ফরিদ আহমদ
গলির মুখে পাভেলের সাথে দেখা হয় আমার। সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে, চায়ের দোকানের বেঞ্চে মুখ শুকনো করে বসে আছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এগিয়ে আসে সে।
“আজকে পড়বো না স্যার।” মলিন কণ্ঠে পাভেল বলে।
ওর শুকনো চোখ-মুখ দেখে সন্দেহ হয় আমার।
“ঝগড়া করেছো বাসায়, তাই না?” আমি জিজ্ঞেস করি। সে উত্তর দেয় না, মাথা নিচু করে থাকে।
“কখন বের হয়েছো বাসা থেকে?”
“সকালে।” মৃদু কণ্ঠে বলে সে।
“খেয়েছো কিছু সারাদিনে?”
আমার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না পাভেল। মাথা নীচু করে থাকে।
“এসো আমার সাথে।”
ওকে নিয়ে মালিবাগ মোড়ে আসি আমি। একটা রেস্টুরেন্টে দুজনে মুখোমুখি বসি। পাভেলের প্রিয় খাবার গরুর ভুনা মাংস আর নান রুটির অর্ডার দেই আমি। নিজের জন্য শুধু চা। পাভেলের মুখোমুখি বসে খাবার আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। মাথা নিচু করে বসে আছে সে।
অত্যন্ত রূপবান একটা ছেলে। বয়স মাত্র চৌদ্দ বা পনেরো। ছয়ফুটের মতো লম্বা হয়ে গেছে এই বয়সেই। চমৎকার এথলেটিক ফিগার। গায়ের রং প্রচণ্ড রকমের ফর্সা, মাথার চুল লালচে মতো। দেখলে ইউরোপিয়ান বলে ভ্রম হয়। সামনের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকে হাঁটে পাভেল। হাঁটার তালে তার এক মাথা সুন্দর করে ছাটা রেশম কোমল লালচে চুল দোলে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের বাঁ হাতি পেস বোলার সে। লাল বলটাকে বাঁ হাতের মুঠোয় পুরে বোলিং মার্ক থেকে যখন পাভেল দৌড় শুরু করে তখন দেখার মতো একটা দৃশ্য তৈরি হয়।
পাভেলের মা নেই। না, মারা যাননি ভদ্রমহিলা। ওর বাবার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ওদের বাসায় থেকে পাভেলের এক দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই পড়াশোনা করতো একসময়। সেই ছেলের সাথে নাকি অবৈধ সম্পর্ক ছিল পাভেলের মায়ের। এ কারণে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার বাবা এবং মায়ের। পাভেলের বাবা আবার বিয়ে করেন।
পাভেলের মা মাঝে মাঝে পাভেলকে দেখতে আসতেন। গলির মোড়ে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন তিনি। বাসায় আসার অনুমতি তাঁর ছিল না। কিন্তু, পাভেল ভদ্রমহিলার সাথে দেখা করতে চাইতো না। মায়ের গাড়ি দেখলেই অন্যদিকে ছুটে পালাতো সে। ঠিক কী কারণে মা-কে সে ঘৃণা করে বুঝতে পারতাম না। জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পাইনি আমি পাভেলের কাছ থেকে।
এই ভদ্রমহিলাকে আমি একদিন দেখেছি। অসাধারণ সুন্দরী একজন মহিলা। বাঙালি নারীদের তুলনায় বেশ লম্বা এবং ফর্সা তিনি। লালচে চুল। পাভেলের সৌন্দর্য এবং লম্বা কাঠামো মায়ের কাছ থেকে পাওয়া, সেটা উনাকে দেখার পরেই বুঝেছি আমি।
শুধু আপন মা না, সৎ মায়ের সাথেও পাভেলের সম্পর্ক ছিল বেজায় রকমের তিক্ত। প্রায়ই দেখতাম পাভেল মুড অফ করে থাকতো ঘরের মধ্যে। এর মানে হচ্ছে সৎ মায়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে। আর এ’রকম ঝগড়াঝাটি ছিলো নিত্য দিনের ঘটনা।
বয় খাবার দিয়ে যায়। সুবোধ ছেলের মতো চুপচাপ খেতে থাকে পাভেল। আমি চায়ের কাপে চুমুক দেই। নীরবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর মলিন মুখ দেখে গভীর মায়া অনুভব করি আমি। ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওর বাহু স্পর্শ করি আলতো করে। তারপর কোমল গলায় বলি, “আর কখনো এভাবে বাসা থেকে বের হয়ো না, ঠিক আছে?”
আমার কথা শুনে খাওয়া থেমে যায় পাভেলের। সারাদিনের ধরে রাখা আবেগ, অভিমান আর রাগ দ্রবীভূত হয়ে তরল আকারে জমা হয় আয়ত দুটো চোখের কোণায়। সবুজ মাঠের বুকে দুরন্ত ষাঁড়ের মতো ছুটে এসে ধূসর পিচে শক্ত লাল বলটাকে দারুণ গতিতে ছুড়ে দেয় যে বাঁ হাতটা, সেটাকে তুলে তার আড়ালে মুখ লুকোয় সে। অবরুদ্ধ কান্নায় সারা শরীর কেঁপে ওঠে তার। ফুঁপিয়ে ওঠে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে, “আমার জীবনটা এমন কেন হলো স্যার?”
আমি কিছু বলি না। এর উত্তর আমার জানা নেই। বুকের মধ্যে এক তাল জমানো কষ্ট নিয়ে তাকিয়ে থাকি রূপবান কিশোরটির দিকে।