কামাল আহমেদ : ২১ জানুয়ারি ১৯৩২-২৫ জানুয়ারি ২০২১

টরন্টোর সাংস্কৃতিক কর্মী আর সৃষ্টিশীল মানুষদের মাঝে কামাল আহমেদ-এর সরব উপস্থিতি আর টের পাওয়া যাবে না, এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তাঁর ৮৯ বছরের জীবনে তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রগাঢ় জ্ঞান নিয়ে বিচরণ করেছেন। তাঁর এই বিচরণ প্রক্রিয়া তাঁর জীবনের একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত সচল ছিল।

কামাল আহমেদ সৃষ্টিশীল আর সংস্কৃতিবান মানুষদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন, আনন্দ পেতেন শিল্পের বিভিন্ন শাখা নিয়ে কথা বলতে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে। চমৎকার এক পরিবেশ ও সাহচর্যের মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেন। পিতা ছিলেন কলকাতার স্বনামধন্য স্থপতি। পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোজাফফর আহমেদ কাছ থেকে পান পরম স্নেহ। এ ছাড়া তিনি জ্যেতি বসু, হেমাংগ বিশ্বাস, কলিম শরাফী, সলিল চৌধুরী, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, ভুপেন হাজারিকা, সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটকের সাহচর্য ও স্নেহ পান।

বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই তিনি কলকাতা আর ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে থাকেন এবং ঢাকার ছাত্র রাজনীতি অংগনে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হন। পরবর্তীতে তিনি বঙ্গবন্ধুর গভীর স্নেহ পান। ১৯৭২ সাথে বঙ্গবন্ধুর আহবানে তিনি সপরিবারে ঢাকায় আসেন এবং বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। জীবনের শেষ দিকের প্রায় ত্রিশ বছর তিনি সস্ত্রীক কানাডায় বসবাস করেছেন।

কামাল আহমেদ তাঁর ভালোবাসার সৌন্দর্য এমনভাবে তাঁর আশে পাশের মানুষদের বিলিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁকে ভুলে যাওয়া সবার জন্য খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। সুন্দর চেতনা, শিল্পবোধ আর জ্ঞান দিয়ে তিনি আমাদেরকে আলোকিত করে গেছেন। তাঁর প্রয়াণে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমাদের এই শোকাতুর মনে আমরা জানাই তাঁর প্রতি পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

জয় বাংলা স্লোগান প্রথম যেদিন উচ্চারিত হয়
১৯৬৯ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৫ই সেপ্টেমর থেকে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে। প্রথম দিন অর্থাৎ ১৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে একটা সাধারণ ছাত্রসভা ডাকা হয়। সভা শুরু হলে জিন্নাহ হলের (পরবর্তী নাম সূর্যসেন হল) ছাত্র আফতাব উদ্দিন আহমদ সবাইকে চমক দিয়ে চিৎকার দিয়ে বলেন, জয় বাংলা’। ইকবাল হলের (পরবর্তী নাম সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র চিশতি শাহ হেলালুর রহমান সংগে সংগে চিৎকার দেন ‘জয় বাংলা’ বলে। এভাবে তারা কয়েকবার স্লোগানটা দেন। ব্যাপারটা আকস্মিকভাবে ঘটে যায়। যেহেতু এটা একটা নতুন স্লোগান, তাই সবাই একটু হতচকিত হয়ে চুপচাপ থাকেন। বিষয়টা এভাবেই চাপা পড়ে থাকে। সত্তরের ১১ই জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ জনসভার আয়োজন করেছিল। প্রধান বক্তা ছিলেন শেখ মুজিব। মঞ্চের সামনের দিকে ‘জয় বাংলা’ লেখা একটা ব্যানার ঝোলানো ছিল। ‘বিজ্ঞাপনী’র কর্ণধার কামাল আহমেদ এটা ডিজাইন করে দিয়েছিলেন। মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে সিরাজুল আলম খান বেশ কয়েকবার এই স্লোগান দেন। এ প্রথম ঢাকার একটি জনসভায় প্রকাশ্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হলো এবং উপস্থিত জনতা তাৎক্ষণিকভাবে তাতে সাড়া দিলো। তবে মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগের কোন নেতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেননি।
(মহিউদ্দিন আহমদ এর ‘জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে।)

স্ত্রী সাঈদা আহমেদ নবু ও কামাল আহমেদ

এক.
কামাল ভাই স্মরণে
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন থেকেই তাঁর কথা শুনে এসেছি, তিনি সদ্য প্রয়াত কামাল আহমেদ। আইপিটিএ (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ)’র বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস- এদের সঙ্গে তিনি যেমন যুক্ত ছিলেন, চলচ্চিত্রের সংগেও যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর নিজের মুখে শোনা, পরে ‘দ্য মাদারটাং’ খ্যাত তথ্যচিত্রের নির্মাতা নাদিম ইকবালের তোলা ভিডিও’তে শুনেছি, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন শুরু হলে, বিশেষ করে ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারির পর তিনি পাগলের মতো ঢাকায় চলে আসেন। তাত্তি¡ক হিসেবে নয়, তত্তে¡র প্রয়োগের ক্ষেত্রটি তাঁকে আকর্ষণ করেছিল। আর সেই উত্তাল ঢাকায়, তার পরেই তো নির্বাচন – ২১ দফার দাবী নিয়ে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন। সপরিবারে তিনি বাংলাদেশ শত্রæকবল মুক্ত হওয়ার পরই চলে আসেন। তাঁর ভাষায়, তোফায়েল আহমেদের চিঠি পেয়েই সীমান্ত পেরিয়েছিলেন, পরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি পাসপোর্ট পেয়েছিলেন।

সুদর্শন, দীর্ঘদেহী, সুকন্ঠের অধিকারী কামাল আহমেদ কলকাতার টান-টেনে নিয়ে কথা বলতেন, আর কথা বলতেন ভারি সুন্দর করে, গুছিয়ে। যতটা মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় গোবিন্দ হালদারকে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের মাধ্যমে তাঁর কাল-জয়ী গান পাই। এই গীতিকারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে দেলওয়ার এলাহী উদ্যেগী হয়ে নিজেই যতটা সম্ভব সাহায্য করেছিলেন, পরে বাংলাদেশ সরকার।

কামাল আহমেদ গুণী চিনতে ভুল করেন নি কখনো। এক নায়কত্বের পাড়-ঘেষা গণতন্ত্র নয়, বরং আধুনিক ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভংগির ভাবনার প্রতি দুর্বলতা ছিল তাঁর। ফলে বামপন্থী ভাবনার মানুষজন, বঙ্গবন্ধুর ভাষায় চাটার দলের ওপর আস্থা কমে আসছিল। ১৯৬৬ সনে ইডেন হোস্টেলের ছাদে বঙ্গবন্ধু লাহোরের পর বাংলাদেশে ছয় দফা উপস্থাপন করেছিলেন, সেই অনুষ্ঠানের মঞ্চের সাজসজ্জা তাঁর ছিল। নিজে ছবি আঁকতেন। ভালো গান, সাহিত্য – এ সবের সমঝদার ছিলেন। তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা সম্ভবত আল মাহমুদের গণকন্ঠ’র দফতরে। সেখানে সে সময় কবি দেলোয়ার, কবি নির্মলেন্দু গুণ, আহমদ ছফা, কবি মাশকুর রহমান চৌধুরী কর্মসূত্রে কী অন্য কারণে তাঁরাও যেতেন।

বলা ভালো, পরীক্ষা দিয়েই আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যাই, নইলে তাঁর সংগে তখনই যোগাযোগটা গভীর হতো। ১৯৯৮ সনে, তাঁর মেয়ে রিংকির সংগে আমার দেখা হয় নিউইয়র্কের এক ট্রাভেলিং এজেন্ট অফিসে। সে বছরই আমি কানাডায় প্রথম আসি, কিন্তু ছিলাম অটোয়ায়, নায়াগ্রা দেখতে এসেছিলাম – এক রাতের জন্য। ২০০৮ এর নভেম্বরে, আমার ছেলে আসিফ তার বাসায় নিয়ে গেল। ছিম-ছাম একটি পরিবার – একটি সুখি দম্পতি। বোধহয়, তখনো তিনি নাগরিকত্ব পাননি। প্রায় ২৬ বছর পরে তাঁর ব্যাপারে ইমিগ্রেশন বিভাগ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়।

একই ফ্রেমে পাঁচ জন; (বাম থেকে) রাশেদ খান মেনন, কামাল লোহানী, কামাল আহমেদ, হায়দার আকবর রণো ও মহাজাতক বোখারী

না, বাংলাদেশে তাঁর জন্ম হয়নি- জন্ম যদিও যুক্ত বঙ্গে —- পশ্চিমবঙ্গ- ভারতের একটি প্রদেশ। ভালোবেসে, প্রচণ্ড শ্রদ্ধা নিয়ে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রমে হিন্দি ও নেপালি বিভাগে কাজ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের প্রথম সেই বিদ্রোহী দশ জনের কনিষ্ঠতম ব্যক্তি ছিলেন আব্দুল্লাহ আল ফারুক। আমার কাছ থেকে প্রথম তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ পান। সে সময় আব্দুল্লাহ আল ফারুক এই বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। বড় শ্রদ্ধার সংগে তিনি বলেছিলেন, তাঁর কথা- আহ, মাত্র দু’দিন পরেই জানলাম, কামাল আহমেদও আর নেই।
এ এমন এক সময়, প্রত্যেককেই মৃত্যুচিন্তা করতে হচ্ছে। সামাজিক দুরত্বের দায় থেকে রেহাই নেই। অসোয়া থেকে পিকারিং আর কত দূরে?

আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, শহীদ খোন্দকার টুকুর কাছে – তিনি অন লাইন মোনাজাতের আয়োজনের করেছিলেন। সেখানে কামাল আহমেদের আরেক মেয়ে এবং বোন উপস্থিত ছিলেন।

পাঠাভ্যাস ছিল আগাগোড়া। প্রচুর পড়তেন। ফারহানা আজিম শিউলী জানালেন যে, একেবারে সা¤প্রতিক লেখকদের লেখাও তিনি পড়তেন। ভালো কিছু পড়লে, তিনি সংগে সংগে তার প্রতিক্রিয়া জানাতেন। রেখে ঢেকে কথা বলতেন না, তিনি সোজা-সাপ্টা কথা বলতেই ভালোবাসতেন।

হিমাদ্রী রয় একদিন নাদিমকে আর আমাকে নিয়ে গেলেন, একটি বৃদ্ধাশ্রমে – আমরা অনেকক্ষণ ছিলাম। আমি আমার লেখা একটি বই তাঁকে উপহার দিয়েছিলাম। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ফুয়াদ চৌধুরী তাঁর ওপর তথ্যচিত্র নির্মাতার জন্য কাজ করছিলেন। এখন তারই জন্য আমাদের প্রতীক্ষা। ক্যামেরার কাজ করেছেন নাদিম ইকবাল।

বাংলাদেশকে ভালোবেসে তিনি তাঁর স্বদেশ এবং অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রটি ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন। ত্রিশ বছরের অধিক তাঁকে কানাডায় থাকতে হলো, প্রবাস-জীবন মেনে নিতে হলো, তাও স্টাটাস পেতে সময় নিয়েছে দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর। তাঁর মৃত্যুতে সবাই মিলে একত্রিত হয়ে একটু শোক জানাবো, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করব সে সুযোগও হলো না। এই আফসোস রয়ে গেল।

আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ অন্য কারণে, তিনি আমার ছেলে আসিফকে খুবই স্নেহ করতেন। আমিতো এখানে ছিলাম না, আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম অন্তত সে একজন ভালো অভিভাবক পেয়েছে। আমার মেয়ে শাওলী যখন এই শহরে আসে, ধীরে ধীরে মেয়ে-জামাইয়ের সাথেও তাঁর চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠে। আমি জানি, শাওলী যখনই খিচুড়ি বা জর্দা রাঁধবে, তার চোখ সজল হবে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি আমার মেয়ের হাতে খিচুড়ি আর জর্দা খেতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রতি, কামাল আহমেদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
– আসাদ চৌধুরী

দুই.
একজন শিল্পীর প্রয়াণ
টরোন্টোপ্রবাসী শিল্পী কামাল আহমেদ আর নেই। বয়স হয়েছিল ৮৫ বা তারও বেশি। কিছুদিন আগে স্ত্রী মারা যান। ভেংগে পড়েছিলেন। থাকতেন একটা হোমে।
কামাল ভাই ষাটের দশকে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। কাজ করতেন ‘বিজ্ঞাপনি’ নামের একটা বিজ্ঞাপনি সংস্থায়। এর মালিক ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি (১৯৬৫-৬৬) মাজহারুল হক বাকী।

১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারি পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভার মঞ্চে কাঠের তক্তার ওপর জয়বাংলা স্লোগান এঁকে সেঁটে দেওয়া হয়েছিল। সিরাজুল আলম খানের অনুরোধে এটি এঁকেছিলেন কামাল ভাই। জয়বাংলা স্লোগানের এটাই প্রথম লিখিত প্রকাশ।
অবিভক্ত ছাত্রলীগ ও পরে জাসদের অনেক মঞ্চসজ্জা ও পোস্টার করেছেন তিনি। ১৯৭৩ সালে জাসদের জন্য তাঁর আঁকা ছুটন্ত ঘোড়ার পোস্টারটি খুব আলোচিত হয়েছিল। আমার অনুরোধে টরোন্টো থেকে তিনি এর স্ক্যানড কপি পাঠিয়েছিলেন। এটি আমার বেলা-অবেলা বইয়ে ব্যবহার করেছি।

আমার তিনটি বইয়ে তাঁর উল্লেখ আছে। বইগুলো বন্ধু ফুয়াদ চৌধুরীর মাধ্যমে পাঠিয়েছিলাম তাঁর কাছে। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হতো। সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে লেখা পরবর্তী বইয়েও তাঁর প্রসংগ থাকবে।
আজই খবর পেলাম, কামাল ভাই আর নেই। তাঁর আত্মার শান্তি হোক।
– মহিউদ্দিন আহমদ

তিন.
কামাল চাচার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আল্লাহ ওনার আত্মাকে শান্তি দান করুক ও জান্নাতুল ফেরদৌস এ স্থান দিক এই দোআ করছি। তিনি সমাজের একজন সম্মানিত ও শ্রদ্ধভাজন ব্যক্তি ছিলেন। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। তাঁর আদরের কন্যা রিংকি আমার স্নেহের পাত্র ও বহু দিনের বন্ধু। চাচা এক জ্ঞানের ভান্ডার ছিলেন। যে কোনো প্রশ্নের উত্তর ওনার কাছে মিলতো। উইকিপেডিয়ার মতো উজ্জ্বল স্মৃতি শক্তির অধিকারী ছিলেন এবং উদার মনে সব জানিয়ে দিতেন। আগের দিনের মানুষ, সুন্দর মনের অধিকারী ছিলেন। সবচাইতে সুন্দর ছিল ওনার আধুনিক দৃষ্টি ভঙ্গি। .পুরাতনী ও আধুনিকতার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল ওনার চিন্তা ধারায়। মায়াবী ও সংবেদনশীল মনের এক মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের সবার মাঝে এক শূন্যতা রেখে চলে গেলেন। এমন মানুষ আবার এই যুগে পাওয়া বিরল হবে। আপনার শূন্যতা আমরা সকলেই অনুভব করবো চাচা। ভালো থাকবেন যেখানেই যাচ্ছেন।
– আলিয়া শরাফী

চার.
কামাল ভাইকে যতটুকু জানি
নিউ ইয়র্কে সাপ্তাহিক ঠিকানায় কাজ করার সুবাদে বাঙালীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে হতো। সময়টা ছিল নব্বই দশকের গোঁড়ায়। প্রায়ই দেখতাম, সে সব অনুষ্ঠানে সৈয়দ মোহাম্মদউল্লাহ্, জ্যোতিপ্রাকাশ দত্ত, পুরবী বসু, হাসান ফৈরদৌস প্রমুখের সঙ্গে একজন দীর্ঘদেহী মানুষ আসতেন। জেনেছিলাম, দেশ থেকে সদ্য আসা এই মানুষটির নাম কামাল আহমেদ এবং তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিতজন। কিছুদিন পরে আরো জানা গেল, ম্যানহাটানের বাংলাদেশী মালিকানাধীন ওয়ার্ড ওয়াইড ট্র্যাভেলস এ কর্মরত আমাদের পাশের জেলা যশোহরের ছেলে তারিক মাহাবুবের সঙ্গে কামাল সাহেবের মেয়ে রিংকির বিয়ে হয়েছে। একসময় আমার নিউ ইয়র্কের বাস সাঙ্গ হয়। কামাল সাহেবের কোন খবর আর আমার জানা ছিল না।

দশ-বারো বছর পরে কামাল আহমেদের সঙ্গে আবার দেখা হল এক সন্ধ্যায় স্কারবরোর এক বাড়ীতে। ডক্টর বাদল, প্রকৌশলী নাঈম ও খুলনার বাকীর সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম তার বাড়ীতে গল্প করতে। সেই সন্ধ্যায় মিসেস কামাল ও তাদের মেয়ে রিংকির সঙ্গেও আমরা পরিচিত হলাম।
আমাদের সাথে দেখা হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে কামাল সাহেব সাত ক্রিসেন্ট প্লেসে বাসা নিয়ে চলে আসেন। তখন নাঈম ও আমি তাদের নতুন বাসায় থিতু হতে অল্প বিস্তর সহযোগিতা করতে পেরেছিলাম।

পাশাপাশি থাকার কারণে এরপর কামাল সাহেবের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বেড়ে গিয়ে ঘনিষ্ঠতায় পৌছায়। আমার পিতার বয়সী হলেও তাকে আমি কামাল ভাই বলতাম।
এক সময় কামাল ভাই আশি বছরে পদার্পণ করলেন। আমারা কজন ঘরোয়া ভাবে তার নিজ বাসাতেই দিনটি উদযাপন করবো, ঠিক করলাম। ফুয়াদ চৌধুরী পরিবার নিয়ে তখন সাত ক্রিসেন্টে থাকেন। আমার অনুরোধে ফুয়াদ ভাই সস্ত্রীক সেদিনের ছোট অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। এরপর থেকে তাদের মধ্যে যোগাযোগ বেড়ে যায়। আনন্দের বিষয়, এক পর্যায়ে ফুয়াদ ভাই – কামাল আহমেদ ও তার স্ত্রীর উপর একটি ছোট্ট তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।

কামাল ভাইয়ের সঙ্গে মিশে, আমি বুঝতে পেরেছি, কলকাতায় স্থায়ী ও শক্ত পারিবারিক অবস্থানের কারণে সেখানকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকের সঙ্গে তার জানাশুনা ছিল। তা বোঝা যেতো, তার সঙ্গে আড্ডায় অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসাতে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিগত বছর গুলোতে কামাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। টরন্টো বসবাসরত তার দুইকন্যা চুমকি আর রিংকির মাধ্যমে তার সম্পর্কে জানা যেত। মাত্র এক বছর আগে কামাল ভাইয়ের স্ত্রী বিয়োগ হয়। প্যানডেমিকের শিকার হয়ে তার এই সময়ে চলে যাওয়া- তার জানাশোনা সকলের জন্যই বেদনার। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। – শেখ শাহনওয়াজ

পাঁচ.
কামাল আহমেদ : এক মুঠো রোদ্দুর
লোকটি তাঁর দেহের দৈর্ঘের মতোই দৃঢ়, স্বাধীঞ্চেতা,জ্ঞানী আর তেমনি প্রস্থের মতোন ছিল হৃদয় খানি। মন দিয়ে ভালবাসতেন বেহিসেবীর মতোন। গল্প-কথার তুবরি দিয়ে আলোকিত করে রাখতেন। ললিতকলা, নাট্যকলা, সাহিত্য রাজনীতির বিষয়-আশয় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপচারিতা। মাইল মাইল পথ চলা, কথা বলা। যে কোন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, ভালমন্দ যাচাই বাছাইয়ে অবতীর্ণ হতে মোটেই কার্পন্যবোধ করতেন না। স্ত্রী’র ভালবাসায় সিক্ত হতে ও স্ত্রীকে ভালবেসে রিক্ত হতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অপলক চেয়ে চেয়ে দেখতাম, নির্বাক হয়ে শুধু শুনে যেতাম অসময়ের অশ্বারোহী হয়ে।
শ্বেত-শুভ্র এক মাথা কেশ, লম্বিত সাদা-কালো জুলপি দু’গাল বেয়ে নেমে গেছে স্বেচ্ছায় ঠিক যেমনটা দেখতে পাই ওয়েস্টার্ণ মুভির হিরোদের। অনেক দিবস ও রজনী তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি, অমৃত কথা শুনেছি মিনিট, ঘন্টা, দিনভর নিরলসভাবে – জানিনা কতটা হৃদয়ের কাছাকাছি যেতে পেরেছিলাম। প্রথম দেখাতেই প্রেম। অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল সেদিন। সিনিয়রদের হারমোনীস হলের মুখপত্র সাহিত্য পত্রিকা ‘অঙ্গীকার’ এর অন্দরমহলে আমাকে প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন সে দিনই। সুন্দর প্রচ্ছদ, মনকাড়া অঙ্গসজ্জা, বর্ণ বিন্যাস – সবকিছুতেই অনুপম শিল্পের ও শিল্পীর হাতের নিপুন ছোঁয়া। তাঁর হাতের লেখা যেন দৃষ্টিনন্দন বাংলা ক্যালিওগ্রাফ।
তারপর অনেকদিন, অনেক বছর সহযাত্রী হয়ে পথচলা কথা বলা পত্রিকা অফিসে, শপিং মলে কিংবা তাঁর বাসায়। লেখা কথোপকথন সাক্ষাৎকার সব কিছুইতো রয়ে গেল শুধু উনিই নেই। হঠাত একদিন কিছু না বলেই হয়ে গেলেন ইতিহাস।
– বিদ্যুৎ সরকার

ছয়.
বিদায় কামাল ভাই
বরফ ঢাকা টরন্টো। আকাশে তুষারের মেলা। চারিদিকে করোনার থাবা। ভয়ের জীবন। হানা দিয়েছে লং টার্ম কেয়ারে। সেই আঘাতে আমাদের প্রিয় কামাল ভাই, কামাল আহমেদ আক্রান্ত হ্লেন। কয়েক দিন লড়াই করে লড়াকু কামাল ভাই পরাজিত হলেন। আমরাও পরাজিত হলাম। বড্ড বেরসিকভাবে কামাল ভাই বিদায় নিলেন।
সংস্কৃতি, রাজনীতি, নানাবিধ স্মৃতির ভাণ্ডার কামাল ভাই। বঙ্গবন্ধু, সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল, আরো অনেক বিজ্ঞ জনের সাথে তাঁর চলার পথের বহু বর্ণাঢ্য স্মৃতি। তিনি ছিলেন এক চলন্ত ইতিহাস।
নব্বই দশকের তাঁর সাথে প্রথম দেখা হয় মন্ট্রিয়েলে। আমার ফিল্ম ‘চাক্কি’র শো ছিল। আয়োজক ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক শাহিন রেজা নুর। সেই সময়ে কামাল ভাই এবং সাইদা ভাবীর সাথে সিনেমা নিয়ে চমৎকার কথা হয়। কামাল ভাইয়ের স্মৃতি ভাণ্ডার আমাকে অবাক করে দেয়। ভালো লেগে যায়। সেই সম্পর্ক ছিল চলমান।
তাঁর সুকন্যা রিংকি ও তারেক মাহবুব এর সাথে নিউইয়র্ক থেকেই আমার গভীর সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে পারিবারিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। তাঁর কানাডার জীবনের কষ্ট-বেদনা আমাদের ব্যথিত করলেও কিছু করতে পারি নাই। সেই বেদনা নিয়ে তিনি প্রস্থান করলেন। কামাল ভাইয়ের অনেক বলার ছিল। বলার সময় পেলেন না। করোনার লক ডাউন আমাদের লক করে দিলো। পারলাম না শেষকৃত্য, এমনকি শেষ দেখার। ক্ষমা করে দিন প্রিয় কামাল ভাই। আর হবে না দেখা। যেখানে আছেন ভালো থাকবেন। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি। – এনায়েত করিম বাবুল

কন্যা রিংকীসহ কামাল দম্পত্তি

সাত.
কামাল আহমেদ: একজন অভিমানী নিঃসঙ্গ পথচারী
কামাল ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় খুব অল্পদিনের। তাঁকে প্রথম জানি ফুয়াদ চৌধুরী নির্মিত একটি ডকুমেন্টারির মাধ্যমে। বাস্তবে তাঁকে প্রথম দেখি চার পাঁচ বছর আগে। অন্যমেলার একটি অনুষ্ঠানে আমি পুরনো দিনের কিছু গান গাইছিলাম। তিনি একটা গানের অনুরোধ করেছিলেন। গানটা আমার তোলা ছিলোনা, গাইতেপারিনি। ক’দিন পর কারো কাছ থেকে আমার নম্বরটি নিয়ে আমাকে ফোন করলেন। পরিচয় দিয়ে অনেক কথা বললেন। খুব আনন্দিতবোধ করছিলাম যখন তিনি আমাকে বলেছিলেন আমার গান বিশষ কোরে আমার কন্ঠ তাঁর খুব ভাল লেগেছিল। তাঁর মত এতো বড় মাপের একজন মানুষের কাছ থেকে এরকম. প্রশংসা আমার একটি মুল্যবা নপ্রাপ্তি ।
অনেক ইতিহাস জেনেছি তার কাছ থেকে। নিজে বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ আরো অনেক ইতিহাসের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, সাক্ষী ছিলেন আরো অনেক ঘটনার। মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি-মুক্তিযুদ্ধ কালীন অবিনশ্বর এই গানটির সৃষ্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েছিলেন তিনি।

যে গানটি ছাড়া ম্সুলমানদের ঈদ পরিপূর্ণতা পায় না কাজী নজরুল ইসলামের রচিত আর আব্বাসউদ্দিনের সুরে ও কন্ঠে গাওয়া সেই গান রমজানের অই খুশীর শেষে এলো খুশীর ঈদ কিভাবে সৃষ্টি হল সেই ইতিহাস তার থেকেই জানা। ভারাক্রান্ত হ্রদয়ে গল্পচ্ছলে একদিন বলছিলেন কমলদাস এর মত কালজয়ী একজন সুরকার কিভাবে এলিফ্যান্ট রোডে বলপেন এর ছোট একটি ব্যবসায় তার শেষ বছরগুলো কাটিয়েছিলেন।
স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিলো সীমাহীন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকেই তিনি খুব বেশী নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তবে তারো বহু বছর আগের থেকেই ইমিগ্রেশন এর একটা জটিলতার কারণে বাংলাদেশে অবস্থানরত তাঁর কয়েকজন সন্তানের কাছ থেকে বছরের পর বছর তাকে দূরে থাকতে হয়েছে। তিনি দেশে যেতে পারতেন না। আরো দুঃখের ব্যপার হল এই জটিলতা সৃষ্টির পেছনে ছিল আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির এ একজন। এই সীমাহীন কষ্টের ভার তিনি বহন কোরে গিয়েছে কয়েক দশক। কামাল ভাইয়ের সাথে আমার শেষ দেখা হয় ড্যানফোরথ এর ওল্ডহোমে, কভিডএর আগে। স্ত্রীর কথা বলতে বলতে সেদিন তাকে অঝর ধারায় কাঁদতে দেখেছি।
বাংলাদেশ নির্মাণে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নানাভাবে তাঁর যে অসামান্য অবদান ছিলো তার যথাযথ সন্মান না পাওয়ায়, দুঃসময়ে এ শহরের নানাজনের নানা ভূমিকা এবং নির্লিপ্তততায় এক বুক অভিমান এবং নিদারুণ এক নিঃসঙ্গতায় তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চির দিনের মত। আমাকেও দুটি ব্যপারে ঋণী কোরে গেলেন। তাঁর প্রিয় কিছু পুরনো বাংলা গান নিয়ে একটা অনুষ্ঠান এর অনুরোধ করেছিলেন। আর একদিন তাঁকে ওল্ড হোম থেকে তুলে নিয়ে শাওলী নাদিমের বাসায় নিয়ে ওখানে গানের আসর করতে বলেছিলেন। পারলাম না তার একটি অনুরোধও রাখতে। তার আগেই তিনি চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
তার স্ত্রীরপাশে, স্বর্গের বাগানে যেন তাঁর ঠাই হয় এইপ্রার্থনা করি। – শহীদ খোন্দকার টুকু

আট.
‘Your life was a blessing,
Your memory a treasure,
You are loved beyond words
And missed beyond measure’
– Reene Wood

শ্রদ্ধেয় কামাল আহমেদকে অনেক বেশি জানা হয়নি। যদি বলি জানার সুযোগ ছিল না তাহলে মিথ্যা বলা হবে। নিচ্ছয়ই তাঁকে জানার সুযোগ ছিল। সম্পর্কগত দিকে খুব কাছাকাছি না হলেও দীর্ঘকাল প্রতিবেশিই ছিলাম তাঁর। জাগতিক লেনদেনে ব্যস্ত সময় স্বার্থপরতায় বয়ে গেছে। কখনোই যাওয়া হয়নি তাঁকে দেখতে, গল্পে, কথায় ঋদ্ধ সময় পার করতে। তবে তাঁর সান্নিধ্যে আসা মানুষদের কাছে প্রায়ই খবর নিতাম। কামাল ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগটা ভীষণ অদ্ভুত ভাবেই ঘটে। লেখালেখি বিষয়টা আমার ভীষণ পছন্দের প্রিয় কাজ হলেও সময় এবং একাগ্রতার অভাবে এই ক্ষেত্রে আমি একপ্রকার অনিয়মিত। বেশ আগে নিতান্তই ঝোঁকের বশে বাংলা কাগজে ‘বঁধু হে! একা বসে থাকি’ শিরোনামে একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম। সুদূর প্রবাসে বাঙলা ভাষায় প্রকাশিত কাগজ হাতে পেলে অভূতপূর্ব আনন্দে মন ভরে যেতো। দিন ক্ষণ ততটা মনে নেই ঠিক, কিন্তু আমাকে লেখা কামাল ভাইয়ের ইমেইলের কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। তখন ছিলোনা ফেসবুক, ছিলোনা বাংলা টাইপ করার সহজ উপায় ‘অভ্র’ ইউনি কোড ফন্ট। বড় বড় ফন্টে টাইপ করা সেই চিঠি আমাকে দুর্লভ আনন্দ দিয়েছিল। কামাল ভাইয়ের মত মানুষের কাছ থেকে পাওয়া প্রশংসা নিঃসন্দেহে আমাকে সন্মানিত এবং গৌরবান্বিত করেছিল, উৎসাহিত করেছিল কলম ধরতে। পরে হাসিচ্ছলে গল্প করেছেন- সেই সময়ে নেইবারহুড লিঙ্কে বসে বাংলায় মেইল করতে না পেরে নিজের মেয়েকে দিয়ে চিঠি টাইপ করে পাঠিয়েছেন। পরবর্তীতে কামাল ভাইয়ের সাথে মুখোমুখি দেখা এবং কথা বলার সুযোগ ঘটে। গান, অভিনয় সহ অনেক বিষয়েই তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের বিষয়টা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি। তাঁর লেখা প্রবন্ধ, কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে। ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে’ শিরোনামে কামাল ভাইয়ের লেখাটা মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। ‘Sometimes you will never know the true value of a moment until it becomes a memory’- পরিশেষে, মৃত্যু কামাল ভাইয়ের নশ্বর দেহকে নিয়ে গেছে চোখের আড়ালে, কিন্তু তার বিশুদ্ধ আত্মার অস্তিত্ব, মুল্যবান স্মৃতিগুলো জড়িয়ে আছে আমাদের, থাকবে চিরকাল। -ঋতু মীর

নয়.
১৯৯৪ সাল, আমাদের বড় মেয়ে মুনিয়া গল্প জন্মের পর কামাল ভাই মেয়ের জন্য একটা ছড়া লিখে ছিলেন,
এক, দুই, তিন
নাচে ধিন ধিন
সবার আশীষ নিয়া
মোমের পুতুল মুনিয়া।
লেখাটা আমি অনেক দিন যতœ করে রেখে দিয়ে ছিলাম। পুরোনো দিনের স্মৃতি চিহ্ন। মানুষ চলে যায়। স্মৃতি চিহ্ন রেখে যায়। এক বছর আগে ডিসেম্বর মাসে নবু ভাবি পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। আজ চলে গেলেন কামাল ভাই নিজেও। অদ্ভুত এক পড়ুয়া ছিলেন কামাল ভাই নবু ভাবি দু’জনাই। আমার মনে হতো ছাপার অক্ষরে যা যা ওনাদের চোখের সামনে আসত তাই দুজনেই বিপুল আগ্রহে পড়ে ফেলতেন। আসরে, মিটিং, ঘরে, বাহিরে কিংবা দূরালাপনে লাগামহীন কথার ফুল্ঝুড়ি ছোটাতেন কামাল ভাই। একটা সময় এমন হলো আমি আর কামাল ভাইয়ের এসব কথার ফাঁকে ফোকরে অসঙ্গতি ধরতে আগ্রহ বোধ না করে বরং অবাক হয়ে ভাবতাম, কামাল ভাই যেনোবা ইতিহাসের অদ্ভুত এক ফিকশনাল ক্যারেক্টর! সুনীল গাঙ্গুলীর সেই সময়ের ভেতর ঢুকে পরা অতীত ইতিহাসে গল্পের খাতিরে লেখকের তৈরি করে নেয়া এক যুতসই চরিত্র বা সুত্রধর। কামাল ভাই এর নিরলস ইতিহাস, রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম গো-গ্রাস পাঠ উনাকে পৌঁছে দিতে পারত এক কাল্পনিক বাস্তবতায়। যার কারনে উনি পারতেন – বর্তমান থেকে ইতিহাসের অলিগলিতে অনায়াসে ঢুকে পরতে, যখন তখন, যেমন চাইতো তেমন করে। কখনো কাছে থেকে কখনো দূরে থেকে গত প্রায় তিরিশ বছর ধরে কামাল ভাইকে জানি, জীবন গল্পের অদ্ভুত এক চরিত্র ছিলেন তিনি! যার যতটুকুন সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টি কর্তা তার ততটুকুনই সৃষ্টি করেছেন তিনি নিজেকে নিজেই। বড়ো অদ্ভুত এক মানুষ ছিলেন কামাল আহমেদ।

প্রায় ষোল, সতেরো বছর আগের কথা। আমি তখন মন্ট্রিয়লে টরন্টো থেকে প্রকাশিত বাংলা কাগজের হকারী করি, সাথে ওই পত্রিকার মন্ট্রিয়ল পাতাটি এক প্রকার সম্পাদনা করি। কামাল ভাই বাংলা কাগজের জন্য প্রায় নিয়মিত লিখতেন। লেখা লিখে কামাল ভাই ফোন করে ডাকতেন। মন্ট্রিয়ল পার্ক-এক্সটেনশনের কার্বস্ রোডের একটি এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর তিন তলায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনে থাকতেন। প্রতি সপ্তাহে উনাদের জন্য দু’কপি বাংলা কাগজ নিয়ে গিয়ে তিন তলায় উঠে দিয়ে আসতাম। ফিরবার সময় ভাবি হাতে গুজে দিতেন এক/দুইটা চকলেট। কখনো অজুহাত দিতে না পেরে কখনো বা ইচ্ছে করেই বসে বসে এক চেটিয়া কামাল ভাইয়ের কথা শুনে আসতাম। কখনো কাবুলি ওয়ালার বাঙালি বৌয়ের চিঠির গল্প তো কখনো তাঁর প্রিয় পাত্র গোবিন্দ হালদারের একটি ফুলের গান! কখনো উনার ঋত্বিক দা আর মানিক’দার গল্প। যুক্তিও নয়, তক্কোও নয়। উনার গপ্পোটাই শুনতাম। শুনতে ভালো লাগতো। ষোল সতেরো বছর আগের সেই সময়ের কোন এক দিন, মন্ট্রিয়লে ওনাদের এপার্টমেন্টে একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকারটি (https://youtu.be/qZmmdBVvPFw) নিয়ে ছিলাম। কোন আলোতে বসতে হবে, কেমন করে বলতে হবে যেমন বলেছি খুশি মনে করেছেন। উনার লেখা ছাপা হলে নিয়ে গিয়ে হাতে দিলে খুশি হতেন খুব।

শেষবারে ২০১৮ তে টরন্টোতে এক দুবার যখনই দেখা হয়েছে, আগ্রহ নিয়ে কাছে ডেকে নিয়ে কথা বলতেন। অনেক অনেক কথা। কথার মাঝে বলতেন, তোমার প্রতিভা ছিল কিন্তু কিছু করতে পারলে না। আমাকে উপদেশ দিয়ে বলতেন, তুমি বিষয় নির্বাচন করতে জানো না। কি সব বানিয়েছো, ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি। আমি হাসি মুখে শুনে আসতাম সে সব। কখনো পাল্টা করে কিছু বলিনি উনাকে। গত কয়মাস আগে হঠাৎ এক দিন ফেইসবুকে কামাল ভাই এর ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট পেয়ে সাথে সাথেই এক্সেপ্ট করে নেই। কামাল ভাইয়ের প্রোফাইলে দেয়া ছবিটা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। তিরিশ বছর আগের কথা মনে করে বিষহ্ন হয়েছি। হায় সময়, কেমন করে জীবনের কতটা সময় পেরিয়ে গেল, না কি ফুরিয়েই গেল!

ফেইসবুকে আমাকে শেষ কমেন্টটি কামালভাই করে ছিলেন মাসখানেক আগের এক ভোরে। তিনি ইরেজী হরফে লিখেছিলেন, Murthy vangarbiruddhe gonoakroser film docu,etihaser dolil,hoye thakbe.chutey jao dhaka.jholmoliar kono abèdon nei. (মূর্তি ভাঙ্গার বিরুদ্ধে গনআক্রোশের ফিল্ম ডকু, ইতিহাসের দলিল, হয়ে থাকবে। ছুটে যাও ঢাকায়। ঝলমলিয়ার কোন আবেদন নেই।) কামাল ভাইয়ের এই কথার জবাবে আমি আর লিখি নাই যে দশ বছর আগে আমি একটা প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছিলাম যার নাম অপরাজেয় বাংলা। বিষয়টা অনেকটাই আপনি যে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে বলছেন সেটাই ছিল। জানি না আপনি জানতেন কি, না! কামাল ভাই আর কোন দিন দেখা হবে না। আর কখনো বলবেন না, তোমার প্রতিভা ছিল কিন্তু কিছু করতে পারলে না।
আহা, জীবন এতো ছোট কেন! – সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল

দশ.
আমার কামাল দা
কামাল আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৮ সালের ফেব্রæয়ারিতে, টরন্টোয় আমি ও আমার পরিবার অভিবাসী হয়ে আসার পরপরই। কিন্তু তারও বছর ৩৫ আগে থেকেই আমার বর খসরু চৌধুরীর সাথে ছিল তাঁর সাংস্কৃতিক যোগ? বর্ষীয়ান কামাল দা’কে এক মুহূর্তের জন্যও বয়স ছুঁতে পারেনি। সবসময় সবকিছুতে নিজেকে আপডেটেড রাখতেন – শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া, বিজ্ঞান সবক্ষেত্রে। আর তাঁর রুচিটাও ছিল উচ্চমার্গের। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ইন্সট্রæমেন্টাল, রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক গান — সবধরনের মিউজিক শোনা ছিল তাঁর প্রাত্যহিকতার অংশ। দেখতেন ধ্রæপদ চলচ্চিত্র, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের। নির্বাচিত সাহিত্যও পড়তেন সব সময়ের, সব অঞ্চলের। বলা চলে আগ্রাসী পাঠক ছিলেন তিনি। বাসা ছেড়ে একসময় ওল্ডহোম গেলে সেখানেও থেমে থাকেনি তাঁর এই শিল্প-সাহিত্য চর্চা। খুব আগ্রহ নিয়ে লেখালেখি করতেন নিয়মিত। সমসাময়িক ফুটবলের ক্লাবভিত্তিক খেলা থেকে টেনিস, ক্রিকেট সব খেলাই আগ্রহ নিয়ে দেখতেন। দেশ-বিদেশের প্রান্তিকতার আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ছিলেন একাত্ম। এক ধরনের স্পিরিচুয়ালিটিতে বিশ্বাসী হলেও তাঁকে দেখেছি স্টিফেন হকিং থেকে বর্তমানের ইউভাল নোয়াহ্ হারারি পড়তে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সবশেষ খবরটাও ছিল তাঁর আগ্রহের। বাংলাদেশ-কানাডা দুইদেশেরই রাজনীতির ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন, সংগ্রহ করতেন কানাডার কমিউনিস্ট পার্টির কাগজও। টরন্টো স্টারের উইকেন্ড ইস্যু রাখতেন নিয়মিত। রীতিমতো উৎসব ভাব দেখা যেত এই কাগজ নিয়ে তাঁর সময় কাটানোয়। কামাল দা’র স্মৃতিশক্তি ছিল ঈর্ষণীয়। ব্যক্তির নাম, সাল, ঘটনার একদম অনুপুঙখ বর্ণনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর ছিল বর্ণিল এক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অতীত। কাজ করেছেন চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ ঋত্বিক ঘটকের সাথে, সান্নিধ্য পেয়েছেন সত্যজিৎ রায়, কমরেড মোজাফফর আহমদ সহ অনেক ব্যক্তিত্বের। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর প্রত্যক্ষ উদ্যোগে গোবিন্দ হালদারের হাতে জন্ম হয়েছিল সেই গান – ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’। যুদ্ধের সময় কোলকাতায় কামাল দা’দের পৈতৃক বাড়িটি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ থেকে আসা শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনের মানুষজনের এক অবাধ বিচরণক্ষেত্র। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর জাসদের প্রথম সম্মেলনের পোস্টারটি ছিল সেই সময়ের কমার্শিয়াল আর্টিস্ট কামাল আহমেদের করা। প্রিয়জনদের খোঁজখবর করা এবং তাঁদের সৃজনশীল কাজে প্রতিনিয়ত উৎসাহ দেবার কাজটি কামাল দা করে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। স্ত্রী সাইদা কামাল নবুর সাথে কামাল দা’র ছিল দারুণ শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাঁদের বোঝাপড়াটা ছিল বেশ। হালে যেই ‘মিনিমালিস্ট দর্শন’ বেশ আলোচিত, সেই মিনিমাল জীবনই ওনারা কাটিয়েছেন বরাবর। আর্থিক সংকট নিয়ে কখনো অভিযোগ ছিল না তাঁর। জীবন যাপনে একদম বাহুল্য বিবর্জিত কামাল দা ও তাঁর স্ত্রী নবু ভাবীর কাছ থেকে এসব শেখার ছিল আমার-আমাদের। সবচেয়ে বেশি শেখার ছিল তাঁর জীবনবাদিতা – ইতিবাচক ও সৃজনশীলভাবে বহমান জীবনবোধ। কামাল আহমেদকে আমি কামাল দা ডাকলেও আমাকে তিনি জানতেন সন্তানের মতো। বেশ যাওয়া-আসা ছিল আমাদের দুই পরিবারের। আমরা থাকতামও একই বিল্ডিং এ। মাঝে মাঝেই এটা ওটা নিয়ে খোঁচাখুঁচি কিংবা মতানৈক্য হতো আমাদের। লেখার সাবেকি বনাম সমসাময়িক স্টাইল ইত্যাদি সহ নানান কিছু নিয়ে হতো নিয়মিত বাহাস। মাঝে মাঝেই কথাবার্তা-মুখ দেখাদেখিও ও বন্ধ থাকত। কিন্তু খুব আপনজনদের মধ্যে যা হয় আর কী। আবার সব ভুলে দুনিয়ার নানা বিষয়ে গল্পে, আড্ডায় মেতে উঠতাম আমরা। কামাল দা চলে গেলেন। এতটা জীবনবাদি-জীবনমুখি মানুষের আসলে মৃত্যু হয় না। কামাল দা থাকবেন জীবন্ত হয়েই আমার সঙ্গে, আমার কামাল দা হয়ে। – ফারহানা আজিম শিউলী

এগার.
কামাল আহমেদ ভাইকে আমি পরম শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম, যখন আমি তাঁর শিল্প-সংস্কৃতি বিশেষ করে চলচ্চিত্র জ্ঞানের পরিচয় পেয়েছিলাম। আমি নিজে প্রায় সারাজীবন চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করে চলেছি। আমার এই যাত্রায় যখন আমি কামাল ভাইয়ের সাথে পরিচিত হলাম এবং জানলাম বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী সব পরিচালক বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন প্রমুখের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রথম প্রথম আমার কাছে বিস্ময় লাগলো, এমনকি মাঝে মাঝে আমার মনে হতো, তিনি হয়তো বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু আমি যখন পরবর্তীতে তাঁর কথাগুলো ‘ক্রস চেকিং’ করতাম, তখন সেগুলোর সত্যতা খুজে পেতাম। এমনকি দুই বাংলার বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছে তাঁর কথা শুনেছি। আসলে, তাঁর জীবনের ক্যানভাসটা ছিল অনেক বড়। সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় তাঁর অগাধ জ্ঞানের পরে যখন লক্ষ্য করতাম, তাঁর বিনয়ী ব্যবহার এবং অপরিচিত জনকে খুব সহজেই আপন করার ক্ষমতা, সেটাকে আমাকে সব সময় মুগ্ধ করতো। কামাল ভাইয়ের চলে যাবার পর তাঁর অভাবটা এখন অনেক বেশি অনুভব করছি। এখন আমি সত্যিই উপলব্ধি করি, কামাল ভাইয়ের মত ব্যক্তিত্বরা হচ্ছেন একটি সমাজের বিশেষ অলংকরণ বা জীবন্ত ইতিহাস। টরন্টোর বাঙ্গালি সমাজ অনেক বেশী ঋদ্ধ ছিল তাঁর জন্য। বলা যেতে পারে, তিনি হয়ে উঠেছিলেন সৃষ্টিশীল তরুণদের এক অনুপ্রেরণার উৎস। এখন তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের বড় বেশী কষ্ট দিবে।
আমিনুল ইসলাম খোকন

বার.
স্মৃতিলেখন : কামাল ভাইর প্রতি শ্রদ্ধা
করোনার প্রভাবে ইদানিং মনের মাঝে একটা অদৃশ্য শংঙ্কা দেখা দিয়েছে, না জানি আগামীতে কি এক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে ! এমনই এক সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই শেলী জানালো,কামাল ভাই আর নাই ! জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে জানতে চাইলাম, কোন কামাল ভাই ? শেলী বললো, “আব্বার ব্যাংকের যিনি লোগো তৈরী করেছিলেন সেই কামাল ভাই ষ স্মৃতিচয়ণ প্রসঙ্গে কিছু অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার অবতারণা এসে যায়-যা কামাল ভাইর কর্মের সাথে সম্পৃক্ত। পাকিস্তান আমলে হাবিব ব্যাংক লিমিটেডের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন আমার শ্বশুর। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর হাবিব ব্যাংকটি অগ্রণী ব্যাংকে রূপান্তরিত হলে সেখানে একটি লোগোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সে সময় অগ্রণী ব্যাংকের দৃষ্টিণন্দন ঐ লোগোটি কামাল ভাই কর্তৃক প্রণীত হয়েছিল যা ইতিহাসের পাতায় আজও সংরক্ষিত রয়েছে। যেহেতু পারিবারিক সূত্রে অগ্রণী ব্যাংকের সাথে একটা সম্পর্ক রয়েছে,সেহেতু কামাল ভাইর পরিচিতিটা পরিবারের মাঝে এভাবেই প্রবেশ করেছিল।মূলতঃ অগ্রণী ব্যাংকের এই লোগো থেকেই কামাল ভাইর প্রভাব,প্রতিপত্তি, যশ, গৌরব বিস্তার লাভ করেছিলেন । যে বয়সে কামাল ভাই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন জীবনের হিসাবে তা ঈর্ষণীয় বটে ! তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা, ধীশক্তি,একাগ্রতা,বিচক্ষণতা ও পরিশ্রমই তাঁকে উৎকর্ষতার উচ্চশিখরে পৌঁছে দিয়েছিল।এহেন সংস্কৃতমনা সমাজছোঁয়া ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটার আকস্মিক তিরোধানে বাঙালী সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি মেনে নেয়া বড়ই কষ্টকর ! কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সীলমোহরকৃত অমোঘ বাণী ” জম্মিলে মরিতে হইবে ” এই শ্বাশ্বত সত্যব্রতী হয়েই জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে কামাল ভাই অগস্ত্যযাত্রায় পা বাড়ালেন স্বর্গের দুয়ারে পৌঁছানোর প্রয়াসে…. !
– দেলোয়ার হোসেন দুলাল

তের.
২০০০ সালে যখন কানাডার টরন্টোতে বসবাস শুরু করি – অপরিচিত জায়গায় কারো সাথে আগে পরিচয় ছিল না। কিন্তু মাঝে মাঝেই খুঁজতে থাকতাম কোথায় কোনো বাংলাদেশী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় কিনা? বাংলাদেশ সেন্টারে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান হয়। সেখান থেকে জানতে পারি অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, শিক্ষক, পেশাজীবীগণ বসবাস করছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেখা হয়, পরিচয় হয় অনেক ব্যক্তির সাথে – তাঁদের মাঝে একজন ছিলেন সাংস্কৃতিক কামাল আহমেদ। তিনি ছিলেন বয়সে অনেক বড়, লম্বা, সুঠামদেহী – যার চুলগুলো ছিল সাদা। শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, সব সময় সমীহ করে গেছি। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ছিল, তিনি যে কোনো বয়সের যার সাথেই কথা বলতেন, মনে হতো তারা তাঁর বন্ধু বা সন্তানতুল্য কেউ। পরিচিতরাও কামাল আহমেদের সব সময় খোঁজ খবর রাখতেন নিজ পরিবারের একজন সদস্যের মত।
তিনি ছিলেন একজন শুদ্ধ চিত্রকর, যার আকুনিতে উঠে এসেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা। আমাদের আপনজন ফুয়াদ চৌধুরী তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর ওপর নির্মাণ করেন ‘এজিং ইন ফরেনল্যান্ড’ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র যার মাধ্যমে তাঁর জীবনের কিছু অধ্যায় উঠে এসেছে। কামাল আহমেদ ছিলেন মহান স্বাধীনতার একজন সৈনিক। সুফীবাদে বিশ্বাসী এই মানুষটার প্রতি আমার শশ্রদ্ধ সালাম। মহামারী করোনা আমাদের মাঝ থেকে তাঁকে কেড়ে নিল। তিনি আজ নেই, কিন্তু তাঁর কর্ম ও চেতনা পরবর্তী প্রজন্মকে উজ্জীবিত করবে। মহান আল্লাহতালার কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
– ফয়েজ নুর ময়না

কামাল দম্পতি

চৌদ্দ.
আমি তখন কানাডায় একেবারে নতুন। সালটা ২০১৩। বাংলাদেশ সেন্টারের ফান্ড রেইজিং প্রোগ্রামে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো হল, একক এক সঙ্গীত সন্ধ্যায় গান গাওয়ার জন্য। তখনও আমি টরন্টোর খুব বেশী মানুষ, বিশেষ করে যারা সত্যিকারভাবে গান ভালোবাসেন তাঁদের চিনতাম না। সেই অনুষ্ঠান চলাকালেই দর্শক সারি থেকে অনেকেই আমাকে তাঁদের পছন্দের গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলেন। দর্শক সারির একেবারে সামনে বসে থাকা একজন বেশ বয়স্ক মানুষের প্রতি আমার বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছিল। এর প্রধান কারণ ছিল, তিনি আমাকে যে কয়েকটা গান গাওয়ার জন্য বলছিলেন, তা সাধারণ কোন শ্রোতার পছন্দের হতে পারে না। আমি তখনই উপলব্ধি করেছিলাম, তিনি একজন সত্যিকারের সংগীতপ্রেমী এবং নিঃসন্দেহে সঙ্গীত নিয়ে তাঁর বিস্তর পড়াশুনা বা চর্চা আছে। যাহোক, অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো, আমি দেখলাম, তিনি আমার সামনে এসে বিনয়ের সাথে বললেন, আমার সাথে তিনি কিছুক্ষণের জন্য কথা বলতে চান। সেখানেই কিছুক্ষণের জন্য আমরা সামনা-সামনি বসেছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম, তিনি বয়সের সীমানায় আশি পেরিয়ে গেছেন, কিন্তু এমন বয়সেও একজন পুরুষ এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে, তা আমার ভাবনায় ছিল না। তিনি প্রথমেই আমাকে প্রশংসার সাথে এবং কিছুটা উচ্ছ¡সিতভাবে বলে ফেললেন, ‘টরন্টোয় বসে অনেক দিন পর আমি সামনা-সামনি একজনের গান শুনলাম, যিনি আমাকে বিমোহিত করলেন সঙ্গীতের সৌন্দর্যে।‘তারপর কিছুক্ষণ থেমে তিনি বলেছিলেন, ‘সত্যি বলছি, আপনি একজন যথার্থই সত্যিকারের শিল্পী।’ কামাল ভাইয়ের সেদিনের সেই কথাগুলো আমার জীবনের এক অমূল্য পাওয়া, কারণ সেই প্রশংসা বাক্যগুলো এসেছিল, এমন একজনের কাছ থেকে যিনি সঙ্গীতকে ধারণ করেছিলেন প্রাণ থাকে। তারপর তিনি আমার স্বামী রানাকে একটি ক্যাসেট দিয়েছিলেন আমাকে দেবার জন্য। নজরুল সঙ্গীতের ক্যাসেট। আমার সব প্রিয় শিল্পীদের গাওয়া সেই ক্যাসেট, যার মোড়কে ছিল তাঁর হাতের অপূর্ব হস্তাক্ষরে লেখা গানের প্রথম লাইনগুলি। সেই ক্যাসেটের ‘যাও তুমি ফিরে’ গানটি তিনি আমাকে বিশেষভাবে শুনতে বলেছিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার, সেই শিল্পীর ঘরাণায় আমি গান গেয়ে থাকি। তাঁর এই ‘টিউনিং সেন্স’ এর জন্য তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল আরো অনেক বেশী।
আমাদের এই জীবন যাত্রায় অসংখ্য মানুষের ভীড়ে কিছু মুখ চির অ¤øান হয়ে থাকে, যা কখনো ভুলবার নয়। তাঁরা এক অন্যরকম শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় থাকেন আমাদের জীবনে। তাঁদের মনের সৌন্দর্য আর জ্ঞান আমাদের বারেবারে স্মরণ করিয়ে দেয় সঙ্গীতের অপার ঐশ্বর্য। কামাল আহমেদ ভাই তেমনি একজন। তাঁর প্রতি আমার পরম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।
– শিখা রউফ

পনের.
কামাল ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ৯ ডজ রোডে, একটি অনুষ্ঠানে। কথা প্রসংগে যখন তিনি জানতে পারলেন, আমি লং টার্ম কেয়ার হোম এ কাজ করি। তখন তিনি অন্যরকম এক স্নেহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমাকে প্রশংসার সাথে বললেন, ‘তুমি জীবনে সত্যিকারের একটা পেশা বেছে নিয়েছো।‘ তারপর তাঁর সাথে আরো অনেক বার দেখা হয়েছে এবং কথা হয়েছে। সেটা ছিল ২০১৭। তিনি মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন, কিছুদিনের জন্য ডাউন টাউনের ‘স্যালভেশন আর্মি’র একটা বয়স্ক কেন্দ্রে ছিলেন। এক বিকেলে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম, কি যে খুশী হলেন, সেটা বুঝানোর ভাষা নেই। সেখানকার অন্যান্য রেসিডেন্টদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন এবং কিছুটা আনন্দের সাথেই তাঁদের বার বার বলছিলেন, আমি যে কাজটা করি সেটা তাঁদের মত মানুষদের নিয়েই। তিনি বার বারই বলতেন, যারা বৃদ্ধ হয়নি, তাদের সব সময় বুঝা উচিৎ তারাও এক সময় বৃদ্ধ হবে। তাহলে সবাই বৃদ্ধ মানুষদের বেদনা বুঝতে পারবে। আমি এখন বুঝি কামাল ভাই কী বলতে চেয়েছিলেন। আমি বুঝি বয়স্ক মানুষ যারা সত্তর-আশি পেরিয়ে গেছে, তাঁদের কষ্ট আর একাকিত্ববোধের নিঃসংগতা।
আমার খুব ভালো লাগতো ভাবীর প্রতি তাঁর অপূর্ব প্রেমময় অনুভূতি দেখে। একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে এমন ভালোবাসতে পারে তা কামাল ভাইকে না দেখলে কখনোই বুঝতাম না। তিনি যখন মেইন স্ট্রীটের রিভেরা লং টার্ম কেয়ার হোমে ভাবীসহ ছিলেন তখন সেখানে আমার এক ভিয়েতনামী সহপাঠি সেখানে কাজ করতো। আমার পরিচয়ে সে কামাল ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল এবং মাঝে মধ্যেই আমাকে ফোন করে বলতো, কামাল ভাইয়ের মত এত রুচিশীল রেসিডেন্ট সে সেই লং টার্ম কেয়ার হোমে আর একটাও দেখে নি। আমি শুধু তাকে বলতাম, কামাল ভাই আমাদের বাঙ্গালী কমিউনিটির একজন বিশাল মাপের মানুষ। এখন কামাল ভাই নাই, এখন আমি বুঝি, কামাল ভাই ছিলেন, আমাদের এক প্রকাÐ বট গাছ। যার অভাব তখনই বুঝা যায়, যখন তিনি আর আমাদের মাঝে থাকেন না। – রেজিনা রহমান

ষোল.
কামাল আহমেদ : বড় বেদনার মত বেজেছ
কামাল ভাইকে আমি টরন্টোতে আসার পর থেকেই দেখেছি। আমার সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছে ২০০৮ সালের কোন এক সময়ে বাংলা কাগজ এর অফিসে। তারপর থেকে ঘনিষ্ঠতা। তাঁকে একটু একটু করে জানতে শুরু করেছি। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছি – কলকাতা, ঢাকার সাথে তাঁর সময়ের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা, তাঁর সংশ্লিষ্টতার কথা। কলকাতা, ঢাকার তাঁর সময়ের বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, লেখক, শিল্পী তথা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সাথে কামাল ভাইয়ের ছিল ঘনিষ্ঠতা।
কামাল ভাইয়ের বিনয়ী প্রমিত-অমিত উচ্চারণে আমি ইতিহাস শুনতাম ছাত্রের মতো। তিনি কবিতা, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা লিখেছেন। গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন। শুনেছি, তাঁর চমৎকার হাতের লেখার প্রথম লোগো হয়েছিল ‘জয় বাংলা’। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কলকাতায় থেকে বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। তাঁর অনেক কাজ বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। নির্লোভ বিনয়ী এই মানুষটি বড় নীরবে চলে গেলেন। কামাল ভাইয়ের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
– সাহিদুল আলম টুকু

সতের.
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স¤প্রচারিত ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মু্ক্িতযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যোগাতে এই অবিস্মরণীয় গানটি লেখা হয়। গানটির গীতিকার গোবিন্দ হালদার। সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন আপেল মাহমুদ। এই গান আমাদের সবার কন্ঠে, হৃদয়ে এবং চেতনায়। গোবিন্দ হালদারের ১৯৭১ সালের স্মৃতিমূলক ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’ গ্রন্থে তাঁর লেখা বিখ্যাত মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে – গানটি লেখার পেছনের কাহিনি বলতে গিয়ে দুই কামালের কথা বলেছেন। একজন কামাল লোহানী, অন্যজন কামাল আহমেদ। মানবর কামাল লোহানী দৈনিক প্রথম আলোয় (১৭ জানুয়ারী ২০১৫) গোবিন্দ হালদারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন “বন্ধু কামাল আহমেদের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল”। আমি খুবই স্মৃতিধন্য এই জন্য যে, সর্বজনপ্রিয় বুদ্ধিজীবী কামাল লোহানীর সাথে আমার পরিচয় ছিল – এটা আমার ভীষণ গর্ব। আমি আর কোনদিন অন্য কামাল মানে কামাল আহমেদের খোঁজ করিনি।
সময় যায়। দিন যায়। বাংলাদেশ থেকে আমি কানাডায় চলে আসি। সবকিছু নতুন। দেশ-সমাজ-মানুষ। সব নতুন। অনেক চরিত্রের মানুষ – তরল -গরল, হরেক রকমের মানুষ। টরন্টোয় থাকি। ব্যাস্ত জীবন। হঠাত একদিন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা গুরু ফুয়াদ চৌধুরীর ফোনৃ
:‘কই তুমি?’
:‘বাসায়’
:‘আসো, একজন বিখ্যাত মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দি।‘
ঠিকানা দিলেন। গেলাম ঠিকানা অনুযায়ী। পরিচয় করিয়ে দিলেন এক সুঠামদেহী, ছিমছাম মানুষের সাথে। সুললিত, গোছনো বাংলায় কথা বলেন নাম কামাল আহমদ। সেই থেকে পরিচয় গোবিন্দ হালদারের কামাল আহমেদের সাথে। তারপর ওনার সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। – পারভেজ চৌধুরী

আঠার.
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যখন কামাল আহমেদকে দেখতাম, তখন কেন যেন তাঁর প্রতি মন থেকেই এক ধরনের শ্রদ্ধা ও সমীহভাব চলে আসতো। তাঁর কথা বলা, চলা ফেরা দেখেই মনে হতো এক ধরনের আভিজাত্য আছে তাঁর মধ্যে। তাঁর এই আভিজাত্যের মধ্যে কোনো আরোপিতভাব ছিল না, বরং এই আভিজাত্যে ছিল সাধারণ-স্বাভাবিকতার বহমানতা। আশি উর্ধ্ব কোনো এক বাঙ্গালী যে এত সুন্দর করে, প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারে তা আমার কল্পনায় ছিল না। আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো, তিনি সহজেই একজনকে আপন করে নিতে পারতেন এবং একবার কারো সাথে পরিচয় হলে খুব সহজেই তিনি তার নামটা মনে রাখতে পারতেন। আড্ডার সৌন্দর্য কাকে বলে সেটা তিনি জানতেন। সহজ কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, তিনি জীবনের নান্দনিকতাকে উপভোগ করে গেছেন। এমন মানুষ একটা সমাজে কালেভদ্রে দেখা যায়।
কামাল ভাইয়ের স্মৃতি সব সময় আমাদের টানবে। আমাদের আড্ডায় অবশ্যই কামাল ভাই বারবার ফিরে ফিরে আসবেন। অবশ্যই তিনি চিরদিন আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে থাকবেন। – সাগর আহমেদ

উনিশ.
কামাল আহমেদের সাথে আমার প্রথম এবং একবারই দেখা হয়েছিল মেইন স্ট্রীটের রিভেরা লং ট্রাম কেয়ার হোমে। আমার সংগে ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ফুয়াদ চৌধুরী এবং নাদিম ইকবাল। প্রথম দেখায় উনি আমার পরিচয় জানতে চাইলেন এবং পরিচয় পর্বের পর উনি সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের শ্যুটিং এর একটি ঘটনা নিয়ে কথা শুরু করেছিলেন। বিষয়টি শেষ করার পর পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সংগে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা জানতে পারি। টরন্টোতে বন্ধুদের কাছ থেকে কামাল আহমেদ সম্পর্কে আরো অনেক বিষয় পরে জেনেছি। হঠাতই জানতে পারি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। – আরিফ হোসেন বনি

কুড়ি.
শ্রদ্ধেয় কামাল ভাই। প্রথম দর্শনেই ভালো লাগা, সেখানেই পরিচয়, আলাপচারিতে, সেখানেই সখ্যতা। ওনার দুরন্ত-দীপ্ত কন্ঠস্বর, প্রমিত বাংলা শব্দচয়ন, ব্যক্তিত্বপুর্ণ চলা-ফেরা চাহনি আমাকেই প্রথমেই কাছে টানে। কামাল আহমেদ অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে কলকাতার পার্ক সার্কাস স্ট্রীটের পিতৃগৃহে বেড়ে উঠেন। তাঁর পিতা ছিলেন কলকাতার একজন স্বনামধন্য স্থপতি। আমি মনে করি, আমাদের জীবনে কালাম ভাইয়ের মত ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ছিল একটি আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ উনি ছিলেন একজন বাতিঘর। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট ও সত্তর দশকের দাপিয়ে বেড়ানো একজন মানুষ। রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও চিত্রাংকন – এমন কোন বিষয় ছিল না, যে বিষয়ের তাঁর পান্ডিত্য ছিল না। কামাল ভাইয়ের তথ্য সমৃদ্ধ আলাপচারিতা আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত ও আলোড়িত করতো এবং যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, উনি প্রতিটি বিষয়ই তথ্যসূত্র সমেত উপস্থাপন করতেন।
এখন কামাল ভাই আমাদের কাছে শুধু স্মৃতি। তবে একটি উজ্জ্বল স্মৃতি। আমি ধন্য ওনার সান্নিধ্য পেয়ে এবং নিজেকে আরো বেশী সৌভাগ্যবান মনে করি, কারণ আমি ওনার দেয়া উপহার কয়েকটি সুন্দর উপহার বহন করছি। তিনি আমাকে ও আমার স্ত্রী শিখাকে ভালোবেসে পুরনো শিল্পীদের গাওয়া দুটি নজরুল গীতির ক্যাসেট দিয়েছিলেন যেটা সহসাই বাজারে পাওয়া যায় না।
আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। আমি মনে করি, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, তিনি ভালো থাকবেন।
– জগলুল আজিম রানা

একুশ.
প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলাম দুজনের।। না পড়ে যে উপায় ছিল না যে একদম ।। কামাল আহমেদ চাচা, নবু চাচি এমনি। অগ্রজ আহমেদ হোসেন ভাই যখন প্রায় হাইজ্যাক করে নিয়ে এলেন আমার আব্বু, কবি আসাদ চৌধুরী, আর আমাকে কামাল চাচার বাসায়, তখন মুহূর্তের মধ্যে – সুনামির মত ভালবাসায়, আদরে, স্নেহে, আর আশীর্বাদে ডুবিয়ে রাখলেন আমাদের এই প্রবীণ দম্পত্তি। ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি সংসারে শিল্পীর হাতের ছোঁয়া সবখানে খেলা করছে। দেয়ালে দেয়ালে নিপুন হাতের আঁকা পোস্টার, নকশা, কবিতা, ডিজাইন, ছবি আর বুকশেলফে হিংসা করার মত থরে থরে সাজানো বই এর নীরব কোলাহল। আদরে টেবিলে বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং, খসড়া, চিঠি, কবিতার বই, টরন্টোর বাংলা পত্রিকা, ঈদ আর পুজো সংখার সভা। গোছানো কলম, তুলি, পেন্সিল, কালি, নোটপ্যাড ছোট্ট টেবিল ল্যাম্প এর আলোয় কৃতজ্ঞতায় আকুল। আশে পাশে অতি যতনে আর আদরে বেড়ে ওঠা হরেক রকম ইনডোর গাছের মেলা। সবকিছু মিলে পরিবেশটা স্বাচ্ছন্দের তৃপ্তির – স্বস্তির।
কিন্তু নজর কাড়ার মত সুদর্শন, সুপুরুষ, দীর্ঘ দেহী কামাল আহমেদ চাচার স্বস্তি নেই কোনও। রহস্যময় তাঁর অস্থিরতা। সারা বিশ্বের সব টাটকা খবরাখবর তাঁর জানা চাই চাই এখুনি; তা হোক রাজনীতি, শিল্প ও সাহিত্য, অর্থনীতি, চিকিৎসা, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত বা ইতিহাসের অথবা টরন্টোর বাংলা পাড়ায় আগামী ২১ এ ফেব্রুয়ারির জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের প্রস্তুতির খবরাখবর। সদা মনোযোগী কামাল চাচা ফোনে হঠাত শোনা আমার কাশি বা হাঁপানির জন্য আপেল সিডার এর সর্বশেষ উপকারিতার কথাও বলতে ভুলতেন না। ভুলতেন না আবদার করতে তাঁর প্রিয় লাড্ডু নিয়ে আসবার জন্য। ভালবাসার দাবি যখন, না মেনে উপায় নাই কারো।
অবাক হয়ে শুনতাম কতভাবে আমাদের পরিবারের কত গুণীজনদের তিনি চিনতেন; সবার কথা জিজ্ঞেস করতেন আগ্রহের সাথে। এ যেন পরম আত্মীয়তা।
অনর্গল কথা বলতে পারতেন এই সুবক্তা। তা সে যে বিষয়েই হোক না কেন। আর আমার দায়িত্ব ছিল চাচার যে-কোনও বিষয় নিয়ে আসা। ইচ্ছে করেই জানতে চাইতাম দেশভাগ, ১৯৭১, বাম রাজনীতির আদর্শ ও বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তাঁর মতামত। অবাক হয়ে শুনতাম তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প
– আসিফ চৌধুরী

বাইশ.
রেখে গেলো বড় এক শূন্যতা
কামাল আহমেদকে নিয়ে অনেক হাত আশীর্বাদের, আদরের, ভালোবাসার, নির্ভরতার, বন্ধুত্বের আর ঋদ্ধ স্মৃতির কথা বলে। তিনি আমাকে হাত নিয়ে ছবি বানাতে বলেছিলেন। এই বিষয় নিয়ে আমরা আরও কথা বলবো, একটা স্ক্রিপ্ট করবোৃ মোটকথা সামনা সামনি একদিন বসবো এমনই কথা ছিল। অনেক কথা থেকেই যায় , মৃত্যু সবকিছু ওলট পালট করে কেড়ে নেয় প্রিয় জীবন। কামাল চাচার মৃত্যু বিশাল এক শূন্যতা রেখে গেলো।
তাঁর জন্ম, মৃত্যু দুইই জানুয়ারী মাসে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই ছিল তাঁর জন্মদিন, ২১ শে জানুয়ারী। বিকালে কল করলাম, “শুভ জন্মদিন চাচা! কেমন আছেন?”, উত্তর, “আমি ভালো নেই। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি মনে হয় আর বাঁচবোনা! আসাদ ভাই আর ভাবী কেমন আছেন? আমার জন্য খাস মনে দোয়া করতে বোলো।” সেই শেষ কথা, আর কথা হয়নি, আর কথা হবেনা! অনর্গল কথা বলা মানুষটার কথা এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারিনি। মেনে নিতে পারিনা এই শূন্যতা!
– নাদিম ইকবাল

তেইশ.
কামাল ভাই চলে গেলেন জানুয়ারি’র পঁচিশে। তাঁর শেষ ফোনটা পেয়েছিলাম জানুয়ারি’র তের’তে। তখন তিনি যেই লং টার্ম কেয়ার হোমে থাকতেন, সেই লং টার্ম কেয়ার হোমের ‘আইসোলেশন ইউনিট’ এ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি কিছুটা হেসে হেসেই বলছিলেন, কিভাবে লং টার্ম কেয়ার হোমের ‘কেয়ার স্টাফরা’ তাঁর দেখভাল করছে। ‘কেয়ার স্টাফদের’ পিপিই বেশভূষাকে তিনি নভোচারীদের পোশাকের সাথে তুলনা করে কিছুটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, কবে যে এই রুদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবো!
কামাল ভাই সেই রুদ্ধ অবস্থার মধ্যেও বই আর পেপার পড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বললেন, তাঁর মেয়ে রিংকি আর মিজান তাঁকে মাঝে মাঝে গিয়ে অন্যান্য জিনিসের সাথে টরন্টো থেকে প্রকাশিত বাংলা কাগজগুলো দিয়ে আসেন। সেই সপ্তাহেই সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’ এ রাশিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা সের্গেই আইজেনস্টাইনকে নিয়ে আমার একটা লেখা বেরিয়েছিল। সেই অসুস্থতা আর অবরুদ্ধতার মধ্যেও তিনি আইজেনস্টাইন নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিলেন। আমার শুধু মনে হয়েছিল, এমন কোন বাঙ্গালী কি কোন কালে জন্মেছে, যার বয়স ৮৯ এবং যিনি মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসেও রাশিয়ান চলচ্চিত্র এবং এক মহীরূহ চলচ্চিত্র নির্মাতা আইজেনস্টাইনকে নিয়ে কথা চালিয়ে গেছেন?
আক্ষরিক অর্থেই কামাল ভাই পরিভ্রমণ করেছেন দুই বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের সব অশ্বত্থ বৃক্ষদের সাথে। টরন্টো আসার আগে সেই ২০১২ সালে আমি কামাল ভাই সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ চলচ্চিত্রের পরিচালক বাদল রহমানের কাছে। বাদল ভাই জানিয়েছিলেন, সেই সত্তর সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের সাথে দেখা করতে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন। আর সেই দেখা করার ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের কামাল ভাই।
কামাল ভাইয়ের স্ত্রী চলে যাবার পর তিনি একেবারে শিশুর মত হয়ে গিয়েছিলেন। মেইন স্ট্রীট আর জেরাড স্ট্রীটের কাছে রেভেরা লং টার্ম কেয়ার হোমে যখন দু’জনে থাকতেন, তখন তিনি দেখেছেন কিভাবে আস্তে আস্তে তাঁর দীর্ঘ দিনের জীবন সংগী মৃত্যুর অসীম শুন্যতায় হারিয়ে যাচ্ছেন। স্ত্রীকে যে কেউ এত বেশি ভালোবাসতে পারেন আর সম্মান করতে পারেন, সেটা কামাল ভাই আমাদের দেখিয়ে গেলেন। ভাবী চলে যাবার অনেক দিন পরও, এমন কি কামাল ভাইয়ের চলে যাবার মাস খানেক আগেও তিনি মাঝ রাতে ফোন করে ভাবীকে হারানোর বেদনা আর শুন্যতার কথা বলতেন। সেই শুন্যতা সময়ে সময়ে আহাজারির মত শুনাতো। তাঁর সেই আহাজারি আর অসময়ের ফোনগুলোয় অনেক সময়ই আনন্দ পাই নি, বরং বার বার মনে হয়েছে, এত ভালোবাসার কি থাকতে পারে? কামাল ভাইয়ের চলে যাবার পর এখন তাঁর বেদনাটা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারি। এখন মাঝে মাঝেই ভাবি, আসলে আমাদেরতো জানাই হলো না, কিভাবে প্রিয় মানুষকে ভালোবাসতে হয়।
– মনিস রফিক

চব্বিশ.
কামাল ভাই আর আমি এক পাড়াতেই থাকতাম। এক পাড়া মানে ক্রিসেন্ট টাউনে। ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের দেখা হতো। দেখা হলেই তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিতে নানারকম কথা। কখনো সংস্কৃতি, আবার কখনো রাজনীতি। তাঁর প্রজ্ঞা আর স্মৃতির প্রতি সেই প্রথম থেকেই আমার প্রগাঢ় এক সমীহ ছিল। নব্বাই ছুঁই ছুঁই একজন মানুষের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করতো। সেই সাথে ড্যানফোর্থের যে কোন অনুষ্ঠানে তাঁর সরব উপস্থিতি আমাকে সব সময়ই মনে করিয়ে দিত, মানুষের জ্ঞান স্পৃহা আর চর্চা থাকলে বয়স কখনো সৃজনশীল কাজ আর চিন্তা চেতনায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। কামাল ভাইয়ের মত এমন প্রমিত বাংলায় কথা বলতে আমি খুব কম মানুষকেই দেখেছি। তারপর তাঁর আড্ডাবাজি মন। একজন কত সুন্দর চেতনার আড্ডাবাজ হতে পারে, তা কামাল ভাইকে না দেখলে আমার বোধগম্য হতো না। তাঁর আড্ডায় উঠে আসতো কোন গ্রন্থ, সঙ্গীত বা চলচ্চিত্র প্রসংগ। একজন কত অভিজ্ঞ আর পড়ুয়া হলে, ওমনভাবে কথা বলতে পারে আর আড্ডা চালিয়ে যেতে পারে, তা কামাল ভাইকে কাছে না পেলে কখনো বুঝতে পারতাম না। কামাল ভাইয়ের সাথে শেষ আড্ডাটা হয়েছিল, করোনা আসার বেশ কয়েক মাস আগে আমার প্রয়াত বন্ধু রাফি লোটনের বাসায়, সেভেন ক্রিসেন্টে। জন্মের পর মানুষের সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে, তাকে মৃত্যুর স্বাদ নিতেই হবে, কিন্তু তারপরও কিছু মানুষের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। সেই মানুষগুলো আর শুধু ব্যক্তি মানুষ থাকেন না, বরং তারা হয়ে উঠেন সামষ্টিক মানুষের এক পরম প্রতিনিধি। কামাল ভাই ছিলেন তেমনি একজন আমাদের মাঝে। কামাল ভাইয়ের অনুপস্থিতি শুধু তাঁর পরিবারের সদস্যরাই অনুভব করবে না, তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের সবার কাছে এক চরম বেদনা ধ্বনি হয়ে বাজবে আগামী দিনগুলোতে। কামাল ভাইয়ের প্রতি আমার পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। – সোলাইমান তালুত রবিন