মুরশাদ সুবহানী : ‘আমি আবু হেনা মোস্তফা কামাল, বাংলার মাটিতে একটি জন্মেছি , আর জন্মাবো না’। এই অহং উচ্চারণ ছিল যাঁর তিনি ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। অসাধরণ প্রতিভাবান, নক্ষত্র তুল্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। সেই কারণেই হয়তো ওই অহং উচ্চারণ করতে পেরেছেন। তিনি পাবনার জেলা শহরের গোবিন্দা গ্রামে ১৯৩৬ সালের ৩ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। পাবনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেয়ে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ত্রয়োদশ স্থান লাভ করেন। এরপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি ঢাকায় চলে যান। সেখানে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ এবং প্রাচ্যের অক্সোফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স(বাংলা) এবং এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। বিএ অনার্স এবং এমএ উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
যতদূর জানা যায় তিনি ছোট বেলা থেকেই গান কবিতার চর্চা করতেন। তিনি বেতারের (তৎকালীন রেডিও)’র তালিকাভূক্ত নিয়মিত গীতিকার ছিলেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি কাব্যে, গানে, প্রবন্ধে অসাধারণ প্রতিভার সাক্ষর রাখেন। তাঁর গান আমাদের কাছে এখনো জীবিত আছে। উল্লেখ যোগ্য গানের মধ্যে ‘কথা দিলাম আজকে রাতে’, তুমি যে আমার কবিতা’ এই পৃথিবীর পাহ্নশালায়।’ এই অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষটির বাল্যজীবন দু:খে-কষ্টে কেটেছে। রেডি-বেতারের গানের সম্মানীতে তিনি চলেছেন অনেক দিন। সুবক্তা ছিলেন। ইতিহাসের পাতায় যেটি খুঁজে পাবেন না, তা হলো, পাবনার নতুন ট্রাফিক মোড়ে আরিফ ভাই (প্রয়াত) তাঁর ছবি তোলার ষ্টুডিও’র চিত্রায়ণ নামকরণ করে ছিলেন আবু হেনা মোস্তাফা কামাল। জনাব আরিফ ভাইয়ের সাথে আমার মত পাবনার অনেকেরই সখ্যতা ছিল। তিনি একদিন গল্পে গল্পে বললেন, আমি ষ্টুডিও দিয়েছি। হেনা এলো। বাইরে বসে দু’জন গল্প করছি। হঠাৎ বললো, ‘ আরিফ কাগজ আর কলম দাও’।‘ আমি (আরিফ ভাই) উঠে গিয়ে কাগজ আর কলম এনে দিলাম। ও (আবু হেনা মোস্তাফা কামাল) কাগজে লিখলো, চিত্রায়ণ।’ কাগজটি আমার হাতে দিয়ে বললো তোমার ষ্টুডিও-’এর নাম। আরিফ ভাইয়ের চিত্রায়ণ ষ্টুডিও আগের আদলে এখন নেই । চেহারা বদলে গেছে এখানে লতিফ টাওয়ার আধুনিক ডিজাইনে মার্কেট হয়েছে । তবে ষ্টুডিটি আগের নামেই আছে।
উজ্জল নক্ষত্রসম প্রয়াত ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী পাবনা আরও কয়েকজন গুণি সাহিত্যিক ,কবি শিল্পীর মতই নিরবে-নির্ভৃতে চলে যায় ।
শুধু পাবনা জেলা শহর কেন দেশের মানুষ তাঁকে ভুলতে বসেছে।পাবনাবাসীর দুর্গগতি। এই জেলায় জন্মেছেন কত গুনি মানুষ। চাটমোহরে প্রমথ চৌধরী। যার ছোট গল্পের ভূমিকা লিখেছিলেন নোবেল বিজয়ী কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এই পাবনার মাটি জন্ম দিয়েছে, কবিও সাংবাদিক আব্দুল গনি হাজারী (প্রয়াত), আবুল মনসুর, কবি বন্দে আলী মিয়া (প্রয়াত) , জিয়া হায়দার (প্রয়াত ) রশিদ হায়দার, কবি মাকিদ হায়দার , দাউদ হায়দার ( বিতর্কিত কবিতা লেখার জন্য বিদেশে অবস্থানরত), আরিফ হায়দার, সঙ্গীতে নিত্য গোপাল জোয়াদ্দার নিতু দা (প্রয়াত), বারিণ মজুমদার, দেলোয়ার হোসেন, শম্ভু জোয়াদ্দার, মনসুর ওস্তাদ, আরো কত গুণি মানুষ। শিল্প-সাহিত্যে, কাব্যে-গল্পে, সঙ্গীতে তাঁরা অসাধারণ কৃত্বিতের সাক্ষর রেখেছেন।
ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের মৃত্যু দিন কেটে গেল গত ২৩ সেপ্টেম্বর নিরবেই। আমেরিকার ফ্লোরিড্ স্টেটে বসে জেলার বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে জানতে পারলাম এবারও নিরবে কেটেছে তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী।
কেন এমনটা হয়। আবু হেনা মোস্তফা কামালকে আর ফিরে পাবো না এটা ঠিক। কিন্তু তাঁর কর্মময় জীবন নিয়ে আলোচনা-স্মরণ সভা হয় না নিজ জেলা শহরে। অথচ যাদের কেবল হাতে খড়ি, কোন মতে চলে। সৃষ্টিশীল এমন কোন বড় কর্ম নেই যা দিয়ে আজকের প্রজন্ম জ্ঞান চর্চায় আরো এগিয়ে যেতে পারেন। অনেকে দেখি পয়সা-কড়ির জোরে তাদের কাব্য-সাহিত্য নিয়ে কিছু লোক বেশ সরগরম থাকেন। আবু হেনা মোস্তফা কামালের অল্পকালের যে লেখা আছে তা পাঠ করলে আমাদের জ্ঞানের পরিধি আরও বাড়বে। একজনকে সম্মান দিলে নিজে ছোট হয়ে যায় না। বরং বড় হতে হলে অন্যকে সম্মান দিতে হয়।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল কবিতার বিষয়ে প্রকৃতি, নারী, যৌবন, জীবন, সমাজকে বেছে নিয়েছিলেন। খুব সাবলিল করে কোন দুর্বোধ্য বাংলা ভাষা দিয়ে নয় সহজ সরলভাবে সবার বোঝার জন্য কবিতা, গান লিখেছেন। এ ক্ষেত্রে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরর সেই বিখ্যাত উক্তি বলা যেতে পারে, “যাহা লোকে বোঝে না, তাহা কোন সাহিত্য নহে।” খুবই বাস্তব সত্য কথা। রবীন্দ্র-নজরুলের মতো সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রতিভার অধিকারী সাহিত্যিক-কবি ইচ্ছে করলে বঙ্কিম চন্দ্রের মতো ‘খটোমটো’ দুর্বোধ্য বাংলা ভাষায় লিখতে পারতেন। এটা অসম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে। তাঁরা তা করেননি। সহজ করে যা বলেছেন, তার গুরু অর্থ খুব গভীর। কিন্তু সাহিত্যের রস আস্বাদনে ক্লাশ থ্রি-ফোরের শিক্ষার্থীকে খুব বেগ পেতে হয় না।
ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল শৈশব থেকেই সাহিত্য চর্চা করেছেন। যৌবন নিয়ে তিনি লিখেছেন, তাঁর কাছে যৌবন কখনও বৈপিরত্য হয়ে ধরা দিয়েছে। যৌবনকে তিনি কখনও শক্র মনে করেছেন আবার বন্ধু হিসেবে কবিতায় আলিঙ্গন করেছেন। তাঁর দক্ষ সুনিপুণ কবিতার বুননে তিনি একজন দক্ষ কারিগর শিল্পীর মতো বুনন করেছেন। যাঁরা আবু হেনা মোস্তফা কামালের কট্টর সমালোচক তাঁরাও এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন, তাঁর কবিতায় ছন্দের পতন বিরল প্রায়।তাঁর প্রথম কাব্য যৌবন বৈরী গ্রহ্ণে (১৯৭৪) প্রথম কবিতায় তিনি লিখলেন, তোমার জন্য হতে পারি লাল কৃষ্ণচুড়া একটি আহত কবিতার মতো..যদি তাই চাও আগুনের মতন জ্বলতে পারি”। আমাদের দেশে আধুনিক বাংলা গানে যে সকল দিগপাল রয়েছেন, তাদের মধ্যে ড.আবু হেনা মোস্তফা কামাল একজন।তাঁর জীবদ্দশায় কোন গানের সংকলন বের হয়নি।১৯৯৫ সালে দুই শতাধিক গান নিয়ে শিল্পকলা একাডেমী প্রকাশ করে ‘আমি সাগরের নীল’ গ্রহ্ণ। এ কথা সকলেই জানেন তৎকালীন পাকিস্তান আমলে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়। ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি গানের দিগপাল ‘কেউ মানুন না, মানুন আমার কথা, আমি বলি’ এই গানের জগতের জনক আব্দুল আলিম এর তনয়া নজরুল সঙ্গীত, আধুনকি, ক্ল্যাসিক্যাল গানে স্বন্যামখ্যাত শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের গান গাওয়া শুরু হয় আবু হেনা মোস্তফা কামালের গান দিয়ে।গানটি ছিল ‘ওই যে আকাশ নীল হলো, সে শুধু তোমার প্রেমে’।
এখানেই আবু হেনা মোস্তফা কামাল তা নয় ।তিনি একজন উচাঙ্গের প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সমালোচক। এক কথায় বলতে গেলে এই মানুষটিও মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মত সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণ করতে চেয়ে ছিলেন। বয়স তাঁকে বাঁধা দেয়। তারপরও বাংলা সাহিত্যে তিনি যা দিয়েছেন অকাতরে তাঁর তুলনা মেলা ভার।বাংলা কবিতা ও সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য আবু হেনা মোস্তফা কামাল অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন। ১৯৭৫ সালে ‘আপন যৌবন বেরী’ কাব্যেও জন্য ফরিদপুর সাহিত্য ও সংষ্কৃতি উন্নয়ন আলাওল পুরষ্কার, ১৯৮৭ সালে একুশে পদক। এ ছাড়াও আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ স্বর্ণপদক এবং বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের কাছ থেকে নানা পদকে ভূষিত হন।এর মধ্যে সুহৃদ সাহিত্য গোষ্ঠি (যশোর) ১৯৮৬ সালে কবিতার জন্য তাঁকে স্বর্ণ পদকে ভূষিত করে। সাদত আলী আকন্দ স্মৃতি পুরষ্কার।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল ১৯৫৬ সালের ২৫ অক্টোবর হালিমা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের পাঁচ সন্তান । কাবেরী মোস্তফা,(কম্পিউটার প্রোগ্রামার), কাকলী মোস্তফা(ইতিহাসবিদ), সুজিত মোস্তফা (সঙ্গীত শিল্পী), শ্যামলী মোস্তফা, চিকিৎসক এবং ড. সৌমী মোস্তফা(আমেরিকার ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যারয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ সমাপ্ত করেছেন। আবু হেনা মোস্তফা কামাল ১৯৫৯ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ (উত্তরবঙ্গের অক্সফোর্ড খ্যাত, এডওয়ার্ড কলেজ প্রভাষক হিসেবে তার কর্মময় জীবনের শুরু হয়। এরপর চাঁপাই নবাবগঞ্জ কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬০ সালে যোগ দেন রাজশাহী সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে। ১৯৬২ সালে প্রাদেশিক সরকারের জনসংযোগ বিভাগে সহকারী পরিচালক হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। পিএইচডি করার জন্য ১৯৬৬ সালে তিনি লন্ডন যান। পিএইচডি শেষে তিনি ১৯৭০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং রিডার পদে উন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের ৫ অক্টোবর তিনি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর মহা পরিচালক পদে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি এই পদেই ছিলেন।
এই জ্যেতিষ্ক নক্ষত্রের সম্মানে নিজ জেলায় কোন স্মরণ সভা হতে দেখলাম না। আজকের প্রজন্মের কাছে তিনি কী অধরা থেকে গেলেন? এই অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বাংলা একাডেমীর মহা পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে হৃগরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে ১৯৮৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে (পৌনে ৪ টায় ) মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহে রাজিউন)। আজিমপুর নতুন কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। তাঁর ৩২তম মৃত্যু বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা ।
তথ্যসূত্র : শাহ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, কুমার দীপ, ষড়ৈশ্বর মুহম্মদ, শাকিব লোহানী এবং লেখকের ব্যক্তিগত অনুসন্ধান ও সাহিত্য চিন্তা-চেতনা।
লেখক (শিল্প-সাহিত্যের সেবক, বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক রাইটার, অ্যাডভোকেট জজকোর্ট,পাবনা, বাংলাদেশ) ফ্লোরিডা, ইউএস প্রবাসী