আবৃত্তিতে মগ্ন দিলারা নাহার বাবু

আবৃত্তিকার এবং উপস্থাপিকা দিলারা নাহার বাবু টরন্টোর সাংস্কৃতিক জগতে অতি সুপরিচিত এক নাম। অনলাইন আবৃত্তি প্ল্যাটফর্মের কারণে বিশ্বের বাংলাভাষী কবিতা প্রিয় প্রায় সব মানুষের কাছে তিনি অতি পরিচিত। সুকন্ঠ, শুদ্ধ উচ্চারণ, নান্দনিকতা, পরিমিতি বোধ, সৃজনশীলতা এবং সেই সাথে কবিতার প্রতি তাঁর ভালোবাসা, বন্ধন ও অঙ্গীকার তাঁকে করে তুলেছে একজন অনন্য আবৃত্তিকার।

আগামী ৪ঠা নভেম্বর, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায়, ৪১-৭৬০ বার্চমাউন্ট রোড, স্কারবোরো’তে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দিলারা নাহার বাবু’র একক আবৃত্তি সন্ধ্যা। এই আয়োজনকে সামনে রেখে দিলারা নাহার বাবু’র আবৃত্তি-যাত্রা নিয়ে ‘বাংলা কাগজ’এর পক্ষ থেকে তাঁর সাথে কথা বলেছেন টরন্টোর সুপরিচিত সাংস্কৃতিককর্মী শারমীন শরীফ শর্মী। ‘বাংলা কাগজ’এর পাঠকদের জন্য দিলারা নাহার বাবু এবং শারমীন শরীফ শর্মী’র কথোপকথন প্রকাশিত হলো।

শর্মী : দিলারা নাহার বাবু, তুমি কেমন আছ?
বাবু : ভাল আছি, তোমরাও ভাল আছ আশা করি।

শর্মী : বাবু, ‘বাংলা কাগজ’ এর পক্ষ থেকে তোমাকে অগ্রিম অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং তোমার একক আবৃত্তি সন্ধ্যার অনেক সাফল্য কামনা করছি। তোমার কাছ থেকে তোমার এই আবৃত্তিকার হয়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই আজকে।
বাবু : শর্মী তোমাকে এবং ‘বাংলা কাগজ’কে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি আজকের সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য। আমাকে আবৃত্তিকার বলছ বলে নিজেকে অনেক ধন্য মনে করছি কারণ আবৃত্তি শিল্পী আর আবৃত্তিকার কিন্তু এক নয়। একজন আবৃত্তি শিল্পীকে অনেক সাধনার ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তবে আবৃত্তিকার হয়ে উঠতে হয়। আমি আবৃত্তিকার হয়েছি কিনা জানি না, তবে জানি কবিতার প্রতি রয়েছে আমার অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং নিজেকে অতিক্রম করার চেষ্টা আমি প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই খুব ছোটবেলা থেকেই আমি কবিতা পড়তে শুরু করেছি এবং কবিতাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।

শর্মী : আমার দেখা মতে অধিকাংশ মানুষ সাধারণত গান না নাচের প্রতি আকৃষ্ট হয়, অত অল্প বয়সে কারো নির্দেশনা ছাড়া একা তুমি কবিতার দিকে ঝুঁকলে কি করে?
বাবু : এটা একটু অদ্ভুত ব্যাপার বলতে পারো, ছোটবেলায় যখন কবিতা শুনতাম বা পড়তাম, তখন কবিতার বিভিন্ন শব্দ আমাকে আকৃষ্ট করত। এই যে যেমন ধর, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’, বা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে উকি মারে আকাশে’ … এই সব কবিতা ছোটবেলায় যখন পড়তাম তখন যেন ছোট্ট একটা নদী বা একটা নিঃসঙ্গ তালগাছের ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত, আমার মনে হত আমি যেন সেখানেই আছি, হাত বাড়ালেই নদীটা বা গাছটা যেন ছুঁতে পারব। কেমন একটা ঘোর লেগে যেত। সেই থেকেই কেমন একটা নেশা লেগে গেল কবিতা পড়বার জন্য।

শর্মী : বাহ! দারুণ তোমার কল্পনা শক্তি বাবু, এজন্যই তুমি আবৃত্তিকার হতে পেরেছ। কবিতা পড়ার সময় সেই কবিতাটির বিষয় আত্মস্থ করতে না পারলে বা ধারণ করতে না পারলে এর অনুভূতি দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব নয় বলেই আমার মনে হয়, নিজে বুঝলে তবেই না অন্যকে বোঝান যায়, তাই না? তোমার পরিবারের কে তোমাকে কবিতা আবৃত্তি করার উৎসাহ যুগিয়েছেন?
বাবু : সত্যি কথা বলতে, আমার পরিবার খুব গোঁড়া প্রকৃতির, কেউ আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলেনি যে , ‘বাবু তুমি গান কর বা কবিতা আবৃত্তি কর’, এটা সম্পূর্ণ আমার নিজের থেকে এসেছে। তবে পরিবারের কেউ যেমন উৎসাহ দেয়নি তেমনি আবার কেউ বাঁধাও দেয়নি।

শর্মী : প্রথম আবৃত্তির স্মৃতি মনে আছে?
বাবু : খুব আছে! আমি খুব ছোটবেলা থেকে বাড়িতে নিজে নিজে আবৃত্তি করলেও দর্শকের সামনে আবৃত্তি প্রথম করেছি যখন কলেজে পড়ি। আমার বান্ধবীরা জানতো কবিতার প্রতি আমার ভালোবাসার কথা। আমি তখন লালমাটিয়া কলেজে পড়ি। বাৎসরিক ফাংশনে আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছে, তো আমার বান্ধবীরা আমাকে অনেকটা জোর করে সেখানে নাম লেখাতে বাধ্য করল এবং শেষে দেখা গেল আমিই প্রথম স্থান অধিকার করেছি। এরপরে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল এবং আমি সিরিয়াসলি আবৃত্তিতে মনোযোগ দিলাম।

শর্মী : এরপরে কি করে কবিতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলে?
বাবু : শিল্পের পর্যায়! ভাল বলেছ! কলেজ শেষ করে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলোসফিতে ভর্তি হলাম। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেলাম এবং সেখানে গিয়ে দেখলাম টিএসসি’তে আবৃত্তি শেখার সংগঠন ‘কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র’, যার প্রাণবিন্দু ছিলেন প্রখ্যাত আবৃত্তিকার ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় (২১শে পদক প্রাপ্ত), আমি বিনা দ্বিধায় সেখানে ভর্তি হয়ে গেলাম এবং তাঁর কাছে শুদ্ধ আবৃত্তি শিখতে শুরু করলাম। সেই জাহাঙ্গীরনগর থেকে টিএসসি’তে আসতাম আবৃত্তি শেখার জন্য।

শর্মী : কোন কিছুর প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা থাকলে যে কোন বাঁধাই উতরানো সম্ভব। সংগঠনে যোগ দেবার পরে কি করলে?
বাবু : ভাস্বরদা মন প্রাণ ঢেলে আমাদের কবিতা আবৃত্তি শেখাতেন এবং আড় ভাঙ্গার জন্য বিভিন্ন জায়গায় প্রতিযোগিতায় নিয়ে যেতেন আমাদের, যেমন বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, মুক্ত মঞ্চ ইত্যাদি জায়গায় আবৃত্তি করে করে সাবলীল ও সাহসী হয়ে উঠলাম। কিন্তু কয়েক বছর পরে যখন বিয়ে, চাকরি, সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম তখন আবৃত্তির ছন্দপতন হল।

শর্মী : ছন্দপতন মানে কি? আবৃত্তি বন্ধ করে দিলে? তাহলে আবার কি করে ফিরে এলে আবৃত্তি জগতে?
বাবু : বিয়ের পরে অনেক বছর আবৃত্তি হয়ে ওঠেনি। কিন্তু নিভৃতে একা একা ঠিকই আবৃত্তি করতাম। এরপরে এলাম টরন্টোতে, এখানে এসে যেন আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম কবিতা থেকে। এখানকার জীবনের সাথে তাল মেলাতে, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, কাজ, সংসার, সন্তান এগুলোতে ব্যস্ত হয়ে গিয়ে আবৃত্তির বারোটা বেজে গিয়েছিল।

শর্মী : আহারে! আমি তোমার কষ্টটা যেন বুঝতে পারছি? কি অসাধারণ গল্প বাবু! এরপরে কবিতায় আবার ফিরে এলে কি করে? শুধু ফিরে আসা নয়, একেবারে সম্রাজ্ঞী হয়ে ফিরে আসা যাকে বলে!
বাবু : হা হা হ, সম্রাজ্ঞী হয়ে! অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে এত সুন্দর করে বলার জন্য! টরন্টোতে অনেক অনুষ্ঠান হয় এটা মানো তো? আমি এসব অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে যখন দেখতাম কেউ আবৃত্তি করছে তখন কেমন একটা কষ্ট, গলায় দলা পাঁকিয়ে উঠত, চোখের কোনটা জ্বালা করত, মনে হত আমিও তো পারি! তবে কেন করি না! ধীরে ধীরে আবার শুরু করলাম। এখানে সেখানে, ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আবৃত্তি শুরু করলাম। এরপরে আহমেদ ভাইএর (আহমেদ হোসেন) সাথে একসাথে ‘অন্যস্বর’ নামে একটি কবিতা আবৃত্তির সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলাম এবং এই প্ল্যাটফর্মে আরো বেশি দৃঢ়তার সাথে আবৃত্তি শুরু করলাম। আহমেদ ভাই আবার নতুন করে ঝালিয়ে দিয়েছেন যা কিছু ভুলে গিয়েছিলাম। অনবরত উৎসাহ দিয়েছেন এবং ধৈর্য ধরে আবৃত্তির ভুলগুলো সুধরে দিয়েছেন। অনবরত চর্চার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস যেন আরো বেড়ে গেল। দেখলাম বন্ধুরা আমার কবিতা ভালোবাসে, প্রশংসা করে। তখন যেন একটু বিশ্বাস হল যে আমি কবিতা আবৃত্তি করতে পারি।

শর্মী : তুমি যাই বল বা যত বিনয়ই কর না কেন আমরা জানি তুমি দিনে দিনে যেন নিজেকেই অতিক্রম করছ! কিভাবে এত ঝকঝকে করলে তোমার আবৃত্তিকে?
বাবু : তুমি একটু বাড়িয়েই বলছ শর্মী, কিন্তু জানতে যখন চাইছ তখন বলি, টরন্টোতে অসংখ্য গুণী আবৃত্তিকার রয়েছেন! তাঁদের মাঝে আমি তেমন কেউ নই, তবুও এটা ভাবতে ভাল লাগে যে, তোমাদের ভালোবাসায় আমিও কিছুটা পরচিতি পেয়েছি সকলের মাঝে এবং আবৃত্তিকার হিসেবে ভালোবাসা পেয়েছি সবার। দুই বছর অতিমারীতে সব কিছু বন্ধ হয়ে গেলে তখন অফুরন্ত সময় পেয়েছি চর্চা করবার জন্য এবং সত্যি করে বলছি, আমি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি তখন বা এখনো করি এবং অনেকটা সময় ব্যয় করি কবিতা আবৃত্তি চর্চার পেছনে।

শর্মী : এভাবে একা একজনের আবৃত্তি এর আগে আর হয়নি, এই একক আবৃত্তি সন্ধ্যার বুদ্ধি কি করে তোমার এল মাথায়?
বাবু : ওই যে বললাম অতিমারীতে অনেক চর্চা করেছি। আরেকটা ব্যাপার হল, যারা শৈল্পিক বিষয়গুলো ভালোবাসে তাঁরা এর থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে পারে না, অতিমারীতে যেহেতু মানুষের সামনে বসে পারফরমেন্স করা যায়নি, মানুষ এর বিকল্প খুঁজে বের করল, ডিজিটাল মিডিয়ার সদ্ব্যবহার করল পুরোপুরিভাবে এবং চালু করে দিল অনলাইন অনুষ্ঠান। আমিও আবৃত্তির আমন্ত্রণ পেয়েছি এখানে বা অন্যদেশের অনলাইন অনুষ্ঠানগুলো থেকে। একসময় নিজে নিজেও রেকর্ডিং করে অনলাইনে ছাড়তে শুরু করলাম। দেখলাম সবাই পছন্দ করছে। এই প্রসঙ্গে আমার সোয়েব মূর্তজা ভাইয়ের কথা বলতে হবে। সোয়েব ভাই তাঁর স্টুডিও’তে আমার অসংখ্য আবৃত্তি রেকডিং এবং প্রফেশনাল ব্যাক-গ্রাঊন্ড মিউজিক করে দিয়েছেন, আর এ জন্য তাঁর কাছে আমার অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা। স্টুডিওতে রেকর্ডিং এর আমেজই আলাদা। অতিমারী শেষ হয়ে যাবার পরে ইচ্ছে হল তোমাদের সামনে বসিয়ে সবাইকে একদিন আমার এবং তোমাদের মন-প্রাণ ভরে আবৃত্তি শোনাবো, সেই থেকেই এই আইডিয়া এল।

শর্মী : তোমার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকুরি এগুলো নিয়ে কিছু বল বাবু।
বাবু : আমার স্কুল হল বটমূলী স্কুল (হলিক্রস কলেজের পাশে), লালমাটিয়া কলেজ, এবং এরপরে ফিলোসফিতে তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বের হয়ে দেশে চাকুরি করেছি অনেকদিন এরপরে ২০০০ সালে এখানে চলে আসি।

শর্মী : আমরা আমাদের আড্ডার শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি বাবু। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে সময় দেবার জন্য। তুমি তোমার অনুষ্ঠান নিয়ে দর্শক বন্ধুদের উদ্দেশ্যে কিছু বল।
বাবু : তোমার সময়ের জন্যও তোমাকে অনেক ধন্যবাদ শর্মী।

আমার প্রিয় বন্ধুরা, আমার অনেক দিনের ইচ্ছে তোমাদের কবিতা শোনাই, নিজের পছন্দের, তোমাদের পছন্দের, পুরনো এবং নব্য কবিদের কবিতার সংমিশ্রণে একটি কবিতার সন্ধ্যা তোমাদের সামনে উপস্থাপন করি। ৪ঠা নভেম্বর আমার সেই ইচ্ছে পূরণ হতে চলছে কিন্তু তোমাদের ছাড়া সেটা সম্ভব নয়, তাই তোমাদের উপিস্থিতি একান্ত কাম্য। এই সন্ধ্যায় আমার কবিতার পাশাপাশি মূর্তজা শোয়েব ভাই আমাদের গান শোনাবেন এবং সেই সাথে রয়েছে উর্মী নুসরাত এবং ইত্তেলা আলির উপস্থাপনায় কবিতার সাথে দু’টি নাচ। কবিতা সন্ধ্যার আয়োজনে রয়েছে নন্দন টিভি। নন্দন টিভির সকল কলাকুশলীদের জন্য আমার অকুন্ঠ ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা। ফয়েজ নূর ময়নাকেও অনেক ধন্যবাদ মজার মজার স্ন্যাকস দিয়ে সহযোগিতার জন্য। আমার যারা বিদেশে বসেও মাতৃভাষার চর্চাকে বুকে আগলে রেখেছি, হতে পারে কবিতা লেখা, আবৃত্তি করা, গান লেখা, গাওয়া, গল্প লেখা, প্রবন্ধ লেখা ইত্যাদিতে নিরলস ভাবে লেগে আছি তাঁদের সকলের জন্য আমার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমরা চাই আমাদের ছেলে মেয়েরাও, বাংলা ভাষায় না হয় না হোক কিন্তু তাদের কথ্য ভাষায় হলেও তারা সাহিত্য চর্চা করুক এবং সেই ভাষাতেই বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিক। সবাই ভাল থেক, সুস্থ থেক। অনুষ্ঠানে আসতে ভুলো না।