ফরিদ আহমেদ : নির্মলেন্দু গুণের অসম্ভব জনপ্রিয় এক কবিতা হচ্ছে ‘হুলিয়া’। অনেকেরই ধারণা এটা তাঁর প্রথম সফল কবিতা। তাঁর নিজের ধারণাও তাই। যে কারণে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’-তে তিনি এই কবিতাটাকে সবার আগে স্থান দিয়েছেন।
সেই ১৯৭০ এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এই কবিতাটা প্রথম কবির কণ্ঠেই পঠিত হয়েছিলো। তারপর থেকে অসংখ্য আবৃত্তিকার এই কবিতার আবেগময় আবৃত্তি করেছেন। দিনে দিনে কবিতাটি হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় থেকে জনপ্রিয়তর। এতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো যে এই কবিতা অবলম্বনে একটা স্বল্প দৈর্ঘ্যের তৈরি করেছিলেন তানভীর মোকাম্মেল। চলচ্চিত্রটা মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৮৪ সালে। তানভীর মোকাম্মেল তখন তরুণ। ওটাই ছিলো তাঁর প্রথম কাজ। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন তানভীর মোকাম্মেল। সাথে ছিলেন মোরশেদুল ইসলামও। ওই কোর্সে চিত্রনাট্যের ক্লাস নিতেন ‘ঘুড্ডি’ চলচ্চিত্রখ্যাত পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী। তিনি কোর্সের অংশ হিসাবে তাঁর ছাত্রদের চিত্রনাট্য লিখতে দেন। মোরশেদুল ইসলাম লেখেন ‘আগামী’-র চিত্রনাট্য আর তানভীর মোকাম্মেল লেখেন ‘হুলিয়া’-র চিত্রনাট্য। এই দুই তরুণ পরিচালকই তাঁদের চিত্রনাট্যকে স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করেন। এঁদের দু’জনের কারণে আশির দশকে বাংলাদেশে স্বলদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নবজাগরণ ঘটে।

কবিতাটি এতো জনপ্রিয় কেনো হয়ে উঠেছিলো? কী আছে এর মধ্যে। এটা একটা গদ্য কবিতা। কবির নিজের জীবন এবং সেই সময়ের অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি একাকার হয়ে মিশে গিয়েছে এই কবিতায়। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে তরুণ কবিদের একটা কবিতা পাঠের আসর বসেছিলো। সেখানেও নির্মলেন্দু গুণ তাঁর এই কবিতাটা পাঠ করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি তখন পূর্বদেশ পত্রিকাতে ‘তৃতীয় মত’ নামে একটা কলাম লিখতেন নিয়মিত। সেখানে তিনি এই কবিতা সম্পর্কে লেখেন,
“এই আসরে একটি আশ্চর্য সুস্থ, সা¤প্রতিক কণ্ঠ শুনলাম একটি কবিতায়। কবিতার নাম সম্ভবত হুলিয়া। কবির নাম নির্মলেন্দু গুণ। ফেরারী নায়ক গ্রামে ফিরেছেন। তার শৈশব ও কৈশোরের অতি-পরিচিত খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, পথ সবই তার কাছে বহুবার দেখা ছবির মতো। অথচ কেউ তাকে চিনতে পারছে না। যেমন তাকে চিনতে পারেনি স্টেশনের গোয়েন্দা পুলিশ এবং টিকিট চেকার। নায়ক ফিরে এলো মায়ের কাছে, সংসারের প্রাত্যহিক দাবির কাছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সকলের কণ্ঠেই একটি প্রশ্ন – দেশের কী হবে? শেখ সাহেব এখন কী করবেন? কবিতার নায়ক জবাব দেয় ….. আমি এসবের কিছুই জানি না – আমি এসবের কিছুই বুঝি না।

জানি না কবিতাটির আখ্যান সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পেরেছি কিনা। দীর্ঘ কবিতা। তাতে শুধু কবিতার স্বাদ নয়, সা¤প্রতিক রাজনীতির যুগ-জিজ্ঞাসাও বেশ স্পষ্ট, এ যেন বাংলার ক্ষুব্ধ তারুণ্যের স্বগতোক্তি। এই জবার চাইতে বড় সত্য এই মুহূর্তে জন-চেতনায় আর কিছু নেই।”
‘হুলিয়া’ কবিতাটা সেই সময়ের রাজনৈতিক জন-চেতনার এই জায়গাটাকে সঠিকভাবে ধরতে পেরেছিলো বলেই একটি ব্যক্তিগত কবিতা মুহূর্তের মাঝেই হয়ে উঠেছিলো সার্বজনীন। স্বাধীনতার ঠিক নিকট সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ছিলো উত্তাল কিন্তু প্রবল অনিশ্চয়তায় ভরা। তখনও কেউ জানে না গণ আন্দোলন আসলে কোনো দিকে যাচ্ছে, কোন গন্তব্যের দিকে তরী এগোচ্ছে। জানার কথাও না। রাজনৈতিক এক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছিলো সময়। ফলে, কারো পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব ছিলো না আসন্ন ভবিষ্যতের।

আগেই বলেছি কবির ব্যক্তিগত জীবন উঠে এসেছে এই কবিতায়। তাঁর নিজের নামেই হুলিয়া ছিলো। তবে, মজার বিষয় হচ্ছে কবিতাটিতে রাজনৈতিক ‘যুগ-জিজ্ঞাসা’ থাকলেই কবি নিজে কিন্তু রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না। তাঁর নামে যে হুলিয়া জারী হয়েছিলো সেটাও রাজনৈতিক কোনো হুলিয়া নয়। মিথ্যা এক ডাকাতির মামলা ফেঁসে গিয়েছিলেন তিনি। গ্রেফতার হবার ভয়ে প্রথমে গ্রাম থেকে তিনি চলে আসেন ময়মনসিংহে। সেখান থেকে ঢাকায়। মাঝে মধ্যে সংগোপনে গ্রামে যেতেন তিনি। তাঁর কবিতাতে এই অভিজ্ঞতায় তিনি লিখেছেন। তবে, বাড়তি যে মুনশিয়ানা তিনি দেখিয়েছেন সেটা ওই সমকালীন রাজনীতিকে টেনে এনে তাঁর জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলা।

এই যে এতো জনপ্রিয় কবিতাটা, এটা হয়তো ধ্বংস হয়ে যেতে পারতো চিরতরে। ধ্বংস আসলে করেও ফেলা হয়েছিলো। আমরা এখন ‘হুলিয়া’ নামের যে কবিতাটা পড়ি সেটা নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন দ্বিতীয়বারে।
কবির এই অমর কবিতাটা ধ্বংস হয়েছিলো কোনো কবিতা অ-প্রেমিকের হাতে নয়, বরং আরেকজন কবির হাতে। তিনি হচ্ছে আবুল হাসান।

আবুল হাসান বিশুদ্ধবাদী কবি ছিলেন। তাঁর মস্তিষ্কে কবিতা ছাড়া আর কিছু ছিলো না। শয়নে-স্বপনে কবিতাই ছিলো তাঁর নিত্যসঙ্গী। কবিতা লেখা এবং কবি যশোপ্রার্থী হবার জন্য গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা আসেন তিনি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু, পড়ালেখা মুখ্য কিছু ছিলো না তাঁর কাছে। ঢাকায় এসে তিনি পেয়ে যান নির্মলেন্দু গুণকে। দু’জনের বয়স কাছাকাছি, দু’জনেই কবি, কবিতা ছাড়া আর কিছু বোঝেন না এবং একই সাথে ছন্নছাড়া। ফলে, দু’জনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হতে সময় লাগে না। ঢাকা শহরে তাদের থাকার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ছিলো না, ছিলো না আয় রোজগারের কোনো ব্যবস্থা। রাতের পর রাত তারা রেলস্টেশনে, পার্ক করা বাসে কিংবা ফুটপাতে ঘুমিয়েছেন। লক্ষ্য ওই একটাই। কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। সেটা দু’জনেই পেয়েছিলেন। তবে, আবুল হাসানের ক্ষেত্রে সেটা ছিলো খুবই স্বল্পস্থায়ী। মাত্র আটাশ বছর বয়সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি।

আবুল হাসান হুলিয়া কবিতাটা ধ্বংস করে ফেললেও, সেটার পিছনে কোনো ঈর্ষাজনিত কারণ ছিলো না। তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ কবি, কবিতার বিশুদ্ধতায় ছিলো তাঁর অখÐ বিশ্বাস। নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ তাঁর কাছে কবিতা হয়ে ওঠেনি। সেটা ছিলো একটা অকবিতা। কাজেই একজন কবি হিসাবে অ-কবিতাকে ধ্বংস করাটাকে নিজের কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন তিনি। নির্মলেন্দু গুণের ভাষাতেই সেই ঘটনা শুনি আমরা।

“হুলিয়া কবিতার প্রথম খসড়াটি আমার প্রিয়বন্ধু শ্রীমান আবুল হাসান রাগ করে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। আগের দিন রাতে আমি আর হাসান সলিমুল্লাহ হলে ছিলাম। সম্ভবত হাসানের বাল্য সুহৃদ মাহফুজুর হক খানের রুমে। পান এবং আড্ডার কারণে অনেক রাত করে আমরা ঘুমাই। তাই পরদিন বেশ দেরিতে আমার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙার পর উঠে দেখি রুম ফাঁকা। হাসান চলে গেছে। তাকিয়ে দেখি টেবিল থেকে ‘হুলিয়া’ উধাও। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে, রুম বন্ধ করে ছুটলাম শরীফের উদ্দেশ্যে। শরীফে যাবার পথে ঘাসের মধ্যে ঐ কবিতার কিছু ছেঁড়া অংশ আবিষ্কার করি। বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় না যে, আমার বন্ধু কবিতাটি পড়তে পড়তে এবং ছিঁড়তে ছিঁড়তে শরীফের দিকে গেছে। জটায়ুর কর্তিত ডানা পথে পড়ে থাকতে দেখে শ্রীরামচন্দ্র যে রকম সীতার গমন পথের সন্ধান পেয়েছিলেন, অনেকটা সে রকমের ঘটনা।

আমি যখন শরীফে পৌঁছি তখন দুপুর নয়, সকাল দশটা। হাসান চা-নাস্তা সেরে, একটি অকবিতার হাত থেকে বাংলা সাহিত্যকে মুক্ত করতে পারার আনন্দে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল এবং তার চারপাশে ভিড় করে বসা তার কয়েকজন ভক্তকে কবিতা জিনিসটা আসলে কী, সে সম্পর্কে জ্ঞানদান করছিল।

আমি শরীফে ঢুকেই পথ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া হুলিয়া কবিতার কিছু ছেঁড়া অংশের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তখন সে হাসে। বলে, এটা তো কবিতা নয়, গল্প, আবার লিখে ফেলো। রাগ করার কী আছে?’

এমন বিশুদ্ধবাদী কবির উপরে আসলে রাগ করা যায় না। নির্মলেন্দু গুণ রাগ করার বদলে ‘আবার লিখে ফেলো’ এই উপদেশ অনুসরণ করেন। সেইদিনই পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে তিনি ‘হুলিয়া’ কবিতাটা আবার লেখেন। তবে, তাঁর ভাষ্য হচ্ছে, কবিতাটা দ্বিতীয়বার লিখলেও এটা আসলে খুব একটা পৃথক হয়নি প্রথমটার সঙ্গে।

পৃথক হয়েছে কী হয়নি, সেটা আসলে এখন আর গুরুত্ববহন করে না। কারণ, আগেরটা আমরা দেখি নাই। দ্বিতীয়টাই আমাদের কাছে প্রথম। তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে কবিতাটা আজো আছে বলে। কবিতাটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলে হতাশায় কবি হাল ছেড়ে দিলে এটাকে আর হয়তো কখনোই আমরা পেতাম না। কবি সেটা করেন নাই। তার বদলে দ্বিতীয়বার কলম ধরেছেন তিনি। হারাতে দেন নাই তিনি কবিতাটাকে। এটা হারিয়ে গেলে কাব্য জগতে বড় ধরনের ক্ষতি হতো বলেই আমার ধারণা।

দ্বিতীয়বার লেখার পরে কবিতাটা নির্মলেন্দু গুণ পড়ে শোনান কবি আবুল হাসনকে। এবার তিনি মেনে নেন এটাকে কবিতা হিসাবে। প্রথম কবিতাটাকে অত্যন্ত হিংস্রতার সাথে হত্যা করার কারণে হয়তো এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছিলো তাঁর মধ্যে কিংবা হয়তো নতুন করে ভেবেছেন, কবিতার বিষয়ে নতুন উপলব্ধি তৈরি হয়েছে। যেটাই হোক না কেনো, দ্বিতীয়টাকে আর ধ্বংস করার দিকে আগ্রহ দেখাননি তিনি।