Home কানাডা খবর ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস-এর জন্মদ্বিশতবর্ষে পাঠশালার আসর

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস-এর জন্মদ্বিশতবর্ষে পাঠশালার আসর

ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টো ভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৩২তম ভার্চুয়াল আসরটি ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এর জন্মদ্বিশতবর্ষ উপলক্ষ্যে নিবেদিত এই আসরে আলোচিত হয় ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এবং এঙ্গেলস রচিত গ্রন্থ “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট”। আলোচনা করেন লেখক, গবেষক ও সংগঠক মোহাম্মদ ইরফান।
মার্ক্সীয় তত্তে¡র সাধারণ পাঠক কিংবা মার্ক্সবাদের সমর্থকদের কাছে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের পরিচয় মার্ক্সের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। এঙ্গেলস নিজেও নিজেকে মার্ক্সের “সেকেন্ড ফিডল” হিসেবে অভিহিত করেছেন। উত্তরকালের গবেষকদের একটি অংশ এঙ্গেলসকে কেবলই মার্ক্সের সম্পাদক, প্রকাশক হিসেবে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক কাজকে খাটো করেছেন। নয়া-বাম জমানায় কেউ কেউ এমনকি স্ট্যালিনের সময়কার জোর-জবরদস্তির জন্য দায়ী করেছেন এঙ্গেলসের “আদর্শিক বাড়াবাড়ি”কে। এঙ্গেলসের জন্মদ্বিশতবর্ষের প্রাক্কালে তাত্তি¡কেরা নূতন করে খতিয়ে দেখছেন – আধুনিক বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মতবাদ বিনির্মাণে কার্ল মার্ক্সের পাশাপাশি এঙ্গেলসের মৌলিক অবদানগুলো।

সরেজমিন গবেষণা (কন্ডিশন অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড) কিংবা সেকেন্ডারি রিসার্চ (অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি এন্ড দ্য স্টেট), মৌলিক কর্মসূচী প্রণয়ন (কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো) কিংবা দার্শনিক সার রচনা (এন্টি-ডুরিং), মার্ক্সের সহলিখন কিংবা সম্পাদনা (ক্যাপিটালের দ্বিতীয় ও পরবর্তী খণ্ডগুলো) – এইসব নানান ধরনের নানান মাপের তাত্তি¡ক কাজ করেছেন এঙ্গেলস, সংগঠন-আন্দোলন এমনকি বিপ্লবী রণাঙ্গনে পদচারণার পাশাপাশি।
“দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি এন্ড দ্য স্টেট” (“পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি”) গ্রন্থে এঙ্গেলস মানবসমাজে শ্রেণীবিভক্তির সৃষ্টিকাল ও স্বরূপ সন্ধানে সচেষ্ট হয়েছেন সমকালীন নৃতাত্তি¡ক গবেষণা ব্যবহার করে। এই গ্রন্থ প্রকাশের শতবর্ষ পূর্তি হয়েছে আজ থেকে ৩৭ বছর আগে। আজও প্রাসঙ্গিক নয় অধ্যায়ের এই ছোট্ট বইটি — কেবল শ্রেণীবিরোধই নয়, লিঙ্গ বৈষম্যের মত বহুলচর্চিত সমকালীন বিষয়গুলোর পেছনের মূল কার্যকারণ অনুধাবনের জন্যে।

মার্ক্সবাদী চিন্তাধারার অন্যতম পথিকৃৎ ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এর জন্মদ্বিশতবর্ষ উপলক্ষ্যে, টরন্টো ভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র এবারের আয়োজন এঙ্গেলস এবং তাঁর কালোত্তীর্ণ রচনা “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি এন্ড দ্য স্টেট” নিয়ে।
আলোচক মোহাম্মদ ইরফান ও সঞ্চালক ফারহানা আজিম শিউলীর মধ্যে সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলাপচারিতার মাধ্যমে এঙ্গেলস ও এঙ্গেলস রচিত গ্রন্থ “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি এন্ড দ্য স্টেট” নিয়ে কয়েকটি ভাগে আলোচনা হয় ।

ফারহানা আজিম শিউলী: ফ্রিডড্রিখ এঙ্গেলসকে যদি চার-পাঁচটি বাক্যে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়, তবে কী বলতে পারি আমরা?

মোহাম্মদ ইরফান: এঙ্গেলস একজন গবেষক, সংগঠক ও লেখক। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মূলত সমাজ ও রাজনীতি। তিনি প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষন থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত ব্যবহার করে নূতন তত্ত¡ তৈরি কিংবা নতুন মডেল তৈরি করে, সেই মডেল দিয়ে সমাজব্যবস্থার বিবর্তন বা পরিবর্তন ব্যাখ্যা করেন। মানবজাতির ঐতিহাসিক আদিম অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যতে কী হবে সেটি খুব সুন্দরভাবে, বৈজ্ঞানিকভাবে উনি ব্যাখ্যা করেছেন বিভিন্ন গ্রন্থে। সংগঠক হিসেবেও এঙ্গেলস ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তিনি এবং কার্ল মার্ক্স একসঙ্গে মিলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে সমাজতন্ত্রের আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতির দার্শনিক এবং সাংগঠনিক ভিত্তিভূমি রচনা করেন। মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্রের কথা বললে আমরা মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজনের কথাই একসঙ্গে বলি। ১৮৪৫ সালে তিনি শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন, রচনা করেছেন কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই হচ্ছে মূলত এঙ্গেলস এর কাজের অবদান।

ফারহানা আজিম শিউলী: এঙ্গেলসের জীবন এবং সেই সময়টা সম্পর্কে কিছু বলুন।
মোহাম্মদ ইরফান: ১৮২০ সালের ২৮শে নভেম্বর জন্ম এঙ্গেলস এর। তাঁর জন্ম হয়েছিল তৎকালীন প্রুশিয়ান সাম্রাজ্যের (বর্তমানে জার্মানি) বারমেন শহরে। প্রুশিয়ানরা ছিল মিলিটারি জাতি। তারা তখন সম্রাটের অধীনে ছিল এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ ভালো ছিল। বারমেন ছিল একটি শিল্প শহর। সেখানকার এক ধনী পরিবারে জন্ম হয়েছিল এঙ্গেলস এর। তাঁর পরিবার ছিল পুঁজিপতি। কটন টেক্সটাইল কারখানা ছিল তাঁদের নিজস্ব শহরে এবং ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের স্যালফোর্ডে, যেখানে পরবর্তীতে পাঠানো হয়েছিল এঙ্গেলসকে। ধর্মীয়ভাবে তাঁর পরিবার খুব গোঁড়া ছিল। জার্মানিতে ক্যাথলিসিজমের বিরুদ্ধে যে প্রোটেস্টানিজম আসে, সেই প্রোটেস্টানিজমের অনুসারী ছিল তাঁর পরিবার। এই পরিবারে জন্ম নেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এঙ্গেলস এর বাবা চেয়েছিলেন এঙ্গেলস অংশ নিক তাঁদের পারিবারিক ব্যবসায়। এমনকি ১৭ বছর বয়সে এঙ্গেলসকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে ব্যবসায় যুক্ত করতে চেয়েছিলেন তাঁর বাবা। কিন্তু এঙ্গেলস কবিতা লিখতেন, দর্শন পড়তেন। হেগেল তখন জার্মানির তারকা দার্শনিক। এঙ্গেলস সেই সময়কার ইয়াং হেগেলিয়দের সঙ্গে মিলে গেলেন, তর্ক-বিতর্ক করলেন। এসব দেখেশুনে বাবা ভাবলেন এভাবে হবে না বরং এঙ্গেলসকে পাঠিয়ে দিলেন দূরে, ম্যানচেস্টারে। কিন্তু এটাই হয়তো তাঁর বাবার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিল। কারণ ম্যানচেস্টারে গিয়েই এঙ্গেলস এর চেতনা আরো শানিত হলো, অভিজ্ঞতা অনেক বেশি বিস্তৃত হলো। রাউল পেক এর “দ্য ইয়াং কার্ল মার্ক্স” চলচ্চিত্রে দেখানো হয় – ম্যানচেস্টারের কারখানায় এঙ্গেলস এর বাবা এসে মেরি বার্নসকে (আইরিশ নারী যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এঙ্গেলস এর সঙ্গে ছিলেন) কারখানা থেকে বহিষ্কার করছেন, আর এঙ্গেলস তার পেছনে পেছনে চলে গেলেন এক আইরিশ পাব এ। সেই পাব এখনকার মতো সুন্দর করে সাজানো আইরিশ পাব ছিল না। আইরিশরা ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠী কিন্তু তারা সামাজিকভাবে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল। পাবে গিয়ে এঙ্গেলস বললেন, তিনি আইরিশদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে চান। ইয়াং হেগেলিয়দের সঙ্গে মিশে ততদিনে তাঁর জানাশোনা হয়ে গেছে। সেই যে শুরু এঙ্গেলস এর জীবনের, তারপর সারাজীবনই তিনি এই কাজে থাকলেন। ঐ সময় ইউরোপের অন্যান্য দেশেও প্রতিরোধ গড়ে উঠছে সামন্তপ্রথা ও পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে। তখন শিল্পবিপ্লব কেবল হয়েছে এবং শিল্প বিপ্লবের কারণে দেখা দিয়েছে কারখানায় শ্রমিকদের দুরবস্থা, দীর্ঘ শ্রমঘণ্টা, অল্প বেতন, কথায় কথায় বরখাস্ত, বাচ্চাদের দিয়ে কাজ করানো। এগুলোর বিরুদ্ধে তখন ধীরে ধীরে আন্দোলন দানা বাঁধছে যেখানে এঙ্গেলস, মার্ক্স এবং অন্যান্যরা মিলে বিশাল তাত্তি¡ক, দার্শনিক এবং সাংগঠনিক ভূমিকা রাখলেন এবং সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষদের একত্রিত করলেন।

ফারহানা আজিম শিউলী: এঙ্গেলস এর যে জীবনব্যাপী অনেক অনেক অর্থবহ কাজ, সেসবের শুরুটা কী করে হলো?
মোহাম্মদ ইরফান: জার্মানিতে ইয়াং হেগেলিয়দের সঙ্গে মিশে এঙ্গেলস কিছুটা উদ্বুদ্ধ হলেন। তারপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ম্যানচেস্টারে। এবং ম্যানচেস্টারেই শুরু হচ্ছে এঙ্গেলস এর একেবারেই শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। সেখানেই তাঁর দেখা হয়েছিল মেরি বার্নস এর সঙ্গে। যেটি আমরা “ইয়াং কার্ল মার্ক্স” চলচ্চিত্রেও দেখি। এঙ্গেলস ও মেরি বার্নস দুজনে মিলে ঘুরলেন নানা জায়গায়। এঙ্গেলস বই লিখলেন “কন্ডিশন অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড”। এর কিছুদিন পরেই মার্ক্সের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ হয়। এ থেকে মূলত শুরু তাঁর প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের এবং মেরি বার্নস তাঁকে “লিগ অফ জাস্ট” এর লোকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। এই “লিগ অফ জাস্ট” থেকে পরে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস “কমিউনিস্ট লিগ” এর সূচনা করলেন। এই সময়টাতেই খুব বেশি করে এঙ্গেলস জড়িয়ে গেলেন এই ধরনের কাজে এবং তাত্তি¡ক ভিত্তি রচনায়।
এ পর্যায়ে এঙ্গেলস এর জীবনসঙ্গী মেরি বার্নস ও কার্ল মার্ক্স এর স্ত্রী জেনির স্থিরচিত্র দেখানো হয়।

ফারহানা আজিম শিউলী: কার্ল মার্ক্সের সঙ্গে এঙ্গেলস এর যোগাযোগটা কীভাবে, ঠিক কোন সময়টায় শুরু হলো?
মোহাম্মদ ইরফান: মার্ক্স ও এঙ্গেলস দুজনেই তখন বেশ তরুণ। এঙ্গেলস এর জন্ম ১৮২০ সালে, মার্ক্সের জন্ম ১৮১৮ সালে। অর্থাৎ প্রায় সমবয়সী ছিলেন তাঁরা দুজন। যেসব ঘটনার কথা আমরা বলছি – ম্যানচেস্টারে চলে এসেছেন এঙ্গেলস, তাঁর বাবা তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেটি ১৮৪৩ সালের দিকে। অর্থাৎ তাঁদের বয়স তখন ২০-২২। মার্ক্স তখন প্রুশিয়াতে পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তাঁর কর্মকাণ্ডের কারণে এবং জেল এড়ানোর জন্য তিনি প্যারিসে চলে আসেন ১৮৪২-৪৩ ঐ সময়টায়। এর আগে জার্মানির কোলনে এক পত্রিকা অফিসে একবার দেখা হয়েছিল দুজনের। সেটি দুজনের মনে কতটা দাগ কেটেছিল তা জানা নেই। পরে যখন প্যারিসে দেখা হয় তখন অবশ্য দুজনই কোলনের পত্রিকা অফিসে সেই দেখার কথা উল্লেখ করেছিলেন, যা আমরা চলচ্চিত্রতেও দেখি। দুজনের মধ্যে মূল মৈত্রীটা তৈরি হয় প্যারিসে ১৮৪৩ সালের আগস্টে। গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক ট্রিস্ট্রাম হান্ট “মার্ক্স’স জেনারেল” নামে এঙ্গেলসের একটি জীবনী লিখেছেন। সেখানে হান্ট দুজনের সেই সাক্ষাতকে “টেন বিয়ারস সৌকড ডেইজ” বলেছেন। “টেন বিয়ারস সৌকড ডেইজ” বা “মদে চুপচুপ দশদিন” অনেকটা জন রিডের “দুনিয়া কাঁপানো দশদিন” এর মতোই। দশদিনের যেই আলোচনা মার্ক্স আর এঙ্গেলস এর প্যারিসে, সেটির কারণেই আমরা এই বিশাল তত্ত¡, যেটা সমাজ পরিবর্তনে কাজ করছে প্রায় দুশো বছর ধরে এবং কাজ করবে আগামী দুশো চারশ বা হাজার বছর ধরে, সেটি পেয়েছি। প্যারিসে বিয়ার খেতে খেতে দুজনের মধ্যে দশদিন ধরে ক্যাফেতে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হয় এবং তখনই তাদের মূল মৈত্রীটা তৈরি হয়। “কন্ডিশন অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস” তখনও বই আকারে প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু প্যারিসে বসে মার্ক্স পত্রিকায় প্রকাশিত এঙ্গেলস এর “কন্ডিশন অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস” এর কিস্তি কিস্তি লেখাগুলো পড়ছেন এবং পড়ে এঙ্গেলস সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। দুজনেরই তো শেকড় জার্মানিতে। দুজনের চেনা সোশ্যালিস্ট চিন্তাধারার লোকজন দুজনকেই তখন দুজনের কথা বলছেন। এঙ্গেলস যাত্রা বিরতি করলেন প্যারিসে, ম্যানচেস্টার থেকে বারমেন যাবার পথে কিংবা বারমেন থেকে ম্যানচেস্টারে আসার পথে। সেখানে মার্ক্স এক প্রকাশকের কাছ থেকে টাকা আনতে গিয়েছেন। কারণ মার্ক্সের খুব দরিদ্র অবস্থা ছিল প্যারিসে। যদিও মার্ক্স এবং তাঁর স্ত্রী জেনি দুজনেই ছিলেন অভিজাত পরিবারের, কিন্তু তাঁদের সবকিছু ছেড়েছুড়ে আসতে হয়েছে বিপ্লবী চিন্তার কারণে। এঙ্গেলস প্যারিসে সচেতনভাবেই যাত্রাবিরতি করলেন মার্ক্সের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। তারপর সেই প্রকাশকের বাসায় দেখা হলো তাঁদের। সেখান থেকে বেরিয়ে তাঁরা প্যারিসের লা রিজেন্সি ক্যাফেতে বিয়ার খেতে খেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করলেন। একদিকে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা সরেজমিনে দেখেছেন এঙ্গেলস, আর সেটির রিপোর্ট নিচ্ছেন মার্ক্স। এঙ্গেলস মার্ক্সকে বলছেন “লিগ অফ জাস্ট” এর কথা, লোকজনের মধ্যে কাজ করতে গেলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র তৈরির কথা। মার্ক্স বলছেন এঙ্গেলসকে তাঁর চিন্তাধারাগুলো। এর মধ্যে আছে হেগেলের ডায়ালেক্টিক কীভাবে বস্তুবাদের দিকে যাচ্ছে সেই বিষয়গুলো, রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে আলাপ ইত্যাদি। এবং তখনই “হলি ফ্যামিলি”র ড্রাফটটি তাঁরা একসঙ্গে রচনা করেছিলেন, সেই দশদিনে। এঙ্গেলস তারপর ফিরে গেলেন ম্যানচেস্টারে।
উল্লেখ্য, এঙ্গেলস এর প্রথম বই কিন্তু “কন্ডিশন অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস” না। ” হলি ফ্যামিলিৃ ” নামে প্রথম প্রকাশিত বই তিনি এবং মার্ক্স একসঙ্গে লিখেছেন। বইয়ের নামটা স্যাটায়ারিস্টিক। ওখানে ছিলেন বাওয়ার ভ্রাতৃদ্বয়। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এর বিতর্ক হয়েছিল যেসব ইয়াং হেগেলিয়দের সঙ্গে, সেইসব রক্ষণশীল হেগেলিয়দের পক্ষে লিখেন বাওয়ার ভ্রাতৃদ্বয়। তাঁদের সমালোচনায় একটি বই মার্ক্স ও এঙ্গেলস দুজনে মিলে প্রথম লিখলেন “হলি ফ্যামিলিৃ ” নামে এবং সেটি প্রকাশিত হলো ১৮৪৪ সালে। আর “কন্ডিশন অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস” প্রকাশিত হলো ১৮৪৫ সালে।
এ পর্যায়ে রাউল পেক এর “দ্য ইয়াং কার্ল মার্ক্স” চলচ্চিত্র থেকে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এর তরুণ বয়সের স্থিরচিত্র দেখানো হয়। চলচ্চিত্রটিতে মার্কের ভূমিকায় অভিনয় করেন অগাস্ট ডিয়েল এবং এঙ্গেলস এর ভূমিকায় অভিনয় করেন স্টেফান কোনারস্ক। আলোচক ইরফান পরিচালক রাউল পেক সম্পর্কে বলেন, রাউল পেক এর “দ্য ইয়াং কার্ল মার্ক্স” ছাড়াও আরো কয়েকটি ভালো চলচ্চিত্র আছে। জেমস বল্ডওয়ের ওপর রাউল চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। রাউল দুবছরের জন্য মন্ত্রী ছিলেন হাইতির। পরে পুরো মন্ত্রী সভাই পদত্যাগ করে। চলচ্চিত্রে আগ্রহীদের রাউল পেক এর অন্য চলচ্চিত্রগুলোও দেখার আহবান জানান ইরফান।

ফারহানা আজিম শিউলী: এঙ্গেলস ও মার্ক্সের বন্ধুত্ব এবং তাঁদের যৌথ কাজ সম্পর্কে বলুন।
মোহাম্মদ ইরফান: এঙ্গেলস আর মার্ক্সের সেই যে বন্ধুত্ব হলো, তারপর পুরো চার দশক যতদিন বেঁচে ছিলেন পুরো সময়টা ধরেই সেই বন্ধুত্ব অটুট ছিল। আমরা জানি, মার্ক্সের “সেকেন্ড ফিডল” হিসেবে এঙ্গেলস নিজেই নিজেকে অভিহিত করতেন। মার্ক্স যে প্রচুর কাজ করতেন, সেই কাজে তাঁকে অনেকটা সময় দিতে হতো। পত্রিকায় লিখতেন তিনি। সেখান থেকে কিছু উপার্জন হতো। নিউইয়র্কের বিভিন্ন পত্রিকায়ও তিনি লেখা পাঠাতেন। কিন্তু মূলত মার্ক্সের পরিবারের আর্থিক যোগানদার ছিলেন এঙ্গেলস। আমরা জানি, এঙ্গেলস ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন এবং তাঁর বাবার কারখানার তিনি শেষ পর্যন্ত ম্যানেজার হয়েছিলেন। সেই উপার্জন থেকে মার্ক্স ও মার্ক্সের পরিবারকে প্রচুর সহযোগিতা করেছেন এঙ্গেলস। আর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংগঠনিক কাজে তাঁরা একেবারে সবসময়ই একসঙ্গে ছিলেন। জার্মানিতে বিপ্লবও করতে গিয়েছেন একসঙ্গে দুজন। সেই বিপ্লব অবশ্য সফল হয়নি। আর লেখালেখির কাজে তো প্রতি ছত্রে ছত্রেই ছিল যৌথ প্রয়াস। “দ্য ইয়াং কার্ল মার্ক্স” চলচ্চিত্রে “কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো” লেখার একটি দৃশ্য আছে – বেলজিয়ামের সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে এঙ্গেলস মার্ক্সকে বলছেন মেনিফেস্টো লেখার কথা, আর মার্ক্স বলছেন তিনি বই লিখতে চান, মেনিফেস্টো না। সাংগঠনিক দিকটায় এঙ্গেলস তখন কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। তিনি মেরির সঙ্গে ঘুরে শ্রমিকদের কাজের অবস্থা দেখেছেন এবং “লিগ অফ জাস্ট” এর সঙ্গেও কথা বলেছেন। কাজেই ইতোমধ্যে এসব ব্যাপারে তাঁর কিছুটা ধারণা ছিল এবং তিনি একটি খসড়ার কথাও চিন্তা করতেন। তিনি মার্ক্সকে রীতিমতো জোর করে বসিয়ে দুজনে মিলে রচনা করলেন “কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো।” প্রুধোঁর কথা আমরা জানি। সেই প্রুধোর সমালোচনাও দুজনে একসঙ্গে মিলে লিখেছেন। “এন্টি ডুরিং” লিখলেন এঙ্গেলস। হের ডুরিং যখন সমাজতন্ত্রের নিজস্ব ব্যাখ্যা লিখলেন, মার্ক্স তখন “ক্যাপিটাল” লেখায় ব্যস্ত। এঙ্গেলস তখন লিখতে এগিয়ে এলেন। মার্ক্স মারা যাবার পর আজকের আলোচ্য বইটি “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলিৃ” মার্ক্সের নোটবুক থেকে এঙ্গেলস লিখলেন এবং মার্ক্সের “ক্যাপিটালে”র বিভিন্ন অপ্রকাশিত অংশগুলো একত্র করে ২য় ও ৩য় খণ্ড প্রকাশ করলেন। অর্থাৎ পুরো সময়টিই দুজন একইসঙ্গে এগিয়ে গেছেন সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক তত্তে¡র ভিত্তিভূমি রচনায়।

ফারহানা আজিম শিউলী: এঙ্গেলসের অন্যতম একটি কাজ, “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি এন্ড দ্য স্টেট” বা “পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি।” প্রথমেই বইটির প্রেক্ষিত, পটভূমি, প্রকাশকাল সম্পর্কে জানতে চাই।
মোহাম্মদ ইরফান: বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৮৮৪ সালে জার্মান ভাষায়। এরপর ১৯০২ সালে এর একটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এই বইটি মার্ক্সের নোটবুক থেকে, মার্ক্স মারা যাবার পর লিখেন এঙ্গেলস। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এর যে পুরো প্রকল্প সেখানে তাঁরা বলছেন, আজকের যে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ এটি স্বাভাবিক বিবর্তন না। এটি একটি বিশেষ ধরনের উৎপাদন সম্পর্কের কারণে আজকের এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজে পরিণত হয়েছে এবং এটি এক ধরনের কৃত্রিমতা। এই যে তাঁদের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা তা প্রতিষ্ঠায় ধীরে ধীরে তাঁরা উপাত্ত সংগ্রহ করে এই বিষয়গুলো প্রমান করার চেষ্টা করছিলেন। নৃবিজ্ঞানী মর্গানের “আদিম সমাজ” বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে। মর্গান দেখালেন, আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে, মাতৃসুত্রীয় সমাজ থেকে কীভাবে পিতৃসূত্রীয় ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ হলো, গোত্র থেকে কীভাবে রাষ্ট্র এলো। এঙ্গেলস ও মার্ক্স তখন এসব উপাদানই খুঁজছিলেন এবং সেসব উপাদান এসব নৃবিজ্ঞানীরা নিয়ে এলেন। মর্গান যাঁদের অন্যতম একজন। ঐ সময়টায় আমরা দুটো ব্যাপার দেখি। একটা হচ্ছে, বিজ্ঞানের একটা বিশাল অগ্রগতি হচ্ছে। ডারউইন ১৮৫৯ সালে “দ্য অরিজিন অফ দ্য স্পিশিজ” প্রকাশ করেছেন। ডারউইন ডিডাকশানিজমে বিশ্বাস করতেন না। সরেজমিনে মাঠে গিয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে তিনি তত্ত¡ রচনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ইন্ডাকটিভ মেথডে। এবং ডারউইনের সফলতার কারণে সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানেও এই ধারাটা তৈরি হলো। সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদী মর্গান, স্পেন্সার, টেইলর একইভাবে সমাজের বিবর্তন ব্যাখ্যা করলেন। সেসব মার্ক্স ও এঙ্গেলস এর হাতে প্রচুর তথ্য দিলো, তাঁদের দুজনের সমাজ বিবর্তনের যে হাইপোথিসিস সেটি প্রমান করার জন্য। এটি গেলো একটা দিক। আরেকটা দিকে আবার তখন নারীদের অবস্থা কী হবে বা “উইমেন কোশ্চেন” নিয়ে সমাজতন্ত্রের তত্ত¡ যাঁরা তৈরি করছেন তাঁদের মধ্যে নানান রকম চিন্তা এলো। কারণ নারীরা যে নির্যাতিত, নিপীড়িত ঐ ভিক্টোরিয়ান যুগে সেটি তো সবাই প্রত্যক্ষ করছিল। সেইক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের তাত্তি¡কদের অবস্থান কী হবে সে নিয়ে নানারকম চিন্তাভাবনা চলছিল। তবে তাঁদের নিজেদের মধ্যেও নানারকম স্ববিরোধিতা ছিল। লা সাল এটাও বলেছিলেন, নারীকে কারখানার বাইরে রাখতে হবে। তবে প্রথমদিকে যাঁরা অগ্রসর কথা বলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন অগাস্ট বেবেল। তিনি একটি বই লিখেছিলেন “উইম্যান এন্ড সোশ্যালিজম” নামে। বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তখন প্রুশিয়ান সাম্রাজ্যে সমাজতন্ত্রের বই হলেই সেগুলোর ওপর খড়গ নেমে আসতো। পরে বেবেল অন্য নামে বইটি লিখেছিলেন। তবে বেবেলেরও স্ববিরোধিতা ছিল। উনি বলেন, নারী পুরুষের লিঙ্গবৈষম্য, নারীর যে নিপীড়ণ এটি নিরন্তর, অনেকদিন ধরে চলে আসছে। এটা ঐতিহাসিকভাবে পরিবর্তন করা দুঃসাধ্য। পরে অবশ্য তিনি একটি সঠিক কথা বলেছেন, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসবে, তাদের মুক্তি আসবে। এঙ্গেলস সরাসরি বেবেলের বিরোধিতা করেননি। তাঁরা দুজন বন্ধু ছিলেন। এঙ্গেলস যেটা দেখাতে চেয়েছিলেন, সেটা পরবর্তীতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী নারীবাদীদের মূল তত্তে¡ দাঁড়ায়। এঙ্গেলস মূলে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, নারীর নির্যাতনের পেছনেও সমাজের বিবর্তনই দায়ী। এই বইটি মার্ক্স ও এঙ্গেলস এর যৌথ প্রকল্প। যদিও শেষ পর্যন্ত এটি লিখেছেন এঙ্গেলস। প্রকল্পটি কিন্তু আরো বড়ো ছিল। মার্ক্স এমনকি জার্মানিতে কৃষিভিত্তিক সমাজের বিবর্তন নিয়ে যাঁরা বই লিখছেন, সেগুলোও একত্র করছিলেন। মার্ক্স শেষ পর্যন্ত সময় পাননি। আমরা জানি, মার্ক্স এঙ্গেলস এর চেয়ে একটু কম দিন বেঁচেছিলেন।
এ পর্যায়ে জার্মান ভাষায় রচিত প্রথম প্রকাশিত “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফামিলিৃ”র স্থিরচিত্র দেখানো হয়।

ফারহানা আজিম শিউলী: আমরা জানি “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফামিলিৃ” বইটি খুব দ্রæত লিখেছিলেন এঙ্গেলস। কী কারণে এত তড়িঘড়ি করে লিখেছেন তিনি?
মোহাম্মদ ইরফান: মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এর যে সার্বিক প্রকল্প তারই একটা অংশ ছিল এই বই। এঙ্গেলস বইটি লিখেন মাত্র দুমাসের মধ্যে, ১৮৮৪ সালের মার্চের শেষ থেকে মে মাসের শেষ এই সময়কালে। মার্ক্স মারা যাবার পর এঙ্গেলস কিছুটা দায়িত্ববোধ করলেন গুছিয়ে মার্ক্সের কাজগুলো প্রকাশ করার। মার্ক্সের নোটবুক থেকে সাহায্য নিয়ে “ক্যাপিটাল” এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড সহ মার্ক্সের অসমাপ্ত কাজগুলো তিনি করেছেন। “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলিৃ” লেখার ক্ষেত্রেও তিনি মার্ক্সেরই দাগানো নোটবই থেকে অনেক তথ্য নিয়েছেন। ঐ সময়টায় সাংস্কৃতিক বিবর্তনের অনেক নূতন নূতন তথ্য এবং নূতন নূতন গবেষণা বেরিয়ে আসছে। সেই গবেষণার কোনো কোনোটি বলছে যে, একক পরিবার প্রাকৃতিকভাবে এসেছে। আবার কোনো কোনো তত্ত¡ বলছিল যে পুরুষের সক্ষমতা নারীর চেয়ে বেশি। আর ওদিকে সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদীরা নূতন তথ্য-উপাত্ত আনছেন। ফলে এইসব অনেক তথ্যের প্রাপ্যতাই হয়তো অন্যতম কারণ ঐ সময়ে লিখে ফেলার এবং নূতন তত্ত¡টি প্রতিষ্ঠিত করার।

ফারহানা আজিম শিউলী: “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলিৃ” বইটিতে নূতন কি ছিল? কেন এটি ক্লাসিক টেক্সট হলো?
মোহাম্মদ ইরফান: “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলিৃ” বইটি একটি বিশেষ ধরনের নারীবাদী চিন্তার পথিকৃৎ। অন্য অনেক ধরনের চিন্তারও এটি পথিকৃৎ। এই প্রথম রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যাখ্যা পরিবারের ক্ষেত্রে নিয়ে আসা হলো। এক ধরনের ফ্যামিলি ইকোনোমিক্স যদি বলি সেটার সূচনা করলেন এঙ্গেলস এই বইয়ের মাধ্যমে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে এই ক্ষেত্রে মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের তত্ত¡, যেটা তাঁরা হেগেলের ধাবাহিকতায় এনেছেন কিন্তু হেগেলের আইডিয়ালিজমকে তাঁরা বস্তুবাদে নিয়ে গেছেন। সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ধারণার প্রথম উদাহরণ এই বই। রাজনৈতিক অর্থনীতির বাইরে এই ধরনের চিন্তার একটি সুসংবদ্ধ উপস্থাপন এই প্রথম। মনে রাখতে হবে, “কন্ডিশন অফ দ্য ওয়ার্কিংৃ ” এর মতো এটি এঙ্গেলস এর অরিজিনাল ফিল্ডওয়ার্ক না, নিজস্ব এথনোগ্রাফিক কাজ না। তবে এক অর্থে এটিও মৌলিক গবেষণা কারণ তিনি একটি নতুন মডেল বের করে এনেছেন এর মাধ্যমে। তিনি মর্গান এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীদের তথ্য ব্যবহার করেছেন তাঁর মডেলের সমর্থনে। আবার বাকোফেন বা ম্যাকলেনানের কথাও তিনি এনেছেন, যাঁরা আসলে দেখিয়েছেন যে তখনকার একক পরিবার স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। অর্থাৎ নিজের মডেলের বিপরীতের যুক্তি খণ্ডন করার জন্য এঙ্গেলস তাঁদের টেক্সটও ব্যবহার করেছেন। এগুলো সবই ব্যবহার করে এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, একক পরিবার প্রাকৃতিকভাবে আসেনি, এর পেছনেও আছে উৎপাদন সম্পর্ক। সেটি আগে দেখানো হতো রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে, তিনি দেখালেন সমাজের ক্ষেত্রে। মার্ক্সীয় তত্ত¡কে ইকোনোমিক ডিটারমিনিস্টিক বা রিডাকশানিস্ট বলা হতো। এঙ্গেলস সেই রিডাকশানিজম থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীদের বিস্তারিত এথনোগ্রাফিক ব্যাখ্যা এনে প্রমান করলেন, মার্ক্সবাদ মানে শুধু ইকোনমিক ডিটারমিনিজম না, এটি ডিডাকশনিস্ট তত্ত¡ না, তথ্য-উপাত্ত থেকে এর মাধ্যমে ইনডাকটিভ মেথডেও উপনীত হওয়া যায়। সেই বিষয়টিও ছিল নূতন।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ শব্দটিকে একটি বিশেষ ঘরানার মনে করা হয়। সিএন এন এর এন্ডারসন কুপার ইজরাইলের হিব্রæ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ইউভাল নোয়াহ হারারিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘তুমি তো ইতিহাসের অধ্যাপক। তুমি ভবিষ্যতের কথা লিখছ কেন?’ এর উত্তরে হারারি বলেন, ‘ইতিহাস পুরোনো জিনিস পাঠের বিষয় না। ইতিহাস হচ্ছে পরিবর্তনের। পরিবর্তন কী করে হচ্ছে তার একটা বৈজ্ঞানিক সূত্র।’ একইভাবে এই বইতে এঙ্গেলস দেখালেন ইতিহাস যে আসলে এক ধরনের পরিবর্তন এবং ইতিহাসকে সূত্রবদ্ধ করা যায়, বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। বৈজ্ঞানিক তত্ত¡ দুটো কারণে তৈরি করা হয়। কী হচ্ছে তা বোঝার জন্য, আর আরেকটা কী হচ্ছে তার ডাইনামিক্স বোঝা গেলে সামনে কী হবে সেটা ধারণা করা যাবে, গতিপথটা বোঝা যাবে। এবং গতিপথ বা গতিপ্রকৃতি জানা থাকলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সুবিধা হয়। এদিক থেকে চিন্তা করলে, বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন এবং ভবিষ্যৎ ধারণা করার উপায়ও তৈরি করে দিয়েছেন এঙ্গেলস এই বইয়ের মাধ্যমে।

ফারহানা আজিম শিউলী: “অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলিৃ” বইতে পরিবারের উৎপত্তিতে কৃষি ও সঞ্চয়ের ভূমিকা সম্পর্কে বলুন।
মোহাম্মদ ইরফান: নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গানের বই থেকে উপাত্ত, এঙ্গেলস তাঁর হাইপোথিসিস প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য ব্যবহার করেছেন। দেখানো হচ্ছে দুটো কাঠামোর পরিবর্তন। আদিম ধরনের জীবনযাপন ব্যবস্থা যেটি শিকার ও সংগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল সেখান থেকে পরিবর্তন হচ্ছে। সেই সমাজে মাতৃসূত্রীয় ব্যবস্থা ছিল, মাতৃতান্ত্রিকতা ছিল, নারীর ভূমিকাটি সেখানে প্রধান ছিল উৎপাদন সম্পর্কে তার ভূমিকার কারণে। নারীরা উৎপাদক তৈরিতে একটা বড়ো ভূমিকা রাখতো, ভূমিকা রাখতো অর্থনৈতিক উৎপাদনেও। শিকার করতে পুরুষ দূরে যেতো কিন্তু শিকার খুব বেশি পাওয়া যেতো না। শিকারের পাশাপাশি এজন্য সংগ্রহের ওপরও নির্ভর করতে হতো অনেকটা। অর্থাৎ নারীর দুজায়গায়ই ভূমিকা ছিল। ঘরের ভেতরে এবং অর্থনৈতিক উৎপাদনেও। যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই নারীর প্রাধান্য ছিল এবং নারীভিত্তিক সমাজ ছিল। উল্লেখ্য, মাতৃতান্ত্রিকতা পিতৃতান্ত্রিকতার বিপরীত না। সম্পদের মাধ্যমে পুরুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং নারীকে পদানত রাখার একটা ব্যবস্থা হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিকতা। মাতৃতান্ত্রিকতা বলতে বোঝায় নারীর ভূমিকা প্রধান কিন্তু নারী ঐ সময় পুরুষকে পদানত রাখেনি। একারণেই মাতৃতান্ত্রিকতা শব্দটি ব্যবহারে সতর্ক থাকা দরকার। ওদিকে দেখা যায় পরিবারেরও বিবর্তন ঘটছে, গোষ্ঠীবদ্ধ বিয়ে থেকে এক ধরনের কনস্যাংগুইন সম্পর্ক থেকে বিবাহের পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবারের ধরন পরিবর্তন হয়ে একক পরিবার হচ্ছে। কিন্তু এর কারণটা কী? সেখানেই হচ্ছে কৃষি ও সঞ্চয়ের ভূমিকা। অর্থাৎ প্রথমে মানুষেরা কিছু হাতিয়ার তৈরি করা শিখল। প্রথমদিকের হাতিয়ারগুলো খুব সরল ছিল। পরে প্যালিওলিথিক থেকে নিওলিথিক যুগে কৃষিকাজের সূচনা হলো। যখনই অস্ত্রের মাধ্যমে শিকার করা হচ্ছে এবং যখনই কৃষিকাজ হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে, যা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে। এই যে উদ্বৃত্ত ও সঞ্চয়ের ব্যাপার এলো, সেটি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দিতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে দলগত বিয়ের কারণে যেই পারিবারিক ব্যবস্থা যেখানে সব ছেলেমেয়ে একসঙ্গে থাকছে সেই ব্যবস্থায় আর কাজ হচ্ছে না। তখনই একক পরিবার এবং পিতৃতন্ত্র চলে এলো। এই হচ্ছে কৃষি ও সঞ্চয়ের ভূমিকা।

ফারহানা আজিম শিউলী: রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও ধরন সম্পর্কে কী আছে “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফামিলিৃ” বইতে?
মোহাম্মদ ইরফান: পরিবার এবং রাষ্ট্র এই দুটো হচ্ছে কাঠামো আর ব্যক্তিগত মালিকানা হচ্ছে এই কাঠামোগুলোর বিবর্তনের বা আজকের অবস্থায় আসার পেছনের ড্রাইভার। মার্ক্স ও এঙ্গেলস শুরু থেকেই বলেছিলেন, যেই শ্রেণির হাতে সম্পদ, যেই শ্রেণির হাতে উৎপাদনের ক্ষমতা, সেই শ্রেণি যাদের হাতে উৎপাদনের ক্ষমতা নেই তাদেরকে শোষণ করার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বইতে মর্গানের গবেষণা থেকে কীভাবে এঙ্গেলস সেটি দেখিয়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় এখনও চার মিলিয়ন লোকের একটা গোষ্ঠী আছে যেখানে মাতৃসূত্রীয় সমাজ এবং ওখানে নৃগোষ্ঠীর নেতা নির্বাচনে মেয়েরা ভোট দেয়। এরা ভোট দেয় মানে এই না ওরা কর্তৃত্ব করে নেতার ওপর। নেতাই সব প্রধান সিদ্ধান্ত নেন। নিপীড়ক রাষ্ট্রের দরকার হয় কেবল সম্পদ রক্ষা করার জন্য কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানা রক্ষা করার জন্য। এমনকি এখনকার কৃষিভিত্তিক সমাজেও তা দেখা যায়। যেমন বাংলাদেশের মতো গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সমাজে গেলে দেখা যায়, ধানক্ষেতে একটু পরপর আইল। অর্থাৎ সম্পদকে পার্সেলে পার্সেলে ভাগ করা হচ্ছে। এই যে ব্যক্তিগত সম্পদে ভাগ করা হচ্ছে এটা রক্ষার উপায়টা রাষ্ট্র করে, অর্থাৎ রাষ্ট্র এই সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা করে এবং ব্যক্তিগত মালিকানায় রাষ্ট্র একটা যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। মর্গানের উপাত্ত থেকে দেখা যায়, নৃগোষ্ঠীভিত্তিক সমাজগুলোতে, এই রাষ্ট্রব্যবস্থাগুলোতে কোনো নিপীড়নের ব্যবস্থা ছিল না। এটা ছিল এক ধরনের সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা। আমরা যখন একটা যৌথ ব্যবস্থায় থাকি, সেই ব্যবস্থায় লোকজনের মধ্যে দ্ব›দ্ব-বিবাদ-বিরোধ দেখা দিলে সেটি অবসানের জন্য যতটুকু দরকার, গোত্রগুলোর মধ্যে সেই গভর্নেন্স ছিল, ততটুকুই ছিল। তার বেশি দরকার ছিল না। উদ্বৃত্ত রক্ষার এবং সম্পত্তি রক্ষার এবং প্রপার্টি ক্লাসকে রক্ষার কোনো দরকার ছিল না বলে। সেটাই সাচেমদের বিভিন্ন ব্যবস্থা, বিভিন্ন গোত্রের ব্যবস্থা ও অন্যান্য সমাজের যেমন এথেনিয়ান বা রোমান সমাজের ব্যাখ্যার মাধ্যমে এঙ্গেলস এই বইতে দেখিয়েছেন।

ফারহানা আজিম শিউলী: বলা হয়ে থাকে, “দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলিৃ” বইটি নারীবাদের পথিকৃৎ একটি টেক্সট – ব্যাখ্যা করুন।
মোহাম্মদ ইরফান: নারীবাদী চিন্তার যাঁরা বড়ো বড়ো চিন্তক তারা অনেকেই মনে করেন যে, এঙ্গেলসের এই টেক্সটটি যথাযথ বা যথেষ্ট না। এঙ্গেলস ইকোনমিক ডিটারমিনিজম থেকে বের হয়ে মর্গানের মতো ইন্ডাকটিভ গবেষণা নিয়ে এসেছেন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যায়। কিন্তু তারপরও অনেকেই বলেন যে, শেষ পর্যন্ত এঙ্গেলস থেকেছেন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যাতেই। তাই এখনকার নারীবাদীরা অনেকেই বলে থাকেন, এটাও এক ধরনের রিডাকশানিজম যে, সবকিছুর মূল হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্ক বা প্রযুক্তিগত ও বস্তুবাদী অবস্থা। সবকিছুকেই যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে এটা ঠিক মনে করেন না অনেক নারীবাদীই। এমনকি সিমন দ্য বোভোঁয়ার মতো নারীবাদীও মনে করেন, এঙ্গেলস রিডাকশানিস্ট। একটি তত্ত¡ আছে ইন্টারসেকশনালিজম বা ইন্টারসেকশনালিটি নামে যেখানে অনেক ধরনের অনুভূমিক সম্পর্কের কথা বলা হয় সমাজে যেগুলো থেকে নিপীড়ন তৈরি হয় এবং নিপীড়ন তৈরি হলে নারী নিপীড়িত শ্রেণি হিসেবে থাকে। আমরা দেখি, আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও মানুষ তার বর্ণের কারণে নির্যাতিত হচ্ছে। আবার যে নারী সে সেই বর্ণের পুরুষের চেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে। তার মানে নারীর নির্যাতন দুজায়গায়। একটা নির্যাতন হচ্ছে তার বৃহত্তর সমাজের ক্যানভাসে আফ্রিকান আমেরিকান হিসেবে, আরেকটা হচ্ছে আফ্রিকান আমেরিকান বাড়ির মধ্যে আফ্রিকান আমেরিকান পুরুষের হাতে। কাজেই আমরা অবশ্যই ইন্টারসেকশনালিজমের দিকে দৃষ্টি দেব কিন্তু এঙ্গেলস এর যুক্তি হচ্ছে, সবকিছুর মূলেই হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্ক এবং সঞ্চয় ও ব্যক্তিগত মালিকানা হচ্ছে এসবকিছুর মূলে। এটা যদি উৎপাটন করা যায় তাহলে নারীর ওপর এই নিপীড়ন আর থাকবে না। এখানেই অন্য নারীবাদীদের সঙ্গে মার্ক্সীয় নারীবাদীদের পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে। কোনো সমস্যার মোকাবিলায় দরকার হয় আশু, মধ্যবর্তী ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের। দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানের জন্য দূরবর্তী কারণ খুঁজলে কিন্তু সমস্ত শোষণের মূলে যেই শোষণ সেটা খুঁজে বের করতে হবে। সেটা এঙ্গেলস খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। এবং ঐ জায়গায় এঙ্গেলস কিংবা মার্ক্সের বিকল্প কিংবা আরো যাঁরা মার্ক্সীয় তাত্তি¡ক আছেন তাঁদের বিকল্প অন্য তাত্তি¡কেরা এখনো দিতে পারেননি। তাঁরা বলেছেন আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দরকার। বিশেষ করে আশু সমাধানের জন্য আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দরকার বটেই। কিন্তু মূল সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য সমস্যার মূলে যেতে হবে, ব্যক্তিগত মালিকানা রহিত করতে হবে সমাজে। এর আগে নারীর কথা অনেকে বলেছেন সামাজিক সম্পর্কের কথা বলে এবং সমাধান দিয়েছেন অনেকটা ইউটোপিয়ান ধরনের, দিয়েছেন প্যাট্রনাইজিং সমাধান, বলেছেন পুরুষের শক্তি সামর্থ প্রাকৃতিক। এঙ্গেলস দেখিয়েছেন এটি প্রাকৃতিক না। আসলে আগে বরং একদম বিপরীত একটা ব্যবস্থা ছিল। এখনকারটাই যে কৃত্রিম সেটি এঙ্গেলস মর্গানের তথ্য ব্যবহার করে দেখিয়েছেন। এখনও এই যুগে এসেও অনেক নারীবাদী বলেন, পুরুষের শক্তি, বাহুবল স্বতঃসিদ্ধ। এমনকি ল্যারি সামার্সের মতো মানুষ বলেছেন, পুরুষের নাকি মেধা নারীদের চেয়ে বেশি। তাঁরা জৈবিক ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু এঙ্গেলস ও মার্ক্স সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদীদের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে, না, এটি আসলে ঐতিহাসিকভাবে তৈরি একটি ব্যাপার। যেহেতু এটি ঐতিহাসিকভাবে তৈরি করা হয়েছে, কাজেই যে কারণটির কারণে এটি তৈরি হয়েছে সেই কারণটির যদি সমাধান করা যায় তাহলে নারীদের ওপর নির্যাতনেরও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করা যাবে।

ফারহানা আজিম শিউলী: এঙ্গেলস এর পুঁজিবাদী ঘরানার সমালোচনা সম্পর্কে আমরা জানি। মার্ক্সবাদী তাত্তি¡কদের মধ্যে এঙ্গেলস এর মতাদর্শ নিয়ে সমালোচনা সম্পর্কে কিছু বলুন।
মোহাম্মদ ইরফান: ষাটের দশকের পরের নয়া মার্ক্সবাদীদের মধ্যে এঙ্গেলসকে নিয়ে একটা সমালোচনা আছে। তাঁর তত্ত¡ কতোটা রিডাকশনিস্ট ইত্যাদি নিয়ে একাডেমিক সমালোচনা আছে। তাঁর ডায়ালেক্টিক্স অফ নেচার নিয়ে সমালোচনা করেছেন লুকাক্স। স্ট্যালিনের সময় যে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তৈরি হলো, ঐ সময় থেকে নয়া-বাম তাত্তি¡কেরা মার্ক্স ও এঙ্গেলসকে কিছুটা আলাদা করে এঙ্গেলসকে বলির পাঠা বানিয়ে ফেলল। মূলত মার্ক্সের জীবনের শেষদিকে ও মার্ক্স মারা যাবার পরও এঙ্গেলস কিছুটা বাড়াবাড়ি করছিলেন। তখন যেসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হচ্ছে সেসবের সঙ্গে মার্ক্সবাদকে, মার্ক্সবাদের রাজনৈতিক তত্ত¡গুলোকে মেলাতে গিয়ে তিনি খুব বেশি অনমনীয় হয়ে পড়ছিলেন ও তত্তে¡ বৈজ্ঞানিকতা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর কারণে যেই অনমনীয়তা তৈরি হচ্ছিল সেকারণেই মার্ক্সবাদ নমনীয়তা হারাচ্ছিল, সে কারণেই রেজিমেন্টেশন হচ্ছিল, সে কারণেই মার্ক্সবাদী ব্যবস্থায় হয়তো কিছুটা নিপীড়ন নেমে এসেছিল। এ ধরনের একটি সমালোচনা আছে। ৮০র দশকের শেষদিকে ও ৯০ এর দশকে, নয়া-বামদের ধারায় এই সমালোচনাগুলো করেছেন এঙ্গেলস এর জীবনীকার হান্ট ও কার্ভার। তবে এখন আবার এঙ্গেলস এর জন্মদ্বিশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে এসে, এইসমস্ত অভিযোগ থেকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে মার্ক্স ও এঙ্গেলস এর লেখাগুলো আবার পড়ে। পল বø্যাকলেজ দুই খণ্ডের একটি বই লিখেছেন। সেই বইদুটোতে মার্ক্স ও এঙ্গেলস এর লেখার পুনঃব্যাখ্যা আছে। আসলে মার্ক্স ও এঙ্গেলস এর বইগুলো তো খুব কনডেন্সড। সেগুলো থেকে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পুনঃপাঠের প্রয়োজন।

ফারহানা আজিম শিউলী: মার্ক্স ও এঙ্গেলসের সামগ্রিক দর্শনের বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বলুন।
মোহাম্মদ ইরফান: মার্ক্সের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তত্তে¡র মূল কথা একটিই – সারপ্লাস বা উদ্বৃত্ত। সোশ্যালিজম ও পুঁজিবাদ সম্পর্কে আমাদেরকে এভাবে ধারণা দেওয়া হয়েছে যে, পুঁজিবাদ হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ। এরা উৎপাদন করে, আর বিতরণের প্রক্রিয়ায় আছে বাজার। ওদিকে সোশ্যালিজমে সরকার সবকিছু চালাবে আর বিতরণের জন্য থাকবে “কেন্দ্রীয় পরিকল্পিত অর্থনীতি”। এই দুটো বিপরীতধর্মী কথা বলা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়টি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চিনে নীরিক্ষা করতে গিয়ে কিছুটা অসুবিধা হয়েছে। এই সমস্যাটার কথাই আমরা সবাই সামনে আনি। মার্ক্স কিন্তু এ ধরনের কথা বলেননি যে, সোশ্যালিজম মানে সরকার। মার্ক্সের লেখা মূল যে বই সেটির নাম সোশ্যালিজম না, সেটির নাম “ক্যাপিটাল।” তিনি সেখানে দেখিয়েছেন, পূঁজির উৎপত্তি। সেটি বলতে গিয়ে তিনি যেই বিষয়ের কথা বলেছেন সেটি এখনো সমাজে বিদ্যমান। এবং সমাজের যতো ধরনের শোষণ, নির্যাতন সেটির পিছে ওটি একটি বড়ো কারণ। পুঁজির মালিকের হাতে যে বিরাট উদ্বৃত্ত আসে তা দিয়ে তারা পুরো ব্যবস্থাটা ম্যানিপুলেট করতে পারছেন এবং এই ম্যানিপুলেশনের কারণেই আজকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া সবকিছুর পেছনেই তারা প্রভাব বিস্তার করছেন। কিন্তু শ্রমিক তার প্রাপ্যর চেয়ে কম পাওয়ায় তার জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটছে। বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখি, একসময় ছিল আমাদের পাটকল, এখন আছে গার্মেন্টস। গার্মেন্টসও কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করছে গার্মেন্টস মালিকেরা। শ্রমিকদের প্রাপ্য না দেওয়া এক ধরনের লুন্ঠন। কাজেই এই ব্যবস্থা তো এখনো রয়ে গেছে। সেই অর্থে, যেই সূত্র মার্ক্স ও এঙ্গেলস দিয়ে গেছেন – সমাজে যেভাবে পুঁজি তৈরি হয় এবং যে কারণে শোষণ হয় তার বিকল্প কোনো সূত্র এখনো পাওয়া যায় না। নারীবাদের ক্ষেত্রে যেমন ইন্টারসেকশনালিটি তত্ত¡ তেমনি সামাজিক নিপীড়নের ক্ষেত্রেও নানান ধরনের তথ্য আছে যেখানে অনুভূমিক বা হরাইজন্টাল অসমতার কথা বলা হচ্ছে। সেগুলোর সবগুলোর পেছনের কারণটা কিন্তু উল্লম্ব বা ভার্টিকেল অসমতা। সেটিরই সমাধান করতে হবে আমাদের।

ফারহানা আজিম শিউলী: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই।
মোহাম্মদ ইরফান: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই আমরা কিছু ইতিবাচক দিকে গিয়েছি। তরুণ প্রগতিশীল যারা জাতীয়তাবাদী ধারায় লীন হয়েছিলেন, দেশের জন্মলগ্নে তারা সমাজতন্ত্রকে দেশের একটি মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু নানান কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি মুক্তিযুদ্ধের পরে এবং সে কারণে অন্য সমাজতান্ত্রিক শক্তির উদ্ভব ঘটেছিল। আমরা জানি, কর্নেল তাহের শোষক রাষ্ট্রযন্ত্রে আঘাত করেছিলেন। সুপরিকল্পিতভাবেই করেছিলেন কিন্তু হয়তো সহায়ক রাজনৈতিক শক্তি ততটা তাঁর পাশে দাঁড়াতে পারেনি। সমন্বয়েরও অভাব ছিল। আমাদের চারটি মূলনীতির মধ্যে তিনটিই এখন খুব বিপন্ন। জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি আগের চেয়ে ভালো অবস্থায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্ত ভিত্তির ওপর, একটা জনপ্রিয় ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, একটা দার্শনিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে। আমাদের দেশে প্রচুর উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু বৈষম্য তৈরি হচ্ছে ধনিক শ্রেণি এবং মেহনতি জনতার মধ্যে। গণতন্ত্র মানে ভোটের গণতন্ত্র না, গণতন্ত্র বলতে সমাজের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিকতার চর্চা প্রয়োজন। যে জন্য শুধু ভোট কিংবা মেকানিজম না, একধরনের সহিষ্ণুতাও দরকার। সেটির অবক্ষয় ঘটছে। আজকাল অনেকে “ফ্যাসিবাদ” টার্মটা ব্যবহার করছে। কিন্তু আমি মনে করি না বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন বর্তমান কারণ ফ্যাসিবাদের অন্তত একটি চরিত্র মিলিটারিজম এখানে অনুপস্থিত আছে। এইসবকিছুর সমাধানের জন্য, যেই তত্ত¡গুলো এবং যেই তথ্যের কথা আজ বলা হলো, যেই দর্শনের কথা বলা হলো, সেসবই সঠিক ভূমিকা রাখতে পারে। সেজন্য সবার একসঙ্গে বসা দরকার। সবাইকে এক মঞ্চে এসে একটা সুস্থ এবং সঠিক দিকনির্দেশনা নিয়ে আলাপ করা দরকার। এইসবের অবসান ঘটাতে হলে তরুণদেরকেও যুক্ত করা দরকার এবং সেটা সম্ভবও।
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এর জন্মদ্বিশতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার আসরে আলোচক মোহাম্মদ ইরফানের স্বতঃস্ফূর্ত, গভীর ও তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা দর্শক-শ্রোতারা ভীষণ উপভোগ করেন এবং আলোচনা শেষে শ্রোতা-দর্শকের প্রশ্নের খুব সাবলীলভাবে উত্তর দেন ইরফান। এই আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।

Exit mobile version