মিথুন আহমেদ

মিথুন আহমেদ মার্কিন অভিবাসী একজন বাঙালি শিল্পী। শিল্পের একাধিক শাখাতে রয়েছে তাঁর সমূহ আগ্রহ। কৃৎশিল্প, স্থাপনাশিল্প, প্রায়োগিক কলা ও চারুবিদ্যায় কৌতুহল বরাবরই তার প্রবল। বিধিবদ্ধতা আর পরম্পরা অনুসরণের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক পাঠ ও অবলোকনে ঋদ্ধতা অর্জনই তাঁর কাছে আপন ও শ্রেয়। তাই জীবনের উৎসমূল থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানই তাঁর অনুশীলনের আঁকড়। পারফরমিং আর্ট ও ভিস্যুয়াল আর্ট ফর্ম বিনির্মাণের প্রধান সহায়ক। নটরডেম থেকে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণী শেষ করে নব্বই দশকের শুরুতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিন দশক বসবাস করছেন নিউ ইয়র্কে। সর্বোপরি তিনি একজন মানবাধিকার সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক সংগ্রামের অগ্রগণ্য নেতৃত্ব। তুমুল আড্ডাবাজ এই সৃষ্টিশীল মানুষটি অতি স¤প্রতি টরন্টোতে এসেছিলেন। টরন্টোর জনপ্রিয় আবৃত্তি সংগঠন ‘বাচনিক’ গত ৫ই নভেম্বর সংগঠনটির দশম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আবৃত্তি শিল্পে অবদানের জন্য ‘বাচনিক সম্মাননা’য় সম্মানীত করে তাঁকে। সম্মানীত এই আবৃত্তিকারের সাথে সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’ এর পক্ষ থেকে তাঁর আবৃত্তি জীবন নিয়ে কথা বলেন ‘বাংলা কাগজ’ এর সম্পাদক মনিস রফিক। মিথুন আহমদ এবং মনিস রফিকের কথোপকথনটি ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।

মনিস : সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় আপনার দীপ্ত পদচারণা হলেও আবৃত্তি শিল্পে আপনার যে মনোনিবেশ এবং চর্চা তা সংস্কৃতিপ্রমী মানুষদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আপনি কখন থেকে নিজেকে আবৃত্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করেন?
মিথুন : আমি প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে আবৃত্তির সাথে নিজেকে জড়িত করি আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে। আজকের যেই আবৃত্তির জায়গা তাকে কিন্তু আমরা উল্লেখ করি প্রাতিষ্ঠানিক আবৃত্তি চর্চা কিংবা সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চা হিসেবে। কারণ বাংলাদেশে আগে যে আবৃত্তি চর্চা হতো সেটা ছিল মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রীক। আবৃত্তি অন্তপ্রাণ কিছু অগ্রজ নিজেরা নিজেদের মত আবৃত্তি করতেন বা পরিবেশন করতেন। আশির দশকের মাঝামাঝি আমি যখন আবৃত্তির সাথে নিজেকে জড়িত করি তখন কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্যই ছিল কিভাবে এটার একটা সাংগঠনিক রূপ দেওয়া যায়। আপনি নিশ্চয় জানেন, আশির দশকে যে স্বৈরাচারী শাসন আমাদের উপর চেপে বসেছিল, তখন আমরা আমাদের চেতনার কথা, বোধের কথা, প্রতিবাদের কথা, আমাদের মানবিকতার কথা বলতে পারতাম না। তখন আমাদের সেই প্রতিবাদের কথা বলার জন্য আমরা মূলত আবৃত্তিকে বেছে নিয়েছিলাম। স্বাধীনতাত্তোরকালে বাংলাদেশে যে তিনটি মাধ্যম নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে হচ্ছে, নবনাট্য আন্দোলন, গ্রæপ থিয়েটার চর্চা আর স্বাধীন ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ। এর অব্যবহিত পরেই এই সাংগঠনিক আবৃত্তির চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে।

মনিস : তাহলে বলছেন, আপনার আবৃত্তির জগতে প্রবেশের মূল কারণ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো?
মিথুন : আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘হ্যাঁ’ শব্দটিই বলবো। বৈরী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আমরা যখন বিপ্লব করতে পারছি না, সরাসরি প্রতিবাদ করতে পারছি না, তখনই সব ধরনের শোষণ এবং অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আমরা শিল্পের এই মাধ্যমটিকে বেছে নিলাম। তখন আমরা শুধু কবিতাই নয়, আমরা কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোকে বাকশিল্পের মাধ্যমে প্রচার করার চেষ্টা করি। আমরা শ্রæতি নাটকের চর্চা করলাম। আমরা খবরের কাগজের সংবাদকে প্রচার করার জন্য পারফর্মিং আর্ট এর সাথে যুক্ত করলাম। আমি মনে করি, আমি খুব সৌভাগ্যবান, কারণ সেই সময় এই আবৃত্তি শিল্পের বিকাশে যে এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আমি খুবই প্রত্যক্ষভাবে সেটাতে একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি এবং এই স্রোতধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। আমি মনে করি ‘সময়’ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। বিশেষ করে ক্রান্তিকালের সময়। কারণ সেই সময়ই আপনি পারবেন, সমাজ বা রাষ্ট্রের মানুষ হিসেবে আপনি কোন চেতনা ধারণ করেন এবং আপনি গণ মানুষের সার্বিক মঙ্গলের জন্য কতটুকু কাজ বা আত্মত্যাগ করছেন। ফলে সেই সময় আমরা যে চর্চার সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেছিলাম, সেটাতে আমরা স্পষ্ট করে সবাইকে জানাতে পেরেছিলাম, আমরা কোন পক্ষে এবং আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটায় বা কি। আমরা ঠিক করেছিলাম, আমরা আবৃত্তির মাধ্যমে শোষিতের কথা বলবো, আমরা শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলবো, আমরা ধর্মনিরপেক্ষ এক রাষ্ট্রের কথা বলবো।
‘বঙ্গবন্ধু’ কথাটি এক সময় সরকারী যে কোন প্রচার মাধ্যমে উচ্চারণ করা যেতো না। কেউ করলে, তাঁকে বø্যাক লিস্টেড করা হতো। কিন্তু আমরা আবৃত্তি চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রাণের বঙ্গবন্ধুর কথা উচ্চারিত করতে পেরেছি। আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে পেরেছি। সেই সাথে এই কবিতার মাধ্যমেই আমরা স্বৈরাচারী এরশাদের সকল নিয়মহীনতা এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে পেরেছি, রুখে দাঁড়াতে পেরেছি। আমাদের এই সাংগঠনিক আবৃত্তি শিল্পই আমাদেরকে সমস্ত অন্যায়, অবিচার এবং অমানবিকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে পথ দেখিয়েছে। শুধু তাই নয়, আজকের আবৃত্তি শিল্পের যে জনপ্রিয়তা এবং শ্রোতা তৈরির যে পরিবেশ, তাতে এই সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চা এক বিশাল ভূমিকা রেখেছে। সেই সাথে এই কাঠামোর জন্যই তৈরি হয়েছে আজকের অসংখ্য আবৃত্তি শিল্পী।

মনিস : আমি আবার জানতে চাচ্ছি, আপনি যে নিজেকে আবৃত্তি শিল্পের কাছে সঁপে দিলেন, এর পেছনে কি আর বিশেষ কারণ কাজ করেছে?
মিথুন : আমি সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চার আগে কিন্তু এককভাবে নিজেই চর্চা করতাম। তারপর আমি যখন নাট্যচর্চার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করলাম, বিশেষ করে কিশোরদের নাট্য সংগঠন ‘অভিযাত্রিক’ এবং প্রফেসর নাজমা জেসমিনের সাথে আমরা কাজ করতাম, তারপর আমি যখন একটু বড় হচ্ছি, মানে কলেজে উঠলাম, তখন আমি এস এম সোলাইমানের ‘ঢাকা পদতিক’ এর সাথে যুক্ত হলাম। সেই সময়ই আবৃত্তির সাংগঠনিক চর্চার যে জোয়ার বাংলাদেশে বয়ে চলে, সেই জোয়ারই আমাকে এর সাথে একনিষ্ঠ হতে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, সব শিল্পের একটা প্রায়োগিক রূপ আছে যা খুব সহজেই সেটাকে গণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের সেই আগুন ঝরা দিনগুলিতে প্রয়োজন হতে পরে কত দ্রæত শিল্পিতভাবে কোন কিছু সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করা যেতে পারে। সেটা সময়ের প্রয়োজনেই প্রয়োজন ছিল। আপনারা লক্ষ্য করবেন, সাংগঠনিক আবৃত্তির মত সেই সময় পথ নাটক একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবৃত্তি শিল্প তখন আমাকে খুব বেশি টানে কারণ সেই সময়ের সেই অন্যায় এবং সা¤প্রদায়িকতার ক্ষেত্র তৈরি করার যে রাষ্ট্র যন্ত্র, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে রাতারাতি স্ক্রিপ্ট তৈরি করে নিজেরা প্রস্তুতি নিয়ে সেটা গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারতাম। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, ইটস এ ভেরী গুড ফর্ম অব আর্ট।
আজকে আমার প্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে আমার বারবার তাঁর একটি উক্তির কথা মনে পড়ছে। আমরা জানি তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ছোট গল্পকার, প্রবন্ধকার, নাট্য নির্মাতা, নাট্য অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁকে আমরা মূলত চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেই চিনি। চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর গভীর প্রেম থাকা সত্তে¡ও তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কথা বলার জন্য আমি যদি চলচ্চিত্রের চেয়ে অন্য কোন বলিষ্ঠ মাধ্যম পাই, তাহলে আমি চলচ্চিত্রকে লাথি মেরে সেই মাধ্যমের কাছে চলে যাবো। কারণ এই সমাজ, এই রাষ্ট্র আর এই মানুষগুলোর জন্য আমার কিছু বলার আছে।’ আমি এই ক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটককে সব সময়ই স্মরণ করি, কারণ আমিও সব সময় কিছু বলতে চেয়েছি, আর সেই বলার জন্যই আমি মাধ্যমটাকে সব সময়ই গুরুত্ব দিয়েছি। আশীর দশকের সেই উত্তাল সময়ে আমার কাছে সাংগঠনিক কবিতা চর্চা ছিল তেমন এক মাধ্যম ।

বাচনিক সম্মাননায় সম্মানীত হচ্ছেন মিথুন আহমেদ। (বাম থেকে) মেরী রাশেদীন, দেলওয়ার এলাহী, রুমানা চৌধুরী, ডলি বেগম, মিথুন আহমেদ এবং রাশেদা মুনীর

মনিস : আমি আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে একটু জানতে চাই। এই যেমন আপনার জন্ম, পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
মিথুন : আমার জন্ম ২৭ এপ্রিল ১৯৬৮, ঢাকা শহরে। বাবা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা এবং মা কল্পনা আহমেদ অবসর নিয়েছেন শিক্ষকতা পেশা থেকে। তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে আমি জ্যেষ্ঠ। আমি ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক, নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্তে¡ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
১৯৯৪ তে ভারতের পন্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যশাস্ত্র ও অভিনয়কলা বিষয়ক ‘আই.সি.সি.আার’ স্নাতকোত্তর স্কলার্শিপ লাভ করেও আর যাওয়া হয়নি। আমি নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে বসবাস করছি।

মনিস : আপনার পেশাগত জীবন?
মিথুন : পেশাগত জীবনে আমি বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সংবাদ সংস্থায় সাংবাদিকতা এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক বিমান ব্যবস্থাপনায় কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলাম। বর্তমানে আমি যুক্ত রয়েছি একটি ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোম্পানির ক্রিয়েটিভ কনসালটেন্ট হিসেবে।

মনিস : আপনার নাটক এবং নাট্যচর্চা নিয়ে কিছু বলেন।
মিথুন : আমি আশির দশকের ১৯৮৪ সালে গ্রæপ থিয়েটার চর্চায় সক্রিয় হই এস এম সোলায়মান নির্দেশিত নাটক দিয়ে ‘ঢাকা পদাতিক’ নাট্য দলের মাধ্যমে। এরও আগে ১৯৭৭ সাল থেকে অভিনয়ে যুক্ত ছিলাম সেই সময়ের অন্যতম প্রধান ও সক্রিয় কিশোর নাট্য সংগঠন ‘অভিযাত্রিক কিশোর নাট্য গোষ্ঠী’র সাথে। অভিনয় করেছিলাম ‘দীপু নাম্বার টু’
‘তোতাকাহিনী’ এবং ‘অন্যরকম অভিযান’ নাটকগুলোতে। ১৯৮৬ তে প্রখ্যাত নাট্য নির্মাতা আতিকুল হক চৌধুরীর নাটকের মধ্য দিয়ে টেলিভিশনে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করি। অভিবাসী জীবনে গড়ে তুলেছি–‘থিয়েটার থিয়েটার’ নাট্য সংগঠন তাও প্রায় তিন দশক কাল হলো। নাট্য আখ্যান রচনা, পারফরমেন্স আর্ট ও চারুশিল্পের প্রতি রয়েছে আমার গভীর অভিনিবেশ আর ভালোবাসা।

মনিস : আমরা জানি, যে কোন সা¤প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় উন্মক্ততার বিরুদ্ধে আপনি সব সময় বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। আপনি কোন কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন?
মিথুন : বাংলাদেশের জাতীয় পরিস্থিতির সংকটে–রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম-আন্দোলনে সেই আশির দশক থেকে আজও পর্যন্ত আমি অতি সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত আছি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনের আমি একজন তৎপর ছাত্র রাজনীতিক ও সাহসী সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছি। আমি ‘নিউইয়র্ক রেসিটেইশন ফেস্টিভাল কমিটির চেয়ারম্যান’। এছাড়া আমি ‘থিয়েটার থিয়েটার’ নাট্য সংগঠনের দলপ্রধান ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। বর্তমানে আমি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার আহবায়কের দায়িত্ব পালন করছি।

মনিস : বাংলাদেশে থাকার সময়েতো আপনি টিভিতেও অভিনয় করতেন। আপনার অভিনীত কয়েকটি টিভি নাটকের নাম বলবেন কি?
মিথুন : আমার অভিনীত টিভি নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করতে পারি, জলাশয় কত দূরে (ধারাবাহিক নাটক) : আতিকুল হক চৌধুরী ১৯৮৭, বন্ধন (ধারাবাহিক নাটক) : ফখরুল আবেদীন ১৯৮৮ এবং এই সময়ের গল্প (ধারাবাহিক নাটক) : ফখরুল আবেদীন ১৯৯০। এছাড়া কয়েকটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক নাটক ছিল। যেমন এই মুহূর্তে মনে আসছে, বেণু গোপালের মাস্টারমশাই : নওয়াজিশ আলী খান ১৯৯১, নিঃশ্বাসের কাছাকাছি : আতিকুল হক চৌধুরী ১৯৮৯ এবং আর কতদূর : আতিকুল হক চৌধুরী ১৯৮৬।

মনিস : আপনিতো বেশ কয়েকটি মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন?
মিথুন : আমি আগেই বলেছি, আমি এস এম সোলাইমানের ঢাকা পদাতিক এর সাথে জড়িত ছিলাম। সেই ঢাকা পদাতিক এর ‘ইংগিত’, ‘গনি মিয়া একদিন’, ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল’ এবং ‘ইলেকশন ক্যারিকেচার’ এ অভিনয় করি।

মনিস : আপনার রচিত ও নির্দেশিত কয়েকটি নাটক আছে, সেগুলো কোনগুলো?
মিথুন : আমার রচিত ও নির্দেশিত নাটক হচ্ছে মূলত দুইটি। সেগুলো হচ্ছে, ‘বঙ কইন্যার পালা’ এবং ‘এ্যালিবাই লাল্লাবাই’। এছাড়া আমার রচিত কিছু আখ্যান রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, অর্ধনারীশ্বর, কাহনব্রজ, মকরক্রান্তি, তৃতীয়া তৎপুরুষ, মাৎস্যন্যায়, বিশেষ দ্রষ্টব্য, গাণ্ডীবা, ক্ষত এবং ক্রীড়নক।

মনিস : সব কিছুর উপরতো আপনি একজন কবি। আপনার কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে কি?
মিথুন : আমার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুটি। দুই ফর্মা প্রেম (১৯৮৬) এবং পকেট ভরতি পদ্য (২০০৮)।

মনিস : আবার আবৃত্তিতে ফিরে আসি। আপনিতো আশির দশকের ঊষালগ্নে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের আবৃত্তিশিল্প আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। আপনার আবৃত্তির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আরও একটু জানতে চাচ্ছি।
মিথুন : আবৃত্তিকে পদ্ধতিগতভাবে পরিশীলনে নতুন চিন্তাজগত তৈরীতে বাচিক শিক্ষাক্রম পরিচালনা এবং শিল্পের প্রচলিত ছককে ভেঙে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রথা-বিপ্রতীপ আবৃত্তি প্রযোজনা নির্দেশনা দিই। আবৃত্তির জনপ্রিয়তা গড়ে তুলতে মধ্য আশি থেকে এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে আমার একুশটি আবৃত্তি এবং পাঁচটি শ্রæতিনাট্যের এ্যালবাম। আমি বাংলাদেশে প্রথম শ্রæতিনাট্য চর্চার সূচনা করেন। আমার সাথে শ্রæতিনাট্যে সহশিল্পী হয়ে যুগলবন্দীতে অভিনয় করেছেন আলেয়া ফেরদৌসী, তারানা হালিম, শিরিন বক‚ল, মৌসুমি মার্টিন ও শমী কায়সার।

১৯৮৬ তে বাংলাদেশের আবৃত্তি আন্দোলনের প্রথম সামষ্টিক প্রচেষ্টা ওয়াহেদুল হকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘বাংলাদেশ আবৃত্তি ফেডারেশন’ এবং এর পর ১৯৮৭তে পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের আহবানে ‘আবৃত্তি শিল্পী সংসদ’ ও ১৯৮৯ তে সৈয়দ হাসান ইমাম ও কাজী আরিফের সাংগঠনিক দক্ষতায় গড়ে ওঠা ‘আবৃত্তিকার সংঘ’ এবং নব্বয়ের শুরুতে ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পারিষদ’ এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমি যুক্ত ছিলাম। এছাড়া আশির দশকের শুরুতে ১৯৮৪ তে ড. আলী রীয়াজের তত্ত¡াবধানে গড়া বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বরশ্রæতি’র সাথে যুক্ত ছিলাম শুরু থেকেই। ১৯৮৫ সালে নটর ডেম কলেজে তৈরী করি আবৃত্তির ক্লাব ‘সমবৃত্ত’। ১৯৮৭ সালে ‘স্বরশ্রæতি’ আয়োজিত তৃতীয় জাতীয় আবৃত্তি উৎসবের আমি ছিলাম প্রধান সমন্বয়কারী।

আমার শ্রুতি নাটকের এ্যালবামগুলি হচ্ছে : পরস্পর (১৯৮৮), সন্ধ্যার সে-শান্ত উপহার (১৯৮৯), সম্পর্ক (১৯৯০), চিরকাল (১৯৯১) এবং বসন্ত দিনের গান (১৯৯২)।
আর আমার আবৃত্তির এ্যালবামগুলি হচ্ছে, অশোক তরুর ক্রোধ (১৯৮৬), যদি নির্বাসন দাও (১৯৮৭), তিমিরহনন (১৯৮৮), জ্যোৎস্নার ভেতরে বাড়ি ফেরা (১৯৮৮), কোন আগন্তুক নই (১৯৮৮), ধ্রæপদী ঘুঙুর (১৯৮৯), ল্যান্ডিং মুখোমুখি ফ্ল্যাট (১৯৮৯), কিংবদন্তির কথা বলছি (১৯৯০), বাসস্টপে তিন মিনিট(১৯৯০), মাধবী এসেই বলে যাই (১৯৯১), রাধা আমার রাধা (১৯৯১), তোমার আমার গল্প (১৯৯২), দিয়ছি সকল আকাশ (১৯৯২), ভালোবাসি ভালোবাসি (১৯৯৩), সাতরঙ্গ দুপুর (১৯৯৩), বেণীমাধব তোমার বাড়ি যাবো (১৯৯৩), রাধা বোল রাধা (১৯৯৪), হৃদয়পুর (১৯৯৫) এবং এইতো মাধুরী এই তো অধর (১৯৯৬)।

মনিস : বাচনিক সম্মাননায় সম্মানীত হবার জন্য সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’ এর পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক অভিনন্দন। টরন্টোতে আবার আসবেন কবে?
মিথুন : আপনাকে এবং ‘বাংলা কাগজ’এর সবার প্রতি আমার ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা। খুব দ্রুতই টরন্টোতে আসবো। আর আপনাদের সাথে রাতভর আড্ডা দিবো। তখন আমরা আড্ডায় আড্ডায় ঘুরবো সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা থেকে এই ধরিত্রীর বিভিন্ন জনপদে। অনেক সুন্দর থাকবেন।