Home কলাম আমি কী গান গাব যে

আমি কী গান গাব যে

ভজন সরকার: বদলে যাচ্ছি। পৃথিবী বদলাচ্ছে। জল-হাওয়া বদলে যাচ্ছে। আমি আপনি সবাই বদলে যাচ্ছি। প্রতি ক্ষণে প্রতি মুহূর্তে বদল হচ্ছে সব কিছুতেই। এই যে মুহূর্তটুকু, অনন্তকাল পরেও সে আর এমনি ক’রে ফিরে আসবে কি?

এই বদল ঠেকাতেই আমাদের কতো আয়োজন। অথচ মানুষের, প্রকৃতির কোনো বদলই ঠেকানো যাবে না। কিন্তু এই পরিবর্তনকে মেনে নিতেও কষ্ট আমাদের। অথচ পরিবর্তনের আরেক নামই প্রগতি। সব পরিবর্তনে প্রগতি নেই। যে পরিবর্তন কল্যাণের সেটাই প্রগতির লক্ষ্যে পরিবর্তন। কিন্তু কিছু পরিবর্তন আছে, যা ক্রমশ ক্ষয?িষ্ণু। সে পরিবর্তনকে যতো বেঁধে রাখা যায়, ততোই মংগল।

মৃত্যুর মাত্র তিন বছর আগে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ-
“মত বদলিয়েছি। কতবার বদলিয়েছি তার ঠিক নেই। সৃষ্টিকর্তা যদি বারবার মত না বদলাতেন তা হলে আজকের দিনের সংগীতসভা ডাইনসর ধ্রুপদী গর্জনে মুখরিত হত”।
জীবনে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন সৃষ্টির আনন্দ থাকবে। সেই সাথে থাকবে পুরানো থেকে গ্রহন করবার শ্রদ্ধাপূর্ণ স্বীকারোক্তি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “তানসেনকে সেলাম করে বলব, “ওস্তাদজী, তোমার যে পথ আমারও সেই পথ। অর্থ্যাত নবসৃষ্টির পথ”।

রবীন্দ্রনাথ শুধু সংগীত নয়, নবসৃষ্টির এ পথকে প্রশস্ত করেছেন সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও। কবিতা-ছোটগল্প-প্রবন্ধ-উপন্যাসসহ সৃষ্টিকলার যা সবচেয়ে উত্কৃষ্ট-উত্কর্ষ, বিশ্বের নানান সাহিত্য থেকে তা আহরণ করে নিজের মতো করে, নিজের ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতির মতো করে সৃষ্টি করেছেন।

উত্তর ভারতীয় কিংবা হিন্দি বলয়ের ভারত থেকে সুর নিয়ে বাংলা গানকে বদলে দিলেন। রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলা গানের প্রচলিত যে কাঠামো স্থায়ী, অন্তরা এবং আভোগ, তার সাথে যুক্ত করে দিলেন সঞ্চারী। বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে সংগীতের জ্ঞান নিয়ে ফিরে এলেন। পাশ্চাত্যের ধারাকে গীতিনাট্যে এবং সংগীতে জুড়ে দিলেন।

রবীন্দ্রনাথ এটাকেই বলেছেন মত বদলানো। এ মত বদলানোর অন্য নাম প্রগতি। এ মত বদলানোর অন্য নাম গ্রহন করা। নিজের অভিজ্ঞতা আর প্রাজ্ঞতা দিয়ে অন্যের ভালো জিনিস গ্রহন করা।

রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, “দেখেছি চিত্ত যেখানে প্রাণবান সেখানে সে জ্ঞানলোকে ভাবলোকে ও কর্মলোকে নিত্যনূতন প্রবর্তনার ভিতর দিয়ে প্রমান করছে যে, মানুষ… একই শিল্পপ্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি করছে না। … শেষ দিন পর্যন্ত যদি আমার মত বদলাবার শক্তি অকুন্ঠিত থাকে তা হলে বুঝব এখনো বাঁচবার আশা আছে”।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাই চিত্তকে জ্ঞান, ভাব ও কর্মের জগতে প্রাণবান করে গড়ে তোলাই মানুষের আদর্শ হওয়া উচিত। অজস্র উদাহরণ পাই রবীন্দ্রনাথের জীবনেই। আজ থেকে প্রায় দেড় শ’ বছর আগে জন্ম নেওয়া একজন মানুষ এতোটা আধুনিক হয়ে গড়ে উঠেছিলেন যে, এই একবিংশ শতকেও তাঁকে পেছনে ফেলা কষ্টকর শুধুই নয়, দুরূহও বটে।

কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ বাদ দিয়ে শুধু গানের কথা বিবেচনায় নিলেও দেখা যায়, কী সুরে, কী কথায় বারবার রবীন্দ্রনাথ মত বদলেছেন, পুরাতনকে ভেংগে নতুন করে গড়েছেন। আবার নতুন-পুরানের মিশেলে সৃষ্টি করেছেন অপরূপ দ্যোতনাময় শিল্পকর্ম।

ব্যক্তি জীবনের সব কিছু তুচ্ছ করে, বয়স-জরাব্যাধিকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে সৃষ্টির আনন্দে ডুবে থেকেছেন। অনেকের মতো আমারও খুব জানতে ইচ্ছে করে সৃষ্টিমুহূর্তের রবীন্দ্রনাথকে। “সীমার মাঝে অসীম” কথাটি তিনি নিজেই লিখেছেন এক গানে। অথচ তিনি নিজেই সারাক্ষণ সেই অসীমেই ডুবে থাকতেন। সৃষ্টি সময়ের ডুবে থাকা সেই রবীন্দ্রনাথকেই খুব জানতে ইচ্ছে করে।

আমরা অনেকে বলি, সৃষ্টির ভিতর তারুণ্য চাই। রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, সে তারুণ্য বয়সে শুধু নয়, চাই অসীম মানসিক শক্তি, প্রেরণা, অদম্য ইচ্ছেশক্তি। আর সে উদ্যমতা- উদ্দামতাই বোধহয় ছিল রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির উত্স। তাই তো যতো বয়েস হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের ভিতরের তারুণ্য ততো বিকশিত হয়েছে।

যুবক বয়সে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান”। অনেকটাই পরিণত বয়সে লিখেছেন, “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে”।
১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৮ বত্সর। তিনি লিখলেন,
“আমি কী গান গাব যে ভেবে না পাই–
মেঘলা আকাশে উতলা বাতাসে খুঁজে বেড়াই”।

আমরা অনেকে প্রায়শঃই বলি, প্রাচীন ভারতীয় দর্শন-ধর্ম রবীন্দ্রনাথকে উদ্দ্বুদ্ধ করেছিল। অথচ ভারতীয় আশ্রমশাস্ত্র অনুযায়ী তো রবীন্দ্রনাথের এ সময় তৃতীয় আশ্রম “বাণপ্রস্থ” শেষে জীবন সায়াহ্নের আশ্রম “সন্ন্যাস”-এ থাকা দরকার। অথচ রবীন্দ্রনাথ করেছেন ঠিক তার উল্টো। তিনি বলেছেন,
“আমার অঙ্গে সুরতরঙ্গে ডেকেছে বান,
রসের প্লাবনে ডুবিয়া যাই”।

তাই ওই যে প্রথমেই বলছিলাম, সময়কে সৃষ্টির ধারায় প্রবাহিত করার মাধ্যমেই ঠেকাতে হয় বদল বা পরিবর্তন। সেটি হোক ব্যক্তি কিংবা হোক না প্রকৃতি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ পেরেছেন, আমরা অধিকাংশই পারি না। এই না-পারা থেকে পেরে ওঠার নিরন্তর প্রয়াসেরই অন্য নাম জীবন কিংবা অনেকের কাছে জীবন-সংগ্রাম।

আজ জীবন সংগ্রামকে অনেকেই নেতিবাচক অর্থে দেখি। অথচ জীবনে সংগ্রাম না থাকলে জীবনের বৈচিত্র থাকতো কি? বৈচিত্রহীন জীবন তো জড় আর ক্লীব জীবন। জীবনের মানে কি জড়তা? অবশ্যই নয়, জীবনের মানে হলো গতি এবং প্রগতি। পেছনে হাঁটা কিংবা হটাও গতি। কিন্তু জীবনের গতি চাই সামনে এগুবার, যারই অন্য নাম হয়ত প্রগতি। রবীন্দ্রনাথই বলেছেন,
“যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে।”

সমাজ বা জাতির জীবনেও বহমানতা বড় প্রয়োজন। ধর্মীয় বিধি-বিধান কিংবা রাষ্ট্র- আরোপিত শৃংখল মানুষকে যেন কোনোভাবেই বৃত্তাবদ্ধ করতে না পারে, সেটিই আমাদের অনেক মনীষী বলে গেছেন। অথচ আমরা যেন চলছি ঠিক উল্টো পথে। পশ্চাদপদ মানসিকতা থেকে প্রগতির পথে উত্তরণেই বাঙালি জাতির মুক্তি।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)

Exit mobile version