“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।” কালজয়ী এ গান সকল শহীদের কথা অকপটে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই জন্ম জন্মান্তরে চিরস্মরণীয় এ গানের মাঝে ভাষা শহীদের আত্মহুতির প্রতিচ্ছবি অজান্তেই ভেসে উঠে। বিনম্র শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২০ উদযাপন করেছে সর্বজনীন একুশে উদযাপন কমিটি টরন্টো, কানাডা। একুশের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা ড্যানফোর্থ এভেনিউএর ঘরোয়া রেস্টুরেন্টের পার্কিন লটে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে রাত বারোটায় সর্বপ্রথম শহীদদের প্রতি নীরবতা পালনের মাধ্যমে ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্যদিয়ে শহীদের শ্রদ্ধা জানানোর কার্যক্রম শুরু হয়। এরপরই বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং সর্বস্তরের প্রবাসী বাংলাদেশি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করেছিল উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। আর সেই ঘোষণায় রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি। মাতৃভাষার জন্য রুখে দাঁড়ানোর সেই দিনটি ছিল ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি।

দিনটি আজ বিশ্ব জুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে। ভাষার লড়াইটা হয়েছিল ঢাকাতে। কিন্তু সেই লড়াইয়ের বিস্তৃতি আজ গোটা বিশ্বে। মাতৃভাষা উচ্চারণ করতে চাওয়া প্রতিটি মানুষের নিরন্তর যে লড়াই। তাতে সে দিন পাকিস্তানিদের বুলেটে হত রফিক, সালাম, জব্বার, বরকতেরা আজ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে তাঁদের ভাষার জন্য লড়াইয়ের শহিদ। ১৯৫২-র সেই জীবনদান বৃথা যায়নি। আর সে কারণে আফ্রিকার সিয়েরালিয়েনের শিশুরাও আজকের দিনে গেয়ে ওঠে- “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।”

এই হত্যাকাণ্ড মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়নি। এই আন্দোলনেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মনে এক হওয়ার অনুভূতি সম্ভবত জাগ্রত হবে না।

মাতৃভাষা নিয়ে এই আন্দোলনেই বীজ বপন হয়েছিল পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একুশের লড়াই দেশের সীমানা অতিক্রম করেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান দিয়েছে। ১৯৫২-র একুশের শহিদেরা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের প্রতিটি বর্ণমালার পাহারাদার। বাংলাদেশ ভাষার জন্য জীবনদানে পেয়েছে অনন্য স্বীকৃতি। বাঙালির নিজের রক্তে অক্ষর কেনার দিন ২১ ফেব্রুয়ারি। আজ তার কোনও সীমান্ত নেই। এ এক এমন দিন, যার অস্তিত্ব পুরো বিশ্ব জুড়ে সব মানুষের কাছে উজ্জ্বল, ভাস্বর।

রাত ১১:৩০ মিনিটে অস্থায়ী শহীদ মিনারে প্রথমে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এতে বাংলা ভাষার ঐতিহ্য তাৎপর্য এবং বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভের উপর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন আমন্ত্রিত অতিথি টরন্টো সিটি মেয়র জনাব জন টোরি, বিচেস্ ইষ্ট ইয়র্ক এর এম পি নাথানিয়েল আরস্কিন স্মিথ, বিচেস্ ইষ্ট ইয়র্ক এর এম পি পি রীমা বার্নস ম্যাগগুয়ান, স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট এম পি পি ডলী বেগম, বিচেস্ ইষ্ট ইয়র্ক’র কাউন্সিলর ব্রাডফোর্ড, প্রাক্তন মন্ত্রী মারিয়া মিন্না,বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল জনাব নাঈম উদ্দিন আহমেদ, রিপ্রেজেন্টেটিভ বিল ব্লেয়ার অফিস নাদিম ও নাহিদ আপা।
সবশেষে একুশে উদযাপন ২০২০ এর অর্গানাইজিং কমিটির পক্ষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সৈয়দ সামসুল আলম। উনার বক্তব্যে সকল অতিথিবর্গসহ আগত বাঙ্গালী ভাই-বোনদেরকে প্রচন্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে মধ্যরাতে ভাষা শহীদদের প্রতি পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ এর শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, এবার সম্ভবত ঘরোয়া প্রাঙ্গণে অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপনের শেষ বর্ষ। আগামীতে ড্যানটনিয়া পার্কে স্থায়ী শহীদ মিনারে দিনটি উদযাপন হবে ইনশাল্লাহ।

সর্বশেষে তিনি বিগত প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যারা টরন্টোর এই শহীদ মিনার এর সাথে ওতপ্রতোভাবে ভাবে জড়িত ছিলেন এবং সার্বিক সহযোগিতা করেছেন তাদেরকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানান। এদের মধ্যে যাদের নাম উল্লেখ না করলেই নয় গোলাম সারওয়ার, মুজাহিদুল ইসলাম, মাহবুব চৌধুরী, কফিল উদ্দিন পারভেজ, সাদ চৌধুরী, খোকন আব্বাস, সাইদুল ফয়সল, আবুল আজাদ, রাশেদ বাবু, কাজী সাকী, সাকিব, দ্বীপ, জিন্নাহ, সোহেল, শামীম মিয়া, তুহিন মিয়া, আ ন ম ইউসুফ, এবাদ চৌধুরী, রাফী সৈয়দ ও তাজুল ইসলামসহ অনেকে। ভুলবসত কারো নাম বাদ পরলে আমি দুঃখিত।