সাজ্জাদ আলী
এক:
কানাডা’র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেশী এবং বিদেশী, এই দুই ধরণের শিক্ষার্থী রয়েছে । আর প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই “স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন” নামে ছাত্রদের সংগঠনও আছে। যেমন, ম্যাকমাষ্টার ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, প্রভৃতি। এই ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে কোন প্রকারেই দেশটির কোন রাজনৈতিক দলের কোন “রাজনৈতিক যোগাযোগ” নেই। দেশটির রাজনীতিবিদরা এর আবশ্যকতা মনে করেন না, আবার ছাত্ররাও তদ্রুপ। এসব ছাত্র সংগঠন স্থানীয়, অর্থাত্ এগুলো দেশব্যাপী কোন সংগঠনের অংগ নয়। সংগত কারণেই এক ইউনিভার্সিটির ছাত্র সংগঠন অন্য ইউনিভার্সিটির অনুরূপ সংগঠনের সাথে কোন রকমেই যুক্ত না। দেশী বা বিদেশী, নির্বিশেষে ছাত্ররা চাইলে এ সংগঠনের সাথে যুক্ত হতে পারে, আবার পরিচালনায়ও অংশ নিতে পারে।

এ সব স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনগুলোর একমাত্র কাজ ছাত্রদের শিক্ষা সংক্রান্ত সুবিধাদি দেখা। আর সে কারণেই সংগঠনগুলো বেকার! কারণ এ দেশে কেউ শিক্ষায় ব্যাঘাত ঘটায় না। মোটাদাগে বলা যায় বছরে (বা দুবছরে) একটা “গেট টুগেদার” ধাঁচের অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যেই অ্যাসোসিয়েশগুলোর কাজ সীমাবদ্ধ। তাতে করে মস্ত সুবিধাটি এই যে, ছাত্ররা লেখাপড়ায় সময় ব্যয় করছে। কানাডিয়ান চিন্তাবিদেরা কখনওই এমনটা ভাবেননি যে, ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতি ছড়িয়ে দিয়ে ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরী করতে হবে। অবশ্য সে জন্য যে কানাডা রাষ্ট্রটির যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক পেতে কখনও অসুবিধা হয়েছে, তা কিন্তু না!

দুই:
কানাডা’র আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর পরিস্থিতির সাদৃশ্য সামান্যই। ভারতবর্ষ এবং কানাডা উভয়ই বৃটিশরাজের সাবেক উপনিবেশ। তথাপিও এই দুদেশের ক্ষেত্রে রাজার শাসনদৃষ্টি ছিলো বিপরীতমুখি। কারণও বোধগম্য। কানাডা’র অধিবাসিদের গরিষ্ঠ অংশ ছিলো বৃটিশ বংশোদ্ভুত। অপরদিকে ভারতীয়রা বিজাতীয়, ওরা ছিলো বৃটিশরাজের প্রজা! তো রাজার বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রজাদের অসন্তোষ যখন ফুঁষে উঠলো, অর্থাত্ ইংরেজ রাজত্বের শেষ দিকে ভারতীয় ছাত্ররা দেশের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে শুরু করলো। এই সস্পৃক্ততার নানাবিধ কারণের মধ্যে প্রধানতম প্রয়োজনটি ছিলো ভারতবর্ষকে বৃটিশ শাসন থেকে স্বাধীন করা। সেদিন ইংরেজদের হটাতে সব শ্রেণী ও পেশার ভারতীয়দের রাজনীতি-সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ অনিবার্য হয়ে পড়েছিলো। আর সেই বৃহত্তর কারণেই মূলত: সেই সময়ের ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা এবং ভারতবাসী দেশের ছাত্রদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি অনুমোদন করেছিলেন।

তিন:
তো দ্বিখন্ডিত স্বাধীন ভারতের একখন্ড পাকিস্তান। তার আবার উপখন্ড পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার সেই আনন্দ-নৃত্যের ঘুঙুরের শব্দ বিলীন হওয়ার আগেই বেদনার সুর বেজে উঠলো। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা বুঝে ফেললো যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা কার্যত: তাদের আবারো পরাধীন বানিয়ে ফেলেছে। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, চাকুরীবাকুরি, উন্নয়ন, রাষ্ট্রনীতি, সবই পশ্চিমাদের কব্জায়। এমনকি মুখের ভাষা বাংলাকে পর্যন্ত ওরা কেড়ে নিতে উদ্যোগী হলো। সেই ১৯৫০-৫২ সালেই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রচিন্তকেরা “স্বাধীন বাংলাদেশের” প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন।

আর অত্যন্ত সঙ্গত সেই কারণেই পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমোর, ছাত্র-জনতা, -সকলের রাজনীতি সম্পৃক্ততা অনিবার্য হয়ে পড়লো। পূর্ব পাকিস্তানের তত্কালীন রাজনৈতিক নেতারা তরুণ ছাত্র সমাজকে অধিক মাত্রায় রাজনীতি সচেতন করতে উদ্যোগী হলেন। সেই সময়ের পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর বাস্তবতায় পূর্ব বাংলার ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া যৌক্তিক ছিলো। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পাঠকদের অজানা নয়। সেগুলো এখানে লিখে কালি-কাগজ খরচের দরকার দেখছিনে।

চার:
ভারতবর্ষের ছাত্রদের রাজনীতিতে জড়াতে হয়েছিলো বৃটিশ খেদাতে। আবার পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের রাজনীতিতে মাথা ঘামানোর দরকার পড়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের তাড়াতে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের ছাত্রদের সেই রাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার আদৌ কি প্রয়োজন ছিলো? বাংলাদেশের ছাত্ররা কাকে বিতাড়ন করবেন? তাদের রাজনীতির ইস্যুটা কি? দেশ কি আবার স্বাধীন করবে তারা?
সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ ৭১’ এ যুদ্ধে গেল। দেশটি স্বাধীন করে শ্রমিক ফিরলো কারখানায়, কেরানী ফিরলো অফিসে, কৃষক ফিরলো খামারে, শিক্ষক ফিরলো বিদ্যালয়ে। শুধু ছাত্ররা রাজনীতি ত্যাগ করলো না। পাঠক বন্ধুরা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, বৃটিশ এবং পাকিস্তান আমলে ছাত্রদের রাজনীতিতে আনা হয়েছিলো বটে, তবে তার নেপথ্যে প্রত্যাশাটা এমনই ছিলো যে; দেশমাতৃকার প্রয়োজন শেষে ছাত্ররা ফিরে যাবে শ্রেণীকক্ষে। একটি স্বাধীন দেশে ডাক্তার রোগী দেখবে, কৃষক চাষ করবে, গৃহিনী রাঁধবে, মাস্টার পড়াবে, বাদক বাজাবে, -এসব প্রবচন যদি সত্য হয়; তবে “ছাত্ররা লেখাপড়া করবে” -এ কথাও সত্য। রাজনীতি তাদের কাজ না।

পাঁচ:
কিন্তু তেমনটা আর হলো কই? স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের একেবারে শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো কোমর বেঁধে নেমে পড়লো ছাত্রদের দলে ভিড়ানোর প্রতিযোগিতায়। দলীয় লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির পালে বেদম হাওয়া লাগলো। কি ডান বা বাম, অথবা মধ্যপন্থিরা, সকল রাজনৈতিক দলই সুপরিকল্পিতভাবে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ছাত্রদের মধ্যে দলবাজি শুরু করলো। অথচ তেমনটা তো হওয়ার কথা তো ছিলো না! বিদেশী দখলদার খেদানোর সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনে বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে ছাত্রদের আপদকালীন সময়ের জন্য রাজনীতিতে আনা হয়েছিলো। সে প্রয়োজন চুকে গেলেও বাংলাদেশে সচেতনভাবেই ছাত্রদের রাজনীতিতে রেখে দেওয়া হলো। কিসের রাজনীতি করবে এবারে ছাত্ররা?
তাত্বিকেরা গাল ভরে তত্ত¡জবাব তো দিতেই পারেন। তবে জনতা এ যাবৎ দেখে ফিরছে যে, ছাত্ররা তাদের নেতাদের এবং দলগুলোকে ক্ষমতায় যেতে, অথবা টিকিয়ে রাখতেই কাজ করে যাচ্ছে। এর বাইরে রাষ্ট্রকল্যাণমূলক কোন কিছুতে তাদের স্মরণযোগ্য অংশগ্রহণ তো দেখিনি আমরা। অথচ দেশব্যাপি আওয়ামীদের ছাত্রলীগ, বামদের ছাত্র ইউনিয়ন/ছাত্র মৈত্রী, পরবর্তীতে বিএনপি’র ছাত্রদল; আরো কত তেজী সব সংগঠন টিকে রয়েছে দশকের পর দশক! সেই ৭১’এ স্বাধীনতার পর থেকে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল ছাত্রদের পেশী বৃদ্ধিতে যে পরিমান মনোযোগ ঢেলেছে, মেধাবৃদ্ধির উত্সাহ দিয়েছে তার সহ¯্রভাগ কম। ক্ষমতার গদি রক্ষা করতে (বা ক্ষমতায় পৌঁছুতে) রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদের ঠোঁটে বসিয়ে দিয়েছে শ্লোগান, মাথায় ঢুকিয়েছে কু-রাজনীতি, আর হাতে তুলে দিয়েছে রামদা, পিস্তল, কাটা রাইফেল! জ্ঞানার্জন ছাত্রদের জন্য এখন এক “দূর দ্বীপবাসিনী” বই ভিন্ন কিছুই নয়।

ছয়:
অপরিনামদর্শী এই ছাত্র রাজনীতি আজ বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে! সব দল ও মত নির্বিশেষে ছাত্র সংগঠনগুলো আজ পতিত। যে দলটি যখন ক্ষমতায় আসে তাদের ছাত্র সংগঠন সরকারের ছত্রছায়ায় তখন অনাচারে লিপ্ত হয়। টেন্ডারবাজী, তদবির বাণিজ্য, চাঁদাবাজী, অস্ত্রবাজী, সন্ত্রাস, ইত্যাদি সর্ববাজীর বাজিগর ওরা! শুধু সময়ের অভাবে অধ্যয়নবাজিটা করে উঠতে পারছে না! ক্ষমতাশীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ আজ অপকর্মের সমুদ্রে আকন্ঠ নিমজ্জিত। ছাত্রলীগের সদ্য বহিস্কৃত সভাপতি ও সম্পাদকের দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট কাজ কারবারে আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনা বেজায় রুষ্ঠ! ওদের দুজনকে সংগঠন থেকে বহিস্কার করেছেন।
মনে জিজ্ঞাসা জাগে, এত বড় একটা ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ পদে ওরা এলো কিভাবে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মূল দলের শীর্ষতম নেতৃত্বের সবুজ সংকেত ছাড়া ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ প্রাপ্তি তো সম্ভব নয়। তবে কি আজকের “রুষ্ঠ” শেখ হাসিনা আগে কখনও ওদের উপরে “তুষ্ট” ছিলেন? নেত্রী কি তাহলে মানুষ চিনতে ভুল করেছিলেন? হবে হয়তো বা! রহম করো মালিক, না জানি শেখ হাসিনা এমনি ধাচের ভুল আরো কত গন্ডা করে থাকবেন? মাননীয় নেত্রী, আপনার সোনার বাংলায় আদর্শ ছাত্রনেতা এখন বাতি জ্বালায়ে খুঁজতে হয়। কালের বিবর্তনে এই বাস্তবতার দায় আপনার পিছু ছাড়বে না।
সেই ১৯৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরে রেখেছেন। নিমজ্জিত ভাঙ্গা নৌকাখানি উজ্জীবিত করে ৩৮টি বছর তিনি এর কান্ডারী। বস্তুত তাঁর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির উপরেই আওয়ামীলীগ এখন টিকে আছে। তবে ব্যক্তির কারণে দল টিকে থাকা তো কোন কাজের কথা নয়! দলের জন্য সে তো দু:সংবাদই বটে। হাজার হাজার আওয়ামীলীগার আজ তাদের জ্ঞাত আয়ের সাথে সংগতিবিহীন সম্পদের মালিক। আওয়ামীলীগের কত যে সহযোগী সংগঠন তার তালিকা প্রস্তুতে একটা ৪ নম্বর খাতার পুরোটাই ভরে যাবে। যুবলীগ, মহিলালীগ, যুবমহিলা লীগ, কৃষকলীগ, তাঁতিলীগ, জেলেলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, শ্রমিকলীগ, ছাত্রলীগ, -হে মাবুদ চারিদিকে শুধু লীগ আর লীগ! এই লীগওয়ালারা যে কি কারণে “লীগ” করে, তা বোঝার মতো ধীশক্তি আল্লাহপাক আপনাকে দিয়েছেন মাননীয়া। আমি আর কথা না বাড়াই।

দেশের সামনে আজ মূল প্রশ্নটি সততার, স্বচ্ছতার, জবাবদিহিতার, নৈতিকতার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার। আর আওয়ামীলীগকে সে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতেই হবে। জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ দলের জন্ম হয়েছিলো। এ দল শহীদ সোহরাওয়ার্দীর, ভাষানীর, মুজিবের। দলটি বাংলা ভুখন্ডের মানুষকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছে। এক শ্রেণীর দুর্মতিদের জন্য আওয়ামীলীগ তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে দলকে রাহুমুক্ত করাই এখন আওয়ামীলীগের সামনে মস্ত চ্যালেঞ্জ। আজকাল কেন যেন মনে হয় বঙ্গবন্ধুর মতোই শেখ হাসিনাও এই সব দুর্বিনীতদের দমন কাজে একা হয়ে পড়েছেন। নইলে আগাছাগুলো এতটা বাড়ে কি করে? কেমনে সরকার এবং দলের প্রতিটি অলিগলি প্রশ্নবিদ্ধ হয়?
শরীরের কোন প্রত্যঙ্গ পীড়িত হলে সবার আগে মস্তিস্ক সেই পীড়া অনুভব করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা, খুব জানতে ইচ্ছা করে দলবল নিয়ে আপনিও কি তবে তেমনই পীড়িত?
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)