খুরশীদ শাম্মী : ২০২০ সালের এক চতুর্থাংশ পার হয়নি এখনও। নতুন বছর আগমনের আমেজ সেদিনও ছিল টানটান, যেদিন হঠাত করে এসে আসন গ্রহণ করলো করোনা ভাইরাস। নামটা শান্ত মনে হলেও চলে সে বেশ দ্রুত। অল্প সময়ের মধ্যেই মহামারী আকার ধারণ করেছে করোনা ভাইরাস। চীনের উহান শহর থেকে ঈঙঠওউ-১৯ এর যাত্রা শুরু হলেও ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের জনগণ আক্রান্ত হয়েছে এর দ্বারা। কোনো বিশেষ দেশ কিংবা মহাদেশে নয়, পৃথিবীব্যাপী মহামারী আকার ধারণ করেছে করোনা ভাইরাস। বিশ্বের প্রায় সকল মানুষ তার ভয়ে আতঙ্কিত। রাষ্ট্রগুলোও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এখনও নিচ্ছে। বলা যায়, পুরো বিশ্ব অদৃশ্য অণুবীক্ষণীয় করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত এবং যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষ এক একজন সৈনিক।

এর প্রভাব পড়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, এমন-কি আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত। বিশ্বব্যাপী বিমান ভ্রমণ হ্রাস পেয়েছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। পাশাপাশি, বিভিন্ন দেশে অন্যান্য স্থানীয় যানবাহনগুলোও তুলনামূলকভাবে কম চলাচল করছে। ব্যস্ততম শহর নিউ ইয়র্ক, রোম, টরন্টোসহ বড় বড় শহরের রাস্তাগুলো জনমানব শূন্য, অচেনা মনে হয়। সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের কথা ভেবে বন্ধ করা হয়েছে মুসলমানদের পবিত্র স্থান কাবা-শরিফ সহ বিভিন্ন দেশের মসজিদ, মন্দির, গীর্জার মতো প্রার্থনালয়গুলো। প্রায় প্রতিটি দেশেই সরকারিভাবে বারবার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে জনসমাবেশ এড়িয়ে চলতে। অনেক দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ডে-কেয়ার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে অলিম্পিক, বিশ্বকাপ, এনবিএ ফাইনালসহ অনেক খেলা। পর্যটকদের অনুৎসাহিত করা হচ্ছে সৌখিন ভ্রমণে। কানাডা আমেরিকার সীমানা ব্যবহার সাধারণ কেনাকাটা ও সৌখিন ভ্রমণের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ক্যাফে ও রেস্তরাঁগুলোতে বসে খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তবে ডেলিভারি দেয়া ও নেয়ার ব্যবস্থা আছে। ব্যাংক ও বিপণীগুলো অল্প কয়েক ঘন্টার জন্য খোলা রাখার আলোচনা চলছে। শুধু কি এখানেই শেষ? না। করোনা ভাইরাস এত মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে বিশ্ব বাজারে যে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা বলা যায় না, বলতে হয় বিশ্ব বাজারে ধস নেমেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম বিশ্ব অর্থনীতি এতটা নিম্নমুখী। শ্রমজীবী মানুষেরা ইতোমধ্যে হারাতে শুরু করেছে চাকরি। ছোট বড় অনেক কোম্পানি বন্ধ হতে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের মতো এলোমেলো করে দিয়েছে সবকিছু। গত তিন মাসে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে প্রায় বারো হাজার মানুষ। দিনদিন আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমন মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। যেহেতু এটি স্পর্শসংক্রামক রোগ, সেক্ষেত্রে প্রতিরোধের জন্য প্রধানত সামাজিক দূরত্ব ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এই রোগের চিকিত্সার জন্য এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো ঔষধ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি, তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বিজ্ঞানীরা রাত-দিন কাজ করছেন। খুব দ্রুত এর ঔষধ আবিষ্কার হবে, প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কার হবে এবং চিকিত্সায় ইতিবাচক সাড়া জাগাবে, এমনটাই আশা করা যায়।

এরপরও ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যায় পর্যন্ত কোথাও কোথাও এই রোগটি নিয়ে তাচ্ছিল্যের মন্তব্য করা হচ্ছে কিংবা গুরুত্বসহকারে বিষয়টা অবলোকন করা হচ্ছে না। এই বিজ্ঞানের যুগে যা সত্যিই দুঃখজনক। এজন্য দায়ী আমরা অর্থাত আমাদের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও নেতিবাচক মনোভাব।

বলা যায়, বিশ্বের এই চরম ক্রান্তিকালে আমরা কেউ-ই সম্পূর্ণভাবে ভালো নেই। সবাই এখনও শারীরিকভাবে আক্রান্ত না হলেও ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছি মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে। যদিও কানাডাসহ কোনো কোনো দেশ অর্থনৈতিকভাবে তাদের নাগরিকদের স্বল্প মেয়াদি সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য স্বল্প সুদে ঋণও হয়তো দিবে। তবুও অনিশ্চিত ভবিষ্যত ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আমাদের অনেকের মধ্যেই বিষণ্ণতার বীজ বপন করতে চাইছে। এখন আমাদের সবারই সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি দরকার মনের প্রশান্তি হয় এমন কিছু করা ও ভাবা। কিন্তু অনেকের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। কেননা আমরা একদল নিজেকে মনে করি, এক একজন মহাপন্ডিত! সারাদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করতে থাকি করোনাভাইরাস সম্পর্কিত বিভিন্ন ভিত্তিহীন পোস্ট, যা সত্যিই আপত্তিকর। বাদ পড়ে না রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক পোশাক আবৃত প্রতিশ্রুতি ও মন্তব্যসহ কোনো কিছুই। নেতা-নেত্রীদের প্রতিশ্রুতি ও মন্তব্যে এত দ্রুত ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করি যে মন্তব্যের গভীর পর্যন্ত পৌঁছাবার সময়টুকুনও নেই না। আচ্ছা, ঔষধ সেবনের পর তো ঔষধের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার জন্যও অপেক্ষা করতে হয় অন্তত কয়েক ঘন্টা, তবে আমরা কেন এই কয়েক ঘন্টা সময় নেই না ভাবনার জন্য? কারণ, আমরা সর্বদাই একটা প্রতিযোগিতায় থাকি, আগে থাকার প্রতিযোগিতায়। আমরা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে যেয়ে ফেসবুক, ইউটিউবে কোনো নেতা, প্রশাসন ও দেশকে বানিয়ে ফেলি প্রভু, একই সাথে সমালোচনা ও গালাগাল করে উদ্ধার করে ফেলি কোনো নেতা, দল, জনগোষ্ঠি ও দেশকে; অথচ, ভুলে যাই মাত্র কয়েকদিন পূর্বে আমরাও একই ধ্বনিতে কথা বলেছিলাম। তুলনা করার আগে একবারও ভাবিনা দু’জন ব্যক্তি, দু’টো গোত্র ও দেশের মধ্যের শিক্ষাগত, অবস্থানগত, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক পার্থক্যগুলো। পোস্ট দেয়ার সময় আমরা হয়ে যাই খুব বড় মাপের নতুন নতুন বিশেষজ্ঞ, অর্থাত যা না, তা। আমাদের পাশাপাশি আছে একদল মৌলবাদী, যাদের ধর্ম নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি অসহ্য ও বিরক্তিকর। বিশ্বব্যাপী মহামারি চলাকালীন সময়ও তারা দাবী করে, নামাজ আদায়ের জন্য তাদের মসজিদে যেতে হবে, মাহফিল অর্থাত জনসমাবেশ করতেই হবে। আমাদের এমন আচরণে কিংকর্ত্যবিমূঢ় নিরীহ মানুষেরা। নিরীহ মানুষদের অনেকেই ধর্মকে বিশ্বাস করেন অন্ধভাবে, সুতরাং তারা ধর্মের জন্য বিজ্ঞানকে অবহেলা করে জীবনকে ফেলে দেয় বিপদের মুখে। আবার, মুক্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য থেকে সত্য মিথ্যা যাচাই করা খুব সহজ কাজ নয়। সেক্ষেত্রেও, নিরীহ মানুষেরা একটা চাপের মধ্যে থাকেন, যা তাদের মানসিক অশান্তির কারণ হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী উন্নত দেশগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পেরেছে কিছুটা, তবে মধ্যম ও ক্ষুদ্র আয়ের দেশগুলো এখনও কিছুটা পিছিয়ে আছে। তাদের পিছিয়ে থাকার অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, অভাব, মানসিকতা, গ্রহণ-ক্ষমতা, ধর্ম-বিশ্বাস অন্যতম। তারা বিগত তিনশত বছরের ইতিহাস থেকে মহামারি সম্পর্কে জেনেছে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী মহামারি সম্পর্কে ধারণা গড়ে তুলতে পারেনি। সেই জন্য ওইসকল দেশের রাষ্ট্র প্রধানকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করাও যায় না। কেননা, আমি মনে করি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই মহামারিকে পৃথিবীব্যাপী মহামারি ঘোষণা দিতে দেরি করেছে ফেলেছে কিছুটা। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানের যুগে যে সবকিছুই বিশ্বের এক কোণ থেকে অন্য কোণে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তা মনে হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ভেবে দেখেনি প্রথম। সুতরাং, যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদেরকে হেয় না করে, বরং সামনে চলায় উৎসাহিত করা দরকার অন্তত এই বিষয়ে।

হঠাত করে সিংহ সামনে এসে দাঁড়ালে ভয়ে গলা শুকোবেই। জীবন যখন প্রশ্নে মুখে, এমন পরিস্থিতিতে ভয় পাওয়া খুব স্বাভাবিক। তবে সেখান থেকে জীবন নিয়ে কীভাবে ফেরা সম্ভব? সেটা চিন্তা করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা এখন খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। যদিও উচ্চ পর্যায় থেকে অনেক কিছু বলা হচ্ছে, তারপরও বেঁচে থাকার লড়াই থাকতে হবে প্রত্যেকের। এই মুহূর্তে, বিশ্ব যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন প্রতিটি ব্যক্তিকেই নিজেকে সুস্থ রাখার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। রাষ্ট্র দেয়নি কিংবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে তা’তে কী? মনে রাখতে হবে, আমাকে সুস্থ রাখার দায় আমার থেকে আর কারো বেশি হতে পারে না। আমরা সবাই আগে নিজের ও নিজের পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেই। প্রয়োজনে চিকিত্সকের পরামর্শ নেই। নিজে সুস্থ থেকে অন্যের সেবা যদি করতে হয়, সেক্ষত্রে অবশ্যই ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক উপকরণ ব্যবহার ছাড়া কোনোভাবেই অন্যের সেবা করা উচিত হবে না। মানসিক সুস্থতার জন্য আমরা প্রতিদিন নির্ধারিত কিছু সময় বই পড়তে পারি, নাটক সিনেমা দেখতে পারি, গান কবিতা শুনতে পারি। পাশাপাশি যেন কেবলমাত্র শিক্ষামূলক পরামর্শ গ্রহণ করি। আমরা নিজেকে সুস্থ রাখি এবং পরিবেশ বাঁচাই।
খুরশীদ শাম্মী, টরন্টো, অন্টারিও