শওগাত আলী সাগর : ১. কুইন্সপার্কের (প্রাদেশিক সংসদ ভবন) প্রেস গ্যালারির দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা একটা ছবির দিকে চোখ আটকে গিয়েছিলো ইউশরার। ছবিতে যারা আছেন তাদের সবাই সাংবাদিক, অধিকাংশই পুরুষ এবং শাদা।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সঙ্গীর দিকে মুখ ফিরিয়ে ইউশরা বলে ফেলেছিলো, আমি জানি এটা কতোটা কঠিন। কারণ- আমরা হচ্ছি বাদামী নারী (ব্রাউন উওমেন) এবং বিপত্তিটা আসলে এখানেই।’ ইউশরার মনে ছিলো, প্রেস গ্যালারির দেয়ালে শোভা পাওয়া জায়েন্ট সাংবাদিকদের ছবির পাশে নারী সাংবাদিকদের ছবিও থাকবে এবং অবশ্যই বাদামী চামড়ার কোনো নারীর।
গত মঙ্গলবার ঠিক সেই ছবিটার পাশেই ইউশরার একটা ছবি টানানো হয়েছে, ছবিটা বেশ বড় আকৃতিরই। কিন্তু হায়! ইউসরা কখনোই জানবে না- কুইন্সপার্কের প্রেস গ্যালারির দেয়ালে ইউসরা নামের ‘বাদামী এক তরুণী’র ছবি শোভা পাচ্ছে। ইউশরা এখন এসব কিছুরই উর্ধ্বে।

‘দ্যা লজিক’ এর রিপোর্টার ফাতেমা সাইদ প্রেস গ্যালারির দেয়ালে শোভা পাওয়া ইউশরার ছবিটা টুইট করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, “Your dream came true. You’re on the wall of Queen’s Park press gallery giants. You’ll be here forever.
Rest easy, friend. We got this for you.”

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ২১ বছরের এই মেয়েটি রায়ার্সনে সাংবাদিকতায় পড়তো। সেই সুবাদেই কুইন্সপার্কের প্রেস গ্যালারিতে গিয়েছিলো ইন্টার্নি করতে। ইন্টার্ন একজন রিপোর্টার কী না পুরো প্রাদেশিক সরকারের প্রিমিয়ার থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সদস্যেরই চেনা জানা হয়ে গিয়েছিলো। সবাই জেনে গিয়েছিলো, অত্যন্ত তেজি এবং নাছোড়বান্দা এই রিপোর্টারটা! যে কী না- যে কাউকে যে কোনো প্রশ্ন করতে একটুও দ্বিধা করে না, প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত, সন্তোষজনক উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত পিছু ছাড়ে না!
গত সেপ্টেম্বরে ‘Takayasu Arteritis’ নামে পরিচিত অটোইমিউন ডিসঅর্ডারে অকালে প্রাণ হারিয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণী। ইউসরা যখন মারা যায়- তখন অন্টারিওর প্রাদেশিক সংসদ গ্রীস্মকালীন অবকাশে। দীর্ঘ অবকাশের পর মঙ্গলবারেই সংসদ বসেছিলো। প্রিমিয়ার, স্পিকার থেকে শুরু করেই সবাই সংসদ অধিবেশনে ফিরে এসেছেন, কিন্তু প্রেস গ্যালারিতে ছিলো না শুধু ইউসরা।

ইউসরা যে নেই- সেটি এড়িয়ে যায়নি অন্টার্ওির প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্টি । ইউসরাকে নিয়ে একটি শোকগাঁথা লিখেছিলেন ‘দ্যা কানাডীয়ান প্রেসের’ এক সাংবাদিক। সংসদের অধিবেশনে সেই শোকগাঁথাটি পড়ে শুনালেন সংসদের স্পিকার নিজে। পুরো সংসদ দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করলো ইউসরা নামের তরুণ এক ইন্টার্ন সাংবাদিকের জন্য।
আর তার সহকর্মীরা! প্রেস গ্যালারির দেয়ালে টানিয়ে দিলো ইউসরার ছবি। ‘শাদা চামড়ার পুরুষ’ সাংবাদিকদের ভীড় ঠেলে কুইন্সপার্কের প্রেস গ্যালারির দেয়ালে জায়গা করে নিলো ‘বাদামী চামড়ার তরুণী ইউসরা।
কোনো একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য প্রাদেমিক সংসদের সকল কাজ স্বল্প সময়ের জন্য হলেও থেমে যাওয়া বিরল ঘটনা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউসরা জাভেদের জন্য সেই বিরল কাজটিই করেছে অন্টারিওর প্রাদেশিক সংসদ।

২. তখন প্রভিন্সিয়াল ইলেকশনের প্রচারণা তুঙ্গে। দারহাম এলাকায় ভোট চাইতে যাচ্ছেন কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী ডাগ ফোর্ড। সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার কোনো কর্মসূচী তার ছিলো না, ইন্টারভিউতো নাই-ই। কিন্তু রাস্তায় তাকে ধরে বসলো ইউশরা নামের এক তরুণী। ডাগ ফোর্ডের ইন্টারভিউ চান তিনি। ডাগফোর্ড যেনো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন এই আবদার। রজার্স টিভির তরুণ এই রিপোর্টারের জেদ যেনো বেড়ে যায়। তিনিও নাছোর বান্দা। ইন্টারভিউ তিনি করবেনই। শেষ পর্যন্ত হার মানলেন ডাগ ফোর্ড। রাস্তায় ক্যাম্পেইন বাস থামিয়ে ইন্টারভিউ দিতে রাজি হলেন তিনি।
ডাগ ফোর্ড এখন অন্টারিওর প্রিমিয়ার। মঙ্গলবার কুইন্সপার্কের প্রেস গ্যালারিতে ইউসরার ছবি টানানোর সময় তিনিও ছিলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা বিতর্কের জন্ম দেওয়া ডাগ ফোর্ডও ইউসরার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কি বিষন্ন হয়ে পড়েছিলেন!
রায়ার্সন ইউনিভার্সিটির জার্নালিজমের ছাত্রী ইউশরার স্বপ্ন ছিলো খ্যাতিমান সাংবাদিক হওয়া। অন্টারিও পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা এন্ড্রিয়া হারওয়াথের সাথে সেই স্বপ্ন ভাগাভাগিও করেছিলো ইউশরা। সেই স্বপ্নকে স্বপ্ন রেখেই হারিয়ে গেছে ইউশরা- বাংলাদেশি কমিউনিটির নতুন প্রজন্মের সন্তানদের জন্য যে হতে পারতো আরেকটি ইতিহাস, প্রেরণার আরেকটি উৎস।
বিরল এক রোগ যা হৃদপিন্ডকে আক্রমণ করে- ইউশরাকে কেড়ে নিয়েছে অকালে। একুশ বছর বয়সে ইউশরা হয়ে গেছে হারিয়ে যাওয়া একটি তারকার নাম। যাকে নিয়ে কুইন্সপার্কের প্রেস গ্যালারিতে, সাংবাদিক মহলে, অন্টারিওর শীর্ষ রাজনীতির অঙ্গনে রীতিমতো মাতম হচ্ছে। আমরা ভালোভাবে জানতেই পারিনি- বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একটি তারকা কানাডার অকাশে কি প্রবলভাবে জ্বলে উঠছে।

৩. ইউশরাকে নিয়ে ভীষণ স্মৃতিভারাক্রান্ত কানাডায় বাংলাদেশিদের জন্য ইতিহাস তৈরি করা মেয়ে ডলি বেগমও। ইউশরার মৃত্যুর পর ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ইউসরার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন ডলি। ইউসরার কথা বলতে বলতে ডলির গলাও কেমন যেনো ভার হয়ে গিয়েছিলো। মঙ্গলবার কুইন্সপার্কে প্রাদেশিক সংসদের অধিবেশনেও ইউসরাকে নিয়ে বক্তৃতা করলেন ডলি বেগম।
সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বের পর এলিভেটরে দেখা হয়ে গিয়েছিলো দুই তরুণীর। ইউসরা নিজে থেকেই পরিচিত হয়েছিলো ডলির সাথে। তারপর ফিসফিস করে বলেছিলো- শোনো, আইন সাপোসড টু বি নন পার্টিজান, ইমাপর্শিয়াল, বাট আই মাষ্ট সে- আই অ্যাম প্রাইড অব ইউ ডলি। উই নিড মোর ব্রাউন উইমেন হিয়ার।’
ডলি আর ইউসরার মধ্যে খানিকটা তর্কও হয়ে যায়- কে কার জন্য প্রাউড তা নিয়ে। ইউসরা বলেছিলো- ডলির জন্য সে প্রাইড ফিল করে, আর ডলি বলেছিলো- ইউসরার জন্য সে প্রাউড ফিল করে। ডলিই ঠিক করে দিয়েছিলো- ঠিক আছে, আমরা দুজনেই দুজনার জন্য প্রাউড ফিল করবো!

৪. রোববার সন্ধ্যায় আমি আর জয়ন্ত বণিক গিয়েছিলাম ইউসরাদের পিকারিং এর বাসায়। ইউসরার বাবা মোহাম্মদ জাভেদ, মা সাবরিনা সুরাইয়া আর ভাই জুনায়েদ জাভেদের সামনে আমাদের দুজনেরই পাথর হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিইবা করার ছিলো। তবু আমরা কথা তুলি, ইউসরাকে নিয়ে টুকরো টুকরো কথার মালা গাঁথার চেষ্টা করি।
জাভেদ ভাই- একটু একটু করে কথা বলতে থাকেন, আমি তার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখি। মেয়ের কথা বলতে বলতে তার বুকের ভেতর যে ভাঙচুর হচ্ছে- তা স্পষ্টই টের পাচ্ছিলাম আমরা, টের পাচ্ছিলাম- নিজেকে শান্ত রাখার কি প্রাণান্তকর চেষ্টাই না তিনি করে যাচ্ছেন। কিন্তু এক সময় বাধ ভেঙ্গে যায়, তার কান্না আমাদেরও স্পর্শ করে, অন্যমনস্কতার ভান করে চোখের জলকে আড়াল করে ফেলি আমরা।

৫. পিকারিং এর এই বিশাল বাড়ীটায় সবকিছুই আগের মতো আছে, চারজনের একজন কেবল হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। সেই একজনের অনুপস্থিতি পুরো পরিবারটিকে, পুরো বাড়ীটাকে সীমাহীন শূণ্যতার অতল গহ্বরে ডুবিয়ে দিয়েছে যেনো। সেই শূণ্যতার অতলেই প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে মা সাবরিনা কন্যা ইউসরার স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে বেঁচে আছেন, সময়ের প্রতিকুলে হেটে যাচ্ছেন যেনো।