সাদী আহমেদ : গুনে গুনে ৫২টি বছর! প্রতি বছর ২৬শে মার্চ যখন আসে আর চারদিকে লাল-সবুজ পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে মনের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে কোনরকমে বানানো লাল-সবুজ আর মাঝে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা ছোট্ট যে পতাকাটি উড়িয়েছিলাম ২৫শে মার্চের ক্রাকডাউনের পরে ২৬শে মার্চ সকালে সেটাকে নামিয়ে নিতে হয়েছিলো পরিবারে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এলাকার অবাঙালি যুবকদের সাবধানবাণীর পরিপ্রেক্ষিতে! সেই সময়ের আমাদের বয়সী (যাঁরা এখনো বেঁচে আছি) সবাই জানি যে ওই পতাকা উড়ানোর কারণে আমি এবং আমার পরিবারের সবাই পাকিস্তানী মিলিটারির হাতে নিহত হতে পারতাম!

২৫শে মার্চের সূর্যাস্তের পর যে অমানিশা আমাদেরকে আবৃত করেছিলো এবং ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে যে কালরাত আমাদের ওপর নেমে এসেছিলো সেই দুঃসহ স্মৃতিকে আমরা এপর্যন্ত স্মরণ করেছি অন্তত ৫১ বার।
এরপর সেদিনের সেই তরুণ আমি জীবনের পথ পরিক্রমায় যতটা পথই অতিক্রম করেছি মনের মাঝে বয়ে বেড়িয়েছি লাল-সবুজ সেই পতাকাকে নামিয়ে ফেলার মুহূর্তের দুর্বিসহ কষ্ট।

পরবর্তী জীবনে কানাডায় অভিবাসন গ্রহণের পর সন্তানের সুশিক্ষার জন্যে নিজের সমস্ত চেষ্টা এবং পরিশ্রমকে নিয়োজিত করেছি। সেইসাথে হৃদয়ে ধারণ করেছি মাতৃভূমি বাংলাদেশকে আর মাতৃভাষা বাংলাকে।
কয়েক বছর আগে টরন্টো বাংলা বইমেলার দাপ্তরিক কাজে টরন্টো সিটি হলে গেলে সাথের একজন সিটি হলের ডান দিকের ৎধসঢ় লাগোয়া একটি পতাকা স্ট্যান্ডে আজারবাইজানের জাতীয় পতাকা উড়ছিল সেদিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমি উৎসাহী হয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে বিভিন্ন দেশের জাতীয় দিবসে ওই দেশের কানাডীয় নাগরিক স¤প্রদায়ের অনুরোধে এই স্ট্যান্ডে ওই দেশের জাতীয় পতাকা সারা দিনের জন্যে উত্তোলন করা হয়।

এরপর প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা ও দাপ্তরিক বিধি ও নিয়ম পালন করে টরন্টোস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলার জেনারেল এর সাথে যোগাযোগ করে এবং ওই অফিসের দেয়া বাংলাদেশের পতাকা ও সার্টিফিকেট সিটি হলে পৌঁছে দেই।
গত বছর (২০২১) কোভিডের কারণে শুধু মেয়র জন টোরি, কাউন্সিলর ব্রাডফোর্ড ও এমপিপি ডলি বেগম ২৬শে মার্চ পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। আমি এবং অন্যান্যরা স্কয়ারের আঙিনায় দাঁড়িয়ে সন্মান জানিয়েছিলাম। আর উপশম হয়েছিল বুকের ভেতরে চেপে থাকা কষ্টটার।
আমার জন্যে এটা একটা অনেক বড় আনন্দের যে এ বছর কোভিডের কড়াকড়ি উঠিয়ে নেয়ায় ২৬শে মার্চের পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানটি অনেক মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সুদীর্ঘ ৫১ বছর পরে মনের গভীরে তাকিয়ে দেখার সুযোগ হলে দেখতে পেলাম আমার সেই কষ্টটা আর নেই। এখন ভেতর-বাহির একাকার একটি গানের সুরে : “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।”
সাদী আহমেদ, অন্যমেলা।