বিদ্যুৎ সরকার : প্রতি বছরই নদীর ভাংগনে ফসলের জমি সমেত বাড়ি-ঘরও নদী গর্ভে চলে যায় অবলিলায়। কখনো কখনো আস্ত গ্রামও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নদী-ভাংগনের কবলে পড়ে। নদীর পাড়ের বাসিন্দারা ঘর-বাড়ি, বসত-ভিটা, জমি-জমা সব হারিয়ে, নিঃশ্ব হয়ে একেবারে পথে বসে পড়ে। অভাব অনটন তখন তাদের নিত্যকার সাথী হয়ে পাশে পাশে থাকে। তবুও আশায় বুক বাধে, নিদ্রাহীন দু-চোখে স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকার। ভাংগা-গড়ার মরন খেলার মাঝে ছন্দ খোঁজে বেরায় মজিদ মিয়া। জমানো কিছু টাকা ভেংগে গড়ে তুলে একটি নৌকা। মালামাল পরিবহন, লঞ্চ যাত্রীদের ঘাটে পৌঁছে দেয়া-নেয়ার কাজও করে সময়-অসময়ে। এতে করে দু’বেলা অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা কখনো হয় কখনো হয় না। তবুও মজিদ মিয়া সম্মুখে এগিয়ে চলে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে। শক্ত, পেশীসমৃদ্ধ দু’বাহু তার পথচলার সম্বল। আশা জাগায় স্বপ্ন দেখায়। নদীর ভাংগন, বর্ষা শেষ হলে দোচালা একটি ঘর তুলবে এবং সেই ঘরের সামনেই ছোট্ট করে একটি মুদি দোকান করে বৌকে সেখানে বসিয়ে দিবে। দিনের বেলাটায় বৌ সামলাবে রাতে মজিদ মিয়া। আর মজিদ মিয়ার নৌকা তো আছেই সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি।

মজিদ মিয়ার সংসারে মেঘ ভেংগে রোদ উঠতে শুরু করেছে। দোকানের আয়তন ও মালামালের আয়োজন দু’টোই বৃদ্ধি পেয়ে সুখের পরশ এনে দিতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। বসত ভিটার পাশেই একটুখানি জায়গা কিনে কিছু শাক-সবজির চাষ করতে চায় মজিদ মিয়া। একটি মাত্র ছেলে সন্তান তাদের, নাম সজিব। পড়াশোনায় মোটেও মন নেই তার, সারাদিন খেলা-ধুলা নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ। সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সাথে ছুটে যাবে লঞ্চ ঘাটে। যাত্রীদের ওঠা-নামার দৃশ্য দেখতে তাদের ভাল লাগে। দু-চার পয়সা পকেটে থাকলে ঘাটের টি স্টল থেকে বিস্কুট কিংবা লজেন্স কিনে সবাই ভাগাভাগি করে খাবে। ওর ভীষণ পছন্দ মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়া। বাবা যখনই বাজারে যাবে তখন সজিবেরও সাথে যাওয়া চাই। কবে একদিন বাজার থেকে জিলাপি কিনে ছেলেকে খাইয়ে ছিল সেই স্মৃতি সজিবকে এখনও তাড়িয়ে বেরায়। তাই, যখনি সুযোগ আসে কোন অবস্থাতেই মিস করে না। জিলাপির রঙ্গিন রসময় প্যাচ তাকে বুঝি আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলেছে সহজেই। মিষ্টির প্রতি তার ভাললাগা, ভালোবাসা অপরিসীম, যে কোন কিছুর বিনিময়ে মিষ্টিমুখে বিমুখ হতে চায় না।

কিছু দিন হলো লঞ্চ ঘাটের টি স্টলটি চা, বিস্কু, লজেন্সের পাশাপাশি কিছু মিষ্টি রাখতেও শুরু করেছে। সজিবের আনন্দের আর সীমা নেই। এখন কিছু পয়সা হাতে আসলেই দৌড়ে গিয়ে নিজে নিজেই পছন্দ মত মিষ্টি কিনে মনের সুখে খেতে পারবে। এটা হবে তার বারতি পাওয়া। আর, বাবার সাথে বাজারে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ার বিষয়টি তো রয়েই গেল। লঞ্চ ঘাটের টি স্টলের মিষ্টি খাওয়ার ভাবনা তাকে দিন-রাত বুকের মাঝে কষ্ট বয়ে আনে। সময় পেলেই ছুটে যায় লঞ্চ ঘাটের সেই দোকানের কাছে। কাচের মধ্য দিয়ে গোল গোল রসসিক্ত রসগোল্লা, আমিত্তি, চম চম দেখে দেখে তার নিজের জিভ রসময় হোয়ে উঠে। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ওখানটায়। কেউ যদি ঘাটে লঞ্চ থেকে নেমে দয়ার বশবর্তী হয়ে কিছু পয়সা-কড়ি হাতে দিয়ে যায় একান্ত অনাথ শিশু মনে করে। তা দিয়ে মিষ্টি কিনে খাবে মনের সুখে। মাঝে মধ্যে পেয়েও যায় ভাগ্য গুনে। সেদিন তার আনন্দের সীমা থাকে না। অনেকটা ঈদের দিনগুলোর মতো মনে হয় সজিবের কাছে ঈদের দিনে যেমন মুরুব্বি ব্যাক্তিরা আদর করে ছোটোদের সেলামি দিয়ে থাকে ওমন।

সেদিন পর পর তিনটি লঞ্চ এসে ঘাট ছেড়ে চলে গেল যার যার গন্তব্যের দিকে। কিন্তু, সজিব যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল ঠায় ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কেউ আদর করে কোন কিছু দেয়নি। তাই, মনটা ভীষণ খারাপ তার। বার বার শো-কেসের গøাসের ভিতর দিয়ে মিষ্টিগুলো দেখছিল আর কিছুক্ষণ পর পর কোত্থেকে এক আজলা জল এসে যেন সমস্ত মুখ ভরিয়ে দিত তার। আর, সে জল যেন আটকে থাকতো ঠিক গলার মাঝখানটায় এসে। অনেক কষ্ট করে বার কয়েক চেষ্টা করে তবেই তা নামাতে পারতো। তার এ কষ্ট শুধু সে-ই অনুভব করতে পারে অন্য কেউ নয়। হঠাৎ সে দেখতে পায় শো-কেসের গøাসের একটি কোনা কেমন করে ভেঙে গেছে কেউই খেয়াল করনি বোধয়। সেই ভাঙা অংশটুকু দিয়ে পর পর দুটো মাছি শো-কেসের ভিতর গিয়ে সরাসরি মিষ্টির উপর বসে পড়লো এবং মনের আনন্দে মিষ্টি খেতে শুরু করে দিল। একবার রসগোল্লায় তো পরক্ষণই চমচমে কিংবা আমিত্তিতে বসে কী সুখে নির্ভীগ্নে খেয়ে যাচ্ছে তা কেবল সজিবই জানে। মাছি হয়ে জন্মানোর কি যে সুবিধে তা তো স্বচোক্ষে দেখতে পাচ্ছে সে। সজিবের মন খারাপের এখন একটি মাত্র কারণ সে কেন মাছি হোয়ে জন্মায়নি! ইস্ মাছি হয়ে জন্মালে কি মজাই না হতো, মনের সুখে যত খুশি পেটপুরে মিষ্টি খেতে পারতো। ‘ভাবতেই ব্যথায় ব্যথায় এ মন ভরে যায়….’। আহা মিষ্টি কি যে মিষ্টি…..।’ কপাল খারাপ না হলে কি মানুষ হোয়ে জন্মায়? আজ মাছি হলে কী মজা করেই না উড়ে উড়ে দূরে দূরে চলে যেতে পারতো। যেখানে খুশি সেখানে কত্তো সহজেই না ঢুকে গিয়ে মজা করে পেট ভরে খেয়ে দেয়ে আসতে পারতো! এত কিছু সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বেলা যে অনেক গড়িয়েছে তা খেয়াল করেনি এতোক্ষণ। খুব বেশি দেরি করে ফেলেছে সে, এখনি ফিরে যেতে হবে তাকে। ঘরে ফিরে যেতে যেতে মাছি হওয়ার মেটামোরফোরসিস বিষয়টি তার মাথা থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেনি মোটেও।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা