হাসান আমিন : বিদেশীদের জন্য আগামী দুই বছর নতুন বাড়ি কেনা নিষিদ্ধ করেছে কানাডা। আপাতভাবে স্থানীয় বাজারে বাড়ির চড়া দাম কমানোর লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কানাডীয় সরকার। তবে এতে বিশ্বের কাছে দেশটির আবাসন খাতে বৈশ্বিক অর্থপ্রবাহ নিয়ে নেতিবাচক বার্তা যাবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

২০২৩ সালের শুরুতেই কানাডিয়ান বিদেশী ক্রেতাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়, বেশ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কানাডিয়ান নন যারা তাদের জন্য সম্পত্তি ক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাত গত রোববার, ১ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে বিদেশী নাগরিকদের বাড়ি কেনায় কানাডা সরকারের সাময়িক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। অবতরণকারী অভিবাসী, অস্থায়ী ভিসা কর্মী, শরণার্থী এবং কিছু আন্তর্জাতিক ছাত্র, ৫ লাখ কানাডিয়ান ডলারের চেয়ে কম মূল্যের সম্পত্তি বা ১০ হাজারের কম জনসংখ্যার এলাকায় এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক রিসোর্ট এবং অবকাশ এলাকা অন্তর্ভূক্ত থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সরকার বাড়ির আকাশচুম্বী দাম নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বাড়ির দাম নভেম্বর পর্যন্ত গড়ে প্রায় ৬ লাখ ৩৩ হাজার কানাডিয়ান ডলার বা ৪ লাখ ৬৬ হাজার ইউএস ডলার ছিল এবং প্রধান শহরগুলোতে দাম ছিল আরও অনেক বেশি। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার প্রাদেশিক সরকার ইতোমধ্যে বিদেশী ক্রেতাদের জন্য ২০ শতাংশ কর কার্যকর করেছে, যা প্রধান মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোতে কার্যকর করা হয়েছে। অন্টারিও প্রদেশে ২৫ শতাংশের অনুরূপ কর রয়েছে।

ব্রেন্ডন ওগমুন্ডসন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, গত দুই বছরে মোট বিক্রয়ের মাত্র অর্ধেক বিদেশী ক্রেতাদের কাছে করা হয়েছে। তিনি বলেন, আসল সমস্যা হলো সরবরাহের অভাব। যদিও এই বিদেশী ক্রেতারা কোন দেশ থেকে এসেছেন সেটির কোনো পরিসংখ্যান নেই। ওগমুন্ডসন বলেছেন, অভিবাসন প্রবণতা ইঙ্গিত করে যে তারা এশীয় দেশগুলো থেকে এসেছে। তিনি বলেন, সাধারণত চীন থেকেই বেশি মানুষ এসে থাকে বলে সমালোচনা রয়েছে।

যে কেউ এই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করলে জরিমানা করা যেতে পারে এবং সম্পত্তি বিক্রি করতে হতে পারে। যারা জেনে শুনে সহায়তা করেন তাদের জরিমানাও হতে পারে। ২০২৫ সালে এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।

কানাডা সরকারের দাবি, ‘অ-উত্পাদনশীল বিদেশী মালিকানা আটকাতে’ এমন পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। গত মাসে কানাডার আবাসন বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি মন্ত্রী আহমেদ হুসেন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই আইনের মাধ্যমে আমরা কানাডীয়দের মালিকানাধীন আবাসন নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এতে এ দেশে বসবাসকারী প্রত্যেকেরই সুবিধা হবে।’

ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর আরবান ইকোনমিক্স অ্যান্ড রিয়েল এস্টেটের পরিচালক টমাস ডেভিডফ বলেছেন, নতুন আইনটি কানাডার দুই বৃহত্তম শহর এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল রিয়েল এস্টেট বাজার টরন্টো ও ভ্যাঙ্কুভারে সম্ভবত খুব কমই কাজে আসবে। সেখানে বর্ধিত প্রাদেশিক কর এরই মধ্যে বিদেশীদের বাড়ি কেনাকে নিশানা করেছে।

তবে সামগ্রিকভাবে চাহিদা কমার ফলে বাড়ির দাম কিছুটা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং কানাডার যেসব শহরে আবাসন খাতে বিদেশী বিনিয়োগে উচ্চ হারে কর আরোপ করা হয়নি, সেখানে এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বেশি কার্যকরী হতে পারে বলে মনে করেন ডেভিডফ।
তিনি বলেন, ‘বাজারে বিদেশী বিনিয়োগ থাকলে সমস্যা নেই। সমস্যা হলো বাড়িগুলো খালি থাকা বা নিয়মিত ব্যবহার না করা। যদি বিদেশ থেকে কেউ একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে চায় এবং স্থানীয়ভাবে বসবাসকারী কাউকে ভাড়া দিতে চায়, তবে এটি কোনো সমস্যা নয়। আমি মনে করি, সম্পত্তি ব্যবহারের পরিবর্তে মালিকের জাতীয়তার দিকে মনোনিবেশ করা ভুল সিদ্ধান্ত।’

২০১৭ সালে কানাডায় প্রথমবারের মতো জাতীয় আবাসন কৌশল উন্মোচন করে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রæডোর সরকার। তাতে গৃহীত বেশ কয়েকটি আবাসন নীতির মধ্যে অন্যতম ছিল বিদেশী মালিকানার ওপর নিষেধাজ্ঞা। ১০ বছরব্যাপী কয়েকশ কোটি ডলারের এ পরিকল্পনার লক্ষ্য নি¤œ আয়ের কানাডীয় নাগরিকদের নতুন বাড়ি নির্মাণে সহায়তা এবং নতুন ক্রেতাদের জন্য ট্যাক্স সুবিধা ও অন্যান্য প্রণোদনা প্রদান করা। সাশ্রয়ী আবাসনও ছিল দেশটির গত বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটের অন্যতম অংশ।

২০২১ সালের মার্চ মাসে কানাডিয়ান রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশন জানায়, দেশটিতে একটি বাড়ি কেনার গড় খরচ রেকর্ড ৭ লাখ ১৬ হাজার ৮২৮ কানাডীয় ডলারে পৌঁছেছে (৫ লাখ ২৪ হাজার মার্কিন ডলার প্রায়), যা ২০২০ সালের তুলনায় ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। এর পেছনে ভূমিকা ছিল মূলত ভ্যাঙ্কুভার, টরন্টো ও এদের আশপাশের এলাকাগুলোতে সম্পত্তির উচ্চমূল্য।

এক মাস পরে রয়্যাল ব্যাংক অব কানাডার জরিপে দেখা যায়, বাড়ির মালিক নন এমন ৪০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ৩৬ শতাংশই ভবিষ্যতে সম্পত্তির মালিক হওয়ার আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছেন। ইউবিসি’র আবাসন গবেষণা সহযোগী পরিচালক পেনি গুরস্টেইন বলেন, ‘যারা বাজারে আসতে পারছে না তারা ভাড়া নিচ্ছে। কিন্তু তাদের আয়ের অনেকটাই এখন ভাড়ার পেছনে খরচ করতে হচ্ছে। আমাদের নি¤œ ও মধ্যম আয়ের লোকদের জন্য সত্যিই আবাসনের ব্যবস্থা করা দরকার।’

গুরস্টেইন আরও বলেন, ‘বিদেশিদের বাড়ি কেনায় কানাডা সরকারের নিষেধাজ্ঞা এমন একটি বার্তা পাঠাবে যে, আমাদের আবাসন বাজারে বৈশ্বিক অর্থ আসার বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে। তবে এটি দামের ওপর কী প্রভাব ফেলবে তা স্পষ্ট নয়।’

কানাডার আবাসন খাতে বিদেশী মালিকানার অংশটি খুবই ছোট। সরকারি ওয়েবসাইট স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্যমতে, ২০২০ সালে অন্টারিওতে ২ দশমিক ২ শতাংশ এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ৩ দশমিক ১ শতাংশ আবাসিক সম্পত্তির মালিক ছিলেন বিদেশিরা ? টরন্টো ও ভ্যাঙ্কুভার মেট্রোপলিটন এলাকায় এর হার ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ৭ শতাংশ ও ৪ দশমিক ২ শতাংশ।

গুরস্টেইনের মতে, ‘আমাদের আবাসনকে অবকাঠামো ও অর্থনীতির অন্যান্য খাতকে উত্সাহিত করার উপায় হিসেবে ভাবতে হবে, কেবল আবাসন শিল্প হিসেবে নয়।’
সূত্র : সিবিসি, ফাস্ট পোস্ট ও আলজাজিরা