অনলাইন ডেস্ক : টি-শার্ট আর জিন্স পরা এক সুদর্শন যুবককে গ্রেপ্তার করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল নিউইয়র্কের পুলিশ। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করছিলেন ওই যুবক। চার বছর আগের কথা। এখন সেই জোহরান মামদানিই শ্রমিক ও স্বল্প আয়ের মানুষের ভোটে নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছেন। তাঁর এ বিজয়ে অনেক কিছুই ঘটেছে প্রথমবারের মতো, যা মার্কিন মুল্লুকে আগে ঘটেনি। কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের পুরো রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে চ্যালেঞ্জ করে জিতেছেন তিনি।
গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শ্রমজীবী মানুষের জন্য লড়াই করা ৩৪ বছরের মামদানি রেকর্ড ব্যবধানে জয় পেয়েছেন। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রায় দুই লাখ বেশি ভোট পান। সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ মেয়র নির্বাচিত হন। এর আগে ১৮৯২ সালে নিউইয়র্ক প্রথম কনিষ্ঠ মেয়র পেয়েছিল। নিউইয়র্কের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র মামদানি।
মেয়র হওয়ার পথে মামদানির এ স্বপ্নযাত্রার পথ সরল ছিল না; কিংবা সামনে হয়তো আরও অনেক চ্যালেঞ্জ তাঁর অপেক্ষায়। কিন্তু হার না মানা এক লড়াকু কি থেমে যাবেন? নানা কারণেই তাঁর বিজয়ের পথ ছিল বন্ধুর। গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের কঠোর সমালোচক মামদানির বিরুদ্ধে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ইহুদি লবি। ইলন মাস্কের মতো ধনকুবের সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণার মাঠে ছিলেন। নিজের মালিকানার সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ মামদানিবিরোধী প্রচারে অর্থ ঢেলেছেন মাস্ক।
যুক্তরাষ্ট্রের পুরো ধনকুবের সমাজই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী মামদানির বিরোধিতায় আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিল। বলা হয়, শক্তিশালী ডিপ স্টেট বা গোপন সরকার তাঁর বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। খোদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিরোধিতা করেছেন মামদানির। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ঠেকাতে তিনি নিজ দলের প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে না করে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুওমোকে সমর্থন করেন। তিনি ফেডারেল সরকারের তহবিল বন্ধেরও ঘোষণা দেন। কিন্তু নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের অকুণ্ঠ সমর্থন মামদানিকে বড় জয় এনে দেয়।
বিজয়ের পর ব্রুকলিনে সমর্থকদের সামনে দেওয়া প্রথম ভাষণে মামদানি বলেন, ‘নিউইয়র্ক দেখিয়েছে। রাজনৈতিক অন্ধকারে এটি আলোর ঝিলিক।’ তিনি বলেন, ‘আপনি যদি অভিবাসী হন, ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির হন বা অগণিত কৃষ্ণাঙ্গ নারীর একজন, যাকে ট্রাম্প ফেডারেল চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন; আপনি যদি কোনো একক মা হন, যিনি নিত্যপণ্যের দাম কমার অপেক্ষায় আছেন অথবা যে কেউ, যার পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে–আমরা তাদের পাশে দাঁড়াব।’
নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র বলেন, ‘নিউইয়র্কে আর ইসলামফোবিয়া টেনে এনে নির্বাচনে জেতা যাবে না।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্দেশে মামদানি বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প, আমি জানি আপনি দেখছেন। আপনাকে শুধু চারটি শব্দ বলতে চাই– ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে নিন।’ তিনি বলেন, ট্রাম্পকে কীভাবে হারানো যায়, নিউইয়র্ক শহর তা দেখিয়েছে।
জোহরান মামদানির বাবা মাহমুদ মামদানি ভারতের গুজরাটি বংশোদ্ভূত। মা মীরা নায়ারও ভারতীয়। মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মামদানি বলেন, ‘আমি যে মানুষ হয়েছি, তা তোমাদের জন্যই। তোমাদের সন্তান হতে পেরে আমি গর্বিত।’ বড় জয়ে মামদানির সিরীয় বংশোদ্ভূত শিল্পী স্ত্রী রামা দুয়াজিরও বড় ভূমিকা দেখেন অনেকে।
সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার রাজনীতিক মামদানি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কট্টর সমালোচক। গুজরাট দাঙ্গার জন্য তিনি মোদিকে দায়ী করেন। মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না বলেও জানিয়েছিলেন। এ অবস্থায় মোদি সমর্থকরা নির্বাচনে তাঁর বিরোধিতায় নেমেছিলেন। তবে অধিকাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসী মামদানিকে সমর্থন করেন। ইহুদিদের একাংশ বিরোধিতা করলেও অপর একটি অংশ তাঁর পাশে ছিল। সবকিছু ছাপিয়ে গেছে নিজ দলের নেতা বার্নি স্যান্ডার্সের সমর্থন। স্যান্ডার্স একাধিকবার নিউইয়র্কে সমাবেশ করে মামদানির পক্ষে প্রচার চালান। তাই মামদানির বিজয় পরোক্ষভাবে বার্নিরও। সেইসঙ্গে এটিকে যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটদের পুনরুত্থান হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
ভাষণে নেহরু প্রসঙ্গ
বিজয়ের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মামদানি স্মরণ করেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে। তিনি বলেন, ‘আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে, আমার মনে পড়ছে জওহরলাল নেহরুর কথা। ইতিহাসে কখনও কখনও এমন বিরল ক্ষণ আসে, যখন আমরা পুরোনো থেকে বেরিয়ে নতুনে প্রবেশ করি, যখন একটি কালের অবসান হয় এবং যখন বহুদিন ধরে অবদমিত একটি জাতির আত্মা নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পায়।’ এনডিটিভি জানায়, নেহরুর কথা পুনরুক্ত করে মামদানি বলেন, ‘আজ রাতে আমরা পুরোনো থেকে নতুনের পথে পা ফেললাম।’
বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অভিনন্দন
বিজয়ের পর নিজ দল ও দেশ ছাড়াও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অভিনন্দনের বার্তা পান মামদানি। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, লন্ডনের মেয়র সাদিক খান তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে লেখেন, ‘ভয়ের বিপক্ষে আশা জিতেছে।’ সামাজিক মাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। তিনি জোহরান মামদানির নাম উল্লেখ না করে লেখেন, বিজয়ী সব ডেমোক্র্যাটকে অভিনন্দন। নিউইয়র্ক ছাড়াও নিউজার্সি ও ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে ভোটে ডেমোক্র্যাটরা জয় পেয়েছেন। ভারত থেকে কংগ্রেস নেতা শশী থারুর, অভিনেত্রী শাবানা আজমি অভিনন্দন জানান। এ ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
কে কত ভোট পেলেন
মেয়র নির্বাচনে অনেকটা নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছেন জোহরান মামদানি। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে তিনি ভোট পেয়েছেন প্রায় দুই লাখ বেশি। ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী মামদানি পেয়েছেন ১০ লাখ ২৯ হাজার ১৯৬ ভোট, যা মোট ভোটের ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট পার্টির বিদ্রোহী প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুওমো পেয়েছেন আট লাখ ৪৯ হাজার ৮১৬ ভোট, যা মোট ভোটের ৪১ শতাংশ। রিপাবলিকান কার্টিস স্লিওয়া পেয়েছেন এক লাখ ৪৫ হাজার ৫৪৩ ভোট, শতাংশে যা ৭ দশমিক ১। মামদানি ৯ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।
যেসব প্রতিবন্ধকতা
স্রোতের বিপরীতে গিয়ে জয় পাওয়া মামদানিকে মোকাবিলা করতে হবে নানা চ্যালেঞ্জ। গতকাল বুধবার বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কয়েকটি কারণে মামদানির বিজয় গুরুত্বপূর্ণ। মামদানি যখন গত বছর এ রাজনৈতিক দৌড় শুরু করেন, তখন তাঁর নাম কেউ জানত না। অর্থকড়ি নেই বললেই চলে। দল থেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে বড় কোনো সমর্থন ছিল না। সাবেক মেয়র অ্যান্ড্রু কুওমোর বিরুদ্ধে অনেকটা একক চেষ্টায় তিনি জয় পেয়েছেন।
মামদানি তরুণ ও প্রাণচাঞ্চল্যে পূর্ণ। তিনি যে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা সামাজিক মাধ্যমে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তিনি বিনামূল্যে শিশুসেবা, গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে জনপ্রিয়তা পান। তিনি শ্রমজীবী মানুষের কথা বলেন। সমালোচকরা বলতে শুরু করেন, যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী একজন ঝানু রাজনীতিক। কুওমো একজন গভর্নরের সন্তান। তিনিও ডেমোক্র্যাট দলের নেতা।
মামদানি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়নই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফেডারেল তহবিল দেওয়ার বিষয়ে অসম্মতি জানিয়েছেন। আর নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হচুল বলেন, মামদানি যে ধনকুবেরদের ওপর অতিরিক্ত করারোপ করতে চাচ্ছেন, তিনি এ পরিকল্পনার বিরোধী। এতে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তহবিল সংকটে পড়তে পারেন মামদানি।
গাজায় গণহত্যার বিরোধিতার জয়
এর আগে নিউইয়র্কের আর কোনো নির্বাচনের দিকে এমন নজর ছিল না বিশ্বের। পুরো ভোটের লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে ছিল ভিন্ন একটি বিষয়, যা ভোটারদের পক্ষ নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। সেটি গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা। জোহরান মামদানি নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ বলে বর্ণনা করেন। তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর গ্রেপ্তারের দাবিও জানান। এ অবস্থায় নেতানিয়াহুর সমর্থকরা তাঁর বিরোধিতায় মাঠে নামেন। এ জন্য তাঁর বিজয়ের অর্থ হলো–গাজায় ইসরায়েলের বিরোধিতা ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি।






