দ্য আদার সাইড অব মি
দ্য আদার সাইড অব মি

ফরিদ আহমদ
সিডনি শেলডনের বই আমি প্রথম পড়েছিলাম বাংলায়, দেশে থাকতে। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়েছিলো বইটা। নাম ছিলো ‘স্বপ্নসখা’। শেলডনের ‘রেজ অব এঞ্জেলস’-এর অনুবাদ ছিলো সেটা। অনুবাদ করেছিলেন আমার ডিপার্টমেন্টেরই এক বড় আপা। উনার নাম রোকসানা নাজনীন এ্যানি। তখন অবশ্য স্পষ্টভাবে জানতাম না এটা সিডনি শেলডনের বইয়ের অনুবাদ ছিলো। কারণ, সেবা প্রকাশনী সাধারণত মূল লেখকের নাম উল্লেখ করতো না। বিদেশী লেখার ছায়া অবলম্বনে লেখা বলে দায় সেরে ফেলতো।
দেশ থেকে বিদেশে আসার পরে, সিডনি শেলডনের প্রথম যে বইটা হাতে আসে, সেটা হচ্ছে ‘টেল মি ইয়োর ড্রিমস’। এই বইটা পড়ার পরে এতোই মুগ্ধ হয়ে যাই যে তাঁর বই সবগুলো জোগাড় করে পড়ে ফেলি আমি। হাতে গোণা মাত্র দুই চারজন লেখক আছেন, যাঁদের সব বই-ই আমি পড়েছি। সিডনি শেলডন তাঁদের মধ্যে একজন।
ভদ্রলোকের সব বই পড়েছি, এরকমইটা ধারণা কিছুদিন আগ পর্যন্তও ছিলো আমার। কিন্তু, সেই ধারণা ভেঙে যায় তাঁর লেখা আরেকটা বই দেখে। বইটার নাম ‘দ্য আদার সাইড অব মি’। এটা অবশ্য উপন্যাস নয়, তাঁর আত্মজীবনী। বইটা দেখার সাথে সাথেই বগলদাবা করে বাসায় নিয়ে এসেছি। কিন্তু, আনার পরেও পড়ার সুযোগ পাইনি কয়েকদিন পর্যন্ত। আনার পরেই আন্না পড়া শুরু করে বইটা। সে ধীর গতির পাঠক। প্রথম দিন পরে জিজ্ঞেস করলাম, কতো পৃষ্ঠা পড়েছো। বলে, উনসত্তর পৃষ্ঠা। শুনে অবাক আমি। বইটা নাকি তার এতো ভালো লাগছে যে তরতর করে পড়ে চলে যাচ্ছে সে।
তিন চারদিনের মধ্যেই তিনশো পৃষ্ঠার বইটা শেষ করে ফেলে সে। এর পর আমার সুযোগ আসে পড়ার। বইটা আমার হাতে দেবার আগে সে শুধু বললো, ‘বইটা তোমার পড়া উচিত।’ ও কেনো বলেছিলো আমার পড়া উচিত, সেটা বইটা পড়ার পরেই আমি জেনে গিয়েছিলাম। পাঠকদের অবশ্য কিছুটা দুর্ভাগ্য, কারণ, সেটা জানানো হবে না এই লেখায়।
সিডনি শেলডনের জন্ম ১৯১৭ সালে, শিকাগোতে। লেক মিশিগান থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে থাকতেন তারা। বাবা-মা আর এক ভাইয়ের সংসার তাদের। তবে, এই সংসারে শান্তি বলে কিছু ছিলো না। তাঁর বাবা-মা প্রতিনিয়ত ঝগড়া করতো। আর এইসব ঝগড়ার অনেক কিছুই হতো সন্তানদের সামনে, যেটা তাদেরকে ডিপ্রেসড করে ফেলতো।
ত্রিশের দশকে বিশাল এক অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত হয় আমেরিকা। স্টক মার্কেট ক্রাশ করে। অসংখ্য ব্যাংক নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। চাকরি-বাকরি হয়ে ওঠে সোনার হরিণ। তেরো মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের চাকরি হারায়। যারা চাকরি করছিলো তাদেরও বেতন কমে যায় মারাত্মকভাবে। বহু মিলিয়নিয়ার দেউলিয়া হয়ে আত্মহত্যা করে, বহু বড় বড় চাকরি করা লোক রাস্তায় আপেল বিক্রি করার কাজে নামতে বাধ্য হয়।
এরকম মন্দাকালে, সিডনির বয়স যখন সতেরো, তিনি সিদ্ধান্ত নেন আত্মহত্যা করবেন। অন্ধকার এক সময় চারিদিকে, আশার কোনো আলো নেই। বেঁচে থাকার কোনো তাড়না তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। একটা ড্রাগ স্টোরে কাজ করতেন তিনি। সেখান থেকে প্রতিদিন অল্প অল্প করে ঘুমের ওষুধ চুরি করতেন তিনি। একদিন যখন তাঁর বাবা-মা বাড়িতে নেই, সেই সময়টাকে তিনি বেছে নেন আত্মহত্যা করার সুবর্ণ সময় হিসাবে। হুইস্কির সাথে ঘুমের ওষুধ খাবার আগেই তাঁর বাবা হঠাৎ করে বাড়িতে ফিরে আসেন। এই দৃশ্য দেখে তিনি সহজেই অনুমান করে ফেলেন বিষয়টা। ছেলের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তিনি সিডনিকে বলেন, “জীবন হচ্ছে উপন্যাসের মতো। পৃষ্ঠা উল্টানোর আগে জানার কোনো উপায় নেই পরের পৃষ্ঠায় কী আছে। মানুষের জীবনের প্রতিটা দিনও উপন্যাসের পৃষ্ঠার মতোই। আগামীকালে না যাওয়া পর্যন্ত তুমি জানো না আগামীকাল কী ঘটতে যাচ্ছে।”
বাবার কথায় আত্মহত্যা থেকে সরে আসেন সিডনি, কিন্তু তিনি সারাজীবন ধরেই আত্মহত্যাপ্রবন ছিলেন। এর পিছনে যতোটা না হতাশা কাজ করেছে, তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে তাঁর মানসিক অসুস্থতা। তিনি ম্যানিক ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ছিলেন। এখন এটাকে বাই-পোলার ডিজ-অর্ডার বলে। এই অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তি এক সেকেন্ডে আনন্দের চরম শিখর থেকে নেমে আসতে পারে গভীর বিষাদের অতলতলে। এক মুহূর্তে যে ব্যক্তি ভাবতে পারে জীবন হচ্ছে অসম্ভব সুন্দর এবং অর্থপূর্ণ জিনিস, সেই একই ব্যক্তি পর মুহূর্তেই জীবনের অর্থহীনতা নিয়ে তীব্র হতাশায় ডুবে যেতে পারে। এই দ্রুত গতির মুড সুইং তাদের জীবনকে করে তোলে ভঙ্গুর। তীব্র বিষাদের সময়ে আত্মহত্যার মতো চরম কাজও এরা করে ফেলতে পারে খুব সহজেই।
দুটো উদাহরণ দিচ্ছি, তাঁর জীবন থেকেই। উনিশ বছর বয়সে গীতিকার হবার জন্য বাড়ি ছেড়ে নিউইয়র্কে আসেন তিনি। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর যখন তাঁর লেখা গান প্রকাশ করার জন্য এক ব্যক্তি রাজি হয়েছেন, তাঁর সাথে মিটিং এ বসার সময় দিয়েছেন। ঠিক সেই দিন তিনি বাস ধরে নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে এসেছেন শিকাগোতে তাঁকে দিয়ে কিছু হবে না এই ভাবনা ভেবে।
১৯৪৮ সালে ‘দ্য ব্যাচেলর এন্ড দ্য ববি সক্সার’ মুভির অরিজিনাল স্ক্রিন-প্লের জন্য একাডেমি এওয়ার্ড পান তিনি। এটাই তাঁর জীবনের প্রথম বড় পুরস্কার। আব্রাহাম পোলোনস্কি, রুথ গর্ডন, চার্লি চাপলিনদের টপকে পুরস্কার জিতে নেন তিনি। কিন্তু, পুরস্কার ঘোষণার সাথে সাথেই গভীর বিষাদে আক্রান্ত হন তিনি। তাঁর ধারণা জন্মায় তিনি কিছুই না। যোগ্য লোকদের পুরস্কার চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
কিছু মানুষ থাকে, যাঁদের প্রতিভা হয় বহুমুখী। সিডনি শেলডন তেমনই একজন ছিলেন। মিডিয়া লাইনে কাজ করার ব্যাপক ইচ্ছার কারণে লজ এঞ্জেলসে চলে যান তিনি। সেখানে তিনি মুভির চিত্রনাট্য লিখবেন, এটাই ছিলো তাঁর ইচ্ছা। এর আগে নিউ ইয়র্কে ব্রডওয়ে মিউজিকের স্টোরি লিখেছেন তিনি। কিন্তু, সেটাতেও তৃপ্তি আসেনি তাঁর। লজ এঞ্জেলসে আসার পরে শুরুতে রিডার হিসাবে ফ্রিল্যান্স কাজ করা শুরু করেন তিনি। কোনো একটা উপন্যাসকে সংক্ষিপ্ত করে লিখে দিলে স্টুডিওগুলো সামান্য কয়েক ডলার পারিশ্রমিক দিতো। সেটা দিয়েই তাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয়। এখান থেকেই নাটকীয়ভাবে তাঁর উত্থান ঘটে। স্টুডিওর ম্যানেজার হিসাবেও কাজ করার সুযোগ ঘটে যায়। একদিন যেখানে স্টুডিওতে ঢোকার জন্য তাঁকে গেইটম্যানের কাছে ধর্না দিতে হয়েছিলো, সেই তিনি মাত্র দশ বছরের মাথায় স্টুডিও ম্যানেজার বনে যান। এর মধ্যে বহু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখেন। চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেন তিনি।
জীবন অবশ্য সবসময় সুখের ছিলো না। এই উত্থানের পরেও পতন ঘটেছিলো তাঁর। স্টুডিও ম্যানেজারের পদ থেকেই শুধু সরে যেতে হয়নি তাঁকে, তাঁর ক্যারিয়ারও প্রায় ধ্বংসের পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো। সেখান থেকে উঠে আসতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে, ধৈর্য ধরতে হয়েছে অসীম। টিকে থাকার লড়াইয়ে হলিউড ছেড়ে টেলিভিশনেও কাজ করতে হয়েছে। সাধারণত হলিউডে কাজ করা লোকজন তখন টেলিভিশনে কাজ করাটাকে নিচু চোখে দেখতো। তিনি এই এলিট মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসেন। ‘আই ড্রিম অব জিনি’ এবং ‘হার্ট টু হার্ট’ এর মতো জনপ্রিয় সিরিজের চিত্রনাট্য লেখেন।
‘আই ড্রিম অব জিনি’-তে কাজ করার সময় দুর্দান্ত এক আইডিয়া আসে তাঁর মাথায়, যেটা তাঁর ক্যারিয়ারকেই বদলে দেয়। এটা ১৯৬৭ সালের ঘটনা। যে আইডিয়াটা তাঁর মাথায় এসেছিলো, সেটা হচ্ছে এরকম। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন, যিনি কোনো কিছুর সাথে-পাছে নেই। কোনো শত্রু নেই। কিন্তু, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কেউ তাঁকে হত্যা করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি এটাকে চিত্রনাট্যে রূপ দিয়ে গিয়ে দেখলেন এটা অনেক বেশি বর্ণনামূলক। চিত্রনাট্যের চেয়ে উপন্যাস হিসাবেই এটা বেশি ভালোভাবে ফুটবে। কিন্তু, তাঁর উপন্যাস লেখার সক্ষমতা নেই, এই বিবেচনা করে তিনি আইডিয়াটাকে সরিয়ে দিলেন মাথা থেকে জোর করে।
জোর করে সরানোর চেষ্টা করলেও আইডিয়াটা ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো তাঁর মস্তিষ্কের ভিতরে। চরিত্রগুলো বাইরে বের হয়ে আসার জন্য তাঁর মাথার ভিতরে দাবি জানাতে লাগলো। এই দাবির প্রেক্ষিতে উপন্যাস লেখার আত্মবিশ্বাসহীনতাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে তিনি লিখে ফেললেন সাইকিয়াট্রিস্টের গল্পটা। এটা ‘দ্য ন্যাকেড ফেস’ নামে প্রকাশ হয়ে গেলো। এটাকে নিউ ইয়র্ক টাইমস বছরের সেরা রহস্য উপন্যাসের মর্যাদা দিয়েছিলো। মিসটেরি রাইটার্স অব আমেরিকার এডগার এলান পো পুরস্কারও পান তিনি এই বইয়ের জন্য।
বায়ান্ন বছর বয়সে একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আকস্মিকভাবে আত্মপ্রকাশ করলেন ঔপন্যাসিক হিসাবে। আর এই আত্মপ্রকাশের পরেই তিনি উপলব্ধি করলেন এটাই আসলে তাঁর নিজস্ব জায়গা। এর পরে আরো সতেরোট রোমাঞ্চ উপন্যাস লিখেছেন তিনি। তাঁর বই তিনশো মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনুদিত লেখকও তিনি।
‘দ্য আদারসাইড অব মি’ শুধুমাত্র আত্মজীবনীই না, এতে উঠে এসেছে হলিউডের একেবারে ভিতরের চিত্রও। চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের হলিউডের স্টুডিও-র ভিতরে পাঠক প্রবেশ করে যাবে এই বই পড়ার সুবাদে। হলিউডের অসংখ্য বর্ণিল চরিত্রের সাথে অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়ে যাবে পাঠকের সিডনি শেলডনের কল্যাণে। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা থেকে শুরু করে জুডি গারলান্ড, রজার মুর, এলিজাবেথ টেলর, কে নেই এখানে তাঁর আত্মজীবনীর ভিতরে?
সিডনি শেলডনের বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে ভাষা। অনেকটা আমাদের হুমায়ুন আহমেদের মতো। কোনো একটা বইয়ের এক লাইন পড়লেই আপনি আটকে যাবেন এই লেখায়। অত্যন্ত আরামদায়কভাবে লাইনের পর লাইন, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আপনি পড়ে যেতে পারবেন। সামান্যতম ক্লান্তি আসবে না কখনো। তাঁর উপন্যাসের মতো আত্মজীবনীও একই রকমভাবে সুখপাঠ্য। রিয়েল পেইজ টার্নার বলতে যা বোঝায়, এটা সেরকমই একটা বই। আত্মজীবনী সাধারণত মজাদার হয় না। বেশ নিরস ধরনের হয়ে থাকে। কিন্তু, এই বইটা ব্যতিক্রম। রিচার্ড ফাইনম্যানের পরে সিডনি শেলডনের আত্মজীবনী পড়েই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি আমি।