ফারহানা আজিম শিউলী: ১৭তম (ভার্চুয়াল প্রথম) আসরে “অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক: দ্য ডায়রি অফ এ ইয়াং গার্ল”:
করোনা প্যান্ডেমিকের গৃহে অবরুদ্ধকালীন সময়ে যে কয়টি বই বিশ্বব্যাপী আলোচনায় এসেছে তাদের মধ্যে “অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক: দ্য ডায়রি অফ এ ইয়াং গার্ল” অন্যতম। এ বইটিকে বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম “মুভিং কমেন্টারি” বলা হয়। বইটি অনূদিত হয়েছে ৬০টিরও বেশি ভাষায় এবং এটি বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক পঠিত বইয়ের একটি।

করোনায় গৃহবন্দ্রি মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত যখন অল্প কিছুদিন ঘরে থেকেই হাঁপিয়ে উঠছেন, নানান অভিযোগ-অনুযোগ করছেন, তখন অ্যানা নামের এক কিশোরীর লেখা এই বই সামনে আনে অন্য বাস্তবতা, চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়- অবরুদ্ধ জীবন আসলে কী।

অ্যানার বাবা অটো ফ্র্যাঙ্ক ১৯৩৩ সালে ৪ বছর বয়সী অ্যানাসহ জার্মানি থেকে সপরিবারে হল্যান্ডে অভিবাসী হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪২ সালে ইহুদি নিধন শুরু হলে, নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে, বাবা অটো ফ্র্যাঙ্কের অফিসের দালানের পেছনের পরিত্যক্ত অংশে গোপনে পালিয়ে থাকতে হয় এই পরিবারটিকে পুরো দুইটি বছর (জুলাই ১৯৪২-আগস্ট ১৯৪৪)। সেখানে গোপনে ঠাঁই নেন অ্যানার বাবা অটো ফ্র্যাঙ্ক, মা এডিথ ফ্র্যাঙ্ক, বোন মার্গো এবং সাথে আরো একটি ইহুদি পরিবার- ভ্যান ডান পরিবারের ৩ সদস্য (মিঃ ও মিসেস ভ্যান ডান, তাদের পুত্র পিটার) ও ডুসেল নামে এক ডেন্টিস্ট।

অ্যানা তখন ১৩ বছরের কিশোরী। ১৯৪২ এর ১২ই জুন, ১৩তম জন্মদিনে অ্যানা উপহার পায় একটি ডায়রি। দারুণ খুশি অ্যানা ডায়রিতে লিখতে শুরু করে তার মনের কথা। এটা ঠিক রোজনামচা মতো কিছু ছিল না। ডায়রিটা ছিল তার বন্ধুর মতো। আর লেখাগুলো ছিল চিঠির আদলে।

জন্মদিনের এক মাসের মাথায় তাদের অবরুদ্ধ জীবন শুরু হলে, এই ডায়রি হয়ে ওঠে অ্যানার সবরকমের আশ্রয়স্থল, পরম বিশ্বস্ত বন্ধু। অ্যানার স্বপ্ন ছিল খুব সামান্যই- আবার মুক্ত জীবনে ফিরে যাবার। কিন্তু অ্যানার আর মুক্ত জীবনের স্বাদ পাওয়া হয় না। অ্যানার মৃত্যুর পর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে কোনোরকমে বেঁচে ফেরা একমাত্র সদস্য বাবা অটো ফ্র্যাঙ্ক মেয়ে অ্যানার ডায়রিটি পারিবারিক বন্ধু মিয়েপের কাছে থেকে উদ্ধার করে ১৯৪৫ সালে বই বের করেন। অ্যানা মরে গেলেও, “অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক: দ্য ডায়রি অফ এ ইয়াং গার্ল” বইটির মধ্যে সে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে বেঁচে আছে জীবনের-মুক্তির প্রতীক হয়ে। করোনা প্যান্ডেমিকের গৃহে অবরুদ্ধকালীন সময়ে বিশ্বব্যাপী অন্যতম আলোচিত “অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক: দ্য ডায়রি অফ এ ইয়াং গার্ল” বইটি নিয়ে, গত ১৬ মে, ২০২০ এ, টরন্টোভিত্তিক সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার ১৭তম (প্রথম ভার্চুয়াল) আসরে আলোচনা করেন লেখক-বøগার মাহরীন ফেরদৌস।

১৮তম আসরে “দ্য প্লেগ” : করোনা প্যান্ডেমিকের চলমান বাস্তবতার একদম শুরু থেকেই বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, হচ্ছে আলবেয়ার কামুর “দ্য প্লেগ।” দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি উল্লেখযোগ্য কাগজে করোনা সময় শুরু হবার পর একাধিকবার আলোচনায় এসেছে বইটি, এখনও চলছে আলোচনা। বইটি রচনার ৭৩ বছর পর এই করোনাকালে ঘরবন্দ্রি মানুষ আবার “দ্য প্লেগ” উপন্যাসটি পড়তে শুরু করেছে। নতুন করে পাঠ করা হচ্ছে “দ্য প্লেগ।” অবরুদ্ধ মানুষ তোড়জোড় করে কিনতে শুরু করেছে বইটি। পেঙ্গুইন ক্লাসিকস জানাচ্ছে, শুধু মার্চ মাসেই “দ্য প্লেগ” প্রতি সপ্তাহে কয়েক হাজার কপি করে বিক্রি হয়েছে, নতুন করে মুদ্রিত হয়েছে বইটি পাঠকের বিপুল চাহিদায়।

সাহিত্যে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী আলজেরীয় লেখক-দার্শনিক আলবেয়ার কামুর ক্ল্যাসিক উপন্যাস- “দ্য প্লেগ।” বইটি বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও আলোচিত সাহিত্যকর্মের একটি। আলবেয়ার কামু বিশ্বসাহিত্যের এক অপরিহার্য ও অনিবার্য নাম। কামুর “আউটসাইডার”ও আরেকটি অন্যতম আলোচিত সাহিত্যকর্ম।
দ্য প্লেগের গল্পটা এমন- আলজেরিয়ার উপক‚লে, ফ্রান্সের বন্দ্রর, ওরাওঁ নামক এক শহর। চরম বৈরি আবহাওয়া আর ভোগবাদী মানুষের যান্ত্রিক জীবন- এই দুই মিলিয়ে ওরাওঁ এক “আধুনিক” শহরের প্রতিনিধিত্ব করে। গত শতকের চল্লিশের দশকের কোনো এক সময়ে ওরাওঁ শহরে আচমকা পালে পালে ইঁদুর মরতে থাকে এক অদ্ভুত রোগে, ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ে তা মানুষের মধ্যে মহামারির মতো। রোগটির নাম প্লেগ। ইঁদুরের মতোই পালে পালে মরতে থাকে মানুষ। প্লেগ আস্তে আস্তে সর্বব্যাপী বাস্তবতায় রূপ নেয়? ওরাওঁ শহরে অতর্কিতে প্লেগের সংক্রমণ, শহরের মানুষজনের এই মারণঘাতী রোগে মৃত্যুবরণ, এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, এর মধ্যে দিনযাপন ও একে অতিক্রমের গল্প – “দ্য প্লেগ।”
“দ্য প্লেগ” বইটিতে কেন্দ্র্রীয় চরিত্র ডাঃ রিওর পাশাপাশি আসে প্লেগের ফলে লকডডাউন ওরাওঁতে আটকে পড়া প্যারিসের শীর্ষস্থানীয় এক দৈনিক কাগজের প্রতিনিধি সাংবাদিক র‌্যাঁবেয়া, প্লেগ মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবক স্কোয়াডের প্রধান জ্যাঁ তারিউ, মিউনিসিপাল অফিসের কেরানি গ্রাঁদ, ভ্যাক্সিন আবিষ্কারক ডাঃ ক্যাসেল, পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট অথন, চোরাচালানি কটার্ড, যাজক ফাদার প্যানালু ও অন্যান্যরা।

বইয়ের পাতা জুড়ে একদিকে প্লেগ কবলিত ওরাওঁবাসীদের সঙ্কট- ভীতি-মোকাবিলা আর অন্যদিকে ডাঃ রিওর অসমসাহসিক সংগ্রাম।
কামু সরলরৈখিকভাবে প্লেগে আক্রান্ত এক শহরের কথা বলেননি। উপন্যাসটিতে প্লেগ কখনো যুদ্ধের সমার্থক আবার কখনো স্বৈরাচারের। আবার কখনো দুঃস্বপ্নের মতো অন্তহীন। প্রতিটি চরিত্র এবং ঘটনা, সাথে সমাজ ও প্রকৃতি এতে উপস্থাপিত হয়েছে বহুমাত্রিকতায়, দার্শনিক বোধে এবং অনেকটা নির্মোহভাবে?
বলা হয়, অ্যাবসার্ডিজম প্রতিফলিত হয়েছে “দ্য প্লেগ”-এ। আবার কেউ বলেছেন অস্তিত্ববাদের কথা। উপন্যাস লেখার সময়কালে ফ্রান্স, জার্মানির নাৎসিদের দ্বারা অধিকৃত ছিল। আবার ওদিকে আলজেরিয়ায় তখন ফরাসি উপনিবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মানি অধিকৃত ফ্রান্সে প্রাণঝুঁকির মধ্যেও কামু চালিয়ে গেছেন আন্ডারগ্রাউন্ড সাংবাদিকতা, সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন প্রতিরোধ-আন্দ্রোলনে। কামুর ব্যক্তিজীবন, রাজনৈতিক সত্ত¡া, অ্যাবসার্ডিজমের দার্শনিক বোধ ও সেই সময়ের রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার একধরনের সমন্বিত প্রতীকি উপস্থিতি পাই “দ্য প্লেগে”। প্লেগ যেন স্বয়ং স্বৈরাচারের মতো মানুষের জীবন মরণের নিয়ামক, প্রাণ হন্তারক হয়ে দেখা দেয় “দ্য প্লেগে।” ডাঃ রিও ধরা দেন কামুর অল্টার ইগো হিসেবে।

দীর্ঘ ৯ মাস ধরে (এপ্রিল-জানুয়ারি) স্বৈরাচারের মতো জেঁকে বসা এই সংক্রামক রোগে, প্লেগে- ওরাওঁ এর মতো একটা আধুনিক শহরও এই ছোঁয়াচে রোগের কাছে আত্মসমর্পণ, সরকারি পর্যায়ে রোগের সংক্রমণের ব্যাপারে ডিনায়েল, মহামারি হিসেবে একে ঘোষণা করতে গড়িমসি, সময়মতো জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা জারি না করা, ভ্যাক্সিনের সরবরাহ না থাকা, শহরে লকডাউন, হতভম্ব-ভীত মানুষ, অবরুদ্ধ জীবন, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বাদে অন্যান্য জিনিসপত্রের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া, গাড়ির তেল কেনার ব্যাপারে বিধিনিষেধ, বড় বড় শপিং মলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া, শুধুমাত্র ট্রাম ছাড়া যানবাহনশূন্য-জনশূন্য ফাঁকা রাস্তাঘাট, রোগীর বাড়িঘর-গাড়ি বাধ্যতামূলকভাবে জীবানুমুক্ত করা, রোগের উপসর্গ দেখা দিলে রোগির কোয়ারেন্টাইনে যেতে না চাওয়া-ডাক্তারের কাছ থেকে লুকানোসহ আরো নানারকম অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, আধুনিক-কর্মব্যাস্ত এক নগর স্তব্ধ-সুনশান-লাশের-মৃতের নগরীতে পরিণত হওয়া, স্পেশাল ওয়ার্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় স্কুলে-অফিসে অস্থায়ী হাসপাতাল, জ্যামিতিক হারে রোগের সংক্রমণ বাড়া, কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র্র, সোশ্যাল-ফিজিক্যাল ডিস্টেন্সিং, মাস্ক ও গিয়ার পরা ডাক্তার, গুজব, ধর্মীয় উপসনালয় থেকে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, শহরময় কেবল প্লেগ নিয়েই কথা, লাশের পাশে আত্মীয়স্বজনের যেতে না পারা, কর্তৃপক্ষের তদারকিতে মৃতদেহ সৎকার, কফিন-কাফনের কাপড়-গোরস্তানে কবর দেওয়ার জায়গার দুষ্প্রাপ্যতা, আক্রান্তদের পরিবারকে আইসোলেশনে নেওয়া, আক্রান্ত বাড়ি বা এলাকা লকডাউন করা, প্লেগের সাম্যবাদী চরিত্র, অর্থনৈতিক বিপর্যয় একসময় প্লেগের আতঙ্ককেও ছাপিয়ে যাওয়া, অসহ্য-নির্মম অবসর, আগে অবহেলা করা বা না-দেখা জিনিসগুলো নতুন আলোয় দেখা, অবরুদ্ধ জীবন কবে শেষ হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, অবরুদ্ধ জীবন শেষে কী কী করবে তা ভাবা, হাল ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি নির্বাসিত জীবন মেনে নেওয়া, নূতন স্বাভাবিকতায় মানিয়ে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠাÑ এসব পড়তে গিয়ে ভ্রম হয় আমরা কি বর্তমানের করোনাক্রান্ত কোনো অবরুদ্ধ শহরের কথাই পড়ছি!?

“দ্য প্লেগে”র গল্পে শ্বাশত জীবন ও নৈতিকতার অনুরনণ আছে বলে ওরাওঁ এর গল্প অনায়াসে হয়ে উঠেছে করোনাক্রান্ত অবরুদ্ধ ঢাকা, টরন্টো কিংবা নিউইয়র্কের গল্প। প্লেগ মহামারির চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে আমাদের নিজ নিজ শহরের অতি চেনা মানুষেরই চরিত্র। আর তাই ৭৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনকার বাস্তবতায় অনিবার্যভাবে উচ্চারিত হচ্ছে “দ্য প্লেগ” এর নাম।
বিশ শিতকের দ্বিতীয়ার্ধের অন্যতম প্রভাবশালী ও আলোচিত সাহিত্যকর্ম, সাহিত্যে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী আলজেরীয় লেখক আলবেয়ার কামুর ক্ল্যাসিক উপন্যাস- “দ্য প্লেগ” নিয়ে, গত ৬ জুন, শনিবার টরন্টো সময় সকাল ১১টায় পাঠশালার ১৮তম আসরের লাইভ স্ট্রেমিং-এ আলোচনা করেন অনুবাদক-সাংবাদিক সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ।
১৯তম আসরে “লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা”: ‘গ্যাবো, ১৭ এপ্রিল ছিল তোমার ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ইতোমধ্যে পৃথিবী চলছে মোটামুটি তার চিরাচরিত নিয়মেই। একটি নতুন জিনিস: হাজির হয়েছে এক মহামারি। এমন একটা দিনও যায় না যেদিন আমার সামনে তোমার লেখা উপন্যাস ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ অথবা সেটার শিরোনাম উল্লেখ করে লেখা কিছু আসে না।’
করোনা মহামারিকালে, গত ২০শে মে, নোবেল জয়ী কলম্বিয়ার লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ছেলে রোদ্রিগো গার্সিয়া এক খোলা চিঠিতে প্রয়াত বাবাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো লেখেন।

আসলেই, তাই। পৃথিবীর অন্যতম পাঠক-প্রিয় ও সুসাহিত্য হিসেবে, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ রচিত হবার পর থেকেই, গত প্রায় ৪০ বছর ধরে বিশ্বসাহিত্যে আলোচিত। কিন্তু করোনা মহামারি আবির্ভূত হলে উপন্যাসটি অন্য এক মাত্রা নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। এটি প্যান্ডেমিক লিটারেচার বা মহামারি-সাহিত্য হিসেবে বর্তমান সময়ের অবশ্য-পাঠ হয়ে ওঠে।
মহামারি নিয়ে বিশেষ এক ধরনের আগ্রহ ছিল মার্কেসের, ছিল মৃত্যু নিয়েও। ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’র শুরুটাও হয়েছে এক সদ্য মৃত্যুদৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে। বলা হয়, এই উপন্যাসের গল্প, মার্কেসের বাবা-মা’র জীবনে ঘটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে। ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ লেখার জন্য ড্যানিয়েল ডিফোর ‘আ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’ উপন্যাসটি প্রেরণা ছিল মার্কেসের। উল্লেখ্য, দুর্দান্ত প্রারম্ভ দিয়ে বাজিমাত করেছিল যেসব উপন্যাস সেগুলোর মধ্যে ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ অন্যতম। ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ উপন্যাসের সময়কাল – ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ। গল্পটা ক্যারিবিয় উপক‚লের এক শহরের। স্প্যানিশ উপনিবেশ থেকে সদ্য-মুক্ত কিন্তু উদারপন্থী ও রক্ষণশীল দলের দ্ব›েদ্ব অর্ধশতাব্দী ধরে একের পর এক গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। কলেরা মহামারি সেখানকার জীবনের অনুসঙ্গ। একসময়ের দাস ব্যবসার কেন্দ্র্র, যুদ্ধশরণার্থীসহ নানা বর্ণ ও শ্রেণির মানুষের আবাস? আর এই ঔপনিবেশিক, কলেরা-আক্রান্ত, বৈরি আবহাওয়ার এই শহরেই ফ্লোরেনটিনো আরিজা ও ফারমিনা দাজা’র চিরন্তন বিশ্বস্ততা ও অন্তহীন ভালোবাসার অবিস্মরণীয় গল্প – ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা।’
ফ্লারেনটিনো প্রেমে পড়ে ফারমিনার। ফারমিনার বাবা লোরেঞ্জো দাজা প্রচণ্ড বাধা দেন। ফ্লোরেনটিনো প্রত্যাখ্যাত হয় ফারমিনার কাছ থেকে। ওদিকে কলেরা মহামারির হাত থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে তোলা ও মহামারি নির্মূলে অন্যতম ভূমিকা রাখা প্রভাবশালী ডাঃ জুভেনাল উরবিনোও প্রেমে পড়ে ফারমিনার। এক সময় বিয়ে হয় ফারমিনা ও উরবিনোর।
ফারমিনার প্রেমে পড়ার সময়ে এবং পরের নানা উল্লেখযোগ্য মুহূর্তে ফ্লোরেনটিনোর কলেরার সব উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু তা ছিল আসলে প্রেমের কলেরা। প্রবল প্রেম আর কলেরার উপসর্গ একরকম হয়েই ধরা দেয় এই গল্পে। আবার সময় সময় গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত কাল আর কলেরা হয়ে ওঠে সমার্থক।

ফ্লারেনটিনো প্রত্যাখ্যাত হলেও, ফারমিনার বিয়ে হয়ে গেলেও, অসম্ভব-সম্ভব সব উপায়ে ফ্লোরেনটিনো ফারমিনাকে পেতে চায়, লিখে অসংখ্য চিঠি, অপেক্ষা করে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি। এ এক অন্যরকম অপেক্ষা, অন্যরকম পাগলপারা প্রেম। অবশেষে ফারমিনার স্বামী উরবিনোর মৃত্যুর পর সুযোগ আসে ফ্লোরেনটিনো ও ফারমিনার এক হবার। এক বিশাল জাহাজে তারা মিলিত হয় বৃদ্ধাবস্থায়। মিছেমিছি জাহাজে কলেরার পতাকা উড়িয়ে তারা সাগরের বুকে ভাসতে থাকে অনন্তকাল।
উপন্যাসের মূল চরিত্র ফ্লোরেনটিনো, ফারমিনাকে ফিরে পাবার আগ পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ে অসংখ্য নারীর সাথে, শয্যাবাস হয় শয়ে শয়ে নারীর সঙ্গে তার। কিন্তু শেষে সে ফারমিনাকে জানায়, সে তার কৌমার্য অক্ষত রেখেছে ফারমিনার জন্য। এই ‘কৌমার্য’ কেমনতর? ফ্লোরেনটিনো চরিত্রটির নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমাজের প্রেম, নারী-পুরুষ নিয়ে প্রচলিত ও তথাকথিত মূল্যবোধ চপেটাঘাত খায়, বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে ফ্লোরেনটিনোর অক্ষত কৌমার্য ও ফ্লোরেনটিনো-ফারমিনার ভালোবাসাবাসির সব গল্প।
বল্টবরি কলেরা কালে এক হার-না-মানা প্রেমের উপাখ্যান, চিরন্তন আশা-জাগানিয়া উপন্যাস, বিশ শতকের শেষার্ধের অন্যতম আলোচিত সাহিত্যকর্ম, নোবেলজয়ী কলম্বিয়ার লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের “লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা” নিয়ে গত ২৫শে জুলাই, শনিবার পাঠশালার ১৯তম আসরে (৩য় ভার্চুয়াল) আলোচনা করেন লেখক-সাংবাদিক সেরীন ফেরদৌস।
২০তম আসরে “ঘরে বাইরে”: বিশ্বজুড়ে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ কি করোনা অতিমারি? উত্তর – না। এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ মানুষে মানুষে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে পারষ্পরিক ঘৃণা, সংশয়, অবিশ্বাস, দোষারোপ, ষড়যন্ত্র তত্ত¡, আমাদের ভেতরকার দানব, লোভ, প্রতিষ্ঠানের মুনাফা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা-অজ্ঞানতা এবং সর্বোপরি উগ্র জাতীয়তাবাদ। অথচ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন- বৈশ্বিক একাত্মতা।
করোনা উত্তর পৃথিবীতে ‘নূতন স্বাভাবিকতায়’ কি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক একাত্মবোধ জাগ্রত হবে, নাকি জাতীয়তাবাদি বিচ্ছিন্নতা বাড়বে?
কারণ এই অতিমারি বা দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের মধ্যকার অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, আশঙ্কা জন্ম দেয়, যোগান দেয়, বাড়িয়ে তোলে সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র উপাদানের, উগ্র জাতীয়তাবাদের। আর এখানেই আমাদের সহায় হয়ে উঠতে পারেন রবীন্দ্র্রনাথ। একশ চার বছর আগে লেখা রবীন্দ্র্রনাথের “ঘরে বাইরে” উপন্যাসের নিখিলেশ হয়ে উঠতে পারেন আমাদের আশ্রয়। তিনি হয়ে উঠতে পারেন আমাদের আদর্শ। দেশপ্রেমের পাঠও আমরা পেতে পারি নিখিলেশের কাছ থেকে। “ঘরে বাইরে”র নিখিলেশ আসলে স্বয়ং রবীন্দ্র্রনাথ। রবীন্দ্র্রনাথেরই প্রতিকৃতি নিখিলেশ।

তখন চলছে স্বদেশী আন্দ্রোলন। বিলিতি কাপড় আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। আর দেশি কাপড় মাথায় তুলে নেওয়া হচ্ছে। পুরো বাংলা প্রচণ্ড আবেগে কম্পমান। সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একজন রবীন্দ্র্রনাথ বলছেন – এই কাজটা ভুল। কেন ভুল? কারণ, যেই গরীব মানুষেরা মিলের কাপড় বিক্রি করছিল এবং যারা সস্তায় মিলের কাপড় কিনতে চায় তাদের কী হবে? যে মুসলিমদের হিন্দ্রুরা এতদিন প্রবেশাধিকার দেয়নি হঠাৎ এখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাছে টানছে কেন? এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, দেশের মানুষকে জোর করে দেশপ্রেম শেখাতে যাওয়াটাই বরং দেশদ্রোহ। তখন রবীন্দ্র্রনাথকে বৃটিশের চামচা ও প্রকারান্তরে দেশদ্রোহী বলা হয়েছে। তাৎক্ষণিক আবেগ থেকে বেরিয়ে, সারা বাংলার সামগ্রিক আবেগের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে, যা ন্যায্য ভেবেছেন সেটা উচ্চারণ করেছিলেন রবীন্দ্র্রনাথ। ব্যক্তি রবীন্দ্র্রনাথ যেসব রাজনৈতিক-দার্শনিক অভিঘাতের মধ্য দিয়ে গেছেন, সেসবের সাথে তার দ্বা›িদ্বক অবস্থান, নিজের সচেতন বোধের প্রকাশ পাই “ঘরে বাইরে”র নিখিলেশ চরিত্রে।
“ঘরে বাইরে” প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে। স্বদেশী আন্দ্রোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসে নিখিলেশ, বিমলা, সন্দ্রীপের আত্মকথনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় কাহিনি। এটি চলিত ভাষায় লিখা রবীন্দ্র্রনাথের প্রথম উপন্যাস। এটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র “ঘরে বাইরে।”
জগৎ-জীবন সম্পর্কে তার্কিকতার পরিমণ্ডল “ঘরে বাইরে।” এর গল্প একরৈখিক না। গল্পটাকে উপরে রেখে জগৎ-জীবন সম্পর্কে একটা দার্শনিক, রাজনৈতিক, চিন্তার সাংঘর্ষিকতা ও চিন্তাগত তার্কিকতার বয়ান “ঘরে বাইরে।” এটি ত্রিভুজ প্রেমের গল্প কিংবা সনাতন গল্প না। মানুষের দার্শনিক, মনস্তাত্তি¡ক, বৃহত্তর প্রেক্ষাপট জীবন বোধের নির্মাণ পাই এই উপন্যাসে।
“ঘরে বাইরে”তে ঘর ও বাহির পরষ্পর-নির্ভর, সমান্তরাল না। আপাত সমান্তরাল পৃথিবীর আন্তঃযোগ পাই “ঘরে বাইরে”তে।
সন্দ্রীপ, বিমলা, নিখিল তাদের নিজ নিজ প্রিজম দিয়ে দ্বা›িদ্বক অবস্থান, কখনো স্ববিরোধিতা, অন্তর্দ্ব›দ্ব, পারষ্পরিক অভিঘাতের মধ্য দিয়ে অন্য চরিত্রগুলোর উন্মোচন করে আবার একইসাথে চলতে থাকে ক্রমাগত আত্ম-আবিষ্কার, আত্ম-উন্মোচন।
নিখিলেশের বয়ানে পাই – স্বজাত্ববোধের বাইরে গিয়ে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেমের ধারণা, দেশের নির্মাণ। সন্দ্রীপের বয়ানে পাই – ঈশ্বর/দেবতার সাথে এক করে দেশের নির্মাণ, জাতীয়তার ধারণা। প্রাবল্য দিয়ে, গায়ের জোরে, হিপনটিজম বা সম্মোহন দিয়ে দেশ-নির্মাণ, সবকিছু জয় করা। সন্দ্রীপ নতুন দেশপ্রেম তৈরি করতে চায়, তৈরি করতে চায় নতুন সত্য। দেবী প্রতিমাকে স্বদেশের প্রতিমা করে তুলতে চায় সন্দ্রীপ। নিখিল চায় সত্য, সন্দ্রীপ চায় মোহ।

নিখিল, সন্দ্রীপ দুজনই নানা যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থানে ফিরে ফিরে আসে, ফেরে একই নির্মাণে আর বিমলার মধ্যে পাই দেশ ধারণাটির ক্রমাগত নির্মাণ ও বিনির্মাণ।
নিখিলেশ, নিখিলেশের স্ত্রী বিমলা ও নিখিলের বন্ধু সন্দ্রীপ এই উপন্যাসের মূল ৩টি চরিত্র হলেও মাস্টার চন্দ্র্রনাথ, অমূল্য, মেজোরানী, পঞ্চু এরাও যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। ঘরে বাইরের অমূল্য যেন রক্তকরবীর কিশোর আর চন্দ্র্রনাথ মাস্টারে পাই ঠাকুর্দার চরিত্রের ছায়া, অনেকটা বিবেকের মতো। চন্দ্র্রনাথের বয়ানে পাই – দেশ মানে মাটি নয়, মানুষ, প্রান্তিক মানুষ।
সন্দ্রীপ যখন “বন্দ্রে মাতরম্” বলে নিখিলেশের সংসারে প্রবেশ করে বিমলাকে উগ্র জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে প্রলুব্ধ করে বাইরে টেনে আনতে চায়, তখন নিখিলেশের স্থিতধী ভাবমূর্তি, উদার চেতনা, মানব ঐক্যের বোধ আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়।
দেশ আর ঈশ্বর এক। দেশকে ঈশ্বরজ্ঞানে ভক্তি করতে হবে। যদি ভক্তি না করো, তবে দেশের প্রতি তুমি তোমার দায়িত্ব, তোমার কর্তব্য পালন করছ না। এই ধ্যানধারণা এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু দেশ আর ঈশ্বর যে এক না সেটি রবীন্দ্র্রনাথ বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন।

১৯০৮ সালে রবীন্দ্র্রনাথ এ এম বোসকে এক চিঠিতে লিখেছেন – ও রিষষ হড়ঃ ধষষড়ি ঢ়ধঃৎরড়ঃরংস ঃৎরঁসঢ়য ড়াবৎ যঁসধহরঃু ধং ষড়হম ধং ও ষরাব – “আমি বেঁচে থাকতে দেশপ্রেমকে মানবতার ওপরে জয়ী হতে দেব না।”
পারষ্পরিক ঘৃণা, অবিশ্বাস, উগ্র জাতীয়তাবাদ- মানবতার বিরোধী এবং একইসঙ্গে এটা প্রকৃত দেশপ্রেমও না? মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী এই মানবতার বিরোধী জাতীয়তাবাদের চর্চা এখন সর্বত্র চলছে। এই ধরনের জাতীয়তাবাদ রবীন্দ্র্রনাথ সারাজীবন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই রবীন্দ্র্রনাথ বর্তমানেও হয়ে ওঠেন সহায়। আগামীতেও আমরা জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম প্রশ্নে যা ভাবব বা ভাবতে বাধ্য হব, বর্তমানে যা ভাবছি, সেই ভাবনায় রসদ জুগিয়ে যাচ্ছে-যাবে শতবর্ষ আগের লেখা রবীন্দ্র্রনাথের “ঘরে-বাইরে।” বর্তমানের করোনা মহামারির সময়কালে বিশ্বজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিস্তারে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, শতবর্ষ আগে স্বদেশী আন্দ্রোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস “ঘরে বাইরে” নিয়ে গত ২৯শে আগস্ট পাঠশালার ২০তম আসরে (৪র্থ ভার্চুয়াল) আলোচনা করেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী, লেখক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অ্যাক্টিভিস্ট শুভপ্রসাদ নন্দ্রী মজুমদার।

২১তম আসরে “দ্য মাস্ক অফ দ্য রেড ডেথ”: ১৭৮ বছর আগে ইংরেজ কবি, ছোটগল্প লেখক, সাহিত্য সমালোচক এবং ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ও গোয়েন্দ্রা গল্পের স্রষ্টা অ্যাডগার অ্যালান পো লিখেছিলেন মহামারি নিয়ে এক রূপকধর্মী গথিক মাস্টারপিস – “দ্য মাস্ক অফ দ্য রেড ডেথ”। এবারের করোনা অতিমারিকালে পো’র এই গল্পটি বিশ্বজুড়ে বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে, এই সময়ের সাথে গল্পটির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে এবং করোনা অতিমারির কিছু বাস্তবতাকে তুলনা করা হয়েছে পো’র ক্ল্যাসিক গল্প “দ্য মাস্ক অফ দ্য রেড ডেথ” এর সাথে।

কেন? কারণ এই গল্পে ‘লাল মৃত্যু’ নামে পরিচিত ভয়ঙ্কর এক প্লেগ মহামারির ভয়াবহতার কাছে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের পাশাপাশি, মহামারিকালে প্রকটভাবে দৃশ্যমান ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এবং সুবিধাবাদী শাসকের স্বার্থপর-অমানবিক চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। মহামারি যে ধনী-দরিদ্র বাছবিচার করে না, ধনীরাও এর শিকার হয় এবং মৃত্যু যে অমোঘ সেটিও উচ্চারিত হয়েছে এই গল্পে।
অনেক অনেক দিন আগে “লাল মৃত্যু” একটা দেশকে শ্মশান করে দিয়েছিল। এর আগে কোনো মহামারিই এত মারাত্মক, এত ভীষণভাবে দেখা দেয়নি। রক্তের বিভীষিকা আর টকটকে লাল রক্তই এই রোগের দূত এবং শেষ পরিণতি। হঠাৎ মাথাঘোরা ভাব, তী² একটা যন্ত্রণা, তারপর পচনের সাথে সাথে দেহের প্রতিটি লোমক‚প থেকে প্রচুর রক্তপাত। রোগীর সারা দেহে, বিশেষ করে মুখের ওপর এমন একটা রক্তাক্ত ভাব ফুটে ওঠে, যার আভাসমাত্রই কেউ আর রোগীর কাছে ঘেঁষতে সাহস পায় না। আত্মীয়-পরিজনের এতটুকু সহানুভূতি বা সেবা-যতœ পাবার আর কোনো পথই খোলা থাকে না। অসুখের আবির্ভাব, বিস্তার আর আধঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ- এই হলো এই রোগের সার্বিক বৃত্ত।

রাজ্যের অর্ধেক লোক যখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল এই মারণঘাতী রোগে, তখন রাজ্যের যুবরাজ প্রসপ্যারো নির্বাচিত হাজারখানেক অভিজাত পারিষদ-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব নিয়ে আইসোলেশনে চলে যায় এক নিরিবিলি, জমকালো, বিশাল দুর্গপ্রাসাদে। বিরাট উঁচু ও মজবুত দেয়াল দিয়ে দুর্গটা ঘেরা। এর বিশাল বিশাল লোহার দরজা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুর্গের ভেতরেই খাবার দাবার, আমোদপ্রমোদের সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এভাবেই সুরক্ষিত দুর্গে প্লেগ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে যুবরাজ। বাইরের লোকেদের কথা ভাবার অবকাশ কোথায় তাদের! অথচ বাইরে তখন চলছে ‘লাল মৃত্যু’র ধ্বংসতাণ্ডব।

এভাবে ছয় মাস যায়।
রাজকীয় আবাস হিসেবে যে অংশটুকু এই বিরাট দুর্গের মধ্যে নির্দিষ্ট করা ছিল সেটাতে মোট সাতটি ঘর। ঘরগুলো সার-বাঁধা। প্রতিটি ঘরে গোথিক জানালা। প্রতিটি ঘর ভাঁজ-করা পাল্লা দিয়ে একটা আরেকটার সাথে যুক্ত আর প্রতিটা ঘরের পরপর একটা বাঁক। বাঁকগুলো বারান্দ্রায় এসে মিশেছে। জানালা, কাঁচ, আসবাব আর প্রতিটি ঘরের রঙ অন্য ঘর থেকে আলাদা। সপ্তম ও শেষ ঘরটির সবকিছুতে কালো রঙ আর জানালার কাঁচ রক্ত-লাল রঙের। ঘরগুলোতে আলো বলতে জানালা থেকে বিচ্ছুরিত হওয়া মৃদু আলো। আর সপ্তম ঘরে রাখা বিরাট এক দেয়ালঘড়ি থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভেসে আসে রহস্যময়, রক্ত হিম করা অস্বস্তিকর বাজনা।

একদিন সেখানে শুরু হলো মুখোশ-নাচ। মাঝ রাত অবধি চলছিল সেই নাচ? ঠিক ঐসময়েই মরার মুখের মুখোশধারী, আপাদমস্তক কাফনের মতো সাদা কাপড়ে ঢাকা এক আগন্তুক প্রবেশ করে সেখানে লাল মৃত্যুর শিকারের ছদ্মবেশে। তার সাদা কাপড়ে ছিটানো রক্তের দাগ সবাইকে মনে করিয়ে দেয় ‘লাল মৃত্যু’র কথা। যুবরাজের হুমকি ধামকির তোয়াক্কা না করে মন্থর-দৃঢ় গতিতে তার দিকে এগিয়ে আসে সেই দীর্ঘদেহী আগন্তুক। যুবরাজকে ছাড়িয়ে একে একে নীল ঘর, সাদা ঘর, সবুজ ঘর, কমলা ঘর, বেগুনি ঘর পার হয়ে সে ঢুকে পড়ে লাল-কালো ঘরে। কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায় না? এবং যুবরাজ প্রসপ্যারোসহ একে একে দুর্গপ্রাসাদে আশ্রয় নেওয়া প্রতিটি মানুষ রক্তাক্ত মুখে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। ঘরগুলো ভরে ওঠে বীভৎস সব মৃতদেহে। সুরক্ষিত দুর্গও ‘লাল মৃত্যু’র হাত থেকে রেহাই পায় না শেষমেশ।
উল্লেখ্য, “দ্য মাস্ক অফ রেড ডেথ” গল্প অনুসরণে একই নামে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে (১৯৬৪, ১৯৮৯, ২০০৭)।
“দ্য মাস্ক অফ রেড ডেথ এন্ড আদার টেইলস” বইটিতে “দ্য মাস্ক অফ রেড ডেথ” ছাড়াও “কিং পেস্ট”, “লাইজিয়া”, “বেরেনিস”, “মেজেনগার্সটিন”, “দ্য স্ফিংস”, “মোরেলা”, “দ্য গোল্ড বাগ” নামে আরো ৭টি গল্প আছে। প্রতিটি গল্পই রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা। গা ছমছমে এসব গল্প টেনে রাখে পাঠককে। শুরু করলে বইটি শেষ করে তবেই উঠতে হয়।
করোনা অতিমারিকালে বহুল আলোচিত, বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক অ্যাডগার অ্যালান পো’র অন্যতম মাস্টারপিস ‘দ্য মাস্ক অফ দ্য রেড ডেথ’ নিয়ে, সেপ্টেম্বর ২৬ শনিবার, পাঠশালার ২১তম আসরে (৫ম ভার্চুয়াল) আলোচনা করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গল্পকার ডঃ দীপেন ভট্টাচার্য। উল্লেখ্য, এটি ছিল একইসাথে পাঠশালার ৩য় বর্ষপূর্তি আসরও।
পাঠশালার আসরগুলোর পোস্টার ডিজাইন করেছেন চিত্রশিল্পী রাগীব আহসান।
প্যান্ডেমিক লিটারেচার নিয়ে অনুষ্ঠিত টরন্টোভত্তিক সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার গত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভার্চুয়ালি আসরগুলোর প্রতিটিতেই মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন ফারহানা আজিম শিউলী।
পাঠশালা ২০১৭ সাল থেকে টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরির এগলিন্টন স্কোয়ার শাখায় নিয়মিতভাবে সাহিত্য আসর করে আসছিল। এতে উপস্থিত থাকতেন টরন্টো শহরের বই-পড়ুয়া, সাহিত্যামোদীরা। এই বছরের মার্চ থেকে করোনা অতিমারির বাস্তবতায় এখন আসরগুলো হচ্ছে ভার্চুয়ালি, লাইভ স্ট্রেমিং হচ্ছে পাঠশালার ফেসবুক পেইজ থেকে। এই ভার্চুয়াল আসর এখন টরন্টোর সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক চরিত্র নিয়েছে। এখন আসরের দর্শক-শ্রোতারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যপ্রিয় মানুষজন। বিশ্বসাহিত্যের নিবিড় স্বাদ নিতে সাহিত্যপাঠে আগ্রহীদের পাঠশালা ভবিষ্যতেও সাথে পাবে এই প্রত্যাশা করে।
পাঠশালার পেইজ ‘লাইক’ বা ফলো করে পাঠশালার লাইভ দেখা যাবে। পাঠশালার পেইজের লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/পাঠশালা-৪৮২৮৭৫১২৮৭৪৯৮৩৯/
পাঠশালার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে নিলে আসরের রেকর্ডেড ভিডিও দেখা যাবে। পাঠশালার ইউটিউব চ্যানেলের লিঙ্ক:
https://www.youtube.com/user/azimfarhana75