অনলাইন ডেস্ক : চীনের কারাগারে বন্দী মাইকেল কোভরিগ তাঁর দেশের রাষ্ট্রদূতকে পেয়ে কিছু বই চেয়েছিলেন, তার একটি হলো ফ্রানৎস কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’। ওই গল্পের অসুখী আর বিপর্যস্ত নায়কের মতোই অবস্থা কানাডার সাবেক এই ক‚টনীতিকের। বেইজিংয়ের এই কারাগারে তাঁর ৮০০ দিন ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে। তাঁর মতোই চীনে বন্দী আছেন আরেক মাইকেল, পুরো নাম মাইকেল স্প্যাভোর। তাঁরা কেন বন্দী, তা কখনো খোলাসা করেনি চীন। তবে আনা হয়েছে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ, আর তার বিচারও করছে।

দুই কানাডীয় কোভরিগ ও স্প্যাভোর দুজনই ২০১৮ সালে চীনে গ্রেপ্তার হন। আর তা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী মেং ওয়ানঝোকে কানাডা আটকের পরপরই। তাঁদের দুজনের ভাগ্য এখন জড়িয়ে গেছে হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন ঝেংফির মেয়ে মেং ওয়ানেঝার সঙ্গে, যাঁর সঙ্গে তাঁদের দৃশ্যত কোনো যোগসূত্র নেই।
কোভরিগ ও স্প্যাভোরকে আটক করা যে চীনের বদলা, তা গত ফেব্রুয়ারিতে হুয়াওয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট মরগান এলিয়টের কথায় অনেকটা স্পষ্ট হয়। তাঁর কথাটি ছিল অনেকটা এমন- ‘অনেক বাবার মতোই রেন তাঁর মেয়েকে বাড়িতে ফেরত চান। মাইকেল কোভরিগ ও স্প্যাভোরকে যেমন করে তাঁদের পরিবার ফেরত চায়।’

এই আটকের পর থেকে চীন ও কানাডার মধ্যকার ক‚টনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, যাকে ‘জিম্মি ক‚টনীতি’ বলছে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। কানাডার পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, চীন জিম্মি ক‚টনীতি করছে। তবে বেইজিং তা অস্বীকার করে আসছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে চীন ও কানাডার ক‚টনৈতিক সম্পর্ক যে পর্যায়ে রয়েছে, এই সংকটের সমাধান কেবল যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই আছে।
মেং ও হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করার অভিযোগ আনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ থেকে মেংকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের জন্য বলা হয়েছিল। ১ মার্চ ওই প্রত্যর্পণ মামলার সর্বশেষ শুনানিতে আদালতে হাজির হয়েছিলেন মেং। ওই মামলা মে মাসে শেষ হওয়ার কথা।

তবে কানাডার দুই মাইকেলের তুলনায় তাঁকে ভ্যাঙ্কুভারের একটি আরামদায়ক বাড়িতে আটক রাখা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে একটি ইলেকট্রনিক ট্যাগ লাগানো আছে। তিনি বন্ধুদের দেখতে বা কেনাকাটা করতে যেতে পারেন। কিন্তু কোভরিগ ও স্প্যাভোরের অবস্থা কারও জানা নেই।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছে, গুপ্তচরবৃত্তির মামলায় স্প্যাভোরের বিচার কোনো রায় না দিয়েই শেষ হয়েছে। গত শুক্রবার চীনের ড্যানডং শহরে বিচারকাজ মাত্র দুই ঘণ্টায় শেষ হয়। চীনে অবশ্য দ্রুত বিচারকাজ শেষ হওয়ার নজির আগে থেকেই রয়েছে। আদালত বলেছেন, স্প্যাভোরের মামলার রায় পরে জানানো হবে। মামলার বিচার চলাকালে বিদেশি কূটনীতিকেরা আদালতের বাইরে জড়ো হলেও কাউকে ঢুকতে দেয়নি চীন। তাঁদের মধ্যে কানাডার দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জিম নিকেলও ছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে চীন। চীনে সংখ্যালঘু উইঘুর জনগোষ্ঠীর প্রতি দেশটির সরকারের আচরণকে গণহত্যা বলে মনে করে কানাডার পার্লামেন্ট। হাউস অব কমন্সে সম্প্রতি এ বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো রুদ্ধদ্বার এ বিচারকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। তবে চীনের আদালত বলেছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্যবিষয়ক মামলা হওয়ায় তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়নি। আগামী সপ্তাহে কোভরিগেরও বিচার শুরু হতে পারে। তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড হতে পারে।

‘জিম্মি কূটনীতি’ নিয়ে কানাডার সরকার বিড়ম্বনার মুখেই পড়েছে। নিয়ম মানতে অস্বীকার করছে, শক্তিশালী এমন একটি দেশের সঙ্গে তারা কীভাবে মোকাবিলা করবে? উদার গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে জিম্মি কূটনীতির পথও তারা ধরতে পারছে না। কানাডার সাবেক মন্ত্রী এবং কূটনীতিকদের একটি দল কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কাছে মেংকে ছেড়ে দেওয়ার তদবির করেছেন। দুই মাইকেলকে দেশে ফেরানোর জন্য তাঁদের এই তদবির। ওই প্রস্তাব অবশ্য ট্রুডো প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, মেংয়ের পক্ষে নাক গলাতে গেলে চীনকে সুবিধা করে দেওয়া হবে।

এদিকে ট্রুডোর ক‚টনীতি নিয়ে তাঁর বিরোধীরাও সমালোচনা করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে চীনা নিপীড়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, কানাডীয় নাগরিক আটক করলেও তিনি পাল্টা ব্যবস্থা নেননি। মেংকে আটকের পর চীনের পক্ষ থেকে কানাডা থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কানাডা সরকার তখন ৫জি নেটওয়ার্ক থেকে হুয়াওয়েকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করেনি। অথচ অন্য অনেকে দেশ তখন হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করেছিল। ট্রুডো যুক্তরাষ্ট্রের সুরে পুরোপুরি কথা বলেননি। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে চীনের উইঘুরদের ওপর নিপীড়নকে সরাসরি গণহত্যা বলেছে, সেখানে ট্রুডো তা করার সাহস দেখাননি।

ট্রুডোর পক্ষের লোকজনেরও অবশ্য যুক্তির অভাব নেই। তাঁর সমর্থকেরা বলছেন, ট্রুডো একটি অসম্ভব পরিস্থিতিতে যৌক্তিক আচরণ করছেন। এতে চীনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হচ্ছে। গত বছর চীনে কানাডার রপ্তানি ৭ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে। কানাডার সরকার হংকংয়ে চীনের নিপীড়নের সমালোচনা করেছে। এ ছাড়া হংকংবাসীর কানাডায় আসার প্রক্রিয়া সহজ করেছেন ট্রুডো। এতে চীন সরকার আরও ক্ষিপ্ত হয়েছে। অবশ্য ট্রুডো কানাডার পার্লামেন্টে উইঘুরদের প্রতি আচরণকে গণহত্যার পক্ষে ভোট দিতে বাধাও দেননি। চীনে সংখ্যালঘু উইঘুর জনগোষ্ঠীর প্রতি দেশটির সরকারের আচরণকে গণহত্যা বলে মনে করে কানাডার পার্লামেন্ট। হাউস অব কমন্সে সম্প্রতি এ বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। উইঘুরদের প্রতি চীনের আচরণকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও তদন্ত দরকার। এই পদক্ষেপের পর কানাডা ও চীনের সম্পর্কে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।

কানাডার ওই প্রস্তাবকে চীনের পক্ষ থেকে নিন্দা জানানো হয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহের শেষ দিকে কানাডায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত কং পিইয়ু কানাডীয় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কানাডা নাক গলাচ্ছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিদেশি নাগরিকদের নির্বিচারে আটকের নিন্দা জানানো হয়। অবশ্য তাদের ওই বিবৃতিতে সরাসরি চীনের নাম নেওয়া হয়নি। এই বিবৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রুডোর বুদ্ধির প্রশংসা করেন অনেকে। তবে ওই বার্তা চীনকে আরও খেপিয়ে দেয়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং বলেন, ‘কানাডার ওই ঘোষণা নিন্দনীয় এবং ভণ্ডামিপূর্ণ কাজ। এটি কানাডার পক্ষ থেকে মেংকে ভুল করে আটক করে রাখার একটি স্বীকারোক্তি।’

ইকোনমিস্ট বলছে, দুই মাইকেলকে কানাডার দেশে ফেরত আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য লাগার বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অটোয়াতে এখন এ নিয়ে আশা বাড়ছে। অনেকে আশা করছেন যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবর্তে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় আশার আলো দেখা যাচ্ছে।

গত ডিসেম্বর মাসে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, আমেরিকার বিচার বিভাগ হুয়াওয়ের আইনজীবীদের সঙ্গে একটি সমঝোতা নিয়ে আলোচনা করছেন। যাতে প্রচুর জরিমানার বিনিময়ে মেংকে ছাড়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের পদত্যাগের পর থেকে মেংয়ের মুক্তির আলোচনা থেমে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এ আলোচনা আবারও শুরু হতে পারে। গত ফেব্রæয়ারি মাসে কানাডার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি দুই মাইকেলকে মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র আইনি সমঝোতার পথে হাঁটবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। বাইডেন বলেছেন, ‘মানুষ বিনিময় করার কোনো মুদ্রা নয়।’ তবে বন্দী কোভরিগের দুঃস্বপ্ন অন্য ইঙ্গিতই দেয়। (সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট)