সেরীন ফেরদৌস : ‘ওরেক্স এ্যান্ড ক্রেক’ উপন্যাসটি যখন লেখা হয়, তখন বলা হয়েছিলো যে এটি নিকট ভবিষ্যতকে উপস্থাপন করে। কিন্তু ২০০৩ সালে বইট প্রকাশিত হবার পর বেশ কিছু বছর পার হয়েছে এবং সেই নিকট ভবিষ্যত আরো নিকটবর্তী হয়েছে। শুধু নিকটবর্তীই হয়নি কোথাও কোথাও আমরা ইতিমধ্যেই সেখানে পা দিয়ে ফেলেছি বলেই বোধ হচ্ছে।

না, বইটির কোনো কোনো অংশ আপনাকে ‘সায়েন্টিফিক ফিকশন’ বলে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিতে পারে বৈকি কিন্তু এর ক্যাটাগরি আসলে তা নয়। ‘সায়েন্টিফিক ফিকশন’ বহু দূরের গল্প বলে, আমাদের ছুঁতে না-পারা বাস্তবতার কথা বলে যা শিহরণ-বিনোদন দিলেও দৈনন্দিন জীবনে সর্তক হবার প্রয়োজনীয়তাকে উসকে দেয় না বা নিত্যদিনের চিন্তায় এসে ক্ষণে ক্ষণে হানা দেয় না। কিন্তু ‘ওরেক্স এ্যান্ড ক্রেক’ দৈননন্দিন চিন্তাকে নাড়া দেয়, অনাগত কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুতির তাগিদ দেয়, পাঠককে নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি করে দেয়।

বইটি সম্পর্কে আগ্রহ জাগে প্রথম যখন দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া বড়কন্যা বাসায় এটিকে টেক্সটবুক হিসেবে নিয়ে আসে এবং রচনা-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সাহায্য চায়। সাথে দুইয়ে দুইয়ে চার হিসেবে আসে বিবিসির ১০০টি চিন্তা পাল্টে দেবার বইয়ের তালিকা যেখানে অগ্রসরমান পৃথিবীর ক্যাটাগরিতে এই বইটির নাম। বহু-স্তরবিশিষ্ট এ উপন্যাসে কি নেই যা আজকের পৃথিবী মোকাবেলা করতে যাচ্ছে দুইদিন আগে বা পরে! ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি আমার অন্যতম প্রিয় ইতিহাসবিদ ও ভবিষ্যতদ্রষ্টা। ‘ওরেক্স এন্ড ক্রেক’ পড়তে পড়তে বারবারই হারারির গ্রন্থগুলোর নানা বিষয়ের মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম যেন!

হারারির মতে, মানুষ আর কি চায় বা চাইতে পারে! এ পৃথিবীর শিশুমৃত্যু কমেছে, খাদ্যসংকট কমেছে, প্লেগ নেই, যুদ্ধও কমেছে- সামগ্রিকভাবে মানুষের আয়ু বাড়ছে। সব মানুষ সমান অবস্থায় নেই সত্যি, কিন্তু সেই সত্যি এমন ‘বিভৎস সত্যি’ যে, মানুষে মানুষে অবস্থানের ব্যবধান যতো বেশি, ততো বেশি অতীতের ইতিহাসে কখনোই ছিলো না! ’ওরেক্স এন্ড ক্রেক’ও আরো একটু সামনে এগিয়ে সেই গল্পই করে। আমরা অনেকেই জানি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বড় বড় কোম্পানীগুলোর হাতে মোটামুটি জিম্মি হয়ে পরেছে পৃথিবীর বড়-ছোট সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা। হারারি বলেন, বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখন আর কোনো দেশকে প্রকৃতপক্ষে নিজের দেশ বলে ‘ওউন’ও করে না। কারণ পৃথিবীর সব দেশেই তাঁর বাড়িঘর, সব দেশই তাঁর বিচরণ ভূমি। তাঁদের একটাই পরিচয়, তারা সম্পদশালী। নাইজেরিয়া, ইন্ডিয়া, ইউএস আর ব্রাজিলের সব ধনীরা আদতে একই জীবনযাপন করে! তাঁদের সন্তানেরা একরকম স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘরানার শিক্ষায় বেড়ে উঠছে পরষ্পরের বন্ধু হয়ে।

এইসব বিচ্ছিন্ন এলিটরা আর কি চাইতে পারে! কি আর, সৌন্দর্য্য, র্দীঘ জীবন এবং র্দীঘ যৌবন ছাড়া! র্দীঘ জীবন দীর্ঘ যৌন-জীবন আর বিলাসিতার শেষ কোথায়! জেনেটিক ইঞ্জনিয়ারিং, মেডিকেল ডেপেলপমেন্ট, মাইক্রেবায়োলজি, কসমেটিক ডেভেলপমেন্টের কল্যানে ইতিমধ্যে আমরা নকল চুল, চোখ, নাক,ঠোঁট, র্হাট, রক্তনালী, স্তন, হাত-পা, পাছা, পেট ইত্যাদি কি পাই নি! ডাক্তারের ছুরির নিচে কি বারবার নিজেকে পেতে দিচ্ছে না বিলিয়ন ডলারের সৌন্দর্য্য আর মেধা বিকিকিনির ইন্ডাস্ট্রি! কোটি কোটি ডলারের ভায়াগ্রার বিজনেস কি হচ্ছে না! স্টেম সেলের গবেষণা তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রযুক্তির শণৈঃ শণৈঃ উত্তরণ ও ’কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের বিশাল হা আমাদের গিলে খেলো বলে! গুগল, আমাজন, অ্যাপেল আর ওয়ালস্ট্রীট কি খুব অপরিচিত আমাদের আজকের পৃথিবীতে! এই এত্তসবের ঢেউ ক্রমশ কোনঠাসা হতে থাকা মানুষের সর্ম্পক, পারষ্পরিক বিশ্বাস, উপরে ওঠার প্রতিযোগিতা, ভালোবাসায় কিরকম জটিল প্রভাব ফেলতে পারে, তারই ইঙ্গিত এই উপন্যাস!

না, উপন্যাসটি তার মৌলিক কতগুলো উপাদান, যেমন স্থান ও সময়, সরাসরি পূরণ না করতে পারলেও উপন্যাসের কাহিনী বিস্তার ও র্কাযকারণ সর্ম্পককে তা কিছুতেই প্রভাবিত করে না। কাহিনী গড়িয়েছে দুই পরবে। পৃথিবীব্যাপী যে গোলমাল লাগে, তার আগে এবং গোলমালের পরে। তবে স্থানটি শেষাবধি আর প্রচ্ছন্ন থাকে না! পাঠক এই বোধে আসে যে স্থানটি হবে শিকাগো, ইউএস। কাহিনীতে পৃথিবীতে দেশগুলোর অবস্থান শুধু নামমাত্র, মানবজাতির বাসস্থান সরাসরি দুইভাগে বিভক্ত। কম্পাউন্ড আর প্লীবল্যান্ড। মুনাফা তৈরিতে উন্মত্ত প্রতিযোগিতামূলক কোম্পানিগুলোর তৈরি করা নিজস্ব বিলাসবহুল এলাকা হচ্ছে কম্পাউন্ড-যেখানে মুনাফা আনতে যারা নিত্য নতুন নতুন উদ্ভাবনার যোগান দিচ্ছে তারা পরিবারসহ বাস করতে পারবে। মুনাফার জন্য যে যতখানি প্রয়োজনীয়, সে তত বিলাসবহুল কম্পাউন্ডে বসবাসের যোগ্যতা রাখে। কিন্তু বদৌলতে তাঁদের স্বাধীন চিন্তা ও চলাচল, ও স্বাধীন জীবনযাপনের অধিকার জিম্মি রাখতে হচ্ছে কোম্পানির কাছে।

পক্ষান্তরে প্লীবল্যান্ড হলো সেই জায়গা যেখানে আপামর বাদবাকি মানুষ বা ভোক্তাদের আবাস। কঠোর সিকিউরিটি দিয়ে কম্পাউন্ডের গেট বন্ধ থাকে। প্লীবল্যান্ডাররা কিলবিলে পরিবেশে, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য, দূষিত বাতাস-পানি আর র্বজ্য নিয়ে বেঁচে থাকে। এদের কোনো সিস্টেম নাই, আইনকানুন বিপর্যস্ত, রাজনৈতিক অনাচার, দূর্নীতি, লোভ-খুন-যুদ্ধ-গুম নিত্য দিনের উপাখ্যান। সীমাহীন লোভী কোম্পানীগুলোর কাছে এরা হচ্ছে সবচেয়ে সুবিধাজনক বাজার। কোম্পানীর উদ্ভাবনের নানারকম পরীক্ষানীরিক্ষার সূতিকাগার!

দুটি ধাপে বিকশিত হওয়া এ উপন্যাসের শুরু হয়েছে একটি পরিবর্তিত পৃথিবীতে, যেখানে ” স্নোম্যান” নামের পুরোনো পৃথিবীর একজন মাত্র ব্যক্তি জীবিত রয়েছে এবং তাঁর সাথে রয়েছে আরো কিছু জেনেটিক্যালি মডিফায়েড নতুন মানুষ! নতুন মানুষেরা ”ক্রেকার” নামে পরিচিত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর এক সাগরতীরে আশ্রয় নিয়েছে টিকে থাকার জন্য। রিজুভেনএসেন্স নামক কোম্পানীর ল্যাবরেটরি থেকে নেমে মাত্রই কম্পাউন্ডের বাইরে এসেছে তারা। গবেষণাগারে তাদের ভেতর থেকে লোভ, সম্পদের বাসনা, সাংবাৎসরিক রিপুর তাড়না ইত্যাদি দুর করা হয়েছে। ক্রেক নামের পুরোনো পৃথিবীর জিনিয়াস বিজ্ঞানীর ইচ্ছেমতো এটি ঘটেছে। বিজ্ঞানী ক্রেক-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী সমস্ত পৃথিবী ধ্বংসযজ্ঞে পরিনত হয়েছে। ক্ষুব্ধ ক্রেক পুরোনো পৃথিবীর স্বার্থপরতা, কোম্পানীর সীমাহীন লোভ, ক্ষমতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার, অসৎ ব্যবসা ইত্যাদি সকল সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছে নতুন মানুষের জেনেটিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

পুরোনো পৃথিবীতে স্নোম্যানের নাম ছিলো জিমি যে কিনা তার বাবা-মাকে হতাশ করে দিয়ে আর্ট আর লিটারেচার ব্রেইন নিয়ে জন্মেছিলো।একাকী-নিঃসঙ্গ জিমির জীবনে সবচেয়ে আনন্দের সঙ্গীর নাম ক্রেক, শৈশব আর কৈশোরের দুনিয়া ভাগাভাগি করে নেয়া মানুষ! ক্রেক আর জিমি বিপরীত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মালে উপন্যাসে ক্রমশঃ এক খলনায়কে পরিণত হয় । ক্রেক আর জিমি ক্রমাগত মানিয়ে চলা সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলোর প্রতিভূ। তুখোড় মেধাবী ক্রেকের চোখে জিমিই একমাত্র মানুষ যার “এমপ্যাথি” নামক অতি বিরল গুণটি রয়েছে। ক্রেক নিজেও সেই গুণ অর্জন করেনি বলে পরিবর্তিত পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার একমাত্র জিমিকেই দিয়ে যায় আত্মহত্যা করার মধ্য দিয়ে। নারী চরিত্র ওরেক্স প্লীবল্যান্ডের দরিদ্র এলাকার আইডেন্টিটি নিয়ে আসে। ওরেক্সের কাছে বেঁচে থাকার বা টিকে থাকার প্রথম শর্তই হচ্ছে মালিকের সন্তুষ্টি আদায়। এক্কেবারে ছোট্ট বেলায় পাচার হয়ে যাওয়া ওরেক্স নানা দেশের নানা প্রতারণায় সিদ্ধ হতে হতে নানা মালিকের হাত ঘুরে এসে কম্পাউন্ডের তুখোড় সায়েন্টিস্ট ক্রেক-এর প্রজেক্টে জড়িয়ে পরে। ওরেক্সকে ঘিরে ত্রিভূজ ভালোবাসার কনফ্লিক্ট গড়ে ওঠে।

উপন্যাসের বেশ কতগুলো জায়গায় টনক নড়ে ওঠার কারণ ঘটে। পৃথিবীব্যাপী মানুষের মৃত্যু ঘটাতে ক্রেকের চমকপ্রদ আইডিয়া তার মধ্যে একটি। ছোটবেলা থেকে কম্পিউটার হ্যাক করার বদভ্যাসের মধ্যে দিয়ে ক্রেকের ভেতরকার পৃথিবী দুর্র্ধষ হয়ে উঠেছিলো সুইসাইড, খুন-জখম, সেক্স ইন্ডস্ট্রি, অত্যাচার, স্বেচ্ছামৃত্যু, জবাই, গোপন নথি ঘাঁটাঘাঁটি, নিরাপত্তরক্ষীর কোডিং ইত্যাদিতে দক্ষতা অর্জনে। তাই তাঁর মৃত্যুপরিকল্পনায় সে ব্যবহার করে “বিøসপ্লাস” নামক যৌন-উত্তেজনাবর্ধক পিল আবিষ্কার এবং তার সার্থক মার্কেটিংয়ে। ক্রেকের ভাষায়, এ এমনই এক পিল যার আকর্ষণ এড়াতে পারবে না পৃথিবীর কেউ এবং এই পিলের ভেতরে সে পুরে দিয়েছে বিষাক্ত ভাইরাস “জুভ!

ক্রেকের জানা দিয়ে ,মরাও জেনে যাই, বড় বড় কোম্পানীগুলো তাদের তৈরি নানা গবেষণার পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যবহার করে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশের মানুষদের। তা সে ওষুধই হোক আর ওষুধের প্রতিষেধকই হোক! ভিটামিন পিলের ভেতর কি ভিটামিনই থাকে না-কি অন্য কোনো নতুন রোগের জীবাণু থাকে, তা-কি আমরা সত্যিই বুঝতে পারি? পৃথিবীতে যদি নতুন নতুন রোগই না হবে, হাজার হাজার মানুষ যদি নাই রোগে ভুগবে তাহলে বড় বড় কোম্পানীগুলো কাদের কাছে ওষুধ বিক্রি করে বিলিয়ন ডলার মুনাফা করবে!

ফিরে যাই হারারিতে! বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে যে গবেষণা ও আবিষ্কারের রেনেসাঁস ঘটেছিলো মানবপ্রজাতির অগ্রগতির নামে, সেখানে দেশজয়, সম্পদজয় আর শক্তিদখলই নেতৃত্ব দিয়েছিলো। পৃথিবীর অগ্রগতির ট্রেনটি আজো চলছে গবেষণায় যারা টাকার জোগান দিচ্ছেন তাদের ইচ্ছের পুষ্টি জোগাতে। সমগ্র মানবপ্রজাতিকে নিয়ে ভাবনা সেখানে গৌণ! তাহলে আজকের পৃথিবীর কম্পউন্ডবাসীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কি হতে পারে যদি ইতিমধ্যেই তারা পেয়ে গিয়ে থাকে পার্থিব যা যা পাাবার আছে। হারারি বলেন, সে হচ্ছে অমরতা। মানুষের পরবর্তী গন্তব্য হচ্ছে অমরতা বা নিদেনপক্ষে দীর্ঘ তারুণ্য!

আর কে না জানে, অমরতার সন্ধান পৃথিবীর মানুষের হাজার বছরের সন্ধান। মৃত্যুকে, মৃত্যুর ভয়কে জয় করাতে কতোই না আহাজারি! এই ধর্ম, স্বর্গ-নরক, বিশ্বাসের নানা ফাঁদে-স্বান্তনায় পা রাখাতো মৃত্যুভয়কে জয় করবারই নানা প্রচেষ্টা! ক্রেক এবং তার কোম্পানী ‘রিজুভেনএসেন্স’সহ বিশ্বের অন্যান্য কমপিটিপিভ কোম্পানীগুলোর তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে বিশেষ নিরাপত্তাবলয়ের ভেতরে ল্যাবরেটরিতে জন্ম নেয় নতুন জেনেটিক কোডের নতুন শিশু। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর ক্ষমতাধরেরা তার আভাস পেয়ে প্রি-অর্ডার দিয়েও রেখেছে নতুন শিশুদের জন্য যাদের ইমিউন সিস্টেম এক্সট্রা অর্ডিনারি এবং অপূর্ব সুন্দর যাদের দৈহিক গঠন। অমরতা বিষয়ে ক্রেকের নিজস্ব ব্যাখাটি ভালো লেগেছে! জিমির প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছে, অমরতা একটি কনসেপ্ট! মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় না, মৃত্যু জীবনেরই অংশ। মানুষ ভয় পায় মৃত্যুর অনিশ্চয়তাকে! মৃত্যুর প্রক্রিয়াকে! মৃত্যুকে স্বাভাবিক গ্রহণ করতে না-পারা মানবপ্রজাতির একটি বড় পরাজয়!

উপন্যাসের ভেতরে প্রচুর নতুন নতুন ভোকাবুলারির আমদানি করেছেন অ্যাটউড! অনেক অর্থহীন-অর্থযুক্ত শব্দও! নতুন প্রকাশভঙ্গীর মানুষ যেমন এসেছে তেমনি তৃতীয় বিশ্বের উপর উন্নত বিশ্বের খবরদারির নানা ইস্যু! উপন্যাসের আগাগোড়া জিমির আখ্যানে ভরপুর হলেও নামকরণে কোথাও জিমি নাই। জিমি চরিত্রটি বহুগামী, আমাদের প্রচলিত ভ্যালুজ-এ জিমি একজন পরিত্যক্ত ব্যক্তিই হবার কথা। অথচ ক্রেক এর বিবেচনায় জিমি-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ পরের প্রজন্মের লালনপালনে। কারণ জিমিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এখনও “যন্ত্র” বা “মেশিন” এর মতো হয়ে যায় নি। জিমিই একমাত্র মানুষ যে নানা সময়ে আর্ট-শিল্পকলা-সাহিত্য ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ক্রেকের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক করেছে। জিমি নির্লোভ এবং কেয়ারিং। মানুষের গল্প, ওরেক্সের গল্প শোনার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় জিমির মতো র্যাটরেসে অংশ না-নেওয়া মানুষের পক্ষেই সম্ভব! ওরেক্সের বেদনায় বা পাওয়ার আশায় কাতর হওয়া মানুষ জিমি! যেটুকু মানবিক গুণাবলী, যদি আমরা সেগুলোকে মানবিক বলে ধরি আর কি, জিমির যেটুকু আছে তাতো আর কারো নাই!

সায়েন্টিফিক প্রজেক্টগুলোর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বর্ণনা অন্তত আমাকে টানেনি। বরং বেশ খানিকটা বোরিং লেগেছে। তবে ধারণা করি, দশম শ্রেণীর এই হাল আমলের সায়েন্স এণ্ড ম্যাথ-বেসড বিশেষ প্রোগ্রামের স্কুলের কিশোর-কিশোরীদেরকে টেনেছে! বেশ কিছু ইঙ্গিতময় কবিতা এসেছে বারবার যেগুলো পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি আমার। [ধারণা করি, ইংরেজি ভাষা বা সাহিত্যের অপ্রতুল জ্ঞান এর কারণ হবে।]

বারবার এবং খোলাখুলিভাবে সেক্সের বর্ণনা এসেছে অবধারিতভাবে। এই উপন্যাস না পড়লে কোনোদিনই জানা হতো না যে টেক্সট বইয়ের মাধ্যমে আমাদের সন্তানেরা মানুষে মানুষে সম্পর্কের কতো জটিল হিসাবনিকাশ পাঠ করে চলেছে এবং তারা সম্পূর্ণ তৈরি এর জন্য! এ বইয়ের কল্যাণে জৈবিক মানুষের বহুগামিতা বিষয়ে ১৫ বছর বয়সী কন্যার সাথে খোলামেলা ও অর্থপূর্ণ আলোচনার সুযোগ অ্যাটউড করে দিয়েছেন। মানুষের আদিম জৈবিক সত্তা, সভ্যতার বিকাশ, নিরন্তর ভোগ, বিকার কোন কোন বাঁকে মানুষকে নিয়ে কোথায় যাবার ক্ষমতা রাখে আর সে দুনিয়া ফেস করার জন্য নিজেদের তৈরি করার সুযোগ কোথায় কোথায় থাকতে পারে, সে চিন্তার উন্মোচনে এই উপন্যাসের ভূমিকা প্রবল হবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই!

তাহলে আশা কি নাই! আছে, আশা আছে! সে আশার ভারও অ্যাটউড পাঠকের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন শেষটায়। বিধ্বস্ত পৃথিবীতে পুরোনো পৃথিবীর কিছু জীবিত মানুষ দেখতে পায় স্নোম্যান। হাতে তার স্প্রেগান। মনে পড়ে, বারবার ওরেক্স আর ক্রেকের কথা যাদের কাছে সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, নতুন পৃথিবীটা শুধুমাত্র নতুন মানুষদের জন্যই রাখা হবে! কিন্তু গুলি চালাতে হাত সরে না তার! কি ক্ষতি করেছে এরা! তাহলে কেন সে বন্দুক চালাবে নিরীহ-অপরাধবিহীনের উপর!

আবারো হারারিতে ফিরে যাই। তাঁর হোমোদিউস গ্রন্থে তিনি ঘুরে দাঁড়ানোর পথ বাতলেছেন। বিজ্ঞানকেন্দ্রীক বিপ্লবে মানুষের জ্ঞানকে বিবেচনা করা হয়েছে পাওয়া তথ্য এবং অংকের সমন্বয় হিসেবে। এই জ্ঞান পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে নানা দিক দিয়ে-পরিবেশ-ইকোসিস্টেম ধ্বংস থেকে শুরু করে মুনাফার বিবেচনায় বিবেচ্য মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিন্ন বুনন তৈরি করেছে। তাঁর মতে, “The Scientific formula for knowledge let to astounding breakthroughs in astronomy, physics, medicine and multiple other discipline. But it has had one huge drawback; it could not deal with questions of value and meaning.” জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার এই পুরোনো হিসাব থেকে বের ুতে হলে নতুন ফর্মুলা দরকার, দরকার মানুষের এথিক্যাল জ্ঞানার্জন যেখানে জ্ঞান মূল্যায়িত হবে অভিজ্ঞতা ও সেনসিটিভিটির সমন্বয়ে।
আমি আশা করবো আমাদের উত্তরসূরীরা সেনসিটিভিটি দিয়ে বিলিয়ন বছরের ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বিচার করতে পারবে সঠিকভাবে!