ফরিদ আহমদ

সূর্য ঠিক মাথার উপরে উঠে আসতে ক্ষান্ত দেয় কুদ্দুস। গান গাওয়া বন্ধ করে দেয় সে। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে তার। এই অবস্থায় গলায় গান আসে না। সেই কোন সকালে একটা টোস্ট বিস্কুট খেয়েছে সে। তারপর থেকে আর খাওয়া হয় নি কিছু তার। তার এক ঘেয়ে সুরের গান বন্ধ হলেও শহরের কোলাহল কমে না। একই রকম থেকে যায়।
গান থামিয়ে গাড়ির এক কোণে রাখা ছোট্ট একটা পুটলি খোলে সে। শুকনো চিড়া রাখা আছে ওখানে। গাড়ি বলতে বিয়ারিং লাগানো গাড়ি। এই গাড়িতেই সারাদিন থাকে সে। সকালে তাঁকে গাড়িসহ ঠেলে রেখে যায় কালু মাস্তানের কোনো সাগরেদ। আবার রাতে এসে নিয়ে যায়। এর মাঝে বার দুই অবশ্য আসে। সেটা তার প্রাকৃতিক কর্ম করা লাগবে কিনা সেটার জন্য। তবে, কুদ্দুসের ক্ষীণ ধারণা হচ্ছে, এটা আসলে সে ঠিকমত কাজ করছে কিনা, সেটা দেখে যাবার বাহানা।

মৌচাক মার্কেট আর মারুফ মার্কেটের ঠিক মাঝখানে ফুটপাতে থাকে তার গাড়ি। ছোট্ট একটা গাড়ি। ওতেই এটে যায় কুদ্দুসের পা বিহীন ছোট্ট শরীরটা। হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটক দেখেছিল কুদ্দুস একবার। সেখানে তিন ফকির একটা গান গেয়ে ভিক্ষা করে। ‘দীনের নবী মোস্তফায় রাস্তা দিয়া হাইটা যায়’ – এটা ছিল সেই গান। কুদ্দুস ওটাই সারাদিন ধরে চিকন গলায় গাইতে থাকে। আয় রোজগার মন্দ হয় না। কিন্তু, নিজে কিছু রাখতে পারে না। সারাদিনের আয় কালু মাস্তানের সাগরেদরা নিয়ে যায়। এর পর সামান্য একটু টাকা দেয় তাকে। একবার একটু নিচু গলায় সামান্য বেশি টাকা দাবি করেছিল সে। কালু মাস্তান চোখ গরম করে বলেছিল, “তুই নুলা মানুষ। টাকা দিয়া তুই কী করবি? ইংলিশ রোডে যাবি?” এই কথা শুনে কালু মাস্তানের সাগরেদদের সেকি হাসি।
দুই একবার ভিক্ষার টাকাকে সরানোরও চেষ্টা করেছে কুদ্দুস। গাড়ির এখানে সেখানে লুকিয়েছে। তার পা-টা হাঁটুর কাছে চামড়া দিয়ে মোড়ানো। সেটার ভাঁজেও লুকানোর চেষ্টা করেছে। কালুর সাগরেদরা ঠিক ঠিক বের করে ফেলে সেগুলো। শরীরের গোপন জায়গাতে লুকিয়েও পার পায় নি সে। প্যান্ট খুলে সেখান থেকেও টাকা বের করে নিয়ে গিয়েছে সাগরেদরা। লাভের লাভ তো কিছু হয় নাই। মাঝখান থেকে কালুর পিটানি খেয়ে হাড্ডিগুড্ডি ভেঙেছে তার।

“আমার সাথে চিটিংবাজি করিস হালার পো নুইলা। তোরে রাস্তা থেইকা কুড়াইয়া আইনা কাজ দিছি আমি। সেই আমার সাথে তুই বিতলামি করস।” এই বলে দড়াম করে লাথি মেরেছে কালু কুদ্দুসের পিঠে দয়ামায়াহীনভাবে।
এগুলোর পরে এইসব চালাকি করা বন্ধ করে দিয়েছে কুদ্দুস। নিয়তিকে মেনে নিয়ে প্রতিদিন একই কাজ করে যায় সে ক্লান্তিহীনভাবে।

একটা গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মোছে কুদ্দুস। সূর্যতো না, যেন গনগনে চুল্লি মাথার উপরে এসে পড়েছে। পুটলি থেকে শুকনো চিড়া নিয়ে খেতে থাকে কুদ্দুস। একটা মামের বোতলে পানি রাখা আছে। সেখান থেকে ঢকঢক করে পানি খায় সে। চিড়া খাওয়া শেষ করে গাড়ির গায়ে হেলান দেয় কুদ্দুস। পেট ভরেছে, ক্ষুধার জ্বালা মিটেছে আপাত। সেটা মিটতেই তলপেট পেরিয়ে আরো নীচে আরেক ক্ষুধার অস্তিত্ব টের পায় সে। ঘুমন্ত কেউ একজন জেগে উঠছে কুদ্দুসের অজান্তেই। ফর্সা ফর্সা সুন্দর মেয়েরা মার্কেটে এসে নামছে। কেউ বা শপিং শেষে বের হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে থাকে সে।

একটা মেয়ে এসে কুদ্দুসের সামনে রাখা পাত্রে দুই টাকার একটা নোট রাখে। নোটটা রাখতে গিয়ে কিছুটা নিচু হয় মেয়েটা। মেয়েটার বুকের ভাঁজ খানিকটা চোখে পড়ে কুদ্দুসের। টাকাটা রেখে মেয়েটা ফুটপাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে মৌচাক মার্কেটের দিকে। পিছনে ঢেউ উঠছে যেন ভূমধ্য সাগরের। সেই ঢেউয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কুদ্দস বুভুক্ষের মতো। মেয়েটা চোখের আড়াল হতেই থু করে একদলা থুথু ফেলে সে। অক্ষম রাগে সারা শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে তার। চ-বর্গীয় একটা গালি সে দেয় সৃষ্টিকর্তাকে মনে মনে। শুধু পেটের ক্ষুধা না, অন্য ক্ষুধা মেটানোরও সামর্থ্য না দিয়েই এই দুনিয়াতে পাঠিয়ে দিয়েছে উল্লুকটা তাকে।