যুগ এই ইতিহাস আমাদের জানা। রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ ও ধর্মতন্ত্র নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তার পেছনে ইউরোপের অবস্থানটাও একটা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই ধর্মতন্ত্র আমাদের এখানেও শোষকের ভূমিকায় নেমেছে এবং এ জি স্টক বহু আগেই সেটি লিপিবদ্ধ করে গেছেন।

আলোচক বলেন, আমাদের দেশে একটা সময় পর্যন্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের উপজাতি বলা হতো এবং বিভাজন করা হতো। তবে সাধারণভাবে বাঙালি সংস্কৃতি অনেক বেশি সহনশীল, অনেক বেশি উদার এবং ইনক্লুসিভ অর্থাৎ অন্তর্ভুক্তিমূলক। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক যে বলয় আছে সেখানে এই বিষয়টা এখনো এতোটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তবে এখনকার তরুণদের ভেতরে এই চিন্তাটা জাগ্রত হচ্ছে। এ জি স্টক প্রত্যেকটা জাতিসত্তাকে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করতেন। ১৯৫০ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা তিনি তাঁর আরোপিত চিন্তা নিয়ে দেখেননি। তিনি হিন্দু ও মুসলিম দুই স¤প্রদায়েরই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেষ্টা করেছেন। এবং তিনি দুই দৃষ্টিকোণের সম্মিলন ঘটালেন বলে সেটি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হলো। আরোপিত কোনো চিন্তা তিনি এখানে চাপিয়ে দেননি। হিন্দুরা যে দেশ ছেড়ে চলে গেল ১৯৪৭ সালে, এই বিষয়টাও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। ব্যাপারটা খুবই মর্মান্তিক হলেও এটিও সত্য, জীবনটাই যখন অরক্ষিত হয়ে যায়, নিরাপত্তা হয় নির্বাসিত, তখন মানুষ নিজের জন্য না হলেও অন্তত পরিবারকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। মানুষগুলো সেসময় যেতে চায়নি।পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা এখানে এসেছে তারাও চায়নি সেখান থেকে চলে আসতে। কিন্তু দেশবিভাগ অসংখ্য জনগোষ্ঠীর জন্য যে ঘোরতর বিপর্যয় সৃষ্টি করলো, সেটিও তিনি প্রকারান্তরে বলে গেছেন। ফলে ইতিহাসের ওপর তাঁর এই বইয়ে অনেক মন্তব্য আছে যেগুলো ইতিহাসবিদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বইটি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লেখার জন্য না, বরং বাংলাদেশের ও এই উপমহাদেশের ইতিহাস লেখার জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

এ পর্যায়ে অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, এ জি স্টক বাঙালি চরিত্রের অসা¤প্রদায়িক প্রবণতাগুলো সনাক্ত করেছেন। একটা জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘Religious fanaticism does not come naturally to Bengalis. কথাটা খেয়াল করে দেখার মতো। ধর্মীয় উগ্রবাদ বাঙালির কাছে প্রাকৃতিকভাবে আসেনি, এটি আরোপিত। এটি আমাদের সময়েও আমরা দেখতে পাচ্ছি। নানান ধরনের আদর্শবাদ বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে, ইউটিউবে ঘুরপাক খাচ্ছে, ইন্টারনেট বাহিত হয়ে আসছে, দৃশ্যমাধ্যম বাহিত হয়ে আসছে এবং সেসবের প্রভাবে অনেকেই প্রভাবিত হচ্ছে। তবে তিনি বাঙালিদের ভেতর যে সা¤প্রদায়িক চিন্তাও আছে, একইসঙ্গে সেটাও চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ বাঙালি মুসলমান, বাঙালি হিন্দু উভয়ের ভেতর যে সা¤প্রদায়িক চিন্তা আছে, তিনি সেটি চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, এই সা¤প্রদায়িক চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই মঙ্গল।

আলোচক বলেন, এ জি স্টকের আদর্শ থেকে নারীরা অনুপ্রাণিত হতে পারে। তিনি বাংলাদেশে নারীশিক্ষার বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন। প্রথম দফা শিক্ষকতার সময় তাঁর কয়েকজন মাত্র ছাত্রী ছিল, ৫-৬ জনের বেশি না। কিন্তু তারা যে আসছে, তারা যে তাদের ঘেরাটোপ টপকে ঘর থেকে বাইরে এসেছে, আসার শক্তি পাচ্ছে – এর ভেতর দিয়ে তিনি দেখাবার চেষ্টা করেছেন – এই জাতি নারীশিক্ষায় অনেকদূর অগ্রসর হবে। ১৯৭২ সালে তিনি আবার যখন আসেন, তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মেয়ে পড়তো। এখন তো আরো অনেক বেশি। তিনি এতে ভীষণ অনুপ্রাণিত হতেন। একদিন ক্লাসে বলেছেন, ‘তখন মেডিকেল কলেজের ওখানে ক্লাস হতো। আমি যখন ক্লাস নিতে যেতাম, মেয়েরা আমার সঙ্গে সঙ্গে আসতো। আমি যখন ক্লাস নিয়ে বের হতাম, মেয়েরা আমাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতো। আমি তাদের নানান জায়গায় পৌঁছে তারপর ফিরতাম। কিন্তু এখন তোমরা হৈ হুল্লোড় করতে করতে আসছ, ছেলেদের সঙ্গে একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসছ, এটি ঐ সময় আমার কল্পনাতেও আসেনি। তবে আমার মনে হয়েছিল, একবার যখন গাছের বীজ থেকে চারা হয়ে গেছে, সেই চারা শত প্রতিক‚লতার মধ্যেও বেড়ে উঠবে এবং আকাশ স্পর্শ করবে।’ নারীশিক্ষার বিষয়টা বরাবরই তাঁর কাছে গুরুত্ব পেয়েছে।

এ জি স্টক বড়ো মাপের অনেক মানুষকে দেখেছেন, দেখেছেন ছোটো মাপের মানুষও। সেসব কথা তিনি অকাতরে লিখে গেছেন। ছোটো মাপের মানুষের ভেতর লিয়াকত আলি খান আছেন, ফিরোজ খান নূন আছেন। তিনি বলছেন, তারা অত্যন্ত পণ্ডিত, খুব সমীহ করার মত ব্যক্তিত্ব, কিন্তু মনের দিক থেকে তারা কখনো বড়ো হতে পারেননি। অথচ তিনি জসীমউদ্দীনকে বলছেন বিশাল মনের এক মানুষ। এই বিষয়গুলোও পাঠককে নাড়া দেয়।
এ জি স্টক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবযাত্রার সাক্ষী ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশটাও লক্ষ্য করেছেন। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি মধ্যবিত্তের সূচনা করেছিল। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই প্রস্তুত হয়েছিল। কারণ মধ্যবিত্তের বিকাশের জন্য কয়েকটি বিষয় লাগে: একটা হচ্ছে শিক্ষা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বস্ততা যার প্রকাশ ঘটবে নানাভাবে যেমন সাহিত্য রচিত হবে, নাটক অভিনীত হবে, চিত্রকলার চর্চা হবে। এইসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সমসাময়িক। তার আগে আমাদের চিত্রকলা ছিলই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রথম চিত্রকলার সূচনা করে। এভাবে যদি আমরা এগিয়ে যাই তাহলে দেখা যাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশে একটা বিশাল ভূমিকা রেখেছে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশে।

বাঙালির নিজস্ব সাহিত্য ধারার উন্মেষ নিয়ে এ জি স্টক বিশদ লিখেছেন। ১৯৫০ সালের মর্মন্তুদ সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার তিনি বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সেই অংশটা পড়া খুব কঠিন, বেশ কষ্ট করে পড়তে হয়। দাঙ্গা শেষে সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার সময়কালেও তাঁর সন্দেহ রয়ে যায়, কতোদিন তা স্বাভাবিক থাকবে। একসময় দেখা যায়, পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা হঠাৎ ভাবলো, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকদের একটা সাহিত্য সম্মেলন আমন্ত্রণ করার কথা। এর আগে ওয়ার্ডসওয়ার্থের সম্মেলন হয়েছে। তিনি বলছেন, ওয়ার্ডওয়ার্থকে এমনভাবে বাঙালিরা আত্মস্থ করেছে, অথচ ওয়ার্ডসওয়ার্থের চিন্তাতে বাংলাদেশ ছিলই না এবং ওয়ার্ডওয়ার্থের কবিতায় কোথাও বাংলাদেশ নেই। তাহলে এমনটা কেন হলো? কারণ, প্রকৃতি-সংলগ্ন মানুষ। প্রকৃতি-সংলগ্ন মানুষের চিন্তা চেতনায় কিছু ব্যঞ্জনা থাকে, কিছু দ্যোতনা থাকে, কিছু অনুরণন থাকে, যা জনজীবনের, যা প্রকৃতির, যা মহাজীবনের এবং তারই প্রকাশ তিনি বাঙালি জীবনে দেখতে পেয়েছিলেন। ওদিকে ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে, বার্নার্ড শ মারা গেলে সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, সব কিছু বন্ধ হয়ে শোকের ছায়া নামে পুরো দেশ জুড়ে। তিনি লিখেছেন, বার্নার্ড শ’র মৃত্যুতে ইংল্যান্ডের জীবনযাত্রায় কোনোরকমের পরিবর্তন হলো না অথচ বাংলাদেশে সব বন্ধ হয়ে গেল। শুধু এটি বাংলাদেশ বলেই সম্ভব। এখানে মানুষ সংস্কৃতিকে জীবন থেকে বেশি ভালোবাসে, কবিতার মূল্য অপরিসীম বাংলাদেশে। তিনি অবাক হতেন, কারণ তখন শিক্ষার হার ছিল মাত্র ১২ শতাংশ। তিনি লিখেছেন, অথচ মানুষের কবিতা পড়ার আগ্রহ এতো প্রবল, নাটক করার আগ্রহ এতো প্রবল, গানের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এতো প্রবল! বাঙালির সংস্কৃতিমনষ্কতার এই জায়গাটিকে তিনি একটা বড়ো ভূমিকায় রাখতে চেয়েছেন। বাঙালির যে কবিতা-প্রীতি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ সম্মেলন, এগুলো নিয়ে তিনি একটা জায়গায় বলেছেন, There is poetry everywhere. বাংলাদেশের সর্বত্র কবিতা। তিনি বলছেন, বাঙালির সম্পদ তার ভাষা, সাহিত্য ও শিল্প। এভাবে একের পর এক বাঙালিকে তার চারিত্র?্যলক্ষণগুলো দেখিয়েছেন তিনি। আমাদের মৌখিক সাহিত্য, আমাদের পুঁথিসাহিত্য নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন এক জায়গায়। আর বাংলাদেশের প্রতি তাঁর প্রচণ্ডরকম ভালোবাসা তো আছেই।

এ জি স্টক আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বলেছেন। তবে তাঁর এখানেই একটু দুঃখ। সেই সময়েই তিনি বলেছেন, আমাদের শিক্ষা পরীক্ষাকেন্দ্রিক। এবং এখনও পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষার ঐ আবর্ত থেকে বের হতে পারেনি। যতীন সরকার বলেছেন, আমরা শিক্ষার্থী তৈরি করি না, শুধু পরীক্ষার্থী তৈরি করি। পরীক্ষার্থীর কাজ হচ্ছে পরীক্ষা শেষে সনদ হাতে নিয়ে চাকরির বাজারে ঢুকে পড়া। তাতে তো মানুষের সেবা করা যায় না। এ জি স্টক আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বলেছেন – examination bound network. তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে, এ দেশের মানুষগুলো এতো কল্পনাপ্রবণ, এতো তাদের সৃষ্টিশীল-সৃজনশীল চিন্তা অথচ তারা এই পরীক্ষার দুষ্টচক্রে বন্দি হয়ে দিনের পর দিন শুধু মুখস্ত করছে, চিন্তা করছে না। আলোচক বলেন, আমাদের সৃজনশীল চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, পরীক্ষা বাদ দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। মূল্যায়নের হরেক রকম পদ্ধতি আছে। সেসব বিবেচনায় নিতে হবে।

এ জি স্টকের এক ছাত্র ছিল খোরশেদ। সেই খোরশেদ তাঁকে নিয়ে গিয়েছে তার গ্রামে, নোয়াখালিতে। তিনি ট্রেনে করে, নৌকায় করে সেখানে গিয়েছেন। খোরশেদ সেখানে তাঁকে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। তিনি বলছেন, ‘আমাকে একটা চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো রেখে দিয়েছে।’ কিন্তু তাতে তাঁর কোনো শ্লেষ নেই, কোনো তীর্যক মন্তব্য নেই। অসাধারণ একটা ভালোবাসা থেকে কথাগুলো বলে গেছেন তিনি। বলছেন, গ্রামের মেয়েরা আসছে, তার সঙ্গে কথা বলছে। বলছেন, ‘তারা কেউ আমার ভাষা জানে না। তাদের ভাষাও আমি জানি না। কিন্তু একটা মেয়ের সঙ্গে ভাষাহীন ভাষায় আমার কথা হয়ে গেলো। তার জীবনের আদ্যোপান্ত আমি বুঝতে পারলাম, সেও আমাকে বুঝতে পারলো।’ মানুষকে বোঝার অসাধারণ ক্ষমতা না থাকলে এসব সম্ভব হতো না।

প্রফেসর স্টক বরাবর বাংলাকে উর্দুর ওপরে স্থান দিয়েছেন। কবি জসীমউদ্দীন তাঁকে মিরপুর নিয়ে গেছেন, এক মিলাদে। সেখানে আবার নাচও হয়েছে একটা সময়। তিনি বলেছেন, এটি বাংলাদেশে বেশিদিন থাকবে না। আলোচক বলেন, আসলেই তো। সেখান থেকে আমরা আজ অনেকটাই বেরিয়ে এসেছি।

প্রচণ্ডরকমের রসবোধ এ জি স্টকের বইটি জুড়ে। একটা বই পড়তে ভালো লাগে কখন? যখন চেনা একটা বিষয় লেখক উপস্থাপন করেন রসের ভেতর দিয়ে, বিষয়টিকে জারিত করে পরিবেশন করেন। এই রসবোধের প্রচুর প্রকাশ আছে তাঁর লেখায়। বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে তিনি প্রবল হাস্যরস তৈরি করেছেন। কিন্তু তিনি হাসেন উচ্ছ¡সিত হয়ে না। কোথাও যেন একটা কৌতুক, মাথা দিয়ে হাসা যাকে বলি উইট যার প্রকাশ, সেইরকম তাঁর হাস্যরস। তাঁর ভাষাটা অত্যন্ত রসালো। কিন্তু সেই ভাষা দিয়ে তিনি কখনো কাউকে আক্রমণ করেননি। ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সেটি তিনি ব্যবহার করেছেন, যা একটা ছুরির মতো শানিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অক্সফোর্ড থেকে পাশ করা ইংরেজির মেধাবি ছাত্রী তিনি। তাঁর ভাষা তো অসাধারণ সুন্দর হবেই। কিন্তু সেই ভাষার ভেতরেও অনেক বৈচিত্র্য। শ্রেণিকক্ষেও তিনি কৌতুক করতেন সময় সময়। এবং তাঁর লালিত্যপূর্ণ ভাষায় বাংলার রূপ-নিসর্গের অকাতর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি বইয়ের নানা জায়গায়।

ডঃ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শেষ ভিজিটে এ জি স্টকের বয়স হয়ে গিয়েছিল, তিনি কিছুটা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন, কিছুটা বিপন্ন হয়ে পড়েছিলেন মানুষের মানসিকতায়। তিনি আশা করেছিলেন, এই নতুন উপনিবেশ-মুক্ত দেশগুলি এগিয়ে যাবে গণতন্ত্রের চর্চা করে, সংস্কৃতির বিকাশ করে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। যখন দেখলেন সেগুলো হচ্ছে না, তিনি খুব বিপন্ন বোধ করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী হয়ে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীকে মিডিওকার করে রাখে, অর্থাৎ খুব নিচে নামিয়ে রাখে কিন্তু তারপরও ছাত্রছাত্রীরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। তিনি বলেছেন, আমাদের সংস্কৃতি এবং শিক্ষায় দুই ধরনের প্রভাব আছে। একটা হচ্ছে ‘কালচার অফ ট্রান্সমিশন’ আর আরেকটা হচ্ছে ‘কালচার অফ ইনিশিয়েটিভ।’ অর্থাৎ আমি যা দেখেছি, শুনেছি, পড়েছি সেটিই আরেকজনের কাছে আমি পৌঁছে দিচ্ছি – এটি হচ্ছে ট্রান্সমিশন। এভাবে একটা জাতি কিন্তু উন্নত হয় না। আমি যা শুনলাম আরেকজনকে শুনালাম, আমি যা পড়লাম আরেকজনকে পড়তে দিলাম, অর্থাৎ ট্রান্সমিশন দিয়ে খুব বেশিদূর যাওয়া যায় না। আমাদের যারা পুঁথিসাহিত্যিক ছিলেন, কথ্য-সাহিত্যিক ছিলেন, তাঁরা কিন্তু এই ধরনের পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন না। তাঁরা দ্বিতীয় কাজটি করছেন, ইনিশিয়েটিভ। অর্থাৎ উদ্যোগ নিয়ে, উদ্যোগী হয়ে নতুন একটা কবিতা সৃষ্টি করা, নতুন একটা আন্দোলন তৈরি করা এসব করেছেন। এই বিষয়গুলি বাঙালি চরিত্রে তিনি দেখেছেন, কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঐ ‘কালচার অফ ট্রান্সমিশন।’ আমি যা পড়ছি, শ্রেণিকক্ষে যা শুনছি সেটিই উগড়ে দিচ্ছি পরীক্ষার খাতায়। তারপর যখন কাজে যাচ্ছি, সে কাজে আমি যা শিখেছি তাই কাজে লাগাচ্ছি। উদ্ভাবনী চিন্তা একেবারেই নেই। তিনি বলছেন, ‘কালচার অফ ইনিশিয়েটিভ’ তিনি বরং মেয়েদের মধ্যে দেখতে পেয়েছেন। এ জি স্টকের সুরে আলোচক বলেন, সেই কালচার অফ ইনিশিয়েটিভকে আমাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে বোধহয় সাংস্কৃতিকভাবে এই জাতি মুক্তি পেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মশতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার চতুর্থ বর্ষপূর্তি আসরে আলোচক শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের পাণ্ডিত্যপূর্ণ, গভীর ও তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা দর্শক-শ্রোতারা ভীষণ উপভোগ করেছেন এবং প্রশ্ন-মন্তব্য করে সক্রিয় থেকেছেন আলোচনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। এই আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক ফারহানা আজিম শিউলী।