ফারহানা আজিম শিউলী: টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৩৩তম ভার্চুয়াল আসরটি জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম কানাডিয়ান জাতীয় আর্ট মুভমেন্ট এর পথিকৃৎ, ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টারদের দল ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর শতবর্ষ উপলক্ষ্যে নিবেদিত এই আসরে আলোচিত হয় ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর শতবর্ষ উপলক্ষ্যে, ডেভিড উইসটো ও কেলি ম্যাকিনলের লেখা, ‘আর্ট গ্যালারি অফ অন্টারিও’ থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘মিট দ্য গ্রুপ অফ সেভেন’ বইটি এবং এর সঙ্গে সংযোজিত হয় ক্রস রেফারেন্স ও আরো নানা তথ্য। আলোচনা করেন শিল্প সমালোচক, শিল্প সংগ্রাহক ও কিউরেটর নিলাদ্রী চাকী।

টরন্টোর ‘আর্টস অ্যান্ড লেটার্স ক্লাব’ ছিল লেখক, চিত্রকর, শিল্পী, শিল্পবোদ্ধা, অগ্রসর-বিপ্লবী চিন্তার মানুষ ও শিল্প-পৃষ্ঠপোষকদের মিলনস্থল। সেখানে কয়েকজন স্বপ্নবাজ তরুণ চিত্রকর নিয়মিত আসতেন এবং তাঁদের ‘অভিন্ন লক্ষ্য’ নিয়ে কথা বলতেন। তাঁরা প্রকৃতিকে শক্তিশালী স্পিরিচুয়াল শক্তি বলে মনে করতেন, যা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব প্রকৃতির সঙ্গে একান্ত-দীর্ঘ সাহচর্যে। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, কানাডিয়ান নিজস্ব আর্ট বিকশিত করা যেতে পারে প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে। তাঁরা এমন এক স্বতন্ত্র আর্ট ফর্ম এর কথা ভাবেন যার অস্তিত্ব তখনো ছিল না। তাঁরা অনুভব করেন, অন্য পেইন্টারদের আঁকা ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিং কানাডার যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সেটি ধারণ করতে পারেনি।

‘আর্ট গ্যালারি অফ টরন্টো’তে, ১৯২০ সালের মে মাসে সেই আড্ডার ৭ জন চিত্রশিল্পী প্রথম যৌথ প্রদর্শনীতে আত্মপ্রকাশ করেন ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ নামে। প্রথম প্রদর্শনীতেই দেখা যায় ব্রাইট কালার ও রাফ ব্রাশস্ট্রোকে আঁকা কানাডার উত্তরের বিস্তীর্ণ-দুর্গম অঞ্চলের অসামান্য সব ল্যান্ডস্কেপ। তারপর তাঁরা একে একে বিভিন্ন ফর্মে কানাডার অ্যালগনকুইন, জর্জিয়ান বে, অ্যালগোমা, ম্যারিটাইমস, লেক সুপেরিয়র থেকে আর্কটিক পর্যন্ত নানা অঞ্চলের প্রকৃতির ছবি উপহার দেন আমাদের।

‘গ্রুপ অফ সেভেন’ সৃষ্টির আগ পর্যন্ত, ইউরোপিয় স্টাইল কানাডার আর্টের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে ছিল। ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর চিত্রকররা এটি থেকে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র এক কানাডিয় পরিচিতি নির্মাণ করতে চাইলেন যাতে মূর্ত হবে দেশটির ল্যান্ডস্কেপের ঐশ্বর্য এবং সেটির প্রতি শিল্পীদের ভালোবাসা। পেইন্টিং এর ইউরোপিয় স্টাইলের একাডেমিক ফর্মূলা ভেঙ্গে গ্রুপের শিল্পীরা জন্ম দেন পেইন্টিং এর জাতীয় স্টাইলের, একান্ত নিজস্ব কানাডিয়ান স্টাইলের। তাঁদের প্রচেষ্টা কানাডিয় আর্ট ও চৈতন্যের বোধ আমূল পালটে দেয়। তাঁদের প্রয়াস কানাডিয়দের মধ্যে জাতীয় পরিচয়ের বোধ এবং নতুন করে দেশকে দেখবার অন্তর্দৃষ্টি জাগায়। কানাডিয়ান আর্ট ও ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় এবং তাঁদের আঁকা ছবি একান্ত নিজস্ব কানাডিয়ান পরিচয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।

‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর প্রথম ৭ সদস্যের মধ্যে ছিলেন – ফ্রাঙ্কলিন কারমাইকেল, লরেন হ্যারিস, এ ওয়াই জ্যাকসন, ফ্রাঙ্ক জনস্টন, আর্থার লিসমার, জে ই এইচ ম্যাকডোনাল্ড ও ফ্রেডেরিক এইচ ভার্লি। এই গ্রুপ তৈরির আগেই টম থমসন মারা গেলেও, শিল্পীদের ওপর তাঁর প্রভাব ও মুভমেন্টে তাঁর অবদানের জন্য ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর সঙ্গে তাঁর নামটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এই গ্রুপের শিল্পীদের কেউ কেউ মারা গেলে কিংবা গ্রুপ ছাড়লে পরবর্তীতে যুক্ত হন – এ জে ক্যাসন, এল এল ফিটসজেরাল্ড ও এডউইন হলগেট। শিল্পী এমিলি কার আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত না থাকলেও ছিলেন ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

যেই গ্রুপ এর শিল্পীদের আঁকা ছবির মাধ্যমে নতুন করে দেশকে, নিজের অস্তিত্বকে, স্বাদেশিক বোধকে, দেশের প্রকৃতিকে, দেশের জল-বৃক্ষ-হ্রদ-আকাশ-শরত ঋতুকে দেখতে পেয়েছে কানাডিয়রা এবং কানাডার একান্ত নিজস্ব প্রকৃতি দেখতে পেয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষ, সেই গ্রুপ সৃষ্টির শতবর্ষ উপলক্ষ্যেই ছিল এবারের পাঠশালার আসর।

১৯১০-১৯২০ এই দশকটা ছিল ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর জন্য কঠিন দশক, প্রস্তুতির দশক। ১৯১৪তেই লরেন হ্যারিসের মাথায় গ্রুপ তৈরি নিয়ে ভাবনা ছিল। ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর সদস্যরা ছিলেন সহকর্মী, কমার্শিয়াল/গ্রাফিক আর্টিস্ট। গ্রিপ লিমিটেড নামে কমার্শিয়াল আর্ট ফার্মে কাজ করতেন তাঁরা। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন বন্ধু। হ্যারিস রোজডেইলের স্যাভার্ন স্ট্রিটে স্টুডিও বিল্ডিং তৈরি করেন। এটা ছিল বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু। হয়ত আগেই অর্থাৎ ১৯১৪ সালেই মুভমেন্ট শুরু করতেন হ্যারিস। কিন্তু ১৯১৪ তে সতীর্থ জ্যাকসন চলে গেলেন যুদ্ধে। ওদিকে ‘আর্টস অ্যান্ড লেটার্স ক্লাব’ খুব সক্রিয় তখন। সেটা ছিল একটা আলোচনা-তর্ক-বিতর্কের জায়গা। ২০ শতকের আর্টের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আলাপ আলোচনাগুলো ঐ সময়কালেই হচ্ছিল। লন্ডনে পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট প্রদর্শনী হলো ১৯১১ সালে ও নিউইয়র্কে ১৯১৩ সালে। মানুষ নতুন নতুন নীরিক্ষা দেখছিল। এটা ছিল একটা বৈপ্লবিক সময়। আলাপ আলোচনা হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। আবার তখন চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। কাজেই সব মিলিয়ে দেখা যায় উপকরণগুলো তখন সব একসঙ্গে হয়েছিল। এর মধ্যে ১৯১৭ সালে টম থমসনের মৃত্যু, যিনি ছিলেন গ্রুপের অপরিহার্য অংশ। আসলে এটা হয়ত ‘গ্রুপ অফ এইট’ই হতো তিনি বেঁচে থাকলে। ১৯২০ এ এসে হ্যারিস রীতিমতো কিছুটা হতাশও এই বিপ্লব দেরি হয়ে যাওয়ায়, যা হ্যারিস খুব সযত্নে লালন করছিলেন বেশ কয়েকবছর ধরেই। অবশেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে হ্যারিসের বাসায় শিল্পীরা গ্রুপ সৃষ্টির ব্যাপারে একমত হন এবং ঐ বছরেরই ৭ই মে প্রদর্শনীর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ আত্মপ্রকাশ করে।

৩ সপ্তাহ ধরে চলা ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর প্রথম প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত ছবির সংখ্যা ছিল ১২০টি। ছবি বিক্রি হয়েছিল ৬টি। গ্রুপের অন্যতম শিল্পী এ ওয়াই জ্যাকসন লিখেছিলেন – ‘প্রচুর লোক সমাগম হয়েছিল প্রদর্শনীতে, ঐ সময়ে প্রায় হাজার দুয়েকের মতো। অবশ্য মানুষজনের তখনো ছবি দেখার চোখ তৈরি হয়নি।’ শিল্পীদের ছবি প্রশংসিত হলেও প্রথম প্রদর্শনী নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। কানাডিয়ান কুরিয়ারে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর প্রথম প্রদর্শনী নিয়ে শিরোনাম হয়েছিল – ‘Are These New Canadian Painters Crazy?’ অবশ্য অগাস্টাস ব্রিডল উপসংহারে লিখেছেন – না, তাঁরা উন্মাদ নন। ব্রিডল আরো লিখেন – ‘They go direct to nature. Their aim in art is greater virility and they have got it.’ প্রথম প্রদর্শনীর ক্যাটালগে হ্যারিস লিখেছিলেন – ‘A word as you view the pictures. The artists invite adverse criticism’। তখন আর্টে নতুন কিছু এলেই প্রতিক্রিয়াশীলরা তাতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাতেন। শিল্পী জে ই এইচ ম্যাকডোনাল্ডের কাজ নিয়ে বলা হয়েছিল ‘…paintings look like content of drunken stomach’। এর চেয়েও অনেক কঠিন সমালোচনা সইতে হয়েছে তাঁদের।
এ পর্যায়ে ‘আর্টস অ্যান্ড লেটার্স ক্লাবে’ শিল্পীদের ছবি, প্রথম প্রদর্শনীর ক্যাটালগ, ‘আর্ট গ্যালারি অফ টরন্টো’তে প্রথম প্রদর্শনী ও প্রদর্শনী নিয়ে সেই সময়কার খবরের কাগজের স্থিরচিত্র দেখানো হয় ও ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর শিল্পীদের পরিচিতিমূলক একটি ভিডিওক্লিপ প্রদর্শিত হয়।

পৃথিবীজুড়ে নানা সংস্কৃতিতে প্রকৃতির আরাধনা প্রসঙ্গে নিলাদ্রী চাকী বলেন, রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় বিশেষ করে গানে ঈশ্বর-প্রকৃতি-ভালোবাসা সব মিলেমিশে একাকার। ‘একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু’র মধ্যে রূপকল্প খুঁজলে সেটা দেখা যায়। কিংবা ‘অশত্থপল্লবে বৃষ্টি ঝরিয়া মর্মরশব্দে, নিশীথের অনিদ্রা দেয় যে ভরিয়া মর্মরশব্দে’ গানটিতে। অথবা ১৯৪৪ সালে ‘উদয়ের পথে’ সিনেমার বিনতা রায়ের ‘জানি নে কোথায় জাগো ওগো বন্ধু পরবাসী কোন্ নিভৃত বাতায়নে। সেথা নিশীথের জল-ভরা কণ্ঠে কোন্ বিরহিণীর বাণী তোমারে কী যায় ব’লে’ গানটিতে। আমাদের দেশের নবান্নও এক ধরনের প্রকৃতির প্রাচুর্যকে অ্যাপ্রিশিয়েট করা। তেমনি আছে জাপানের হানামি বা চেরি বøসম ফেস্টিভ্যাল। সেই উৎসবে সারা জাপান মেতে ওঠে। এবং গ্রীষ্মের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরের দিকে যায় চেরি বøসম ফেস্টিভ্যাল। জাপানিরা পূর্বপুরুষকে স্মরণ করে লণ্ঠনে মোমবাতি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয় চেরি গাছে। আবার উত্তর আমেরিকায় বিরাট উৎসব হচ্ছে ‘কর্ন ফেস্টিভ্যাল।’ এই ফেস্টিভ্যালটা পুরোটাই হচ্ছে প্রকৃতির অ্যাপ্রিসিয়েশন। নভেম্বরের ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ও আমাদের নবান্নের মতো। প্রথম ফসল উঠলে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং’ এ ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানো হয়। তেমনই প্রকৃতিকে অ্যাপ্রিসিয়েশনের একটা প্রকাশ হচ্ছে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর পেইন্টিং। গ্রুপের শিল্পীরা হয়ত এতটা ভেবে ছবি আঁকেননি, দেশটাকে ভালোবেসে এঁকেছেন, কিন্তু বিষয়টা তাই। আবার নজরুল ইসলাম যখন লিখেন – ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু পল্লীজননী’, সেটিও একই সূত্রে বাঁধা। কাজেই ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর শিল্পীরা যে শুধু নিসর্গ নিয়ে শিল্পকলা করতেন, সেটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীতে অসুন্দর প্রকৃতি বলে কিছু নেই। কালবৈশাখীর সৌন্দর্য একরকম, সাহারা মরুভূমির সৌন্দর্য আরেকরকম, আবার নিশীথ সূর্যের দেশের একরকম সৌন্দর্য এবং পৃথিবীর সবখানেই সৌন্দর্য বিরাজমান।

নীলাদ্রি চাকী বলেন, ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর শিল্পীরা শরতের ছবি এঁকেছেন বেশি এবং তাঁদের আঁকা ছবিতে উজ্জ্বল রঙের প্রয়োগ সম্পর্কে তিনি বলেন, কানাডায় মূলত ৪টি ঋতু। এখানে বর্ষা ও হেমন্ত নেই। বর্ষা গ্রীষ্মের মধ্যেই, আর শীতকালটা হয় প্রলম্বিত। শীত পড়ার আগে থেকেই বরফ পড়া শুরু হয়, আবার বসন্ত এসে গেলেও বরফ থাকে। প্রথম প্রথম বরফ পড়লে মনে হয়, যত মালিন্য পৃথিবীর সব যেন একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দিলো। চারদিক থাকে শুভ্র। কিন্তু যখন বরফ মার্চেও গড়ায় তখন আর যেন উপভোগ করা যায় না। আর চারদিকের এই বর্ণহীনতার মধ্য থেকেই উঠে এসেছে রঙগুলো। এই বর্ণহীনতার মধ্যে শরতকালে গাছের পাতায় পাতায় ‘কে রঙ লাগাল বনে বনে’ গানটির মতো হয়। রঙ যেন ছেয়ে যায় চারদিকে। বাংলাদেশে কিন্তু এ ধরনের রঙ দেখা যায় না পাতা ঝরার আগে। আকাশটাও তখন থাকে বাংলাদেশের মতো ঝকঝকে নীল। আবার বর্ণহীন রাজস্থানে শুধুই বালিয়াড়ি, একই রঙ। সবুজ খুব কম সেখানে। কিন্তু সেখানের পোশাক-আশাকে খুব রঙ। পুরুষদের মাথায় পেল্লাই পাগড়ি কমলা হলুদ মেশানো গেরুয়া রঙের এবং মেয়েদের পোশাকে ঝলমলে রঙ। প্রকৃতিও সেখানে ময়ূর দিয়েছে। বাংলায় কিন্তু ময়ূর নেই কারণ বাংলা এমনিতেই রঙ্গিন। মানুষ এভাবেই বোধহয় রঙহীনতাকে জয় করেছে।

‘গ্রুপ অফ সেভেন’[ এর শিল্পীরা অ্যালগনকুইন পার্ক, জর্জিয়ান বে, অ্যালগোমা, লেক সুপেরিয়র, কিউবেক, ম্যারিটাইমস, রকিজ থেকে আর্কটিক পর্যন্ত নানা অঞ্চলের প্রকৃতির ছবি এঁকেছেন। উল্লেখ্য, গ্রুপের প্রতিটা শিল্পী একই ভিশন নিয়ে কাজ করলেও প্রত্যেকের ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, কাজে নিজস্বতা।

টম থমসনকে (১৮৭৭-১৯১৭) কানাডার সবচেয়ে আইকনিক পেইন্টার বলা হয়। টম থমসনের জন্ম অন্টারিওর ক্লেয়ারমাউন্টে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোটো। বেড়ে উঠেছেন ওয়েন সাউন্ডের কাছে লেইথ নামে এক এলাকায়। ছোট বেলায় টমসন ভায়োলিন ও ম্যান্ডোলিন বাজাতেন। অন্টারিওর ওয়েন সাউন্ডের ‘টম থমসন আর্ট গ্যালারি’তে টম থমসনের ছবির পাশাপাশি এসবও সংরক্ষিত আছে। টম থমসনের আঁকা ছবিতে সঙ্গীতের সেই মূর্ছনা খুঁজে পাওয়া যায়। যুবক বয়সে তিনি একজন উৎসুক আউটডোরসম্যান এবং একজন দক্ষ ক্যানু-চালকে পরিণত হন। অ্যালগনকুইন পার্কেই তিনি অধিকাংশ সময় কাটাতেন ও গাইড হিসেবে কাজ করতেন। শুধুমাত্র প্রচণ্ড শীতের সময় শহরে ফিরতেন অল্প কিছুদিনের জন্য। এই কাজের ধরন তাকে স্বচ্ছলতা দেয়নি কিন্তু বিস্তীর্ণ প্রকৃতিতে তাঁকে ছবি আঁকার অবাধ সুযোগ করে দিয়েছিল।

এ পর্যায়ে ১৯১৪ সালের শরতে অ্যালগনকুইন পার্কে টম থমসন, টম থমসনের সঙ্গে সতীর্থ লিসমার-লিসমারের পরিবার-ভার্লি-জ্যাকসনের ছবি প্রদর্শিত হয়। সঙ্গে আরো দেখানো হয় অন্টারিওর ওয়েন সাউন্ডে ‘টম থমসন আর্ট গ্যালারি’তে রাখা টম থমসনের ম্যান্ডোলিনের ছবি এবং সিয়াটলে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে প্রথম কাজের সময়কার টম থমসনের নিজ হাতে করা ভিজিটিং কার্ড।

১৯১৭ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে, লেইক ক্যানুতে ক্যানু ডুবে অসময়ে মৃত্যুর কারণে টম থমসন ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর জন্ম দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু টম থমসনের নামটি সর্বঅর্থেই ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর সমার্থক এবং গ্রুপটিকে বলা হয় ‘টম থমসন অ্যান্ড দ্য গ্রুপ অফ সেভেন’। কানাডার সব গ্যালারিতেও সাত শিল্পীর সঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে টম থমসনের ছবি সংরক্ষিত আছে।

এ পর্যায়ে টম থমসনের আঁকা মাস্টারপিসসহ আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি দেখানো হয় এবং কয়েকটি ছবি নিয়ে আলোচনা করেন নিলাদ্রী চাকী। ছবিগুলোর মধ্যে ছিল – Autumn Foliage (1916), The Pool (1915-16), Approaching Snowstorm (1915), Sunset (1915), Summer Day (1915), Hot Summer Moonlight (1915), The Bateaux (1916), The Canoe (1912), Northern River (1915), Spring Ice (1915), Snow in the Woods (1916), Pine Island, Georgian Bay (1914-16), The West Wind (1917), Sketch for Jack Pine (1916) ও The Jack Pine (1917)।

টম থমসনের ‘অটাম ফলিয়েজ’ প্রসঙ্গে নিলাদ্রী চাকী বলেন, ছবিটি টম থমসনের মৃত্যুর এক বছর আগে আঁকা। কী অসাধারণ ছবির রঙ! অসম্ভব সুন্দর রঙের সমারোহ! কমলা, টেরাকোটা, লাল, হলুদ সবরকম রঙ আছে এর মধ্যে। আকাশটাও নীল। সেটির প্রতিবিম্ব পড়েছে জলে। যেন রঙ বিদায় নিচ্ছে চোখের সামনে থেকে, তার একটা সংবর্ধনা এই ছবিতে।

‘দ্য জ্যাক পাইন’ ও ‘দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’কে কানাডার ল্যান্ডস্কেপের আইকনিক ইমেজ বলা হয়। যে বছর টম থমসন মারা যান সেবছরই ‘দ্য জ্যাক পাইন’ও ‘দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’ এই ছবি দুটো আঁকা শেষ হয়। ‘দ্য জ্যাক পাইন’ ছবিটি অটোয়ার ‘ন্যাশনাল গ্যালারি অফ কানাডা’তে আছে ১৯১৮ থেকে। ফোরগ্রাউন্ডে গাছ এবং ডিস্টেন্ট বডি অফ ওয়াটার ছিল টমসনের কমন মোটিফ। ১৯১৪-১৬ সালে আঁকা ‘পাইন আইল্যান্ড, জর্জিয়ান বে’ ছবিটিকে ‘দ্য জ্যাক পাইন’ ও ‘দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’ এর অগ্রদূত বলা হয়। নীলাদ্রি চাকী বলেন, ‘দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’ এ একটা গাছ আকাশ আর মাটি ছুঁয়ে আছে এবং প্রচণ্ড ঝড়ের মাঝখানে রুখে দাঁড়িয়েছে। পুরো গাছটাই যেন একদিকে ঝুঁকে পড়েছে কিন্তু ভেঙে পড়ছে না। এ যেন মানুষেরই সংগ্রামের প্রতীক। এই ছবি দেখলে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র নন্দিনীর কথা কিংবা একজন সাধারণ মানুষের কথা। কানাডার রুক্ষ, কঠিন প্রকৃতির কাছে সেই সময়ে মানুষ অনেক বেশি অসহায় থাকলেও ভেঙে যে পড়তো না, এই ছবিটি যেন সেটিরই প্রতিনিধিত্ব করছে। টম থমসনের আঁকা ‘জ্যাক পাইন’ ছবিটি এতটাই আইকনিক যে, পরবর্তীতে ‘গ্রæপ অফ সেভেন’ এর প্রতিটি শিল্পী এবং গ্রুপের বাইরের শিল্পীরাও নানাভাবে জ্যাক পাইনের ছবি এঁকেছেন। ‘দ্য জ্যাক পাইন’ একটা প্রতীকি ছবি সেই অর্থে।

লরেন হ্যারিস (১৮৮৫-১৯৭০) এর জন্ম অন্টারিওর ব্র্যান্টফোর্ডে। ধনী পরিবারে জন্ম হ্যারিসের। তাঁরা ছিলেন ম্যাসি-হ্যারিস গ্রুপের কো-ফাউন্ডার। ১৯ বছর বয়সে হ্যারিস জার্মানি যান এবং ৩ বছর সেখানে আর্টের প্রশিক্ষণ নেন। দেশে ফিরে আর্মিতে যোগ দেন। ১৯১৮-১৯২১ এই সময়কালে তিনি অন্টারিওর অ্যালগোমায় সতীর্থ শিল্পীদের নিয়ে অত্যন্ত বিখ্যাত ‘বক্সকার ট্রিপ’ করেন। এই বিশেষভাবে তৈরি কারটি মোবাইল আর্টিস্ট স্টুডিওর কাজ করতো। শিল্পীরা এই কারটি মূল ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত করে অ্যালগোমায় যেতেন এবং পথিমধ্যে নানান জায়গায় কারটি বিচ্ছিন্ন করে নেমে পড়তেন, আবার ছবি আঁকা শেষে ট্রেনের সঙ্গে সেটি যুক্ত করে ফিরতেন। এর সবশেষ ট্রিপটি হয় ১৯২১ সালে, যখন হ্যারিস ও জ্যাকসন লেইক সুপিরিয়রের নর্থ শোরে ছবি আঁকতে যান।

‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর আনুষ্ঠানিক দলনেতা না থাকলেও লরেন হ্যারিস ছিলেন সর্বঅর্থেই দলনেতা। তাঁর ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব ছিল। হ্যারিসের সহশিল্পী জ্যাকসন বলেন – “Without Harris there would have been no Group of Seven. He provided the stimulus; it was he who encouraged us to always take the bolder course, to find new trails.”

এ পর্যায়ে লরেন হ্যারিসের আঁকা মাস্টারপিসসহ আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি দেখানো হয় এবং কয়েকটি ছবি নিয়ে আলোচনা করেন নিলাদ্রী চাকী। ছবিগুলোর মধ্যে ছিল – Snow Fantasy (1917), Autumn, Algoma (1920), Algoma Country (1948), Mt. Lefroy (1930), The Idea of North (1923), North Shore, Lake Superior (1926) ও Abstraction (1967)।

সুইডিশ শিল্পী গুস্তাফ ফিয়াইজতাদ এর আঁকা ‘সাইলেন্স উইন্টার’ ছবির প্রভাব আছে হ্যারিসের ‘স্নো ফ্যান্টাসি’তে। উল্লেখ্য, ১৯১৩ তে হ্যারিস ও ম্যাকডোনাল্ড বাফেলোর অলব্রাইট আর্ট গ্যালারিতে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান আর্ট শো দেখতে যান। এই প্রদর্শনী দারুণ প্রভাব ফেলেছিল তাঁদের ওপর। ‘স্নো ফ্যান্টাসির’ বিষয়বস্তুতেও সেটা দেখা যায়। সেই প্রদর্শনী দেখেই তাঁরা ভাবেন, তাঁরা একটা ভাষা, কানাডিয়ান ল্যান্ডস্কেপ ভিশন তৈরি করতে পারেন। স্ক্যানডিনেভিয়ান শিল্পীরাও ল্যান্ডস্কেপ ট্র্যাডিশন নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের আঁকা ছবিগুলো দেখতে ইউরোপের অন্য কোনো ছবির মতো ছিল না। দেশটাও কানাডার মতো বরফে আচ্ছাদিত। তাঁরা অন্যরকমভাবে আঁকলেন এবং একটা অন্য ভাষা তৈরি করলেন। সেটা খুবই অনুপ্রেরণার ছিল হ্যারিস ও ম্যাকডোনাল্ডের জন্য। তবে এই প্রভাব ছিল খুবই অল্প সময়ের। হ্যারিস খুব দ্রুতই ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্নো স্কেপ’ থেকে বেরিয়ে আসেন। ম্যাকডোনাল্ডও দু’একটা ছবি এঁকেছেন মাত্র এই ধাঁচের। টম থমসনও কিছু ‘স্নো পিস’ এঁকেছেন। তবে বড়ো অনুঘটক ছিল টম থমসনের মৃত্যু। হ্যারিসের ‘স্নো ফ্যান্টাসি’ ১৯১৭র। একই বছরে টম থমসনের মৃত্যু। ছবিটায় হ্যারিস স্ল্যাবস অফ কালার ব্যবহার করেছেন, অনেকটা ব্রিকওয়ার্ক এর মতো যা মনে করিয়ে দেয় টম থমসনের ‘দ্য জ্যাক পাইন’ এর কথা। মনে হয় দুই শিল্পী যেন আলোচনা করছেন, ভাবনা বিনিময় করছেন, বিভিন্ন টেকনিক নিরীক্ষা করছেন একে অন্যের সঙ্গে ছবিটির মাধ্যমে। গ্রুপের প্রস্তুতিমূলক সময়টাতে এভাবেই ছবির মাধ্যমে বিনিময় হচ্ছিল শিল্পীদের মধ্যে। এই ‘স্নো ফ্যান্টাসি’ তারই একটা উদাহরণ।

টম থমসনের মৃত্যুর পর সব শিল্পীরা খুব ভেঙে পড়েন। সবাই তখন অ্যালগনকুই থেকেও সরে আসেন। কারণ অ্যালগনকুইনের সঙ্গে টম থমসন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। শিল্পীরা তখন যান অ্যালগোমায়। ১৯১৮-১৯২১ এই তিন বছর নিয়মিতভাবে তাঁরা অ্যালগোমায় যান। অ্যালগোমায় তাঁরা পুরোপুরি টমের লিগ্যাসি বয়ে নিয়ে গেছেন। সেটা সবার আঁকা ছবিতেই খুব স্পষ্ট। এবং তাঁরা জানতেন, তাঁরা যা মনে মনে চাইছিলেন সেটাই করে গেছেন টম থমসন – ইউনিক কানাডিয়ান ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ।

লরেন হ্যারিস অ্যালগোমায় টম থমসনের মতোই এঁকেছেন। হুবুহু এক না কিন্তু মাল্টিকালার সুন্দর সব স্কেচ। তারপর তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান আরো উত্তরে – লেক সুপিরিয়রের নর্থ শোরে। শুধুমাত্র সুন্দর ল্যান্ডস্কেপের জন্য না, হ্যারিস নিরেট শিলা ও পোড়া গাছ খুঁজছিলেন। কারণ হ্যারিস স্কাল্পচারাল শেইপ ভালোবাসতেন। উল্লেখ্য, হ্যারিস সেখানে যাবার আগের বছরই ভীষণ বড়ো ওয়াইল্ড-ফায়ার হওয়ায় তিনি তাঁর পছন্দের ল্যান্ডস্কেপ পেয়ে যান। লেক সুপিরিয়রে হ্যারিস কঠিন ও বিবর্ণ ল্যান্ডস্কেপের মুখোমুখি হন এবং সেখান থেকেই তাঁর ছবি আঁকার নতুন ভাষা তৈরি হয়। গাছের প্রতি তাঁর অ্যাপ্রোচ ছিল অর্গানিক।
লরেন হ্যারিসের ‘মাউন্ট লেফরয়’ তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ। ততদিনে হ্যারিস তাঁর নিজস্ব ভাষা তৈরি করেছেন, যা ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর সবার থেকে আলাদা। অনেকটা দেখতে কার্ভড ফার্নিচার এর মতো। লাইনগুলো সরল, ফর্ম সরল এবং বিমূর্ততার দিকে তিনি চলে যাচ্ছিলেন দ্রুত। হ্যারিসের পেইন্টিং এ থিওসোফি, বায়োলজি ও স্পিরিচুয়াল উপাদান পাওয়া যায়। নীলাদ্রি চাকী বলেন, ‘মাউন্ট লেফরয়’ ছবিটি দেখতে অপার্থিব। পাহাড়ের মাথায় মুকুটের মতো পেছনদিকে মেঘের টুকরো থেকে চারদিকে আভা বের হচ্ছে। বিদেশি পেইন্টিং এ যিশু খৃষ্ট কিংবা মেরি মাতার মাথার ওপরে একটা আলোর বৃত্ত থাকে, অনেকটা সেইরকম। এই ধরনের ছবি দেখে একটু যেন শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। হ্যারিস স্পিরিচুয়ালিজম নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তাঁর ওপর খুব বেশি প্রাচ্যের দর্শনের প্রভাব পড়েছিল। এবং ১৯৮৪ সালে ‘আত্মা-বুদ্ধি-মানস’ শিরোনামে হ্যারিসের একটা প্রদর্শনী হয় ‘আর্ট গ্যালারি অফ অন্টারিও’তে। বৌদ্ধ দর্শন, ভারতীয় দর্শন সবকিছু মিলিয়ে তাঁর আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে সেই প্রদর্শনীর ছবিগুলোতে।

হ্যারিসের ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ ছবিটি ম্যাকমাইকেল আর্ট গ্যালারির ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর শতবর্ষের প্রদর্শনীর সবচেয়ে সা¤প্রতিক পেইন্টিং। ভালো করে তাকালে দেখা যায়, ‘মাউন্ট লেফরয়’ ও ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ দুটো খুব কাছাকাছি ধরনের ছবি। রঙ ভিন্ন কিন্তু দুটো ছবিরই আকার একদম পাহাড়ের। অন্য উপাদানেও মিল। দুটোতেই আছে গোলাকার মেঘ, মেঘ ঘিরে থাকা আলো। আরো লক্ষণীয়, হ্যারিসের সমাধিস্তম্ভটাও দেখতে এই দুটো ছবির আকারের।

আর্থার লিসমার (১৮৮৫-১৯৬৯) ও হ্যারিসের একই বছরে জন্ম। লিসমার ইংল্যান্ডের শেফিল্ড থেকে টরন্টোয় আসেন ১৯১১ সালে। এসেই গ্রিপে যোগ দেন, যেখানে টম থমসনসহ গ্রুপের অন্য শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর তার যোগাযোগ হয়। লিসমার তাঁদের সঙ্গে ১৯২০ সাল পর্যন্ত অন্টারিওর অ্যালগনকুইন ও জর্জিয়ান বে’তে স্কেচিং ট্রিপে যেতেন। লিসমার খুব মজার মানুষ ছিলেন। তিনি তাঁর শিল্পী বন্ধুদের নিয়ে অনেক চমৎকার ও মজার কার্টুন এঁকেছেন, স্কেচ করেছেন। লিসমারের ড্রয়িং এর দারুণ সংগ্রহ আছে ম্যাকমাইকেল আর্ট গ্যালারিতে। দারুণ ড্রয়িং করতেন লিসমার, স্কেচ করতেন। তিনি ছিলেন দারুণ এক কার্টুনিস্টও। অনেক ক্যারিকেচার করেছেন এমিলি কারের মতো। উল্লেখ্য, ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর সহযোগী শিল্পী এমিলি কার ছিলেন একজন দারুণ কার্টুনিস্ট।

লিসমারের শিক্ষক সত্ত্বা খুব প্রবল ছিল। তিনি উত্তর আমেরিকায় একটা অন্যতম সফল চিলড্রেন’স আর্ট প্রোগ্রাম করেন এবং ১৯৩৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় স্কুল প্রোগ্রাম চালু করেন। মানুষ তাঁকে দারুণ একজন শিক্ষক হিসেবেও মনে রেখেছে। তিনি কানাডিয়ান আর্ট নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন।

এ পর্যায়ে প্রথমেই টম থমসন, হ্যারিস, জ্যাকসন, কারমাইকেল, ভার্লি, জনস্টন, ক্যাসন, গ্রুপ অফ সেভেন ও এমিলি কারকে নিয়ে আর্থার লিসমারের আঁকা কার্টুন, স্কেচ ও ক্যারিকেচার দেখানো হয়। লিসমার সহশিল্পী হ্যারিসকে নিয়ে দারুণ মজার স্কেচের সিরিজ করেছেন। হ্যারিসের আঁকা ‘Country North of Lake Superior (1921)’ থেকে লিসমার চারকোল ও গ্রাফাইটে ১৯২৭ সালে আঁকেন ‘Babes in the Woods’। এই ছবির ফোরগ্রাউন্ডে আছেন ঝাঁকড়া-চুলো হ্যারিস। ছবির গাছগুলোও মজার, এদের মাথা আছে, হাত আছে। এই ছবি এঁকেই লিসমার থেমে থাকেননি। হ্যারিসের গাছ আঁকা নিয়ে মজা করে লিসমারের স্বহস্তে লেখা ছড়াও সংরক্ষিত আছে ম্যাকমাইকেল গ্যালারিতে। ছড়ার অংশবিশেষ – Ye Brookers & ye Harris now listen all to me, Ye may have been to Paris but You canna draw a tree.

পরে লিসমারের আঁকা মাস্টারপিসসহ আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি দেখানো হয়। ছবিগুলোর মধ্যে ছিল – Bright Land (1938), Canadian Jungle (1946), Sumach Pattern, Georgian Bay (1933), Pine Wrack (1933), A September Gale, Georgian Bay (1921) ও Minesweepers, Halifax 1919।

গ্রুপের অন্য সবাই পাইনগাছ এঁকেছেন লেকের বিপরীতে, ওপরে আকাশ। কিন্তু লিসমারের ‘ব্রাইট ল্যান্ড’, ‘কানাডিয়ান জাঙ্গল’, ‘পাইন র‌্যাক’ এসব ছবিতে দেখা যায়, তিনি ফোকাস করছেন গাছে না, করছেন পাইনের শেকড়ে-মূলে। তিনি আগ্রহী ছিলেন জর্জিয়ান বে’র শিলা ও গাছের ডিটেইল এ।

লিসমার জর্জিয়ান বে’র স্কেচের সিরিজ করেছেন। উল্লেখ্য, জর্জিয়ান বে সব শিল্পীর জন্য খুবই অনুপ্রেরণার ছিল, মূলত আবহাওয়ার জন্যই। সেখানটায় আছে – অবাধ জলরাশির বিস্তীর্ণ বিস্তার, জলের মধ্য থেকে উঠে আসা শিলা, রকের ওপর পাইন গাছ এবং ঝড়ো বাতাস। টম থমসনের ‘দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’ ও ভার্লির ‘স্টর্মি ওয়েদার’ দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়।

লিসমারের মতো এত সুন্দর সুমাখ আর কেউ আঁকেননি। তাঁর ‘সুমাখ প্যাটার্ন’ ছবিটি দেখলে তা বোঝা যায়। তাঁর আঁকা সুমাখের ছবিগুলোকে ‘গ্লোরিয়াস পেইন্টিং’ বলা হয়।
‘মাইন সুয়েপারস, হ্যালিফ্যাক্স’ ছবিটি লিসমার আঁকেন নোভাস্কোশিয়ায় ৩ বছর শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সময়। হ্যালিফ্যাক্স পোতাশ্রয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধসহ হ্যালিফ্যাক্স বিস্ফোরণেরও অনেক ছবি এঁকেছেন তিনি। সেখানে অনেকটা ড্রাফটসম্যানের মতো ভূমিকা ছিল তাঁর।

জে ই এইচ ম্যাকডোনাল্ড (১৮৭৩-১৯৩২) ইংল্যান্ডের ডারহাম থেকে কানাডায় আসেন ১৮৮৭ সালে, ইংলিশ মা ও কানাডিয়ান বাবার সঙ্গে। তিনি ‘হ্যামিলটন আর্ট স্কুল’ এবং টরন্টোর ‘সেন্ট্রাল অন্টারিও স্কুল অফ আর্ট অ্যান্ড জে ই এইচ ম্যাকডোনাল্ড (১৮৭৩-১৯৩২) ইংল্যান্ডের ডারহাম থেকে কানাডায় আসেন ১৮৮৭ সালে, ইংলিশ মা ও কানাডিয়ান বাবার সঙ্গে। তিনি ‘হ্যামিলটন আর্ট স্কুল’ এবং টরন্টোর ‘সেন্ট্রাল অন্টারিও স্কুল অফ আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন’ এ পড়াশোনা করেন। গ্রিপ লিমিটেডে ছিলেন এবং তখনই হ্যারিস তাঁকে পূর্ণকালীন পেইন্টার হতে উৎসাহ দেন। তিনি ছিলেন গ্রিপের লিড ডিজাইনার। এই দারুণ চাকরিটি ১৯১১ সালে ছেড়ে দিয়ে তিনি পূর্ণকালীন শিল্পী হবার মতো অসম্ভব ঝুঁকি নেন। ১৯২২ সালে তিনি ‘অন্টারিও কলেজ অফ আর্ট’ এ পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন গ্রুপের পিতৃস্থানীয় সদস্য। ১৯৩১ সালে ম্যাকডোনাল্ডের স্ট্রোক হয় এবং ১৯৩২ সালের ২৬শে নভেম্বর মাত্র ৫৯ বছর বয়সে টরন্টোতে মারা যান।

ম্যাকডোনাল্ড ছিলেন একজন কবি ও দার্শনিক। স্কেচিং ট্রিপগুলোতে আঁকাআঁকির সময়টুকু ছাড়া বাকি সবটা সময় তিনি বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতেন। তিনি একজন লেখকও ছিলেন। ‘West by East’ নামে তাঁর কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর।

ম্যাকডোনাল্ড ও জন উইলিয়াম বেটি মিলে ক্যানু লেকের ‘হেইহার্স্ট পয়েন্ট’ এ টম থমসনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘মেমোরিয়াল কেয়ার্ন’ স্থাপন করেন। টম থমসনের মেমোরিয়াল কেয়ার্নের ইন্সক্রিপশনও ম্যাকডোনাল্ডের লেখা। লেখাটির অংশবিশেষ –
HE LIVED HUMBLY BUT PASSIONATELY
WITH THE WILD IT MADE HIM BROTHER
TO ALL UNTAMED THINGS OF NATURE
IT DREW HIM APART AND REVEALED
ITSELF WONDERFULLY TO HIM
IT SENT HIM OUT FROM THE WOODS
ONLY TO SHOW THESE REVELATIONS
THROUGH HIS ART AND IT TOOK
HIM TO ITSELF AT LAST.

এ পর্যায়ে ম্যাকডোনাল্ডের আঁকা মাস্টারপিসসহ আরো কয়েকটি ছবি দেখানো হয়। ছবিগুলোর মধ্যে ছিল – Harvest Evening Moon (1927), Leaves in the Brook (1918), Beaver Dam and Birches (1919), The Beaver Dam (1919), Forest Wilderness (1921), The Tangled Garden (1916), Mist Fantasy (1922), Algoma (1920) ও The Solemn Island (1921)। উল্লেখ্য, ম্যাকডোনাল্ডের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডস্কেপগুলো অ্যালগোমাতে আঁকা।

ম্যাকডোনাল্ডের ‘হারভেস্ট ইভিনিং মুন’ অসম্ভব সুন্দর একটা কাজ। এটা দেখতে অনেকটা আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস পেইন্টিং এর মতো। এই ছবিতে ব্রিটিশ পেইন্টার জর্জ ক্লজেনের কিছুটা প্রভাব দেখা যায়। জর্জ গ্রামীণ ইংল্যান্ডের দুর্দান্ত সব রোম্যান্টিক ছবি আঁকতেন।
‘লিভস ইন দ্য ব্রুক’ ছবিতে টম থমসনের লিগ্যাসি দেখা যায় এবং এই সময়টাতেই ম্যাকডোনাল্ড তাঁর ভাষা-ছন্দ খুঁজে পান। উল্লেখ্য, টম থমসনের মৃত্যুর পর অ্যালগনকুইন ছেড়ে অ্যালগোমায় শিল্পীরা যা এঁকেছেন, সেসবের সবই বলা চলে টম থমসনের লিগ্যাসি। ম্যাকডোনাল্ডের ছবিগুলোও সেই ধরনের।

‘বেভার ড্যাম অ্যান্ড বার্চেস’ ছবিটি শুধু ম্যাকডোনাল্ডের না, সমস্ত কানাডা মিলিয়ে একটা অন্যতম মাস্টারপিস। এটা একটা নিদারুণ স্কেচ। ছবিতে বার্চের ওপর পেছন থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। বস্তুত এইসব ছবির মধ্য দিয়ে টম থমসনের পর ম্যাকডোনাল্ড কানাডিয়ান আর্ট জগতের গ্রেটেস্ট মাস্টার হিসেবে আবির্ভূত হন।

‘ফরেস্ট উইল্ডারনেস’ আরেকটি সন্দেহাতীত মাস্টারপিস ম্যাকডোনাল্ডের। অনেক বড়ো ছবি এটি। ছবিতে অনেক উঁচু থেকে অ্যালগোমার ভিউ। খুব উঁচু স্পটে দাঁড়িয়ে নিচের প্যানোরোমা দেখার এই বিষয়টা শিল্পীরা অ্যালগোমায় শিখেছিলেন। এর আগের জর্জিয়ান বে’র ছবিগুলো ছিল গ্রাউন্ড লেভেলের, ক্রস দ্য লেক, সঙ্গে বিশাল আকাশ। কিন্তু অ্যালগোমায় তাঁরা ওপর থেকে তাকিয়েছেন নিচে।

ফ্রেডেরিক ভার্লি (১৮৮১-১৯৬৯) এসেছেন ইংল্যান্ডের শেফিল্ড থেকে। পড়াশোনা ‘শেফিল্ড স্কুল অফ আর্ট’ এ। পরে পড়েছেন বেলজিয়ামে। ছোটোবেলার বন্ধু লিসমারের উৎসাহে তিনি প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় ১৯১২ সালে কানাডার টরন্টোতে চলে আসেন এবং যোগ দেন গ্রিপ লিমিটেডে।

ভার্লি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার অফিশিয়াল war artist। তিনি একজন দুর্দান্ত ওয়ার আর্টিস্ট ছিলেন। এরপর তিনি হিউম্যান ফিগার আঁকায় আগ্রহী হন, আর ল্যান্ডস্কেপ ছিল সঙ্গে। অস্থির স্বভাব তাঁকে নিয়ে গিয়েছে নানা দুর্গম এলাকায় – আর্কটিকে, রাশিয়ায়। ১৯৪৫ সালে তিনি টরন্টো ফেরেন এবং বাকি সময়টা এখানেই থাকেন। অন্টারিওতে ভার্লির বাসস্থান ইউনিয়নভিলে আছে ‘ভার্লি আর্ট গ্যালারি।’

এ পর্যায়ে ভার্লির আঁকা মাস্টারপিসসহ আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি দেখানো হয়। ছবিগুলোর মধ্যে ছিল – Gas Chamber at Seaford (1918), For What (1918), Early Morning, Sphinx Mountain (1928), Night Ferry, Vancouver (1937), Girl in Red (1920-21), Stormy Weather, Georgian Bay (1921) ও Dharana (1932)।

‘গ্যাস চেম্বার অ্যাট সিফোর্ড’ ছবিটি সংরক্ষিত আছে কানাডিয়ান ওয়ার মিউজিয়ামে। এটা একটা অন্যতম ওয়ার পেইন্টিং। ১৯১৯ এ লন্ডনের রয়্যাল একাডেমিতে একটা প্রদর্শনী হয় কানাডিয়ান ওয়ার মেমোরিয়াল ফান্ড আর্টের উদ্যোগে। সেখানে এই ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, শিল্পী জ্যাকসন ও ভার্লি দুজনই ট্রেঞ্চে আহত হন এবং তাঁরা দুজনেই ছিলেন ওয়ার আর্টিস্ট। এই ছবিটা ইংল্যান্ডে আঁকা। এটা ছিল সৈন্যদের ট্রেনিং এর অংশ। ট্রেঞ্চে গ্যাস অ্যাটাক খুব নিয়মিত হতো। এ কারণে সৈন্যরা নকল ট্রেঞ্চ করে, গ্যাস মাস্ক পরে অনুশীলন করত। সেটা থেকেই ভার্লি এই অসম্ভব দারুণ ইমেজ এঁকেছেন। সিফোর্ড দেখতে খুব সুন্দর। জল বয়ে যাচ্ছে এখানটায় উপত্যকার মধ্য দিয়ে। অনেক শিল্পী এখানের ছবি এঁকেছেন। এটা একটা সুপরিচিত বিউটি স্পট এবং ভার্লি এঁকেছেনও দুর্দান্ত। একটা ফিগারও বেরিয়ে আসছে ছবিটায়। ১৯১৯ এর সেই প্রদর্শনীতে আধিপত্য ছিল জ্যাকসনের ছবির। প্রতিটা রুমে তাঁর পেইন্টিং ছিল। তবে এই ছবিটাসহ ভার্লির দুই তিনটা ছবিও খুব ছাপ ফেলেছিল।

‘আরলি মর্নিং, স্ফিঙ্কস মাউন্টেইন’ ভার্লির আরেকটি অসামান্য মাস্টারপিস। তাঁর মতো আর কেউ এমন রঙ ব্যবহার করেননি। ভার্লি ছিলেন একজন অসাধারণ কালারিস্ট। এই ছবিতে ব্যবহার করেছেন গোলাপি, লাল, হট রেড এবং খুব ডাইনামিক ও আকর্ষণীয়ভাবে এঁকেছেন। সুইস আর্টিস্ট ফার্ডিন্যান্ড হডলারের ১৯১১ সালে আঁকা Jungfrau ছবির প্রভাব আছে ভার্লির এই ছবিতে।

১৯২৬ সালে ফ্রেড ভার্লি শিক্ষকতার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ‘ভ্যাঙ্ক্যুভার স্কুল অফ আর্ট’ এ। উল্লেখ্য, ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর প্রত্যেক শিল্পী কোনো না কোনো সময়ে হয় কমার্শিয়াল আর্টিস্ট ছিলেন কিংবা শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ভার্লি ভ্যাঙ্কুভার ছাড়েন ১৯৩৫ সালে। এই ‘নাইট ফেরি, ভ্যাঙ্ক্যুভার’ ছবিটি স্মৃতি হিসেবে আঁকা। নর্থ শোর থেকে নিয়মিত এই ফেরিতে ফিরতেন তিনি। ছবিতে কিছু হ্যালুসিনেট কোয়ালিটি আছে। সাইকোডেলিক কালার ব্যবহার করা হয়েছে ছবিটিতে। চাঁদ নোঙ্গর করছে মাথার ওপর। ফোরগ্রাউন্ডে আছে একটা ফিগার। এই ফিগার তাঁর আরো তিন/চারটা ছবিতে আছে। এটা সম্ভবত ভার্লি নিজেই। তিনি সবসময় তাঁর ছবিতে উপস্থিত। এটা একটা মেমোরি পেইন্টিং, ভ্যাঙ্ক্যুভারের নস্টালজিক মেমোরি। এই ছবি আঁকেন ভার্লি তাঁর ‘পিক অফ পাওয়ার’ এর সময়। ১৯২০ এর প্রথম প্রদর্শনীতেও ভার্লির আঁকা পোর্ট্রেট প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। তাঁর আঁকা চারটা পোর্ট্রেট স্থান পেয়েছিল সেখানে। আর ছিল হ্যারিসের আঁকা পোর্ট্রেট।

‘গার্ল ইন রেড’ ভার্লির গ্রেটেস্ট মাস্টারপিস। এই ছবিতে রঙের জয়জয়কার। অসাধারণ এক কমলা রঙ ব্যবহার করেছেন তিনি এই ছবিতে? ১৯১৯ সালে অগাস্ট জন এর আঁকা ‘Marchesa Casati’ ছবির সঙ্গে ভার্লির এই ছবির মিল আছে। জন তখন ব্রিটিশ আর্টের বোহেমিয়ান সুপারস্টার। জিপসি ক্যারাভানে করে ঘুরতেন তিনি। বোহেমিয়ান জন রোল মডেল ছিলেন বোহেমিয়ান ফ্রেড ভার্লির।

পাইন নিয়ে গ্রুপ অফ সেভেন এর শিল্পীরা যত ছবি এঁকেছেন, তার মধ্যে টম থমসনের ‘দ্য জ্যাক পাইন’, ‘দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’, ফ্রেড ভার্লির ‘স্টর্মি ওয়েদার’ এবং ক্যাসনের ‘হোয়াইট পাইন’ অন্যতম।

শিল্পীদের ওপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব এবং ভার্লির ‘ধারণা’ ছবিটি নিয়ে নীলাদ্রি চাকী বলেন, প্রথম থেকেই গ্রুপের দুইজন শিল্পী – লরেন হ্যারিস ও আর্থার লিসমার পরিচিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজের সঙ্গে। এঁরা ১৯১৪ সালে ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকে অভিনয় করেন। আর্টস অ্যান্ড লেটার্স ক্লাবের হলে মোট তিনবার মঞ্চস্থ হয় ডাকঘর। ১৯১৪ সালে একইসঙ্গে আয়ারল্যান্ড ও টরন্টোতে ডাকঘরের মঞ্চায়ন হয়। অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শিল্পীদের সরাসরি দেখা হয়। রবীন্দ্রনাথ ভ্যাঙ্ক্যুভারে অর্থাৎ ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে এসেছিলেন ট্রাইয়েনিয়াল এডুকেশনাল কনফারেন্সে ১৯২৯ সালে। এর আগেও রবীন্দ্রনাথকে কানাডায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ১৯১৪-১৫ সালের দিকে। কিন্তু তিনি আসতে রাজি হননি কারণ ১৯১৪ সালে একটা ঘটনা ঘটে ওখানে। জাপানিদের কোমাগাতা মারু নামে একটা জাহাজে প্রায় ৩০০ জন ভারতীয় ভ্যাঙ্কুভারে এসেছিলেন। এর মধ্যে পাঞ্জাবি ছিল প্রায় আশি ভাগ আর বিশ ভাগ ছিল হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে। ভ্যাঙ্ক্যুভারের বর্ণবাদী সরকার সেই জাহাজের সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। লোকগুলো আটকে ছিল দুই-তিন মাসের মতো। এর প্রতিবাদ স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ তখন আসেননি। পরে এলেন ১৯২৯ সালে কনফারেন্সে। ‘ফিলোসফি অফ লেইজার’ শিরোনামে একটা বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন সেই কনফারেন্সে। সেবারে তাঁকে আনার ব্যাপারে ফ্রেড ভার্লিসহ ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর অন্য শিল্পীদেরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল। রবীন্দ্রনাথ এলে ভ্যাঙ্ক্যুভারের এক আলোকচিত্রীর সেলুনে তাঁর সঙ্গে শিল্পীরা দেখা করেছিলেন। এক বেলা একসঙ্গে কাটান তাঁরা। এবং ‘স্পিরিচুয়াল কমপোনেন্ট ইন নেচার’ এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় তাঁদের মধ্যে। শিল্পীদের অনেকের মধ্যে বিষয়টির ছাপ পড়েছিল। এর মধ্যে হ্যারিস ও ভার্লি অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির মধ্যে স্পিরিচুয়ালিজম খুঁজে পেতেন। অনেকে এর সঙ্গে ঈশ্বরের সন্ধানও করেছেন। যেমন লরেন হ্যারিস। তবে ভার্লির ওপর প্রভাব পড়েছিল সবচেয়ে বেশি। এর পরপরই ভার্লি আঁকেন ‘ধারনা’ ছবিটি। যার মধ্যে ‘স্পিরিচুয়াল কমপোনেন্ট ইন নেচার’ এর গভীর প্রভাব দেখা যায়। এই ছবিটা দেখে রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন ‘আকাশ ভরা তারার মাঝে আমার তারা কই’ এর কথা মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য মৈত্রেয়ী দেবী রাশিয়ান কবি মায়োকোভস্কির একটি ৪ লাইনের কবিতার ভাবানুবাদ করেছিলেন। এই ছবি দেখে সেই কবিতার কথাও মনে পড়ে – “শোনো এখন যদি আকাশে তারা জ্বলে তাহলে এমন কেউ আছে যে সেই তারা দেখতে চায়। কেউ যেন বলে ‘আকাশের ওই বিন্দুটা কি! ওটা কি একটা রত্ন! মধ্যদিনের ধুলোর ঝরে আক্রান্ত হয়ে ঈশ্বরের হস্তচুম্বন করে সে বলে আকাশের ওই তারা তুমি কেড়ে নিও না। তারাহীন হয়ে আমি বাঁচবো কেমন করে?” ভার্লির ‘ধারণা’ ছবিতে মধ্য রাতে কেউ বসে আছে, চারদিকে অন্ধকার, নির্ণিমেষ নেত্রে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর আর সব ছবি থেকে এটা সম্পূর্ণ আলাদা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভার্লির দেখা ১৯২৯ এ, আর এই ছবিটি ১৯৩২ সালে আঁকা।

এ ওয়াই জ্যাকসন (১৮৮২-১৯৭৪) ছিলেন মন্ট্রিয়লের অধিবাসী। তিনি ১২ বছর বয়সে স্কুল ছাড়েন ও মন্ট্রিয়লের এক প্রিন্টিং ফার্মে কাজ শুরু করেন। ১৯০৬ সালে তিনি শিকাগোর আর্ট ইন্সটিটিউটে পড়তে যান। এর এক বছর পর প্যারিসে পড়তে যান ও ১৯১২ পর্যন্ত থাকেন। এই সময়কালে তার আঁকা ছবিতে ইম্প্রেশনিস্ট প্রভাব খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।

হ্যারিস ও ম্যাকডোনাল্ড জ্যাকসনের কাজে খুব মুগ্ধ ছিলেন এবং তাঁকে ১৯১৩ সালে টরন্টোতে চলে আসতে অনুরোধ করেন। হ্যারিস ম্যাকডোনাল্ড ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষক ডঃ ম্যাককালামের সাহায্য নিয়ে জ্যাকসনকে টরন্টো নিয়ে আসেন। ডঃ ম্যাককালাম তাঁকে সাবসিডি অফার করেন এক বছরের জন্য, যা তিনি টম থমসনকেও করেছিলেন শুরুর দিকে। ১৯১৪ থেকেই জ্যাকসন হ্যারিসের স্যাভার্ন স্ট্রিটের স্টুডিও বিল্ডিং এ টম থমসনের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন ও থাকেন ১৯৫৫ পর্যন্ত ৩০ বছর, অটোয়া চলে যাবার আগ পর্যন্ত। তিনি জীবনের শেষ ৬ বছর মিঃ ও মিসেস ম্যাকমাইকেলের বাসায় থাকেন, যেটা এখন গ্যালারি।
জ্যাকসনের মতো আর কোনো শিল্পী কানাডা এতটা চষে বেড়াননি। আক্ষরিক অর্থেই তিনি কানাডার প্রতিটি ইঞ্চি স্পর্শ করেছেন। তিনি কানাডার একদম উত্তরের শেষ প্রান্তে যান এবং ফারদেস্ট নর্থ পয়েন্টে ছবি আঁকেন।

জ্যাকসনের শত শত ড্রয়িং আছে ম্যাকমাইকেল গ্যালারিতে। তিনি তাঁর স্কেচপ্যাড এভাবে ব্যবহার করতেন, যেমনটা আমরা করি সেলফোন। যে কোনো কিছু চোখে পড়লেই স্কেচ করতেন তিনি এবং আঁকতেন খুব দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে। অসম্ভব সুন্দর তাঁর ড্রয়িংগুলো। তিনি ছিলেন অসামান্য ড্রাফটসম্যান – রেকর্ডার অফ ডেইলি লাইফ।

এ পর্যায়ে জ্যাকসনের আঁকা মাস্টারপিস সহ আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি দেখানো হয়। ছবিগুলোর মধ্যে ছিল – The Red Maple (1914), Entrance to Halifax Harbour (1919), A Copse, Evening (1918), October Morning, Algoma Wartz Lake (1920), Early Spring Quebec (1923), Hills at Great Bear Lake (1953), Cobalt Ontario (1932) ও Radium Mine (1938)।

জ্যাকসনের ‘কোবাল্ট, অন্টারিও’ ছবিটি সাক্ষ্য দেয়, শিল্পীরা শুধুই উইল্ডারনেস, নিঃসঙ্গ পাইন, হ্রদ, পাহাড় এসবই আঁকতেন না। তাঁরা অনেক আরবান পেইন্টিংও এঁকেছেন। উল্লেখ্য, কোবাল্ট কানাডার সিলভার মাইনিং টাউন। জ্যাকসনের ‘র‌্যাডিয়াম মাইন’ ছবিটিও ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর সচরাচর ছবির সঙ্গে মেলে না। ছবিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিন দেখা যায়।
ফ্রাংকলিন কারমাইকেলের (১৮৯০-১৯৪৫) জন্ম ওরিলা, অন্টারিওতে। তাঁর আগ্রহে খুব ছোটোবেলাতেই তাঁর মা তাঁকে গান ও আর্ট শেখাতে ভর্তি করে দেন। তিনি যখন টিনএজার তখন থেকে তিনি তাঁর বাবার স্টোরে ক্যারেজ স্ট্রাইপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই ক্যারেজ সাজাতে গিয়ে শুরু হয় তাঁর ডিজাইন, ড্রয়িং ও কালারিং স্কিলের। ১৯১১ সালে এই সমস্ত আগ্রহের কারণেই তিনি টরন্টো চলে আসেন ও ‘সেন্ট্রাল টেকনিক্যাল স্কুল’ এবং ‘অন্টারিও কলেজ অফ আর্ট’ এ পড়াশোনা করেন। অন্টারিওর নানা জায়গায়, জর্জিয়ান বে’তে, লেক সুপিরিয়র এর নর্থ শোরে ছবি আঁকলেও ফ্যামিলি কটেজের সাইট ছিল তাঁর প্রিয় পেইন্টিং লোকেশন। তিনি ছিলেন প্রথমত একজন ওয়াটারকালারিস্ট। মূল ‘গ্রæপ অফ সেভেন’ এর তিনি ছিলেন কনিষ্ঠতম সদস্য।

কারমাইকেল গ্রিপে যোগ দেন ১৯১১ সালে। ম্যাকডোনাল্ড তখন গ্রিপের লিড ডিজাইনার। তিনি অত্যন্ত সফল কমার্শিয়াল আর্টিস্ট ছিলেন। খুব ভালো ইলাস্ট্রেটরও ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন খুপ চুপচাপ, ফোকাসড মানুষ। সব শিল্পীদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে কন্সিস্টেন্ট ছিলেন সব মাধ্যমে।

১৯২৫ সালে গঠিত ‘অন্টারিও সোসাইটি অফ ওয়াটারকালারিস্টস’ এর ক্যাসনের সঙ্গে কারমাইকেল ছিলেন কো-ফাউন্ডার। তিনি কানাডিয়ান আর্টের ইতিহাসে একজন সেমিনাল চরিত্র।

এ পর্যায়ে কারমাইকেলের আঁকা মাস্টারপিসসহ আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি দেখানো হয়। ছবিগুলোর মধ্যে ছিল – Red Hugh (1942), Gambit #1 (1945), Cobalt Mine Shaft (1930), Sketch 4, October (1920), October Gold (1922), Autumn Hillside (1920) ও Farm Haliburton (1940)।

কারমাইকেলের উডকাটের কাজ ‘রেড হিউ’। অনেকেই জানেন না যে, কারমাইকেল বিমূর্ত ছবিও আঁকতেন। ‘গ্যামবিট # এক’ তাঁর বিমূর্ত কাজ। হ্যারিসের প্রভাবে তিনি বিমূর্ত ছবি আঁকেন। পরে ফিটসজেরাল্ডও আঁকেন। আসলে, ৪০ এর দশকে কানাডার শিল্পীদের ওপর বিমূর্ত ছবি আঁকার ব্যাপারে বেশ চাপ ছিল, যা ছিল ৩০ এর দশকে ইংল্যান্ডে? তাঁর মৃত্যুর বছরেই এই ছবিটা আঁকা। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তিনি খুব নামী ওয়াটারকালারিস্ট ছিলেন। তেলরঙেও আঁকতেন। ক্যাসনও ছিলেন ওয়াটার কালারিস্ট ও কারমাইকেলের এসিস্ট্যান্ট।

কারমাইকেলের কোবাল্টে জলরঙে আঁকা ছবি ‘কোবাল্ট মাইন শ্যাফট’। কোবাল্টে তিনি অনেক ড্রয়িং ও ছবি এঁকেছেন। পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে তিনিই প্রথম কোবাল্টে যান। তার আগে এক নারী চিত্রশিল্পী প্রথম কোবাল্টে যানও ছবি আঁকেন ১৯১৬ সালে। ১৯১০ এ সারা পৃথিবীতে রূপা উৎপাদনে কানাডার কোবাল্ট চতুর্থ অবস্থানে ছিল। কারমাইকেলের কালার সেন্স ছিল খুব ইউনিক। সেটি তাঁর আঁকা ‘স্কেচ ফোর, অক্টোবর’ ছবিতে খুব স্পষ্ট। খুব ডেকোরেটিভ এই ছবিটি।

কারমাইকেলের পঁয়ত্রিশটা এনগ্রেভিং টুল ম্যাকমাইকেল গ্যালারিতে আছে। তিনি একজন দুর্দান্ত এনগ্রেভার ছিলেন।

ফ্রাঙ্ক জনস্টনের (১৮৮৮-১৯৪৯) জন্ম টরন্টোতে। তিনিও গ্রিপে ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রলিফিক আর্টিস্ট। গ্রুপের মধ্যে কিছুটা ডার্ক হর্স। অ্যালগোমার কাজ নিয়ে দল প্রদর্শনী করে প্রথম। সেখানে জনস্টনের আঁকা ছবি ছিল সবচেয়ে বেশি। ৬০টি কাজ ছিল সেখানে। ১৯২০ এর প্রদর্শনীতে ছিল ১৭টি। অন্য সবার চেয়ে বেশি কাজ ছিল তাঁর। ১৯২০ এর শীতকালে ইটন স্টোরে একক প্রদর্শনী করেন তিনি ২০০টা ছবি নিয়ে। ১৯২০ এর ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর প্রদর্শনী থেকে খুব কম ছবি বিক্রি হয়েছিল, কিন্তু জনস্টনের একক প্রদর্শনীতে অনেক সাড়া পেয়েই হয়ত তিনি ভাবেন তিনি এককভাবেই ক্যারিয়ার গড়বেন। ১৯২০ এর প্রদর্শনীর কয়েক মাস পরেই তিনি উইনিপেগের ‘স্কুল অফ আর্ট’ এর প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি শহরের সবচেয়ে বড়ো একক প্রদর্শনী করেন। থাকেন ১৯২৪ পর্যন্ত। ফিরে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রুপ থেকে বিদায় নেন। কমার্শিয়ালি তিনিই সবার চেয়ে সফল ছিলেন। ১৯২৭ এ ফ্রাঙ্ক থেকে ফ্রাঞ্জ নাম ধারণ করেন তিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্টাইলে পরিবর্তন আসে। প্রথমদিকে ছিল ল্যান্ডস্কেপের খুব শক্তিশালী ডেকোরেটিভ ইন্টারপ্রেটেশন। পরের দিকের ছবিগুলো রিয়ালিস্টিক ধাঁচের এবং আলোর ব্যবহারে ফ্যাসিনেশন দেখা যায়। জনস্টন মারা যান ১৯৪৯ সালে।

এ পর্যায়ে জনস্টনের আঁকা মাস্টারপিসসহ আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি দেখানো হয়। ছবিগুলোর মধ্যে ছিল – Moose Pond (1918), Autumn Algoma ও Dark Waters।

‘অটাম অ্যালগোমা’ ছবিতে জনস্টন কালো রঙের অপূর্ব ব্যবহার করেছেন, যা অন্য কোনো শিল্পী করেননি। ছবিটি প্রতীকি ধরনের। তাঁর ‘ডার্ক ওয়াটার্স’ ছবিতে পানি ও বরফ খুব রিয়ালিস্টিক ধাঁচে আঁকা। বরফ আর জল আঁকায় বিশেষজ্ঞ, অত্যন্ত কালেক্টিবল নরওয়েজিয়ান আর্টিস্ট, ইম্প্রেশনিস্ট রিয়েলিস্ট ফ্রিটস টাউলোর ‘এ মাউন্টেন স্ট্রেম’ ছবির প্রভাব আছে জন্সটনের এই ছবিটিতে।

এ জে ক্যাসন (১৮৯৮-১৯৯২) এর জন্ম টরন্টোতে। কিন্তু শৈশব কেটেছে অন্টারিওর গুয়েল্ফ ও হ্যামিলটনে। ক্যাসনের আর্টিস্ট ক্যারিয়ার শুরু ফ্রিল্যান্স কমার্শিয়াল ডিজাইনার হিসেবে। ‘রাউস অ্যান্ড মান’ এ যোগ দিলে তিনি কারমাইকেলের নজরে পড়েন এবং কারমাইকেলের সঙ্গে ক্যাসন উইকেন্ডের স্কেচিং ট্রিপগুলোতে যেতে শুরু করেন। তাঁর খুব সম্বৃদ্ধ কমার্শিয়াল আর্ট ক্যারিয়ার ছিল। তিনি ছিলেন কারমাইকেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট। ক্যাসন পরে ওই কমার্শিয়াল ফার্মেরই প্রেসিডেন্ট হন।

ক্যাসন ছিলেন একজন দুর্দান্ত ওয়াটারকালারিস্ট। তিনি ও কারমাইকেল মিলে ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অন্টারিও সোসাইটি অফ ওয়াটারকালারিস্টস’। এর পরের বছরই তাঁকে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এ যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান কারমাইকেল। তিনি ছিলেন গ্রুপের কনিষ্ঠতম সদস্য। জনস্টন গ্রুপ ছাড়েন ১৯২৪ এ, আর ক্যাসন যুক্ত হন ১৯২৬ এ। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মার্গারেট ছিলেন ম্যাকমাইকেলদের বন্ধু। অনেকবার ম্যাকমাইকেল গ্যালারি ভিজিট করেছেন তিনি। ক্যাসন ৯৪ বছর বয়সে মারা যান।

এ পর্যায়ে ক্যাসনের আঁকা মাস্টারপিসসহ আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি দেখানো হয়। ছবিগুলোর মধ্যে ছিল – At Rosseau, Muskoka (1920), October, North Shore (1929), White Pine (1957), Picnic Islands (1948), Little Island (1965) ও Keinburg (1931)।

দারুণ স্কেচে ক্যাসনের ‘অ্যাট রসো, মাসকোকা’ ছবিটি অনেকটা হ্যারিসের ‘লেক সিমকো’র স্টাইলে আঁকা। তাঁর মাস্টারপিস ‘অক্টোবর, নর্থ শোর’ ছবিটিতে ক্লাসিক ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর ইমেজ পাওয়া যায়, তবে এর বিশেষত্ব দেখা যায় ড্রয়িং ও কালারে। তাঁর ‘হোয়াইট পাইন’ সবচেয়ে রিমার্কেবল ও বিখ্যাত কাজ। অরিজিনাল ছবিটা প্রিন্ট করেছিলেন টেম্পোরায়। অরিজিনাল কাজটা আকারেও ছোটো ছিল। জনস্টনও টেম্পোরায় করতেন। টেম্পোরা খুব কঠিন ও দুর্লভ মিডিয়াম। পরে ম্যাকমাইকেলদের অনুরোধে তিনি জলরঙে ‘হোয়াইট পাইন’ আঁকেন। তাঁর ‘পিকনিক আইল্যান্ডস’ চমৎকার ড্রয়িং এর প্রায় বিমূর্ত একটা ছবি। তাঁর ‘লিটল আইল্যান্ড’ দেখলে মনে হয়, ৬০ এর দশকে আবার এই ছবিতে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ ফিরে এসেছে। খুব স্পেশাল ছবিটি। ছবিতে তিনি গাছ এঁকেছেন পাখির পালকের মতো করে। ব্যবহার করেছেন ব্যতিক্রমী রঙ। তাঁর ‘ক্লাইনবার্গ’ ছবিটি সাক্ষ্য দেয়, ম্যাকমাইকেল গ্যালারি প্রতিষ্ঠার বহু আগেই তিনি ক্লাইনবার্গ আবিষ্কার করেন। তিনি অন্টারিওর রুরাল টাউন আঁকতেন, ভার্নাকুলার স্থাপত্য রেকর্ড করতেন। অন্টারিওর শহর ও গ্রাম ট্রেডমার্কে পরিণত হয় তাঁর তুলিতে।

এডউইন হলগেট (১৮৯২-১৯৭৭) এর জন্ম অন্টারিওর এলেনডেইলে। তাঁর বেড়ে ওঠা মন্ট্রিয়লে। অনেক বছর প্যারিসে থাকেন তিনি। হলগেট একজন অসম্ভব ভালো পোর্ট্রেট আর্টিস্ট। ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এ যোগ দেন ১৯২৯ সালে। ইতোমধ্যেই তাঁর জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতি ছিল। তবে পোর্ট্রেটের জন্য বিখ্যাত হলেও তিনি অনেক ম্যুরাল এঁকেছেন। হলগেট ‘কানাডিয়ান সোসাইটি অফ গ্রাফিক আর্টিস্টস’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

এ পর্যায়ে হলগেটের আঁকা মাস্টারপিসসহ আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি দেখানো হয়। ছবিগুলোর মধ্যে ছিল – Baie des Moutons, Looking Northward (1930), The Blacksmith, Nudes in the Laurentians ও The Cellist (1923)।

কারমাইকেলের মতো গ্রেট প্রিন্টমেকার ছিলেন হলগেট। তিনি মন্ট্রিয়লের ‘স্কুল অফ আর্ট’ এ উডকাট শেখাতেন। এই মাধ্যমে তাঁর কাজ ‘দ্য ব্ল্যাকস্মিথ।’ গ্রুপের মধ্যে তিনিই একমাত্র সদস্য যিনি ন্যুড এঁকেছেন। ‘ন্যুডস ইন দ্য লরেনশিয়ান’ এ ন্যুড এঁকেছেন তিনি অনেকটা স্কাল্পচারাল লুকে। তাঁর মাস্টারপিস হচ্ছে ‘দ্য চেলোইস্ট’। এর সঙ্গে মিল পাওয়া যায় অগাস্টাস জনের বিখ্যাত পেইন্টিং ‘মাদাম সাগিয়া’র।

এল এল ফিটসজেরাল্ড (১৮৯০-১৯৫৬) থাকতেন ম্যানিটোবায়। কানাডার প্রেইরি অঞ্চলের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল তাঁর। আঁকার জন্য তিনি খুব সাধারণ বিষয় বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এ যোগ দেন তিনি। এর পরের বছরই গ্রুপ ভেঙে বৃহত্তর ফোরাম তৈরি হয়।

লিসমারের মতো ফিটসজেরাল্ডও ছিলেন শিক্ষক। তিনি ছিলেন সেজানে, ভ্যান গগের ভক্ত এবং তাঁদের ছবির স্টাইলে এঁকে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি
ফিটসজেরাল্ডের মাস্টারপিস – ‘দ্য হারভেস্টার’। এই ছবিতে ভ্যান গগের প্রভাব খুব স্পষ্ট।
কানাডার প্রধান প্রধান সব আর্ট গ্যালারিগুলোতে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর ছবি আছে। কিন্তু টরন্টোর ম্যাকমাইকেল আর্ট গ্যালারির সঙ্গে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর খুব ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। নীলাদ্রি চাকী বলেন, রবার্ট ও সেইন ম্যাকমাইকেল অর্থাৎ ম্যাকমাইকেল দম্পতি ছিলেন শিল্প অন্তঃপ্রাণ মানুষ। প্রচুর ছবি কিনতেন তাঁরা। “ওয়ান ম্যান’স অবসেশন” নামে রবার্ট ম্যাকমাইকেলকে নিয়ে একটি বই আছে। ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর ছবি কেনা শুধু না, শিল্পীদের সঙ্গেও ছিল তাঁদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। পরে একসময় তাঁরা তাঁদের বসবাসের জায়গাতেই তৈরি করেন ‘ম্যাকমাইকেল আর্ট গ্যালারি।’ গ্যালারিটি বিরাট পাহাড়ি উপত্যকার ওপর। গ্যালারির জানালাগুলো দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বিশাল, একটা বড়ো কাচের। জানালা দিয়ে দেখা যায় বাইরের প্রকৃতি আর ভেতরে শিল্পীদের আঁকা প্রকৃতির ছবি। এই দুইয়ে মিলিয়ে অপূর্ব এক ছবির গ্যালারি। এতো ছোটো ও সাধারণ একটা গ্যালারি যে এত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে, তা ম্যাকমাইকেল গ্যালারি না দেখলে বোঝা যায় না। এই গ্যালারিতে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর ছবি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২০০০ এর মতো আইটেম রয়েছে। রয়েছে টম থমসনের শ্যাকও। ম্যাকমাইকেল আর্ট গ্যালারিতে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ২০০০ সালের জানুয়ারি থেকে “A Like Vision: The Group of Seven at 100” নামে একটা চমৎকার প্রদর্শনী চলছে। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের ছবির ভ্রাম্যমান প্রদর্শনী বোস্টন, নিউইয়র্ক, ইউরোপসহ পৃথিবীর আরো অনেক জায়গায় হলেও ঐ সময় কানাডায় কোনো কারণে আসেনি। পরে ২০১২ সালে জোসেফ ও’কনোলের প্রচেষ্টায় ‘লাস্ট হারভেস্ট’ নামে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী হয় এই ম্যাকমাইকেল আর্ট গ্যালারিতেই।

ম্যাকমাইকেল আর্ট গ্যালারি প্রাঙ্গণের সমাধিক্ষেত্রে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর ছয় জন শিল্পী – হ্যারিস, লিসমার, ভার্লি, জ্যাকসন, ক্যাসন ও জনস্টনের সমাধি আছে। এই “আর্টিস্ট’স সেমেটারি”র আইডিয়া জ্যাকসন ও ক্যাসনের। আর বাস্তবায়িত করেন শিল্পীদের আজন্ম সুহৃদ ম্যাকমাইকেল দম্পতি।

ভারতীয় শিল্পী যোগেন চৌধুরী নীলাদ্রি চাকীর আমন্ত্রণে টরন্টোয় এসেছিলেন ২০০২ সালে, ইন্ডিয়ান আর্টের ওপর বিশেষ বক্তৃতা দিতে। তখন ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর শিল্পীদের শান্ত-সমাহিত ছবি দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ছবিগুলো খুব সুন্দর, পাকা হাতের কিন্তু শিল্পীরা কখনো দুঃখ-কষ্ট দেখেননি। সেটির ছাপ আছে ছবিতে।’ কারণ যোগেন চৌধুরী নিজে উদবাস্তু হয়ে এসেছিলেন কোলকাতায়। ফলে তাঁর জীবনসংগ্রাম উঠে এসেছে তাঁর আঁকা ছবিতে।
‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর সমালোচনায় বলা হয় – তাঁদের ছবিতে আদিবাসীদের কথা আসেনি। তাঁদের ছবি দেখলে মনে হয়, অ্যালগনকুইন, অ্যালগোমা মনুষ্যবসতিহীন, অথচ সেসব জায়গায় আদিবাসীরা আরো বহুকাল আগে থেকেই ছিল। তবে একটি কথা সত্য, শিল্পীরা আগ্রহী ছিলেন সাবলাইমে, ল্যান্ডস্কেপে। তাঁরা সদ্যজাত দেশটিকে জাগিয়ে তুলতে ল্যান্ডস্কেপ আঁকাকেই যথার্থ মনে করেছেন। তাঁরা ছবির মাধ্যমে নবীন দেশকে ঔপনিবেশিক লিগ্যাসি থেকে মুক্ত করেছেন, দেশ নিয়ে মানুষকে নতুন করে ভাবিয়েছেন। কারণ এর আগে কানাডিয়দের নিজের দেশের ভৌগোলিক স্কোপ সম্পর্কে কোনোই ধারণা ছিল না। তারা ভাবতে পারতো না, এই দেশের ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে এই ধরনের শিল্প তৈরি হতে পারে। ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর শিল্পীরা দেশটির প্রকৃতির সঙ্গে চিত্রকলাকে অবিচ্ছেদ্য করে খুব মৌলিক অবদান রেখেছেন।

‘গ্রুপ অফ সেভেন’ ভেঙে ১৯৩৩ সালে তৈরি হয় ‘কানাডিয়ান গ্রুপ অফ পেইন্টারস।’ ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ ছিল মূলত অন্টারিও ভিত্তিক। কিন্তু নতুন গ্রুপ সমস্ত কানাডা জুড়ে তৈরি হয়। তবে গ্রুপ ভাঙার অন্যতম কারণ ম্যাকডোনাল্ডের মৃত্যু। পিতৃস্থানীয় শিল্পীর মৃত্যুতে পরবর্তী পর্যায়ে যাবার কথা ভাবেন শিল্পীরা। ততদিনে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ উর্বর জমিন তৈরি করে দিয়েছে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য। ‘কানাডিয়ান গ্রুপ অফ পেইন্টারস’ এর হ্যারিস ছিলেন প্রেসিডেন্ট। এর সদস্য ছিল ২৮জন। ৯ জন মহিলা শিল্পীসহ ‘গ্রুপ অফ সেভেনের সবাই ছিলেন ‘কানাডিয়ান গ্রুপ অফ পেইন্টারস’ এর সদস্য।

নীলাদ্রি চাকী বলেন, যাঁরা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, রবীন্দ্রনাথের গান ভালোবাসেন, দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদ-নজরুল ভালোবাসেন, তাঁদের সবার অস্তিত্বের সঙ্গে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ আজন্ম জড়িয়ে থাকবে।

কানাডিয়ান আর্ট মুভমেন্টের পথিকৃৎ ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ এর শতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার আসরে আলোচক নীলাদ্রি চাকীর স্বতঃস্ফূর্ত ও গভীর আলোচনা এবং আসরের তথ্যসমৃদ্ধ ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন দর্শক-শ্রোতারা উপভোগ করেন এবং আলোচনা শেষে শ্রোতা-দর্শকের প্রশ্নের খুব সাবলীলভাবে উত্তর দেন নীলাদ্রি চাকী। এই আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।