দেলওয়ার এলাহী : গত ৪ নভেম্বর, শুক্রবার সন্ধ্যায় টরন্টোর নন্দন টিভির আয়োজনে স্ক্যারবরোর ৭৬০ বার্চমাউন্ট রোডের নন্দন ইভেন্ট সেন্টারে অত্যন্ত সফলতার সাথে অনুষ্ঠিত হলো টরন্টোর প্রিয়মুখ আবৃত্তিকার ও উপস্থাপিকা দিলারা নাহার বাবুর একক আবৃত্তি সন্ধ্যা ‘শুধু কবিতার জন্য’। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নন্দন গ্রুপ এর প্রধান নির্বাহী নীলউৎপল দেবনাথ এবং অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার ডালিয়া আহমেদ ও নতুন দেশ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর। শুধু কবিতার আবৃত্তি শোনার জন্য টরন্টো শহরের প্রায় দুই শত শ্রোতাদর্শক পিনপতন নীরবতায় নন্দন টিভির স্টুডিওতে আয়োজিত সারিবদ্ধ আসনে নিবিষ্টমনে বসেছিলেন। প্রায় তিন ঘন্টা সময় একটানা কেউ ফোন না ধরে, ফেইসবুকে না গিয়ে, ইউটিউবে কোন কিছু না দেখে বসে থাকা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সেই গল্পের মতো। ঈশ্বরচন্দ্র মজা করার জন্য একটু মিথ্যে গল্প বলেছিলেন – ‘স্টিমারঘাটে অপেক্ষমাণ কয়েকজন বাঙালি রমণী পাশাপাশি নীরবে বসে আছেন।’ কয়েকজন বাঙালি রমণী পরস্পরের সঙ্গে কথা না বলে পাশাপাশি বসে আছে! বর্তমান সময়েও প্রায় তিনঘন্টা সময় ধরে কেউ ফোনে কথা বলেনি, ফেইসবুক ব্যবহার করেনি, ইউটিউবের কোন কিছু দেখেনি, পাশের কারো সঙ্গে কোন গুঞ্জন করেনি বললে, অনেকটা মিথ্যে মনে হতে পারে। তথাপি, তাই হয়েছিল।
আম্মা বলতেন, এমনকি আমিও বলি, পৃথিবীতে কিছুই কিছু না। না সাফল্য, না পদবী, না প্রতাপ, না খ্যাতি, না টাকার খেলা, কিছুই কিছু না। সবই সাময়িক। অথবা আরো নির্দিষ্টভাবে বললে- সবই মিথ্যে? কেননা, সবই ফুরিয়ে যায়। নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর স্ফুলিঙ্গের আলোর মতো ক্ষণিকের উজ্জ্বলতার পর সবই কালের অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে যায়? রবীন্দ্রনাথ যেভাবে তা বলেছিলেন – স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় মেলে ক্ষণকালের ছন্দ / উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে যায়, এই তারই আনন্দ। সবই যদি মিথ্যে হয়, সবই যদি ফুরিয়ে যায়, তাহলে আছে কী!
আছে। এবং আশ্চর্যজনকভাবেই আছে। কবি সানাউল হক খান তাঁর ‘আছে’ কবিতায় এই কথাটিই লিখেছেন :
‘আছে।
আছে বলেই ফুরোয় না,
আরো বেশী পাবার আকাঙ্খা।
আছে বলেই,
দেহের মাঝে এতো বেশী দেহক্ষয়।’
হ্যাঁ, হ্যাঁ আছে? এর নাম ‘মায়া’। মায়া আছে বলেই জীবন সুন্দর। এবং মায়া আছে বলেই, যা পেয়েছি তার চেয়ে আরো বেশী পেতে চায় মন। মায়া আছে বলেই আমরা সব ভুলে, আরো মায়াবী কথা শুনতে চাই? নভেম্বরের চার তারিখ সন্ধ্যায় দিলারা নাহার বাবু বাংলা কবিতার আবৃত্তি দিয়ে এরকমই এক ঐন্দ্রজালিক মায়াবী চাদরে জড়িয়ে ধরেছিলেন শ্রোতাদর্শকদের। বাবুর আকুলতা ভরা আবেগময় কণ্ঠের যাদুকরী ধ্বনিতে মুগ্ধ হয়ে মানুষ নিবিষ্টচিত্তে অনড়ভাবে বসেছিলেন। তার উচ্চারিত আবৃত্তি শুনে মানুষও বাবুকে অধিক মায়া ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি পুরো আয়োজনটি একেবারে শেষ পর্যন্ত সবাই উপভোগ করেছেন। সত্যি এক অনবদ্য আবৃত্তি সন্ধ্যা উপহার দিয়েছেন দিলারা নাহার বাবু।
সাবলীম ও সহাস্যমুখ নিবেদনে চমৎকার সঞ্চালনা করেছেন ফ্লোরা সূচি। কবিতার সঙ্গে চমৎকার নৃত্য পরিবেশন করেছেন উর্মি নুসরাত। আরেকটি কবিতায় বর্ণিত কলকাতার বিখ্যাত নর্তকী হেলেন-এর ভূমিকায় অসাধারণ নৃত্য পরিবেশন করেছেন ইত্তেলা আলী? আবহ ও সঙ্গীত সংযোজনায় বাবুর সাহস ও প্রেরণা সঞ্চারে পাশে বসে কীবোর্ড বাজিয়ে সঙ্গত করেছেন প্রখ্যাত জাহিদ হোসেন। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার দিলারা নাহার বাবুর আবৃত্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথেরই একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন প্রখ্যাত গজল শিল্পী শোয়েব মুর্তজা?
কী ছিল বাবুর আবৃত্তি করা কবিতায়, যা মুগ্ধ হয়ে শুনে মানুষ অনড় বসেছিলেন? আমার ধারণা বাবুর সারল্যমাখা মুখের ‘মায়া’। তার প্রাণের গভীর থেকে উৎসারিত ধ্বনিমাধুর্য। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কবিতা নির্বাচন। আর মানুষের প্রতি নিঃশর্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বাবু যে পুরোপুরিভাবে এই অংকে সফল তার কারণ, মানুষ বিপুলভাবে বাবুকে তার অধিক ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছেন। এটাও হয়তো বাবুরই দান। তার আবৃত্তির জাদু! বাবু যে মানুষটাই এরকম! জয়তু দিলারা নাহার বাবু।