রনি মজুমদার : পুরো অক্টোবরটাই বলতে গেলে আমি একটু ব্যস্তই ছিলাম। বিশেষ করে, মাসের প্রথম তিনদিন এবং শেষ তিনদিনতো চরম! ছয়টি দিনের প্রতিদিনই সন্ধ্যা থেকে ঐ ৬৯ এ! আর প্রতিটি দিনই সাথে ছিল আমার ছোট কন্যা! মাঝে মাঝে রিক্তা। প্রথম দিন কন্যা সাথে গেল কারণ বাড়িতে কেউ নেই তাকে দেখার জন্য। দ্বিতীয় দিনও ‘যাবো না, যাবো না’ করে মায়ের সাথে আবার চললো।
অক্টোবর ৩ ছিল শেষ দিন, শেষ দু’টো প্রদর্শনী। জানি রাত হবে একটু। আর টিকেট বুকিংও ছিল বেশি। যতই বলছি, ওয়াক-ইন হবে না, তারপরেও প্রতি শো-তেই ৪/৫ জন চলে আসছে বন্ধু বা পরিবারের সাথে। অন্যদিকে কিছু দাওয়াতের কারণে আসেও না। তো কোন না কোন ভাবে ‘হাউজ ফুল’ হচ্ছে! আমি খুশী, দলও খুশী! কিন্তু শেষ রাতের দুটো শো নিয়ে আমি মহাচিন্তিত! এমনিতে বেশ কিছু ওভার বুকড্ ! বেশ কিছু এক্সট্রা চেয়ার দিতে হবে ভাবছিলাম। আরো ভাবছিলাম, রবিবার, পরদিন কাজ আছে বলে দু-চারজন তো বাদ পড়বেই। তারপর আবার রাতে বৃষ্টি! এত্তোসব মাথায় নিয়ে রিমো নাকে বললাম, ‘তুমি আজকে বাসায় থাকো। কাকু আছে। আমার ফিরতে আরো রাত হবে আজকে।’ কীসের কিৃ.? সে আমাকে নানা কাজে সাহায্য করবে, টিকেট গুছিয়ে দেবে, পোস্টার গুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে রোল করবে, আমি বেশি ব্যস্ত থাকলে আমার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে দিবেৃ. নানা গাল-গপ্পো মেরে সে তার এক ব্যাকপ্যাক নিয়ে প্রস্তুত হলো।
প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দফায়ও একই অবস্হা। অবশ্য এবারে দুই দিন রিক্তা ছিল। এতে অবশ্য সমস্যা কমেনি, বরং বেড়েছে! ন’টা বাজার পর থেকে, মেয়ে কি খাবে, ওর কি ক্ষুধা লেগেছে- এ’সব নিয়ে যাবতীয় পারিবারিক ‘উৎপাত’! বুঝি মায়ের মন, কিন্তু উৎপাত বলছি, আমার মন যদি কোন কাজে লেগে থাকে, বিশেষ করে এ ধরণের কোন কাজে, পারিবারিক বিষয়গুলো খুবই ঝামেলার মনে হয় তখন! কি জানি, পরিবার পরিবার করে এরকম কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারিনি বলে হয়তো।
অন্যথিয়েটার টরোন্টো এবং অন্যস্বর টরোন্টোর এই তিনটি চরিত্রের ‘মনোলগ’ (Monologue) পরিবেশনা টরোন্টোর বাংলা সংস্কৃতিচর্চার অঙ্গনে এক বিশেষ মাইলস্টোন স্হাপন করলো, এটা বললে অতুক্তি হবে না আমার বিশ্বাস। মাসের শুরুতে তিনদিনে ছয়টি প্রদর্শনী! প্রতিদিন দু’টো করে। শুক্রবার থেকে রবিবার। যার যখনই সময় মেলেছে, এসেছেন! শুধুই যে এসেছেন, তা নয়, পরিবেশনা থেকে একটা ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে ঐ ছোট্ট মিলনায়তন থেকে বের হয়েছেন! মাসের শেষের তিনদিনও সেই ছয়টি প্রদর্শনী। প্রথম তিনদিনে দর্শক সংখ্যা মোট ২২১! এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনদিনে দর্শক সংখ্যা ১৮৩!
পরিসংখ্যানগত তথ্যই বলে দেয়, এই আয়োজনের সফলতা কতটুকু। ভাললাগা না লাগা, সে তো সেইসব দর্শকদের কাছে, যারা ১২টি প্রদর্শনীর অন্ততঃ একটিতে উপস্থিত হতে পেরেছেন। সবার অনুভূতি কমবেশি আমি বা দলের অন্যরা বা পরিবেশনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত যারা, তারা সবাই জানি। তারপরেও দু-একটি বিক্ষিপ্ত বিষয় যা আমার মনের খুব কাছ দিয়ে গিয়েছে, তা উল্লেখ না করে পারছি না।
১. বিগত দু-চার বছরে টরোন্টো বা অন্টারিও প্রোভিন্স বা সর্বোপরি কানাডায় অনেক বাংলাদেশী অভিবাসী এবং ছাত্র-ছাত্রী এসেছে। অভিবাসীদের মধ্যে তরুণদের একটা বিশাল সংখ্যা আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ্য করেছি, আমাদের ছয়দিনের প্রদর্শনীতে অনেক তরুণ দর্শক উপস্হিত হয়েছেন। এর মধ্যে আমার কোন এক প্রদর্শনীর কথা বেশ মনে পড়ছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আসার পরদিনই আমাকে ফোন করে প্রথম ২টি টিকেট বুক করেন। পরে সেটি ৮টি টিকেটে পৌঁছে। শো শেষ হলে আলাপচারিতার মাধ্যমে জানতে পারলাম, পরিবেশনা তাদের চমৎকার লেগেছে। দলের কোন ফেইসবুক পেইজ আছে কি না জানতে চাইলো, যেখানে নিয়মিত আপডেট পেতে পারে। সেটা জানালাম। দু’জন বললো, দেশে তারা থিয়েটার করতো, এখানে নতুন এসেছে বছর দুয়েক হলো। দলে যোগ দিতে আগ্রহী। ব্যস্ত জীবনের মাঝে দেশের সেই স্বাদ বা আনন্দ পেতে চায়। আমি নিজের ফোন নম্বরের কথা উল্লেখ করে বললাম, তিনদিন শেষ হোক। অবশ্যই যোগ দিতে পারবেন।
২. আগেই বলেছি, অক্টোবর ৩ ছিল একটি বৃষ্টিভেজা দিন। সারাদিন টিপ টিপ করে তো পড়লোই, সন্ধ্যার পরে বেশ শুরু হয়েছিল। সেদিন দুপুরের খাবার শেষ করে রিমোনার সাথে প্যানপ্যান করে বলছি ঘরে থাকতে, আর অন্যদিকে বুকিং অনুসারে টিকেটগুলো গুছাচ্ছিলাম। সাড়ে তিনটা নাগাদ একটা ফোন এলো। অপরিচিত নম্বর! আমি সাধারণতঃ অপরিচিত নম্বর ধরি না, কিন্তু এটা ধরলাম। ভাবলাম, যদি টিকেট চায়, বলতে তো হবে যে টিকেট সব শেষ! হ্যালো বলতেই ওপাশের কন্ঠ শোনা গেল।
‘আপনি কি রনি মজুমদার বলছেন?’
‘জ্বী বলছি।’
‘আমার নাম অমুক। আপনাদের যে নাটক হচ্ছে, আজকে তো তার দুটো শো আছে, তাই না?’
‘জ্বী দুটো শো আছে। কিন্তু…’
‘আমি প্রথম শো তে আসতে চাই। আমার স্ত্রীও আসবে। তাই দুটো টিকেট লাগবে’ খুবই গোছানো কথা, কিন্তু কন্ঠস্বর শুনে আমার মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোক একজন বয়স্ক মানুষ হবেন।
আমি বললাম, দেখুন, আজকে তো শেষদিন। আমাদের দুটো শো এর টিকেটও শেষ। আমি তো কোন টিকেট দিতে পারছি না।
‘তাই!? দুটোর কোনটাতেই হবে না?’
‘প্রথমটাতে তো কোন ভাবেই হচ্ছে না। দ্বিতীয়টা তো আপনাদের জন্য একটু রাত হয়ে যাবে না? তারপর আবার বৃষ্টিৃ..’ আন্দাজ করে বলেই ফেললাম। খারাপ লাগছে ‘না’ বলতে, কিন্তু আমি জায়গা দেব কোথায়?
‘আমরা খুব বেশি দূরে থাকি না, কাছেই থাকি। বৃষ্টি হবে জানি, তবু আসতে চাই। আপনি আমাদের দুটো টিকেটের ব্যবস্হা করে দিবেন।’ বুঝতে পারলাম যে কোনভাবেই ঠেকানো যাবে না।
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করবো। তবে আপনাদের একটু আগে আসতে হবে। ৯টার মধ্যে চলে আসবেন।‘
ভদ্রলোক রাজি হলেন। আমিও ফোন রেখেই তাঁর নামে দুটো টিকেট লিখে রাখলাম। ন’টা বাজার ঠিক তিন/চার মিনিট আগে, করিডোর দিয়ে ছোটমতন এক বৃদ্ধ দম্পত্তি, দু’জনেই ছাতা হাতে আমাদের টিকেট-টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছেন। জনি কোভিড স্ক্রিনিং করছে, আমি পেছনে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবছি, এই দম্পত্তিই বিকেলের সেই ফোনের দর্শক। আমি নাম জিজ্ঞেস না করেই রিফাতকে তাঁদের টিকেট দুটো দিলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনিই কি রনি?
আমি কথা বলতে পারছিলাম না। এই বয়সে, রাত ন’টায়, বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি এবং শীত শীত ভাব- আর তিনি এসেছেন স্ত্রীকে নিয়ে নাটক দেখতে! বিজলীর মত মনে হলো, আমি তাদের তারুণ্যভরা সময়টা এক ঝলক দেখতে পেলাম! মনে হলো তাঁরা তাঁদের জীবনের স্মৃতিচারণ করতেই টরোন্টোর বন্দী জীবন থেকে পালিয়ে এখানে এসেছেন। ভাবতে ভাবতে আমি নিজেই হলের দরজা খুলে সিট নিয়ে তাঁদের বসতে বললাম।
শোর শেষে আবার দেখা। আমাক দেখেই একটু দাঁড়িয়ে বলে গেলেন, আপনি সুযোগ না করে দিলে খুব ভাল একটা কিছু মিস্ করতাম! আমি আর তখন তাঁকে ধন্যবাদের চেয়ে বেশি কিছু দিতে পারলাম না!
৩. টিকেটের মূল্য ছিল ৫ ডলার বা যার যেমন ইচ্ছে!!! আমার অপরিচিত এক দর্শক উপস্হিত হয়ে টিকেট নিলেন। আগে বুকিং ছিল না, যদিও তিনি বললেন যে তাঁর জন্য একটা টিকেট বুক করা আছে। যাই হোক, সেদিন যেহেতু ‘হাউজ ফুল’ না, তাই আমি একটা টিকেট দিতে বললাম। ভদ্রলোক ৫ ডলার দিয়ে ভিতরে গেলেন। শোর শেষে আমার সামনে এসে ওয়ালেট থেকে একটা ২০ ডলারের বিল দিয়ে বললেন, যা পরিবেশন করেছেন, ইট ওয়োর্থস মোর দ্যান ফাইভ ডলারস্!!!
অনেক জ্ঞানী-গুনীদের বসবাস এই টরোন্টোয়। অনেক থিয়েটার এবং সাংস্কৃতিক জগতের মানুষও আছেন। জানি, প্রতেকেই এখানে নানারকম জীবন-যুদ্ধে জড়িত। কোভিডও একটা কারণ বটে! তারপরেও একটু খারাপ লেগেছে, এক ঘন্টার জন্য ১২টি প্রদর্শনীর একটিতেও সময় বের করতে পারেননি অনেকেই। প্যানডেমিক, ভ্যাকসিন, ৫ ডলার- এসব কোন বিষয় নয়। ‘তিন কন্যার উপাখ্যান’ ফ্রি এবং কোভিডবিহীন হলেও এঁরা কখনোই আসবেন না!!
তবে, ঐ যে ছোট ঘটনাগুলো তুলে ধরলাম, যে রকম আরো অনেক আছে। মোদ্দা কথা, আমরা একটা নতুন দর্শকশ্রেণী তৈরী করতে এবং তাঁদের মনের কাছাকাছি যেতে সক্ষম হয়েছি। এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি!
তিন কন্যার চরিত্রায়নে- ফারিহা রহমান, ফ্লোরা শুচি এবং মুনিমা শারমিন। কথা লিখেছেন- শামীম আহসান, বিদ্যুৎ সরকার এবং আহমেদ হোসেন। আর পরিচালনায় ছিলেন- আহমেদ হোসেন। এই কাব্যময় তিনটি নারীর জীবন-কাহিনী, যে আবেগের ছোঁয়া দিয়ে আমাদের দলের তিনজন চরিত্রায়ন করেছেন, তা অতুলনীয়! অসামান্য! আর পরিচালক, আমাদের দলনেতা! তাঁর গুণাবলী আলোচনা করার ঔদ্ধত্য আমার নেই। তবে তিনি একজন চরম ‘আইডিয়া ডিপো’, এজন্য তাঁকে আমি সেল্যুট জানাই, সবসময! ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে ধন্যবাদ দেই, আমাকে এই পরিবেশনার সাথে সম্পৃক্ত রাখার জন্য। আমার জীবনে এটা একটা ‘অন্যরকম’ অভিজ্ঞতা!
১২টি প্রদর্শনীর সকল দর্শকদের প্রতি অন্যথিয়েটার টরোন্টো এবং অন্যস্বর টরোন্টোর পক্ষ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা! সেই সাথে আমার অকৃত্রিম ভালবাসা দলের মানুষগুলোর জন্য, যারা মঞ্চের বাইরে/পেছনে আমার কাজে সহযোগিতা করেছেন!