ফরিদ আহমদ

নাম তার হেইডা। জন্ম ইংল্যান্ডের নিউক্যাসল শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রয়োজনে জন্ম হয়েছিলো তার।
১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কমনওয়েলথের জন্য মোট সাতাশটা ট্রাইবাল ক্লাস ডেস্ট্রয়ার তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ষোলটা ছিলো ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির, আটটা রয়্যাল ক্যানাডিয়ান নেভির আর তিনটা ছিলো রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান নেভির। গতি, ম্যানুভারিং এবং যোগাযোগব্যবস্থা এগুলোর বিবেচনায় সেই সময়কার সেরা প্রযুক্তি ছিলো এই ডেস্ট্রয়ারগুলো।
আর এই সেরাদের মধ্যে সেরা ছিলো হেইডা, যার নামকরণ করা হয়েছিলো ব্রিটিশ কলম্বিয়ার কুইন শার্লট আইল্যান্ডের আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান হেইডাদের নামে।
সাতাশটা ট্রাইবাল ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের মধ্যে ষোলটা ডুবে গেছে, দশটাকে স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। একটা মাত্র অবশিষ্ট রয়েছে, যদিও কর্মক্ষম নয়। ডিকমিশনড করা হয়েছে তাকে ১৯৬৩ সালে। এই টিকে যাওয়া সবেধন নীলমণিটাই হচ্ছে হেইডা।
সবাইকে টেক্কা দিয়ে একা টিকে আছে বলেই হেইডা সেরা নয়, রয়াল ক্যানাডিয়ান নেভির সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধজাহাজ হচ্ছে হেইডা। যুদ্ধজীবনে চৌদ্দটা জাহাজকে ডুবিয়েছে হেইডা। তার চেয়ে বেশি সংখ্যক জাহাজ ডোবানোর রেকর্ড আর কোনো ক্যানাডিয়ান যুদ্ধজাহাজের নেই। বিশ বছরের সক্রিয় জীবনে পাঁচ পাঁচবার বীরত্বের পুরস্কার পেয়েছে হেইডা।
১৯৪৩ সালে কমিশনড হয় হেইডা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এসকোর্ট শিপ হিসাবে আর্কটিক, ফরাসী উপকূল নানা জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছে সে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কোরিয়ান যুদ্ধেও অংশ নেয় হেইডা। এর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছিলো, সেখানেও সক্রিয় থাকে হেইডা।
১৯৬৩ সালে হেইডাকে ডিকমিশনড করা হয় নৌবাহিনী থেকে। সেই সময় পর্যন্ত হেইডা ছয় লক্ষ অষ্টাশি হাজার নটিকাল মাইল পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। বিশ্বকে সাতবার পাড়ি দিয়ে ফেলা যায় এই পরিমাণ পথ অতিক্রম করলে।
হেইডাকে স্ক্র্যাপ করার কথা ছিলো। সৌভাগ্যক্রমে হেইডা ইনক নামের একটা কোম্পানি যুদ্ধজাহাজটা কিনে নেয়। একে এনে তোলে টরন্টোতে। মিউজিয়াম হিসাবে এটাকে রাখে তারা। ষাটের দশকে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে এই কোম্পানি। ফলে, মাত্র এক ডলারে হেইডাকে তারা বিক্রি করে দেয় অন্টারিও সরকারের কাছে। অন্টারিও সরকারের কাছ থেকে পরে এর মালিকানা হস্তান্তরিত হয় পার্ক ক্যানাডার হাতে। তারা সেটাকে নিয়ে আসে হ্যামিল্টনে। হেইডা পরিণত হয় মিউজিয়ামে।
সালমা আমাদের সহপাঠী বন্ধু। সে থাকে আমাদের বাসার খুব কাছে। সালমার চাচা-চাচি এসেছেন বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে। গতকাল বেরিয়েছিলাম তাঁদের নিয়ে কিছুটা ঘোরাঘুরি করার জন্য। সেই ঘোরাঘুরির প্রথম অংশ ছিলো হেইডা দর্শন।
হেইডাতে ভ্রমণ করা এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতায় বলা চলে। জাহাজটা যদিও অচল, কিন্তু এখনো অক্ষতই রয়েছে বলা চলে। মাত্র চার ডলারের বিনিময়ে এর ভিতরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ করে নেওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের যুদ্ধজাহাজগুলো কেমন ছিলো, তার একটা পরিষ্কার চিত্র আপনি পেয়ে যাবেন হেইডার ভিতরটা পর্যবেক্ষণ করলেই।
জাহাজের উপরে নানা জায়গায় কামান পোতা রয়েছে। ট্রাইবাল ক্লাস ডেস্ট্রয়ারগুলো বৈশিষ্ট্যই ছিলো এটা। টর্পেডোর পরিবর্তে কামানের উপর বেশি নির্ভরশীল ছিলো এগুলো। জাহাজের ভিতরে মিউজিয়ামের অসংখ্য কর্মী রয়েছে। আপনি ইচ্ছা করলে নিজের মতো করে জাহাজের ভিতরের ঘুরে ফিরে দেখতে পারেন। কিংবা তাদের সাহায্য নিতে পারবেন। তারা আপনাকে গাইডেড ট্যুর দেবে, নানা বিষয় ব্যাখ্যা করে জানাবে।
বিভিন্ন ফ্লোরে ফ্লোরে গিয়ে, অপারেশন রুম দেখে, রেডিও রুম ভ্রমণ করে, নাবিকদের শোয়ার ব্যবস্থা দেখে মনে হবে সবাই বুঝি আশেপাশেই আছে। এই এখুনি বুঝি শুরু হবে কর্মব্যস্ততা। জার্মান কোনো যুদ্ধজাহাজের দিকে ছুটে যাবে হেইডা, আক্রমণ শানাবে সেটার উপরে। কিন্তু, বাস্তবে সেরকম কিছু আর ঘটবে না। হেইডা তার সেই যৌবন হারিয়েছে। তবে, একশনে নিয়ে না গেলেও হেইডা ঠিকই আপনাকে নিয়ে যাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আপনি হারিয়ে যাবেন প্রাচীন সেই সময়ে। এটাই বা কম কীসে!